নিজস্ব প্রতিবেদক: ২৮ সেকেন্ডের একটি ভিডিও। দেখা যায়, রাতের আঁধারে রশি দিয়ে হাত-পা বেঁধে ফেলা হয়েছে রিপন ব্যাপারী (৫০) নামের এক ব্যক্তির। জীবন্ত মানুষটির চোখ উপড়ে ফেলা হচ্ছে। পুরুষদের পাশাপাশি এ কাজে দুই নারীও সহায়তা করছেন। অসহায়ভাবে ছটফট করছিলেন, তবু রক্ষা পাননি তিনি। এখন ঢাকার একটি হাসপাতালের বিছানায় ব্যথায় কাতরাচ্ছেন ।
রিপন ব্যাপারীর অভিযোগ, ৮০ বছর বয়সী বাবার উপস্থিতিতে দুই ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী ও মেয়েসহ অন্য স্বজনেরা তাঁর দুই চোখ উপড়ে ফেলেছেন। এ ছাড়া দা দিয়ে রিপনের মাথার তালুসহ সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন আছে।
রিপন ব্যাপারী ভর্তি আছেন রাজধানীর জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। গত বৃহস্পতিবার (২৮ আগস্ট) দুপুরে হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেল, সকালে রিপন ব্যাপারীর অস্ত্রোপচার হয়েছে। দুই চোখে ব্যান্ডেজ। ব্যথায় কাতরাচ্ছেন তিনি। সেখানেই তাঁর স্ত্রী ভিডিওটি দেখান।
চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, রিপন আর কখনোই দুই চোখে দেখতে পারবেন না। রিপন নিজেও তা বুঝতে পারছেন। তাঁর অভিযোগ, ভাইসহ স্বজনেরা জমির হিসাব মেটাতে এমন নির্মমভাবে তাঁর দুই চোখ উপড়ে ফেলেছেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন তাঁর বাবাও।
গত ২২ আগস্ট গভীর রাতে বরিশালের মুলাদীতে নিজের বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে বলে জানান রিপন। তিনি একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘টাকাপয়সার হিসাব পরে, আমারে মারল কেন, কোন বিষয়ে মারল, আগে তার বিচার চাই।’
রিপন ব্যাপারী আরো অভিযোগ করেন, তাঁর টাকায় কেনা সম্পত্তি ভাইয়েরা নিজেদের নামে দলিল করেছিলেন। এত দিন তাঁরাই জমির ফসল খাচ্ছিলেন।
জমির পরিমাণ কত, তা স্পষ্ট করে বলতে না পারলেও রিপন বলেন, এক দাগে ১৪ কড়া। আরেক দাগে ১২ কড়া, ৪ বিঘা…। বললেন, তিনি অশিক্ষিত মানুষ, নিজের নামও লিখতে পারেন না। তাই বিশ্বাস করেছিলেন, ভেবেছিলেন বাপ আর ভাই-ই তো। ভিডিওতে দেখা যায়, রিপনকে মারার সময় একজন অন্যজনকে বলছিলেন, ‘ধরছ না কেন, মারস না কেন’ ।
রিপন ব্যাপারীর অন্য স্বজনদের অভিযোগ, রিপন রাজধানীর রায়েরবাজারে রিকশা চালান। তাঁর স্ত্রী নূরজাহান বেগম মানুষের বাড়িতে কাজ করেন। তাঁদের দুই ছেলেও পেশায় রিকশাচালক। দীর্ঘদিন ধরে বাবা ও ভাইদের সঙ্গে তাঁর বিরোধ চলছিল। ২০ আগস্ট রিপনকে জমি বুঝিয়ে দেওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে ভাইয়েরা ফোন করেছিলেন। ২২ আগস্ট রিপন বাড়ি গেলে জমিসংক্রান্ত বিষয়ে তর্কবিতর্ক হয়। পরে রাতে মামলার আসামিরা মিলে রিপনকে রশি দিয়ে বেঁধে মারধর করেন। মেরে ফেলার জন্য মাথায় দা দিয়ে কোপ দেন। সারা শরীরেও দা দিয়ে কোপাতে থাকেন। পরে মাটিতে ফেলে দুই চোখ উপড়ে ফেলেন।
এ ঘটনায় ২৫ আগস্ট বরিশালের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলি আদালতে রিপনের স্ত্রী নূরজাহান বেগম মামলা করেন। মামলায় রিপনের বাবা আর্শেদ ব্যাপারী, ছোট ভাই স্বপন ব্যাপারী, বড় ভাই রোকন ব্যাপারী, রোকন ব্যাপারীর স্ত্রী নুরনাহার বেগম, প্রতিবেশী চাচাতো ভাইসহ আটজনকে আসামি করা হয়েছে।
মামলার নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে, রিপন ব্যাপারীর কাছ থেকে ৩ লাখ টাকা নিলেও রিপন ব্যাপারীকে জমি বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। মারধরের পর অর্ধমৃত অবস্থায় আশপাশের লোকজন রিপনকে মুলাদী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। সেখানে কোনো চিকিৎসক না থাকায় ভর্তি করা হয়নি। পরের দিন বরিশালের শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। মুলাদী থানায় মামলা করতে গেলে থানা মামলা না নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আদালতে মামলা করার পরামর্শ দেন।
রিপন ব্যাপারীরা চার ভাই, বোন নেই। রিপনের স্ত্রী নূরজাহান বেগম বলেন, শ্বশুর, শাশুড়ি ও অন্যদের অত্যাচারে গত ২০ বছরের বেশি সময় তাঁর স্বামী স্ত্রী-সন্তানদের কাছে ছিলেন না। তিন–চার বছর ধরে ঢাকায় দুই ছেলে ও স্বামীকে নিয়ে থাকছেন নূরজাহান বেগম। স্বামী তাঁর উপার্জনের টাকা আগে বাবা ও ভাইদের দিতেন। তবে মোট কত টাকা দিয়েছেন বা কতটুকু সম্পত্তির জন্য রিপন ব্যাপারীর চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে তা নূরজাহান বেগম বা তাঁর ছেলেরা জানেন না। এ নিয়ে কথা বলতে চাইতেন না রিপন ব্যাপারী।
নূরজাহান বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী যদি অপরাধ কইরা থাকে, চোখ দুইটা না তুইল্যা থানা-পুলিশ করতি। বাইন্ধ্যা রাইখ্যা আমার দুই পুলারে খবর দিতে পারত। তা না কইরা মনে যা চাইল, তা-ই করল। আমার তো এহনে আর কিছু করার নাই।’
এ ঘটনার সময়েও কাছে ছিলেন না বলে উল্লেখ করেন নূরজাহান বেগম। তিনি অভিযোগ করে বলেন, তিনি অন্যদের কাছ থেকে জানতে পেরেছেন, ভাশুর, দেবর যখন নূরজাহান বেগমের শ্বশুরকে জানান রিপন মারা যাননি, তখন শ্বশুরই নাকি বলেছিলেন চোখ দুটো তুলে ফেলতে। আর এর পেছনে টাকাপয়সা, জায়গা-জমিই ছিল মূল শত্রু।
ধার করে বরিশাল থেকে রিপন ব্যাপারীকে ঢাকায় আনাসহ আনুষঙ্গিক খরচ করছেন উল্লেখ করে নূরজাহান বেগম তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সমাজের সবার প্রতি আহ্বানও জানিয়েছেন। পাশাপাশি তাঁর স্বামীকে যাঁরা এই অত্যাচার করেছে, তাঁদের উপযুক্ত শাস্তি দাবি করেছেন তিনি। রিপন ব্যাপারীর ছেলে শাহেদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ভিডিওতে দেখা গেছে, তাঁর চাচা রোকন ব্যাপারী চোখ উপড়ে নিচ্ছেন। আর শুনেছেন, এই কাজ করার জন্য তাঁর দাদা নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাঁর বাবাকে বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেনি। ভিডিওতে অনেক মানুষের গলা শোনা যাচ্ছিল। এ ঘটনায় ন্যায্য বিচার দাবি করে শাহেদুল ইসলাম বলেন, ‘এ রকম পরিবারে আমার জন্মের কারণে ঘৃণা হচ্ছে। নিজের দাদা-চাচারা এমন কাজ করছে তা বলতে লজ্জা লাগছে।’
শাহেদুল ইসলাম বলেন, তিনি প্রথমবারের মতো বাবা হতে যাচ্ছেন। স্ত্রীকে যখন তখন হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে, তখন তিনি নিজে হাসপাতাল, আদালতে দৌড়াচ্ছেন। মামলার আসামি স্বপন ব্যাপারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে, অন্যরা পলাতক বলেও জানিয়েছেন তিনি।
এমন ঘটনা আগে দেখেননি চিকিৎসকেরা: জীবন্ত একজনের চোখ উপড়ে ফেলেছেন আর অভিযোগ স্বজনদের বিরুদ্ধে এমন ঘটনা জীবনে আর দেখেননি বলে জানিয়েছেন জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকেরা। হাসপাতালের জুনিয়র কনসালট্যান্ট মোনতাসিম বিল্লাহ বলেন, রিপন ব্যাপারীর চিকিৎসায় তিন সদস্যবিশিষ্ট মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। ২৫ আগস্ট রাত সাড়ে আটটার দিকে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। গত বৃহস্পতিবার (২৮ আগস্ট) অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। তাঁর দুই চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছিল। দুই চোখের খারাপ বা মৃত টিস্যু কেটে পরিষ্কার করা হয়েছে। পরে কৃত্রিম সিলিকন বল লাগিয়ে দুই চোখের পাতা সেলাই করে দেওয়া হয়েছে। ঘা শুকালে দেখতে চোখের মতো ডিভাইস বসানো হবে। তবে এই ডিভাইস দিয়ে তিনি আর দেখতে পাবেন না। রিপন ব্যাপারীর মতো এমন রোগী এর আগে দেখেননি বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
একই ধরনের কথা বলেছেন রিপন ব্যাপারীর জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্য জুনিয়র কনসালট্যান্ট রেসিডেন্ট সার্জন মো. জাহেদুল হাসান। তিনি বলেন, হাসপাতালে সরকারিভাবে বিনা মূল্যে রিপন ব্যাপারীর চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তাঁকে কত দিন হাসপাতালে থাকতে হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। এমন দুঃখজনক ঘটনা তিনিও এ জীবনে আর দেখেননি।
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক খায়ের আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘রোগীর চিকিৎসা দেওয়াই আমাদের প্রধান দায়িত্ব। তবে রোগী এবং তাঁর স্বজনেরা জানিয়েছেন, রিপন ব্যাপারীর দুই চোখ উপড়ে ফেলেছেন তাঁরই আপনজনেরা। এটা খুবই হিংস্র ঘটনা।’
হাসপাতালের সমাজসেবা কর্মকর্তা ইফফাতারা মনিরা নাছরিন চৌধুরী বলেন, এই রোগী মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। তাঁকে এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের কাউন্সেলিং করা হয়েছে। চিকিৎসার জন্য হাসপাতালের বাইরে থেকে যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে সে খরচও দেবে সমাজসেবা বিভাগ।
রিপন ব্যাপারীর স্ত্রী নূরজাহান বেগমের আক্ষেপ যেন শেষই হচ্ছিল না। বললেন, তাঁর স্বামীর দুই চোখ উপড়ে না ফেলে হাতের কবজি কেটে দিতে পারত। তবু তো কষ্ট একটু কম হতো। এখন স্বামীকে এই অবস্থায় রেখে তিনি মানুষের বাড়িতে কাজ করতেও যেতে পারবেন না। তাঁর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ল।