প্রত্যাশা ডেস্ক: বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়—আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মূল স্লোগান বা ভিত্তি। কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে এই স্লোগান বা নীতিটি পুনর্বিবেচনা করা দরকার। বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশের জনগণ আর কাঁটাতারে ফেলানীর ঝুলন্ত লাশ দেখতে চায় না। সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশিদের রক্তাক্ত মরদেহ আর দেখতে চায় না। প্রতিবেশী দেশ ভারত যদি পানির ন্যায্য হিস্যা না দেয় বা দিতে যদি দেরি করে, তিস্তা চুক্তি করতে অনীহা প্রকাশ করে, তাহলে দেশ ও জনগণের স্বার্থে কৃষি, কৃষক ও নদী বাঁচাতে তিস্তা সমস্যার সমাধানের জন্য আমাদেরই বাঁচার পথ খুঁজে নিতে হবে।’
মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা ও তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে রংপুর বিভাগের পাঁচটি জেলার ১১টি স্থানে ৪৮ ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচিতে আয়োজিত জনসভায় ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে তারেক রহমান এ কথাগুলো বলেন।
‘জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই’ স্লোগানে এ কর্মসূচির আয়োজন করে তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক ও বিএনপির রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল হাবিব (দুলু)।
তারেক রহমান বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে ৫৪টি অভিন্ন নদী, এই নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা প্রাপ্তি কারও করুণার বিষয় নয়। এটা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রাপ্য। অথচ আমরা কী দেখছি, তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য পাওনা আদায়ের জন্য বাংলাদেশ তথা উত্তরাঞ্চলের মানুষকে আন্দোলন করতে হচ্ছে। এই পানিবণ্টন নিয়ে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে অপ্রতিবেশীসুলভ আচরণ করেই চলেছে।’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘উত্তরাঞ্চলের পানির ন্যায্য হিসাববঞ্চিত মানুষেরা দুই দিনব্যাপী অবস্থান কর্মসূচি করে সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছেন। আমাদের সবার জানা আছে, আজকে প্রায় ৫০ বছর হলো ফারাক্কার অভিশাপ থেকে বাংলাদেশ মুক্তি পায় নাই। তিস্তা বাংলাদেশের আরেকটা অভিশাপ হিসেবে দেখা দিয়েছে। সব আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে আমাদের প্রতিবেশী উজানে গজলডোবায় একটা বাঁধ নির্মাণ করেছে। তিস্তার স্বাভাবিক পানিপ্রবাহকে তারা নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে।’
তারেক রহমান বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশের অপ্রতিবেশীসুলভ আচরণের কারণে আজকে উত্তরাঞ্চলের মানুষ বন্যা, খরাসহ দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। তিস্তার বুকে আজকে ধু ধু বালুচর। একদিকে পানির অভাবে হাজার হাজার কোটি টাকার ফসল নষ্ট হচ্ছে; আবার হঠাৎ করে উজান থেকে পানি ছেড়ে দিচ্ছে। পানির কারণে বন্যায় ভাসিয়ে দিচ্ছে সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি ও কৃষকের আবাদি ফসল। প্রতিবছরে বন্যার কারণে এ রকম ক্ষতি হয়, এমনকি কোনো বছরে তিনবার বন্যা হয়। প্রতিবছর লক্ষ কোটি টাকার ফসলের আর্থিক ক্ষতি হয়।’
নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে তারেক রহমান বলেন, ‘৫ আগস্ট আমরা দেখেছি, একটা স্বৈরাচার এই দেশ থেকে পালিয়ে গিয়েছে। এই স্বৈরাচার একবার বলেছিল, ভারতকে যা দিয়েছি তারা সারা জীবন মনে রাখবে। ভারত শুধু পলাতক স্বৈরাচারকেই মনে রাখেনি। এ জন্য তিস্তার পানির ন্যায্য হিসাববঞ্চিত বিক্ষুব্ধ তিস্তাপারের মানুষের প্রশ্ন, পলাতক স্বৈরাচার ভারতকে যা দিয়েছে বা পলাতক স্বৈরাচারকে ভারত যা দিয়েছে, সেই পলাতক স্বৈরাচারকে আশ্রয় দেওয়ার পর ভারত বাংলাদেশকে কিছু দিয়েছে? কিছু দেয় নাই।’
তারেক রহমান বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সমস্যা সমাধান কিংবা পারস্পরিক স্বার্থ থাকে। নিজ নিজ দেশের স্বার্থ রক্ষা করে প্রতিটি দেশ সমস্যার সমাধান করে। আমরা সবাই জানি, এটি হচ্ছে কূটনীতিক রীতি। কিন্তু খুনি স্বৈরাচার পালিয়ে গিয়েছে ৫ আগস্ট, আমরা দেখেছি জোর করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে রাখতে গিয়ে নিজেদের তাদের সেবাদাসীতে পরিণত করেছিল। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশন ও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন সম্পূর্ণ অকার্যকর করে রেখেছিল। বাংলাদেশের মানুষ জানে, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরাজমান ফারাক্কার সমস্যার সমাধান হয়নি। উত্তরাঞ্চলের বহুল প্রত্যাশিত তিস্তা চুক্তিও হয়নি। অথচ সব আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ভঙ্গ করে এই পলাতক খুনি স্বৈরাচার ট্রানজিট দিয়ে বন্দর ব্যবহারের একতরফা সুবিধা দিয়ে দিয়েছে। এসব চুক্তিতে কোনোরকম ন্যায্যতা রক্ষা করা হয়নি।’
তারেক রহমান আরও বলেন, ‘দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সব বিকল্পকে কাজে লাগাতে হবে। আমরা মনে করি, পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে জাতিসংঘসহ সংশ্লিষ্ট সব আন্তর্জাতিক ফোরামে জোরালোভাবে বাংলাদেশের দাবি তুলে ধরতে হবে। একই সঙ্গে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক আলোচনা শুরু করতে হবে। আন্তর্জাতিক উদ্যোগের পাশাপাশি বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলকে মরুকরণের হাত থেকে বাঁচাতে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। বিএনপি জনগণের সমর্থনে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে অবশ্যই আমরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের সব রকম উদ্যোগ নেব। পাশাপাশি বর্ষাসহ অন্যান্য উৎস থেকে পানি সংরক্ষণ করার জন্য বাংলাদেশের ভেতরে থাকা তিস্তার ডান পাশের সাতটি নদী ও বাঁ পাশের পাঁচটি শাখা বা উপনদী খনন করা অত্যন্ত জরুরি। এগুলোকে আমাদের খনন করতে হবে।’
বিএনপির শীর্ষ নেতা বলেন, ‘জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট মাফিয়া সরকার পালিয়ে যাওয়ার পর দেশে জনগণের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুযোগ ও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তৈরি হয়েছে ভোটের অধিকার প্রয়োগ করে জনগণের দায়বদ্ধ একটি সরকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ। কিন্তু গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি কিংবা সরকারের কোনো হঠকারী সিদ্ধান্তের কারণে যাতে খুনি পলাতক স্বৈরাচার ও তার দোসররা পুনর্বাসনের সুযোগ না পায়, সে ব্যাপারে আমাদের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের সবাইকে অতীতের মতো ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।’
তারেক রহমান আরও বলেন, গণতান্ত্রিক দলগুলোর পক্ষ থেকে জাতীয় নির্বাচনের কথা শুনলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিচলিত হয়ে ওঠে। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে একেক রকম বক্তব্য খুনি মাফিয়া চক্রের সামনে বিশৃঙ্খলা তৈরির সুযোগ করে দেয়। এ জন্য বিএনপি বারবার অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তাদের কর্মপরিকল্পনার রোডম্যাপ ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছে।