প্রত্যাশা ডেস্ক: গত তিন চার দিন ধরে প্রায় একটানা বৃষ্টিতে এবং কোথাও কোথাও ভারী বর্ষণের ফলে ফেনীসহ কয়েকটি জেলার অনেক এলাকায় প্লাবন দেখা দিয়েছে। প্রতিনিধিদের প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, ফেনীতে ভারী বর্ষণ ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা ঢলের কারণে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের কমপক্ষে ১৪ স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার ৩০টিরও বেশি গ্রাম প্লাবিত হয়ে হাজারো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, মঙ্গলবার (৮ জুলাই) রাত ১০টায় পরশুরামের মুহুরী নদীর পানি রেকর্ড করা হয় ১৩.৯২ মিটার উচ্চতায় প্রবাহ হচ্ছে, যা বিপদসীমার চেয়ে ১.৩৭ মিটার বেশি। মঙ্গলবার সকাল ৭টায় যেখানে নদীর পানি ছিল ৭.০০ মিটার, সেখানে মাত্র ১৫ ঘণ্টায় তা বেড়ে যায় প্রায় ৬.৯২ মিটার।
আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, সোমবার রাত ১২টা থেকে মঙ্গলবার রাত ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ফেনীতে ৪৪১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে। যা চলতি বর্ষা মৌসুমের সর্বোচ্চ। ফুলগাজী ও পরশুরামের নদীর বাঁধে ভাঙনের ফলে একের পর এক গ্রাম পানিতে তলিয়ে যায়। মুহুরী নদীর বাঁধ ভেঙেছে জঙ্গলঘোনা, অলকা, শালধর ও উত্তর শ্রীপুর এলাকায়। কহুয়া নদীর বাঁধ ভেঙেছে সাতকুচিয়া, বেড়াবাড়িয়া ও দৌলতপুরে। এ ছাড়া সিলোনিয়া নদীর বাঁধে ভাঙন দেখা গেছে গদানগর ও দেড়পড়া এলাকায়। পরশুরামের চিথলিয়া এলাকার গৃহবধূ জাকিয়া আক্তার জানান, রাত ৮টার দিকে পানি ঘরে ঢুকে পড়ে। কোনোরকমে কিছু জিনিস নিয়ে অন্য জায়গায় আশ্রয় নিয়েছি। গতবারের বন্যায় যা হারিয়েছি, এবার আবার সেই দুঃখ ফিরে এলো। মির্জানগরের রফিকুল ইসলাম বলেন, পাউবোর গাফিলতির কারণেই বল্লামুখা বাঁধের প্রবেশ মুখ বন্ধ করা হয়নি। প্রতি বছর কিছু লোকের দায়িত্বহীনতার শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলায় মোট ১৩১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে প্রস্তুত করা হয়েছে। এর মধ্যে ফুলগাজীতে ৩২টি মাধ্যমিক ও ৬৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং পরশুরামে ৩২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফুলগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহরিয়া ইসলাম জানান, উপজেলায় তিনটি নদীর বাঁধ ভেঙেছে চারটি স্থানে। আশ্রয়কেন্দ্রে ইতিমধ্যে শতাধিক মানুষ এসেছে। তাদের জন্য শুকনো খাবার, রান্না করা খাবার ও চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে হাজারো মানুষ। এতে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। দুর্গতদের অভিযোগ, বাঁধ ভাঙার ২৪ ঘণ্টা পার হলেও এখনো প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহায়তা মেলেনি।
এদিকে বন্যা পরিস্থিতির কারণে বুধবার থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা স্থগিত করেছে ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলা প্রশাসন। বিদ্যুৎ বিভাগ জানিয়েছে, অনেক সাব-স্টেশন ও বৈদ্যুতিক মিটার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় দুর্ঘটনা এড়াতে অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে। পানি আরো বাড়লে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতার পরিধি বাড়তে পারে। ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আক্তার হোসেন বলেন, রাত ১২টার পর মুহুরী নদীর পানি কিছুটা কমেছে। তবে ভারতের ত্রিপুরা অঞ্চলে বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে নতুন করে আরো এলাকায় প্লাবনের আশঙ্কা রয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুর্গতদের সহায়তায় প্রাথমিকভাবে সাড়ে ছয় লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সার্বক্ষণিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুম।
পদ্মা সেতু প্রকল্প রক্ষা বাঁধে ভয়াবহ ভাঙন, আতঙ্কে ৬০০ পরিবার: শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার পদ্মা সেতু প্রকল্প রক্ষা বাঁধে ভয়াবহ ভাঙন শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে বসতঘর, দোকানপাটসহ ২৬টি স্থাপনা। ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটছে অন্তত ৬০০ পরিবারের।
বুধবার (৯ জুলাই) দুপুর পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্প রক্ষা বাঁধের ওই অংশে ১৩০ মিটার নদীতে বিলীন হয়েছে। ভাঙন আতঙ্কে ইতোমধ্যে নদীর পাড় থেকে বাড়িঘর অন্যত্র সরিয়ে নিতে শুরু করেছেন স্থানীয়রা। তাদের আশঙ্কা দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে নদীতে বিলীন হবে রাস্তাঘাট, হাট-বাজারসহ শতাধিক বসতবাড়ি। উপজেলার আলম খার কান্দি, উকিল উদ্দিন মুন্সি কান্দি ও ওছিম উদ্দিন মুন্সি কান্দি গ্রামের অন্তত ৬০০ পরিবার এখন ভাঙনের ঝুঁকিতে আছেন।
পটুয়াখালীতে ইতিহাসের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতে বিপর্যস্ত জনজীবন: টানা বৃষ্টিতে ভাসছে উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালী। মঙ্গলবার (৮ জুলাই) রাত ৯টা পর্যন্ত শেষ ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ২৭৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, যা এ জেলার ইতিহাসে একদিনে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এর আগে ২০২১ সালের ২৭ জুলাই পটুয়াখালীতে সর্বোচ্চ ২৫১.৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ ও আশপাশের এলাকায় একটি লঘুচাপ বিরাজ করছে। এর ফলে উত্তর বঙ্গোপসাগরে বায়ুচাপের তারতম্যের আধিক্য সৃষ্টি হয়েছে। একই সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় উপকূলে বৃষ্টির মাত্রা বেড়েছে। এই অতিভারী বৃষ্টিপাতে পটুয়াখালী পৌর শহরের বিভিন্ন এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। ছোট চৌরাস্তা, তিতাস মোড়, এসডিও রোড, সবুজবাগ, নতুন বাজার, জুবলী স্কুল রোড, টিবি ক্লিনিক, পুরান বাজারসহ বেশ কিছু নিচু এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। এখনো বিটাইপ এলাকা, এলজিইডি কার্যালয়ের সামনে, এখনো জলাবদ্ধতায় আটকে আছে। তিতাস মোড় এলাকার রাব্বি বলেন, টানা বৃষ্টিতে রাস্তাগুলো পানির নিচে চলে গেছে। ড্রেনেজ ব্যবস্থায় ময়লা আবর্জনা থাকায় সব কিছু আটকে পানি যায় না। চরপাড়া এলাকার নোমান মিঠু বলেন, টানা বৃষ্টির পাশাপাশি আমাদের কারণে ড্রেনে ময়লা আবর্জনা সরাসরি ফালানোয় ড্রেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। পানি দ্রুত চলাচল করছে না, বৃষ্টির পানি শহরে থেকে যায় এই কারণেই জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। এদিকে শুধু শহরেই নয়, জেলার গ্রামাঞ্চলেও দেখা দিয়েছে বন্যা পরিস্থিতি। সদর উপজেলার বড় বিঘাই এলাকার মাছচাষি মুছা সিকদার জানান, আমার মাছের ঘের আর পুকুর পানিতে ছুঁইছুঁই অবস্থা। বৃষ্টিতে নাজেহাল অবস্থা, গ্রামের রাস্তা ঘাট ডুবে আছে। পটুয়াখালী আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাহবুবা সুখী বলেন, উপকূলীয় এলাকায় অতিভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে। পটুয়াখালীর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ২৭৫ মিলিমিটার। এই বৃষ্টি আরোও কিছু দিন চলমান থাকবে।
ভারি বর্ষণে লংগদু বিচ্ছিন্ন, মেরুংয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষ: সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে রাঙামাটির লংগদুর সঙ্গে সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। দীঘিনালা-লংগদু সড়কের হেড কোয়ার্টার এলাকায় সড়ক ডুবে যাওয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। একই সঙ্গে খাগড়াছড়ির দীঘিনালার মেরুং ইউনিয়নের নিচু এলাকার কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
বুধবার (৯ জুলাই) সকাল থেকে মেরুং ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে পানি উঠতে শুরু করে বলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি জানিয়েছেন। এতে চিটাইগ্যাংয়া পাড়া বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষ মেরুং বাজার সংলগ্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে মেরুং বাজার ডুবে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে বলেও জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
পাইকগাছায় ৩৭৫৫ ঘের-পুকুর ভেসে গেছে: ভারী বর্ষণে খুলনার পাইকগাছার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে মাছের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বর্ষার পানিতে ডুবে গেছে তিন হাজার ৭৫৫ মৎস্য ঘের ও পুকুর। বেড়েছে জনদুর্ভোগ। উপজেলা কৃষি অফিস ও আদালত চত্বরসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দফতর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বৃষ্টির পানিতে প্লাবিত হয়েছে। কয়েক দিনের বৃষ্টিতে পাইকগাছার বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। এ বছর আষাঢ় মাসের প্রথম থেকে একটানা গুঁড়ি গুঁড়ি, হালকা ও ভারী বৃষ্টি লেগে আছে। এতে পুকুর, ঘের ও বসতবাড়ি তলিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পাইকগাছার গদাইপুর, হরিঢালী, কপিলমুনি ও রাড়ুলী উঁচু এলাকা হলেও বাকি ছয়টি ইউনিয়ন নিচু এলাকায় অবস্থিত। সামান্য বৃষ্টি হলে এসব এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। তবে গত দিনের ভারী বর্ষণে উঁচু এলাকাও পানিতে তলিয়ে গেছে। পৌর বাজারের সোনা পট্টি, মাছ বাজারসহ বিভিন্ন রাস্তা জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। উপজেলার বেশিরভাগ গ্রামীণ রাস্তা পানিতে তলিয়ে থাকে। বাড়ির উঠান পানিতে তলিয়ে থাকায় সাধারণ মানুষ বিড়ম্বনায় পড়েছে। কয়েক দিনের বৃষ্টিতে শ্রমজীবী মানুষরা কাজে যেতে না পারায় কর্মহীন হয়ে পড়ে আর্থিক অনটনের মধ্যে পড়েছে। উপজেলার সদর ইউনিয়ন গদাইপুরের কয়েকশ নার্সারি ক্ষেত পানিতে তলিয়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সবজি ক্ষেত ও আমন ধান ঝোড়ো হাওয়ায় পড়ে পানিতে তলিয়ে গেছে। কয়েক দিনের একটানা বৃষ্টিতে মানুষের জনদুর্ভোগ বেড়েই চলেছে।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা: টানা দুদিনের বৃষ্টিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। সড়কের খানাখন্দ ও বড় বড় গর্তে বৃষ্টির পানি জমে বেড়েছে দুর্ভোগ। এতে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, কর্মজীবী মানুষসহ ভোগান্তিতে পড়েছে নগরবাসী। মঙ্গলবার (৮ জুলাই) থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টিপাত বুধবার (৯ জুলাই) বিকাল পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। ফলে রাজধানীর মিরপুর, ধানমন্ডি, মহাখালীসহ পুরান ঢাকার বেশ কয়েকটি এলাকায় পানি জমে গেছে। সরেজমিনে দেখা যায়, ধানমন্ডির হকার্স মার্কেট, নিউমার্কেট, কারওয়ান বাজারসহ পুরান ঢাকার বংশাল এলাকার বিভিন্ন অলিগলিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়াও যাত্রাবাড়ী, নারিন্দা, দয়াগঞ্জ, টিকাটুলি, স্বামীবাগ ও গেন্ডারিয়ায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।