অর্থনৈতিক প্রতিবেদক : আমদানি করা নি¤œমানের বিটুমিন বন্দর থেকে ছাড় করাতে চট্টগ্রাম কাস্টমসে ভুয়া মান সনদ জমা দিয়েছিল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ঢাকার ‘ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড’। এ প্রক্রিয়ায় তারা ৯ কন্টেইনার বিটুমিন ছাড়ও করিয়ে নেয়। কিন্তু বিষয়টি ফাঁস হবার পর ওই ৯ কন্টেইনার বিটুমিন ফেরত দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠানটি এক লাখ টন বিটুমিনের চালান ছাড়ের জন্য ভুয়া মানসনদ তৈরি করে চট্টগ্রাম কাস্টমসে জমা দিয়েছে। ৭২ লাখ টাকার শুল্ক পরিশোধ করে ৫০ কন্টেইনারের মধ্যে ৯টি কন্টেইনার বিটুমিন সোমবার ছাড়ও করে নেয়। এরই মধ্যে অভিযোগ পেয়ে সনদ যাচাই করতে গিয়ে জালিয়াতি ধরা পড়ে। তরপর ৫০ কন্টেইনারের পুরো চালানটি আটক করে কাস্টমস। একই সঙ্গে ছাড় হওয়া বিটুমিনভর্তি কন্টেইনারগুলো বন্দরে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দেয়া হয়।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম কাস্টমসের সহকারী কমিশনার উত্তম চাকমা বলেন, অর্থবছর শেষ হতে সময় মাত্র তিনদিন। আমরা রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে প্রচ- ব্যস্ততার মধ্যে দিন পার করছি। ঠিক এ সময়টাকেই বেছে নিয়েছে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ও সিঅ্যান্ডএফ সানশাইন এজেন্সি।
তিনি আরো বলেন, ইস্টার্ন রিফাইনারির মানসনদ এমন সূক্ষ্মভাবে জালিয়াতি করা হয়েছে; সাদা চোখে দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই। এই সুযোগে সোমবারই বিটুমিনভর্তি ৯টি কন্টেইনার ছাড় হয়েছে। আমি সরেজমিনে গিয়ে যাচাই করে ছাড় হওয়া কন্টেইনার পুনরায় ফিরিয়ে আনার নির্দেশনা দিয়েছি। আশা করছি কিছুক্ষণের মধ্যে এগুলো ফেরত আসবে।
এদিকে সনদ জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ার পর তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম বলেন, মান সনদ উত্তীর্ণ না হয়ে পণ্য ছাড় করা অপরাধ। সেইসাথে সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের সনদ জালিয়াতি করে জমা দেয়া আরো কঠোর অপরাধ। আমরা প্রথমে ছাড় হওয়া পণ্য ফেরত নিয়ে আসছি। এরপর আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টকে শোকজ করবো। তারপর আইনগত কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করবো। কোনো ছাড় হবে না।
দেশে নি¤œমানের বিটুমিন আমদানির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। দীর্ঘদিন ধরে এসব বিটুমিন আমদানি হলেও মান নিশ্চিত করা হয়নি। ফলে অহরহ নি¤œমানের বিটুমিন আমদানি হচ্ছিল; কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছিল না। এতে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে হাজার কোটি টাকা গচ্ছা যাচ্ছিল সরকারের। সর্বশেষ গত ২৫ মে বিটুমিনের মান নিশ্চিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তিনটি নির্ধারিত ল্যাবে মান পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করে। এরপর থেকেই মুলত নি¤œমানের বিটুমিন আমদানির চক্রটি বিপাকে পড়ে। মান যাচাই বাধ্যতামূলক করার পর এই প্রথম কোনো চালান ধরা পড়লো কাস্টমসের হাতে।
নমুনা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পেরে আমদানিকারক ঢাকার ‘ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড’ ভুয়া মানসনদ কাস্টমসে জমা দিয়ে বিটুমিন চালান ছাড় নিতে চেয়েছিল। ৫০ কন্টেইনারের মধ্যে ৯টি কন্টেইনার ভুয়া সনদ দিয়ে বন্দর থেকে খালাস পর্যন্ত করা হয়েছে। কিন্তু কাস্টমসের হাত থেকে শেষ রক্ষা হলো না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার ‘ন্যাশনাল ডেভলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড’ এর একটি বাণিজ্যিক চালান চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে ১৪ জুন। এই চালানে ৫০টি কন্টেইনারে মোট প্রায় এক লাখ মেট্রিক টন বিটুমিন ছিল। চালানটির মূল্য ৪ লাখ ১৭ হাজার মার্কিন ডলার। ইরানের পতাকাবাহী জাহাজ ‘এমভি নেগার’ থেকে নামিয়ে গত ২০ জুন বিটুমিনের চালানটির নমুনা সংগ্রহ করা হয়। নমুনাটি পাঠানো হয় সরকারি ইস্টার্ন রিফাইনারিতে (ইআরএল)। ইআরএল গত ২৪ জুন পণ্যের মান সনদ দেয়।
রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৮টি শ্রেণিতে চালানটির মান পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু দুটি শ্রেণিতে চালানটি মান উত্তীর্ণ হয়নি। মান উত্তীর্ণ না হওয়ায় চালানটি বন্দর থেকে ছাড়ের সুযোগ ছিল না। এই কারণে ইস্টার্ন রিফাইনারির মূল সনদ কাস্টমসে জমা না দিয়ে জালিয়াতি করে ভুয়া সনদ দিয়ে কাস্টমস থেকে বের করার কৌশল নেয় আমদানিকারক ও চট্টগ্রামের সিঅ্যান্ডএফ সান শাইন এজেন্সি। জালিয়াতির বিষয়ে জানতে চাইলে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট সান শাইন এজেন্সির মালিক মাহমুদ রেজা বলেন, আমরা ওই আমদানিকারকের কাজ মাঝে মধ্যে করি। ভুয়া সনদ দিয়ে পণ্য ছাড়ের বিষয়টি আমার জানা নেই। ৯ কন্টেইনার ফেরতের বিষয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি প্রতিবেদকের সাথে সামনাসামনি কথা বলতে চান। এরপর উল্লেখিত বিষয়ে ফোনে বক্তব্য চাইলে তিনি আর কথা বাড়াননি। জানতে চাইলে মান সনদ দেয়া প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারির উপমহাব্যবস্থাপক (মান নিয়ন্ত্রন) জাহিদুল ইসলাম বলেন, সোমবার বিকালে কাস্টমস থেকে আমাকে ফোন করে জানানো হয়েছে জালিয়াতির বিষয়টি। আমি আসল সনদ কোনটি সেটি তাদেরকে নিশ্চিত করেছি।
তিনি আরো বলেন, নমুনা পরীক্ষায় ‘ন্যাশনাল ডেভলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড’ এর চালানটি মান উত্তীর্ণ হয়নি। দুটি শ্রেণিতে চালানটি মান উত্তীর্ণ হয়নি। এরমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, পেনিট্রেশনে সেটি ৭২ পয়েন্ট পেয়েছে। কিন্তু চালানটি ৬০-৭০ গ্রেডের মধ্যে থাকতে হবে। ফলে আমদানিকারক কিভাবে জালিয়াতি করলো আমার জানার কথা নয়।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম কাস্টমসে গত বছর এই ধরনের বেশ কিছু মান সনদ জালিয়াতি ধরা পড়ার পর ম্যানুয়ালি এবং মেইলে দুইভাবে মান সনদ কাস্টমসে পাঠানোর নিয়ম আছে। এক্ষেত্রে তা করা হয়নি কেন জানতে চাইলে জাহিদুল ইসলাম বলেন, আমাদের কাছে তো আমদানিকারকের পক্ষে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট সিলগালা করা নমুনা পাঠান এবং মান সনদও সিলগালা করে নিয়ে যান কাস্টমসে। এক্ষেত্রে বাহক কিন্তু সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট। এখন কাস্টমস যদি ইমেইলে মান সনদ চায় তাহলে তো আমরা দিতে পারি। তাহলে জালিয়াতি বন্ধ করা যাবে বলে জানান তিনি।