মাসুদ আনোয়ার : আপনি যদি ইংরেজিতে স্পেশাল ট্রেন আর বাংলায় ঠেলাগাড়িও হন, কোনো সমস্যা নেই। আপনি শিক্ষিত। আর যদি বাংলার সাথে ইংরেজির মিশেলে অনর্গল বকতে পারেন তো আরো ভালো কথা। আপনি স্মার্ট।
বাংলায় ভালো করে লিখতে পারেন না? মানে ভাষাটা তেমন এস্তেমাল নয়? অসুবিধে কী? ইংরেজিতে দিস্তার পর দিস্তা ওড়াতে পারেন তো? তাইলে ঠিক আছে। শিক্ষিতজনের অত বাংলা জানার দরকারই বা কী? বাংলা লাগেটাই বা কোন কাজে? আমাদের শিক্ষিত পাঠকরা ইংরেজিতে আর্টিকেল পড়েন, বাংলায় প্রবন্ধ বা নিবন্ধ পড়ার সময় বড় একটা পান না। তাছাড়া তাদের ড্রইংরুমে বইয়ের তাক বিদেশি জার্নালে ভরা, বাংলা পত্র-পত্রিকায় তাদের আভিজাত্য ঠিক ফুটে ওঠে না।
অবশ্য এটাও ঠিক যে, আমরা ভালো ইংরেজি না-জানাওয়ালারা হাজার বাংলা জানলেও সঙ্কোচের খোলসটা পুরোপুরি খুলে ফেলতে পারি না। ইংরেজি না-জানাটাকে নির্বিকারভাবে নিতে পারি না। এমন এক ধরনের মানসিকতায় আক্রান্ত থাকি যে, ইংরেজি ভালো বলতে এবং লিখতে না জানাটা যেন একটা অপরাধ। অপরাধ অবশ্য বাংলাও ঠিক মতো বলতে এবং লিখতে না পারাটাও। কিন্তু সেটাকে আবার অনেকে অপরাধ না ভেবে ‘বাহাদুরি’ হিসেবে নিয়ে থাকেন। তবে সেটা ইংরেজি ভালো জানেওয়ালাদের ক্ষেত্রে। আমাদের এক সময়কার এক মন্ত্রীর মুখে শুনেছিলাম, তিনি বাংলায় ভাব ভালো প্রকাশ করতে পারেন না। অক্সফোর্ডের শিক্ষিত তো।
মন্ত্রীকথন থাক। মন্ত্রী কাকে বলে সেটা জানি না। এমনিতে মন্ত্রণা যিনি দেন, তিনি মন্ত্রী। আবার যিনি মন্ত্র পড়েন, তাকেও কি মন্ত্রী বলা যায়? আমাদের মন্ত্রীরা অনেক কথা বলেন। তাদের সব কথায় মন দেয়া এবং কান দেয়ার দরকার নেই। আমরা বরং সাধারণ মানুষের কথা বলি।
সাধারণ মানুষ, মানে যারা লিখতে ও পড়তে জানেন, তাদের মানসিক দৈন্যদশার অন্ত নেই। বরং এদিক দিয়ে যারা লিখতে-পড়তে জানেন না কিংবা জানলেও যৎসামান্য জানেন, তাদের মধ্যে এ সমস্যা নেই। তারা ইংরেজির ধার ধারেন না, বাংলা নিয়েও মাথা ঘামান না। বাংলাটা তাদের জন্যে কাজ সারার মতো হলেই হলো। বানান টানান, বাক্য গঠনগত শুদ্ধাশুদ্ধি নিয়ে চিন্তা করার দরকার কিংবা ঔচিত্য নিয়ে ভাবার সময় কোথায় তাদের? কিন্তু যারা বিএ, এমএ পাস, তাদের অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিতদের মতো ভুল হবে। আবার কেউ ভুল ধরিয়ে দিতে গেলে চটে উঠে বলবেন– ভাই, বাংলা বানান মনে থাকে না। কোনটা ‘শ’, কোনটা ‘ষ’ আর কোনটা ‘স’, কোনটা হ্রস্ব ই-কার, কোনটা দীর্ঘ ই-কার, সব জগাখিচুড়ি। মজার ব্যাপার হলো তাদের মতো বিএ, এমএ পাঠকরাও তাতে খুব একটা মাইন্ড করেন না। করবেন কেন? লিখতে গেলে তাদেরও তো লেজেগোবর লেপ্টে যাবে।
কিন্তু আপনি যখন ইংরেজি লিখতে যাবেন, তাহলে ভুল হলে খবর আছে। থার্ড পার্সন সিঙ্গুলারের ক্রিয়ায় যদি ভুলক্রমে ‘এস’ না পড়ে, তাহলে মরেছেন। ওরা ভুল ধরে হাততালি দেবে, আর আপনি ভুল করে মরমে মরে যাবেন। বাংলায় স্নাতকোত্তর শেষ করেও ইংরেজিতে ক্লাস সিক্সের ছেলেমেয়েদের মতো ‘এস’ বা ‘ইএস’ দিতে ভুল করে আপনার ‘এডুকেটেড’ স্বীকৃতিটাই ঝুঁকির মুখে পড়ে যাবে।
আমার এক আত্মীয়ের কথাই বলি। ভদ্রলোক সরকারি জীবন বীমা অফিসের মাঝারি মানের অফিসার। একদিন আমাকে জীবন বীমার বিভিন্ন দিক বোঝাতে গিয়ে লিখলেন ‘আয়জীবন’। আমি জানতে চাইলাম, এর মানে কী? বললেন, আজীবন মানে জানো না? লাইফটাইম।
লাইফটাইম? কিন্তু সে তো আজীবন। আপনি অহেতুক একটা ‘য়’ বসিয়ে দিয়েছেন মাঝখানে। ভদ্রলোক একটু থমকে গেলেন। তবে সামলে উঠে বললেন, বাংলা বানান শুদ্ধ না হলেও সমস্যা নেই। কেউ কিছু মাইন্ড করে না।
থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বারের কর্তার ক্রিয়ায় ‘এস’ না পড়লে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়, আর ‘আজীবনে’ উটকো একটা ‘য়’ ঢুকে পড়লেও কেউ পারতপক্ষে রা কাড়েন না।
এক সময় কিছুদিনের জন্যে কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষকতা করেছিলাম। সেখানে ক্লাস টু থেকেই ‘জধফরধহঃ ঊহমষরংয’ নামের একটা গল্পের বই পাঠ্য থাকত। বইটিতে ইংরেজ শিশুদের উপযোগী ছড়া বা গল্প থাকত। যেমন একটা গল্পে একটা শিশুর কুকুরের নাম ‘ঝঁষঃধহ’ ছিল। আমার মনে হয়েছিল কুকুরের নাম ‘সুলতান’ ইচ্ছে করে ব্যবহার করা হয়েছে। ক্রুসেডার সুলতান সালাউদ্দীন আইয়ুবিকে তাচ্ছিল্য করার জন্যে যে এই নামটা ব্যবহার করা হয়েছে, এটা পরিষ্কার বোঝা যায়। কারণ এই সুলতানের কাছেই খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা বার বার নাকানি চুবানি খেয়েছিলেন। ওই রাগ থেকে কুকুরের নাম ‘সুলতান’ রাখা। আমি পড়ানোর সময় সুলতান উচ্চারণ না করে ‘সালতান’ উচ্চারণ করতাম। একদিন প্রধান শিক্ষিকা ধরে বসলেন। বললেন, আপনার এ উচ্চারণটা ভুল।
আমি বললাম, ভুল নয়। এটাই সঠিক উচ্চারণ। কুকুরের নাম ‘সালতান’ হতে পারে। ‘সুলতান’ হতে পারে না। সুলতান মুসলমান রাজাদের উপাধি, কুকুরের নাম হয় না।
কিন্তু আমার যুক্তি তার পছন্দ হলো না। এ নিয়ে আরো অনেক কথা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত আমার ইংরেজির ক্লাস নেয়াটাই বাতিল হয়ে গিয়েছিল। স্কুল কর্তৃপক্ষকে বোঝাতে পারিনি, কুকুরের নাম সুলতান রেখে তারা মুসলমানদের অপমান করেছে। কর্তৃপক্ষের মধ্যে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও ছিলেন।
যাইহোক, শেষ পর্যন্ত চাকরিটা চলে যায়নি, এটাই ছিল সান্ত¡নার কথা। ঔপনিবেশিকতার বিষবাষ্প যে আমাদের মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষকে কীভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে, এটাই বোধ হয় তার একটা উদাহরণ হতে পারে। আমরা ভীষণ ভীষণ ইংরেজি ভক্ত।
তা শুধু ইংরেজি নয়, আরবিও একটা ভাষা, যা আমাদের শেকড়কে আলগা করে রেখেছে। মাদ্রাসাগুলোতে যারা পড়ান, সে আরবিতে শিক্ষিতরা কথায় কথায় বাংলার মধ্যে আরবি-উর্দু শব্দ ঢুকিয়ে দেন। ধর্মকে ‘দীন’ শিক্ষাকে ‘ইলম’ ‘মাননীয়’কে ‘হযরত’ বলতেই ভালোবাসেন তারা। নবী-রসুল, সাহাবি, পীর আওলিয়ার নামের আগে ‘হযরত’ বলাটা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আসে। কিন্তু একজন আরবি শিক্ষায় শিক্ষিতকে ‘হযরত’ বলাটা কেমন যেন শোনায়। মনে হয় আরোপিত। অর্থের পার্থক্য নেই, ঠিক আছে, কিন্তু সাধারণ মানুষের সংস্কারে লাগে বৈকি! অবশ্য তিনি আবার ‘আলেম’। শিক্ষিত বললে তার মরতবা যেন ঠিক মতো ফোটে না।
ইংরেজির ঢঙটা যে অবশ্য বাঙালদের মধ্যেও নেই, এমনটা একেবারে বলা যাবে না। একবার একজন তার দরজির দোকানের নাম নিয়ে পরামর্শ করতে এলো। বলল, দোকানের নাম ‘ড্রেস অ্যাজ ইয়োর লাইক’ দিতে চায়, কেমন হবে?
আমি বললাম, ভালো হবে না। কারণ গ্রামের দোকানের নাম ইংরেজিতে রাখলে কে বুঝতে পারবে এর অর্থ? কিন্তু সে নাছোড়বান্দা। শেষে বললাম, রাখবেই যদি, তাহলে শুদ্ধ করে রাখো। অশুদ্ধ নাম রাখবে কেন? সে জানতে চাইল, শুদ্ধটা কী? বললাম, শুদ্ধ হবে, ড্রেস অ্যাজ ইউ লাইক।
সে মাথা দুলিয়ে চলে গেল। কদিন পরে তার দোকানে গিয়ে দেখি, মাঝারি মাপের একটা সাইনবোর্ড। আর তাতে জ্বল জ্বল করছে দোকানের নাম। ‘ড্রেস অ্যাজ ইয়োর লাইক’। বুঝলাম, আমার দেয়া নামটা তার পছন্দ হয়নি। হয়তো ভুল ভেবেছে। এটা স্রেফ মোহ। বিদেশি ভাষার প্রতি অন্ধ ভক্তি। ধারণা, এতে নিশ্চয় আভিজাত্য বাড়ে।
ফরাসিরা ইংরেজি জানে না, জানলেও বলে না কিংবা পারতপক্ষে বলতে চায় না। জাপানি-চীনারা তাদের মুখের ভাষায় ইংরেজি ঢোকায় না। ঢোকালেও একান্তই কোনো বিকল্প না পেলে তখন। কিন্তু আমাদের উপমহাদেশের ভাষা, বিশেষ করে বাংলা, হিন্দি ও উর্দু কারণে অকারণে ইংরেজি শব্দকে জায়গা ছেড়ে দেয়। অথচ তার যুৎসই প্রতিশব্দ এই তিন ভাষাতেও আছে।
আমরা মনে করি, এটা আভিজাত্য, স্মার্টনেস। কিন্তু সেটা মোটেও নয়। আমাদের অধীনতাবোধ এখনো কাজ করে মনের গভীরে, চেতনার বালুচরে।
লেখক : সাংবাদিক ও লেখক, বর্তমানে দৈনিক সমকালের সহসম্পাদক হিসবে কর্মরত আছেন।
ভুল ইংরেজি ভুল বাংলা
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ