প্রত্যাশা ডেস্ক: ঢাকার কাছে নরসিংদীতে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পেই যে ক্ষতির তথ্য আসছে, সেটা ৭ মাত্রার হলে কতটা ক্ষতি হতে পারে, তা একবার কল্পনা করতে বললেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদি আহমেদ আনসারী।
সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে এ বিশেষজ্ঞ বলছেন, শুক্রবারের ভূমিকম্পটা বলা যেতে পারে ‘ফোরশক’। বড় ভূমিকম্পের আগে ছোট ছোট যে ভূমিকম্প, এটা সেগুলোর একটি।’
দেশে সাড়ে ৩১ ঘণ্টায় চারবার ভূমিকম্প হয়েছে। এর মধ্যে গত শনিবার (২২ নভেম্বর) সকালে একবার ও সন্ধ্যায় পরপর দুবার ভূকম্পন অনুভূত হয়। এর আগে গত শুক্রবার (২১ নভেম্বর) সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে রাজধানীসহ আশপাশের এলাকা।
শনিবার সন্ধ্যায় রাজধানীতে পরপর দুটি ভূমিকম্প হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, শনিবার সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিট ৪ সেকেন্ডে রিখটার স্কেলে ৩ দশমিক ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়। এর এক সেকেন্ড পর সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিট ৫ সেকেন্ডে দ্বিতীয়বার ভূমিকম্প হয়। রিখটার স্কেলে এটির মাত্রা ৪ দশমিক ৩। একটির উৎপত্তিস্থল বাড্ডায়, আরেকটির উৎপত্তিস্থল নরসিংদীতে। এর আগে শনিবার সকালে নরসিংদীতেই আরও একটি মৃদু ভূমিকম্প হয়। জেলার পলাশ উপজেলায় সকাল ১০টা ৩৬ মিনিট ১২ সেকেন্ডে ভূমিকম্পটি অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৩।
এ অঞ্চলে এর চেয়ে বড় ভূমিকম্পের শঙ্কা যে রয়েছে, সেটা স্মরণ করে দিয়ে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, ঢাকার ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে ৭ মাত্রার ভূমিকম্পন হলে ২ থেকে ৩ লাখ মানুষ হতাহত হবে। পাঁচ থেকে সাত লাখ মানুষ অবরুদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি ভেঙে পড়তে পারে ঢাকা শহরের ৩৫ শতাংশ ভবন। বিশ্লেষকরা বলছেন, বড় ধরনের ভূমিকা এড়ানো হয়তো সম্ভব নয়, তবে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ভবনের মান পরীক্ষা করা, ঝুঁকির ভিত্তিতে সেগুলোকে আলাদা করা এবং নাগরিকদের সতর্ক করাসহ নিয়মিত মহড়া আয়োজনে জোর দেওয়ার কথা বলেছেন তারা।
গত শুক্রবার (২১ নভেম্বর) ছুটির দিনের সকালে দেশের মানুষ যে ভূমিকম্প দেখল, তার মাত্রা ছিল কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। রেলিং ধসে, দেয়াল ধসে, মাথায় ইট পড়ে এবং গাছ থেকে পড়ে এখন পর্যন্ত তিন জেলায় ১০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে; আহত হয়েছেন ছয় শতাধিক।
যেসব কারণে সতর্কবার্তা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ববিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার কয়েক দশক ধরে ভূমিকম্প নিয়ে কাজ করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপিত আর্থজারভেটরির তত্ত্বাবধায়কও ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের ঝুঁকির জায়গাটা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ভূমিকম্প, পাহাড়-পর্বত, অগ্নুৎপাত-সবই নিয়ন্ত্রিত হয় ভূত্বক গঠনকারী প্লেটগুলোর সঞ্চারণের ওপর। পৃথিবীর উপরিভাগের ৭০ থেকে ১০০ কিলোমিটার পুরুত্বের লিথোস্ফিয়ার ছোট-বড় ১৩টি খণ্ড বা প্লেটে বিভক্ত। উত্তপ্ত ও নরম এস্থোনোস্ফিয়ারের ওপর ভাসমান থাকা এসব প্লেট গতিশীল। দেশের উত্তরে আছে ইন্ডিয়ান প্লেট এবং ইউরেশিয়ান প্লেটের সংযোগস্থল; পূর্বে বার্মিজ প্লেট ও ইন্ডিয়ান প্লেটের সংযোগস্থল।
হুমায়ুন আখতার বলেন, এবার ভূমিকম্পটা হয়েছে ইন্ডিয়া ও বার্মা প্লেটের সংযোগস্থলে, যেটা সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জের হাওর হয়ে যমুনা নদীর নিচে নেমে গেছে। এ সংযোগস্থলের উত্তর পূর্ব-কোণে ভূমিকম্পটা হলো। তিনি বলেন, ৮ দশমিক ২ মাত্রার যে শক্তি, সেটা কিন্তু এখনো জমা হয়ে আছে। যে কোনো সময় দেখা যাবে, এরচেয়ে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয়ে গেছে।
শুক্রবারের ঘটনাকে বড় ভূমিকম্পনের ‘ওয়েকআপ কল’ মন্তব্য করে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, এটা (শক্তি) আনলকিং শুরু হয়েছে। এটা লকড অবস্থায় ছিল। মানে একটার সঙ্গে আরেকটা (দুই প্লেট) লেগে ছিল, আটকে ছিল।
আর বুয়েটের অধ্যাপক আনসারী শুক্রবারের ভূমিকম্পের কথা তুলে ধরে বলেন, রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ৭ মাত্রায় যে ক্ষতি হয়েছে, ৭ মাত্রার হলে ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেড়ে যাবে। ভবন ধসে পড়বে, হতাহত বাড়বে। ঢাকার ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে বড় ভূমিকম্প হলে ২ থেকে ৩ লাখ মানুষ হতাহত হবে। ঢাকা শহরের ৩৫ শতাংশ ভবন ভেঙে পড়ার আশঙ্কা আছে।
বিশেষজ্ঞরা আগে থেকেই বলে আসছেন, দুটি প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশে পড়ায় এখানে বড় ভূকম্পনের ঝুঁকি রয়েছে। এছাড়া নদ-নদীর গতি পরিবর্তন হওয়ায় তা দেশে বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকি তৈরি করেছে।
অতীতের কম্পন পর্যবেক্ষণ: অধ্যাপক আনসারীর পর্যবেক্ষণ বলছে, এই অঞ্চলে গড়ে দেড়শ বছর পরপর ৭ মাত্রার এবং আড়াইশ থেকে তিনশ বছর পরপর ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়ে থাকে। ১৭৬২ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে ৭ থেকে সাড়ে ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের নজির রয়েছে বলে তুলে ধরেন তিনি। এর আগে সংবাদমাধ্যমকে এই বিশ্লেষক বলেছিলেন, শেষ এক-দেড়শ বছরে এ অঞ্চলে বড় ভূমিকম্প হয়নি। এখন যে কোনো সময় ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে; ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের আশঙ্কা এখন নেই। ‘২০২০ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে একটা বড় ভূমিকম্প হবেই। সাম্প্রতিক বছরগুলোর পরিসংখ্যান ঘেটে দেখা গেছে, ২০২১ সালে বাংলাদেশ ও আশপাশের অঞ্চলে ২৭টি ভূমিকম্প হয়েছে। এরপর ২০২২ সালে ১৯টি, ২০২৩ সালে ৩৫টি, ২০২৪ সালে ৫৪টি ভূমিকম্প হয়েছে। এর মধ্যে ২০২১ সালে ৯টি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল বাংলাদেশ। ২০২৩ সালে ছিল সাতটি এবং ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চলে উৎপত্তিস্থল ছিল দুটি। ২০২৪ সালে ১৩টি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল বাংলাদেশ। ২০২২ সালে কোনো ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশে ছিল না। বিগত কয়েক বছরে যেসব ভূমিকম্প হয়েছে, সেগুলো ছিল ২ দশমিক ৮ থেকে ৬ মাত্রার।
অধ্যাপক আনসারী বলেন, এ অঞ্চলে রিখটার স্কেলে ৮ দশমিক ১ মাত্রার একটা ভূমিকম্প হয়েছে, সেটা ১৮৯৭ সালে। এমন ভূকম্পনের শঙ্কা আড়ইশ থেকে তিনশ বছর পর পর আসে। ১৯৩০ সালের পর থেকে এখানে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়নি, কিন্তু গবেষণা অনুযায়ী সেটা হওয়ার শঙ্কা থাকার কথা বলেছেন এ বিশ্লেষক।
কোথায় কোথায় ঝুঁকি বেশি: ভূতাত্ত্বিক গঠন বিশ্লেষণ করে পাওয়া তথ্য তুলে ধরে অধ্যাপক আখতার বলেন, দেশের মধ্যে শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাব্য ফাটলগুলোর একটি পড়েছে সিলেট-মেঘালয় সীমান্তের ডাউকি ফল্টে। আরেকটি পড়েছে চট্টগ্রাম উপকূল বরাবর সীতাকুণ্ড-টেকনাফ ফল্টে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের সমতল ভূমিতে অসংখ্য ফাটল রয়েছে, যা থেকে ভূমিকম্প হতে পারে। ঢাকার পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ-চারপাশেই ভূমিকম্প সৃষ্টির মত ফাটল রয়েছে। ২০১৬ সালে প্রকাশিত নিজেদের একটি গবেষণার তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ইন্ডিয়া ও বার্মা প্লেটের সংযোগস্থলে যে ‘সাবডাকশন জোন’, সেটি থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রার মাত্রার ভূমিকম্পের শক্তি জমা হয়ে আছে। আমরা বলেছি, যে কোনো সময় ভূমিকম্প হতে পারে। এ অধ্যাপকের ব্যাখ্যায়, ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প তৈরি হওয়ার মত যে শক্তি ভূত্বকের মধ্যে জমা হয়ে আছে, সেই শক্তি বের হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে ঘন ঘন হওয়া কম মাত্রার ভূমিকম্পগুলো। বড় ধরনের যে কোনো ভূমিকম্পে ঢাকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে। এখানে ভবন ও জনবসতি অনেক বেশি।
দেশের উত্তর পূর্ব ভাগকে ‘অধিক ঝুঁকিপূর্ণ’ এক নম্বর অঞ্চল; মধ্যভাগের দুই নম্বর অঞ্চলকে মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ এবং দক্ষিণ পশ্চিমের তিন নম্বর অঞ্চলকে কম ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্ণিত করা হয়েছে। ২০০৯ সালে সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (সিডিএমপি) ও জাইকার যৌথ জরিপের ফল বলছে, ঢাকায় ৭ বা এর বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে শহরের ৭২ হাজার ভবন ভেঙে পড়বে; ক্ষতিগ্রস্ত হবে এক লাখ ৩৫ হাজার ভবন।
ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলও বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) ২০১১ সালের এক গবেষণা অনুযায়ী, চট্টগ্রাম মহানগরীর ৭৮ শতাংশ ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ। গত দেড় দশকে এই হার খুব একটা কমেনি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
করণীয় কী: ভূতত্ত্ববিদ হুমায়ুন আখতার বলেছেন, এখন ভূমিকম্প মোকাবেলার প্রস্তুতি ও ক্ষয়ক্ষতি কমানোর একমাত্র উপায় হলো মহড়া, মহড়া ও মহড়া। ঢাকার এক-তৃতীয়াংশ ভবন ঝুঁকির মধ্যে জানিয়ে বুয়েট অধ্যাপক আনসারী বলেন, ২১ লাখ ভবনের মান যাচাই করা অন্যতম কাজ এবং ‘রেড বিল্ডিং’ চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। ভূমিকম্পের আগে সবুজ, হলুদ, কমলা ও লাল রঙে চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হাতে নিতে হবে।
প্রশিক্ষিক লোকবল ও প্রস্তুতি দেশে রয়েছে মন্তব্য করে এ বিশ্লেষক বলেন, এখন এগুলো বাস্তবায়ন করা দরকার। দেশে প্রায় ৫০টি কোম্পানি রয়েছে, যাদের আমরা ট্রেনিং দিয়েছি রানাপ্লাজা ধসের পর। তিনি মনে করেন, ভবনগুলোর নকশায় যেসব পরিবর্তন আসছে, সেসব বিষয়ে প্রশিক্ষক দরকার। জাতীয় পর্যায়ে ইনস্টিটিউট করা খুবই দরকার। এটা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় করা সম্ভব নয়, সেন্ট্রালাইজ ইনস্টিটিউট দরকার। এ জন্য ২০১৫ সালে একটা চিন্তা ছিল ইন্সটিটিউট করার, এটা স্থবির হয়ে আছে। এ মুহূর্তে যদি ইনস্টিটিউট করতে পারি, তাহলে বড় ভূমিকা থাকবে। দেশের ‘গুরুত্বপূর্ণ’ কিছু স্থাপনা ঢাকার বাইরে নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, পশ্চিমাঞ্চলে ভূমিকম্পের ফলে ক্ষয়ক্ষতি কম হবে। ফলে ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পশ্চিমাঞ্চলে স্থানান্তর করা গেলে ঢাকার ক্ষতি হলেও দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করা যাবে।
সানা/ওআ/আপ্র/২৩/১১/২০২৫
























