ঢাকা ০৬:২৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২১ মে ২০২৫

ভারতে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত ২৬১

  • আপডেট সময় : ০১:৫৮:৪৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩ জুন ২০২৩
  • ৮৬ বার পড়া হয়েছে

প্রত্যাশা ডেস্ক : ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ওড়িশায় ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এই দুর্ঘটনার প্রায় ১৮ ঘণ্টার পর গতকাল শনিবার বিকেলের দিকে উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করেছে ভারতীয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। রেলওয়ের মুখপাত্র অমিতাভ শর্মা বলেছেন, বালাসোর দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২৬১ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। যদিও এর আগে ভারতের স্মরণকালের অন্যতম ভয়াবহ এই দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ২৮০ জনের বেশি বলে জানানো হয়েছিল। দুর্ঘটনায় ৬৫০ জনেরও বেশি যাত্রী আহত হওয়ায় মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
শুক্রবার সন্ধ্যা ৭ টা ২০ মিনিটে ওড়িশার বালেশ্বর জেলার বাহাঙ্গা বাজার এলাকায় ঘটে ভয়াবহ এই দুর্ঘটনা। শালিমার থেকে চেন্নাইগামী সেন্ট্রাল করমন্ডল এক্সপ্রেস, বেঙ্গালুরু থেকে হাওড়াগামী সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস এবং একটি মালবাহী ট্রেন- এই তিনটি ট্রেন এই দুর্ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডে।
ট্রেনটির গতি ছিল ১২৭ কিলোমিটার, ঢুকেছিল ভুল লাইনে: ভারতের ওড়িশায় ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার ‘সম্ভাব্য’ কারণ জানা গেছে। দেশটির সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমস জানিয়েছে, দুর্ঘটনায় দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া চেন্নাইগামী করম-ল এক্সপ্রেস ভুল লাইনে ঢুকে পড়ে। এখান থেকেই দুর্ঘটনার সূত্রপাত হয়। সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, নাম গোপন রাখার শর্তে রেলওয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, শুক্রবার (২ জুন) ওড়িশার বালেশ্বরের বাহানগর বাজার স্টেশনের লুপ লাইনে দাঁড়িয়েছিল একটি মালবাহী ট্রেন। ওই সময় চেন্নাইগামী করম-ল ট্রেনের মূল লাইন দিয়ে চলে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মূল লাইনে না গিয়ে এটি লুপ লাইনে ঢুকে পড়ে। দুর্ঘটনার সময় ১২৭ কিলোমিটার গতিতে এগিয়ে আসা করম-ল এক্সপ্রেস অত্যন্ত জোরে মালবাহী ট্রেনকে ধাক্কা দেয়। তখন করম-ল এক্সপ্রেসের কয়েকটি বগি ছিটকে পাশের আরেকটি মূল লাইনে গিয়ে পড়ে। এর কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিপরীত দিক থেকে বেঙ্গালুরু থেকে হাওড়াগামী সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস চলে আসে। লাইনের ওপর পড়ে থাকা করম-ল ট্রেনের কয়েকটি বগিতে সজোরে ধাক্কা মারে সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস। এতেই সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। ভারতের খড়গপুর ডিভিশনের সিগন্যাল রুমের ভিডিওতে দেখা গেছে, বালেশ্বরের ওই স্টেশনের কাছে মোট চারটি লাইন রয়েছে। এর মধ্যে দুটি লুপ লাইন। আর বাকি দুটি মেইন লাইন।
লুপ লাইন কী? ভারতের রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, লুপ লাইন তৈরি করা হয় স্টেশন এলাকায়। মূলত ট্রেন চলাচল সহজ করতে এসব লুপ লাইন বানানো হয়। লুপ লাইন সাধারণত ৭৫০ মিটার লম্বা হয়, যেন কয়েকটি ইঞ্জিনসহ একটি বড় মালবাহী ট্রেন দাঁড়াতে পারে। তবে এখন এ লুপ লাইনের দৈর্ঘ্য বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে ভারতের রেলওয়ে।
দুর্ঘটনার জন্য কে দায়ী? ভয়াবহ এ দুর্ঘটনা কি মানুষের ভুলে হয়েছে নাকি কোনো কারিগরি ত্রুটির কারণে হয়েছে সেটি এখনো নিশ্চিত নয়। তবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, মানুষের ভুলই এজন্য দায়ী। কারণ করম-ল এক্সপ্রেস প্রথমে ভুল লাইনে প্রবেশ করেছিল। এরপর এটি লাইনচ্যুত হয়েছিল। তবে আরেকটি সূত্র বলছে, লুপ লাইনে ট্রেনটি দাঁড়ানো থাকলেও হয়ত এটির কয়েকটি বগি মূল লাইনের ওপর ছিল। আর ওই সময় মূল লাইন দিয়ে আসা করম-ল এক্সপ্রেস ওই বগিগুলোতে সজোরে ধাক্কা মারে। সূত্র: হিন্দুস্তান টাইমস
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ভারতে যত ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেসবের মধ্যে গত শুক্রবারের দুর্ঘটনাটি ছিল অন্যতম ভয়াবহ ও প্রাণঘাতী। কেন্দ্র ও রাজ্য প্রশাসনের কর্মকর্তারা বিবিসিকে জানিয়েছেন, শালিমার থেকে চেন্নাইগামী করম-ল এক্সপ্রেস সন্ধ্যা ৭টার দিকে লাইনচ্যুত হয় এবং ট্রেনের কয়েকটি বগি বিপরীত লাইনে আড়াআড়িভাবে পড়ে যায়। কাছাকাছি সময়েই বিপরীত লাইন ধরে হাওড়া থেকে আসা সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস ওই সময় সেখানে পৌঁছায় এবং লাইনের ওপর পড়ে থাকা করম-ল এক্সপ্রেসের বগিগুলোর সঙ্গে মুখোমুখী সংঘর্ষের ফলে সেটিও লাইনচ্যুত হয়। গোটা ঘটনায় মালবাহী ট্রেনটির ভূমিকা কী ছিল-জানা যায়নি। তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, দুর্ঘটনার পর মালগাড়ির ওপর উঠে গিয়েছিল করম-লের ইঞ্জিন। দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া এক যাত্রী বিবিসিকে বলেন, ‘হঠাৎ করে ব্যাপক একটা ধাক্কা অনুভূত হলো এবং অন্তত ১০ থেকে ১৫ জন মানুষ আমার ওপর এসে পড়ল। আমি ছিলাম তাদের সবার নীচে।’
‘আমি হাতে, পিঠে, ঘাড়ে ব্যথা নিয়ে যখন কোনো রকমে বাইরে বের হতে পারলাম-দেখলাম কেউ ইতোমধ্যে তার হাত হারিছেন, কেউ পা, কারো বা চেহারা সম্পূর্ণ বিকৃত হয়ে গেছে।’ ইতোমধ্যে শুক্রবারের দুর্ঘটনায় নিহত প্রত্যেক ব্যক্তির পরিবারকে ১০ লাখ রুপি ও আহতদের ৫০ হাজার রুপি করে ক্ষতপূরণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েক হতাহতদের জন্য শনিবার রাজ্যে এক দিন শোক পালনের ঘোষণা দিয়েছেন। ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনাটি হয়েছিল ১৯৮১ সালে। ঘূর্ণিঝড়ের শিকার হয়ে বিহারের একটি যাত্রীবাহী ট্রেন নদীতে পড়ে গিয়েছিল সেবার। এতে ৮০০ মানুষ নিহত হয়েছিলেন।
উদ্ধার অভিযান: ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা দপ্তর ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্সের (এনডিআরএফ) ৩টি ইউনিট, ওড়িশা রাজ্য সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা দপ্তর ওড়িশা ডিজাস্টার র‌্যাপিড অ্যাকশন ফোর্সের ৪টি ইউনিট, রাজ্যের ফায়ার সার্ভিস বিভাগের ১৫টি উদ্ধারকারী দল, ২০০ পুলিশ সদস্য ও কর্মকর্তা, ৩০ জন ডাক্তার এবং ৬০টি অ্যাম্বুলেন্স ঘটনাস্থলে উদ্ধার তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত আছে বলে জানিয়েছেন ওড়িশার মুখ্য সচিব। ঘটনাস্থলে উদ্ধার তৎপরতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ফায়ারসার্ভিস ও অন্যান্য বাহিনীর কর্মকর্তাদের বরাতে জানা গেছে, হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
শুক্রবার (২ জুন) স্থানীয় সময় দুপুর ৩টা ১৫ মিনিটের দিকে কলকাতার শালিমার স্টেশন থেকে তামিলনাড়ু রাজ্যের রাজধানী চেন্নাইয়ের উদ্দেশে ছেড়ে যায় ১২৮৪১ আপ করম-ল এক্সপ্রেস। তারপর পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পার হয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা নাগাদ ট্রেনটি পৌঁছায় বালেশ্বরে। তার আরও এক ঘণ্টা ২০ মিনিট পর বাহাঙ্গা বাজারের কাছে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ২৩ কামরার ট্রেনটি।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত সংবাদকর্মীরা জানিয়েছেন, দুর্ঘটনার অভিঘাত এতটাই বেশি ছিল যে করম-ল এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনটি মালগাড়ির উপর উঠে গেছে। যে রেললাইনে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে তার কাছেই অশোকের দোকান। দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফেরার কথা ভাবছিলেন তিনি। হঠাৎ শুনলেন রেললাইনে কানফাটা এক শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ও আরও বেশ কয়েকজন রেল লাইনের দিকে ছুটে যান। সেখানে গিয়ে দেখেন, রেল লাইন থেকে ছুটে মাটিতে পড়ে আছে ট্রেনের বগি। ঠিক ওই সময়ের দৃশ্যের বর্ণনা করে অশোক বলেন, সবাই চিৎকার করছিল আর রক্তে ভেসে যাচ্ছিল চারিদিক। উল্টে যাওয়া বগিগুলোতে আটকে পড়া বেশ কয়েকজন সাহায্য চাইছিল। আমি উল্টে যাওয়া বগির নিচে বেশ কিছু মৃতদেহ আটকে থাকতেও দেখেছি। দুর্ঘটনা কবলিত ট্রেনে থাকা শ্রমিক গোবিন্দ মন্ডল ভাগ্যক্রমে রক্ষা পেয়েছেন। তিনি বলেন, আচমকা দুর্ঘটনায় আমাদের কামরাটা খুব দ্রুত গতিতে লাইনচ্যুত হয়েছিল। বেশ কিছু দূর গিয়ে সেটা থেমেছিল। হট্টগোলের মধ্যে হঠাৎ দেখেছিলাম, আমার আসনের পাশের জানালাটা লোহার গ্রিলসহ ভেঙে গেছে। উদ্ধারকারীদের একজন সেটা ধাক্কা মেরে খুলে ফেলেছিল। তাতেই আমরা বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম।
মৃতদের পরিবার পাবে ১০ লাখ ক্ষতিপূরণ, মোদির দুঃখপ্রকাশ: করম-ল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনায় মৃতদের পরিবার প্রতি ১০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণো। দুর্ঘটনায় আহতদের ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেবে রেল।
এদিকে শুক্রবার রাত পৌনে ১০টার দিকে টুইট করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, এ ভয়াবহ দুর্ঘটনার খবর পেয়ে তিনি মর্মাহত। রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণোর সঙ্গে তিনি গোটা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর কথায়, উদ্ধার কাজ চলছে। আহতদের চিকিৎসারও ব্যবস্থা করা হয়েছে। রেল সূত্রে বলা হচ্ছে, যতদ্রুত সম্ভব বালাসোরে পৌঁছনোর চেষ্টা করছেন রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণো। শনিবার সকালে বালাসোরে পৌঁছান ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েকও।
আহতদের রক্ত দিতে শত শত মানুষের ভিড়: ভারতের ওড়িশায় ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় আহতদের রক্ত দিতে হাসপাতালে ভিড় করেছেন শত শত মানুষ। ওড়িশার বালেশ্বরে হওয়া স্মরণকালের সবচেয়ে বড় এ দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২৮৮ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। এছাড়া আহত হয়েছেন প্রায় ৯০০ জন। আহতদের স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
ভারতীয় বার্তাসংস্থা এএনআই শনিবার (৩ জুন) এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার পরই অনেকে রক্ত দানে ছুটে আসেন। ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী প্রদীপ জেনা সাধারণ মানুষের এগিয়ে আসার ব্যাপারে বলেছেন, ‘মানুষ স্বেচ্ছায় রক্ত দিতে আসছেন। আমি অনেকের কাছ থেকে অনুরোধ পাচ্ছি, এটি ভালো। দুর্ঘটনার পরই স্থানীয়রা উদ্ধারকাজে আমাদের অনেক সহায়তা করেছেন।’
স্বতস্ফূর্তভাবে মানুষ রক্ত দিতে আসার ব্যাপারে ডক্টর রবি দিয়োরা নামের এক ব্যক্তি টুইটারে লিখেছেন, ‘এজন্যই ভারত বসবাসের জন্য অন্যতম সেরা একটি দেশ। সংস্কৃতি, নীতি এবং সহায়তার মনোভাব ভারতীয়দের রক্তে আছে। যারা রক্ত দেওয়ার জন্য লাইন ধরেছেন তাদের সবার জন্য অনেক গর্বিত।’ পাবন মালোহোত্রা নামে একজন লিখেছেন, ‘বালেশ্বরের মানুষের জন্য গর্বিত এমন সংকটময় সময়ে তাদের নিঃস্বার্থতা ও সহানুভূতির জন্য। ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার পর রক্তদাতাদের দীর্ঘ সারি আমার মনকে ভরিয়ে দিয়েছে। আপনাদের এই রক্তদান জীবন বাঁচাবে এবং যাদের প্রয়োজন তাদের মধ্যে আশার সঞ্চার করবে।’

 

 

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

ভারতে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত ২৬১

আপডেট সময় : ০১:৫৮:৪৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩ জুন ২০২৩

প্রত্যাশা ডেস্ক : ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ওড়িশায় ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এই দুর্ঘটনার প্রায় ১৮ ঘণ্টার পর গতকাল শনিবার বিকেলের দিকে উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করেছে ভারতীয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। রেলওয়ের মুখপাত্র অমিতাভ শর্মা বলেছেন, বালাসোর দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২৬১ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। যদিও এর আগে ভারতের স্মরণকালের অন্যতম ভয়াবহ এই দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ২৮০ জনের বেশি বলে জানানো হয়েছিল। দুর্ঘটনায় ৬৫০ জনেরও বেশি যাত্রী আহত হওয়ায় মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
শুক্রবার সন্ধ্যা ৭ টা ২০ মিনিটে ওড়িশার বালেশ্বর জেলার বাহাঙ্গা বাজার এলাকায় ঘটে ভয়াবহ এই দুর্ঘটনা। শালিমার থেকে চেন্নাইগামী সেন্ট্রাল করমন্ডল এক্সপ্রেস, বেঙ্গালুরু থেকে হাওড়াগামী সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস এবং একটি মালবাহী ট্রেন- এই তিনটি ট্রেন এই দুর্ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডে।
ট্রেনটির গতি ছিল ১২৭ কিলোমিটার, ঢুকেছিল ভুল লাইনে: ভারতের ওড়িশায় ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার ‘সম্ভাব্য’ কারণ জানা গেছে। দেশটির সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমস জানিয়েছে, দুর্ঘটনায় দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া চেন্নাইগামী করম-ল এক্সপ্রেস ভুল লাইনে ঢুকে পড়ে। এখান থেকেই দুর্ঘটনার সূত্রপাত হয়। সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, নাম গোপন রাখার শর্তে রেলওয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, শুক্রবার (২ জুন) ওড়িশার বালেশ্বরের বাহানগর বাজার স্টেশনের লুপ লাইনে দাঁড়িয়েছিল একটি মালবাহী ট্রেন। ওই সময় চেন্নাইগামী করম-ল ট্রেনের মূল লাইন দিয়ে চলে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মূল লাইনে না গিয়ে এটি লুপ লাইনে ঢুকে পড়ে। দুর্ঘটনার সময় ১২৭ কিলোমিটার গতিতে এগিয়ে আসা করম-ল এক্সপ্রেস অত্যন্ত জোরে মালবাহী ট্রেনকে ধাক্কা দেয়। তখন করম-ল এক্সপ্রেসের কয়েকটি বগি ছিটকে পাশের আরেকটি মূল লাইনে গিয়ে পড়ে। এর কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিপরীত দিক থেকে বেঙ্গালুরু থেকে হাওড়াগামী সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস চলে আসে। লাইনের ওপর পড়ে থাকা করম-ল ট্রেনের কয়েকটি বগিতে সজোরে ধাক্কা মারে সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস। এতেই সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। ভারতের খড়গপুর ডিভিশনের সিগন্যাল রুমের ভিডিওতে দেখা গেছে, বালেশ্বরের ওই স্টেশনের কাছে মোট চারটি লাইন রয়েছে। এর মধ্যে দুটি লুপ লাইন। আর বাকি দুটি মেইন লাইন।
লুপ লাইন কী? ভারতের রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, লুপ লাইন তৈরি করা হয় স্টেশন এলাকায়। মূলত ট্রেন চলাচল সহজ করতে এসব লুপ লাইন বানানো হয়। লুপ লাইন সাধারণত ৭৫০ মিটার লম্বা হয়, যেন কয়েকটি ইঞ্জিনসহ একটি বড় মালবাহী ট্রেন দাঁড়াতে পারে। তবে এখন এ লুপ লাইনের দৈর্ঘ্য বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে ভারতের রেলওয়ে।
দুর্ঘটনার জন্য কে দায়ী? ভয়াবহ এ দুর্ঘটনা কি মানুষের ভুলে হয়েছে নাকি কোনো কারিগরি ত্রুটির কারণে হয়েছে সেটি এখনো নিশ্চিত নয়। তবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, মানুষের ভুলই এজন্য দায়ী। কারণ করম-ল এক্সপ্রেস প্রথমে ভুল লাইনে প্রবেশ করেছিল। এরপর এটি লাইনচ্যুত হয়েছিল। তবে আরেকটি সূত্র বলছে, লুপ লাইনে ট্রেনটি দাঁড়ানো থাকলেও হয়ত এটির কয়েকটি বগি মূল লাইনের ওপর ছিল। আর ওই সময় মূল লাইন দিয়ে আসা করম-ল এক্সপ্রেস ওই বগিগুলোতে সজোরে ধাক্কা মারে। সূত্র: হিন্দুস্তান টাইমস
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ভারতে যত ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেসবের মধ্যে গত শুক্রবারের দুর্ঘটনাটি ছিল অন্যতম ভয়াবহ ও প্রাণঘাতী। কেন্দ্র ও রাজ্য প্রশাসনের কর্মকর্তারা বিবিসিকে জানিয়েছেন, শালিমার থেকে চেন্নাইগামী করম-ল এক্সপ্রেস সন্ধ্যা ৭টার দিকে লাইনচ্যুত হয় এবং ট্রেনের কয়েকটি বগি বিপরীত লাইনে আড়াআড়িভাবে পড়ে যায়। কাছাকাছি সময়েই বিপরীত লাইন ধরে হাওড়া থেকে আসা সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস ওই সময় সেখানে পৌঁছায় এবং লাইনের ওপর পড়ে থাকা করম-ল এক্সপ্রেসের বগিগুলোর সঙ্গে মুখোমুখী সংঘর্ষের ফলে সেটিও লাইনচ্যুত হয়। গোটা ঘটনায় মালবাহী ট্রেনটির ভূমিকা কী ছিল-জানা যায়নি। তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, দুর্ঘটনার পর মালগাড়ির ওপর উঠে গিয়েছিল করম-লের ইঞ্জিন। দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া এক যাত্রী বিবিসিকে বলেন, ‘হঠাৎ করে ব্যাপক একটা ধাক্কা অনুভূত হলো এবং অন্তত ১০ থেকে ১৫ জন মানুষ আমার ওপর এসে পড়ল। আমি ছিলাম তাদের সবার নীচে।’
‘আমি হাতে, পিঠে, ঘাড়ে ব্যথা নিয়ে যখন কোনো রকমে বাইরে বের হতে পারলাম-দেখলাম কেউ ইতোমধ্যে তার হাত হারিছেন, কেউ পা, কারো বা চেহারা সম্পূর্ণ বিকৃত হয়ে গেছে।’ ইতোমধ্যে শুক্রবারের দুর্ঘটনায় নিহত প্রত্যেক ব্যক্তির পরিবারকে ১০ লাখ রুপি ও আহতদের ৫০ হাজার রুপি করে ক্ষতপূরণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েক হতাহতদের জন্য শনিবার রাজ্যে এক দিন শোক পালনের ঘোষণা দিয়েছেন। ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনাটি হয়েছিল ১৯৮১ সালে। ঘূর্ণিঝড়ের শিকার হয়ে বিহারের একটি যাত্রীবাহী ট্রেন নদীতে পড়ে গিয়েছিল সেবার। এতে ৮০০ মানুষ নিহত হয়েছিলেন।
উদ্ধার অভিযান: ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা দপ্তর ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্সের (এনডিআরএফ) ৩টি ইউনিট, ওড়িশা রাজ্য সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা দপ্তর ওড়িশা ডিজাস্টার র‌্যাপিড অ্যাকশন ফোর্সের ৪টি ইউনিট, রাজ্যের ফায়ার সার্ভিস বিভাগের ১৫টি উদ্ধারকারী দল, ২০০ পুলিশ সদস্য ও কর্মকর্তা, ৩০ জন ডাক্তার এবং ৬০টি অ্যাম্বুলেন্স ঘটনাস্থলে উদ্ধার তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত আছে বলে জানিয়েছেন ওড়িশার মুখ্য সচিব। ঘটনাস্থলে উদ্ধার তৎপরতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ফায়ারসার্ভিস ও অন্যান্য বাহিনীর কর্মকর্তাদের বরাতে জানা গেছে, হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
শুক্রবার (২ জুন) স্থানীয় সময় দুপুর ৩টা ১৫ মিনিটের দিকে কলকাতার শালিমার স্টেশন থেকে তামিলনাড়ু রাজ্যের রাজধানী চেন্নাইয়ের উদ্দেশে ছেড়ে যায় ১২৮৪১ আপ করম-ল এক্সপ্রেস। তারপর পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পার হয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা নাগাদ ট্রেনটি পৌঁছায় বালেশ্বরে। তার আরও এক ঘণ্টা ২০ মিনিট পর বাহাঙ্গা বাজারের কাছে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ২৩ কামরার ট্রেনটি।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত সংবাদকর্মীরা জানিয়েছেন, দুর্ঘটনার অভিঘাত এতটাই বেশি ছিল যে করম-ল এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনটি মালগাড়ির উপর উঠে গেছে। যে রেললাইনে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে তার কাছেই অশোকের দোকান। দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফেরার কথা ভাবছিলেন তিনি। হঠাৎ শুনলেন রেললাইনে কানফাটা এক শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ও আরও বেশ কয়েকজন রেল লাইনের দিকে ছুটে যান। সেখানে গিয়ে দেখেন, রেল লাইন থেকে ছুটে মাটিতে পড়ে আছে ট্রেনের বগি। ঠিক ওই সময়ের দৃশ্যের বর্ণনা করে অশোক বলেন, সবাই চিৎকার করছিল আর রক্তে ভেসে যাচ্ছিল চারিদিক। উল্টে যাওয়া বগিগুলোতে আটকে পড়া বেশ কয়েকজন সাহায্য চাইছিল। আমি উল্টে যাওয়া বগির নিচে বেশ কিছু মৃতদেহ আটকে থাকতেও দেখেছি। দুর্ঘটনা কবলিত ট্রেনে থাকা শ্রমিক গোবিন্দ মন্ডল ভাগ্যক্রমে রক্ষা পেয়েছেন। তিনি বলেন, আচমকা দুর্ঘটনায় আমাদের কামরাটা খুব দ্রুত গতিতে লাইনচ্যুত হয়েছিল। বেশ কিছু দূর গিয়ে সেটা থেমেছিল। হট্টগোলের মধ্যে হঠাৎ দেখেছিলাম, আমার আসনের পাশের জানালাটা লোহার গ্রিলসহ ভেঙে গেছে। উদ্ধারকারীদের একজন সেটা ধাক্কা মেরে খুলে ফেলেছিল। তাতেই আমরা বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম।
মৃতদের পরিবার পাবে ১০ লাখ ক্ষতিপূরণ, মোদির দুঃখপ্রকাশ: করম-ল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনায় মৃতদের পরিবার প্রতি ১০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণো। দুর্ঘটনায় আহতদের ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেবে রেল।
এদিকে শুক্রবার রাত পৌনে ১০টার দিকে টুইট করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, এ ভয়াবহ দুর্ঘটনার খবর পেয়ে তিনি মর্মাহত। রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণোর সঙ্গে তিনি গোটা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর কথায়, উদ্ধার কাজ চলছে। আহতদের চিকিৎসারও ব্যবস্থা করা হয়েছে। রেল সূত্রে বলা হচ্ছে, যতদ্রুত সম্ভব বালাসোরে পৌঁছনোর চেষ্টা করছেন রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণো। শনিবার সকালে বালাসোরে পৌঁছান ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েকও।
আহতদের রক্ত দিতে শত শত মানুষের ভিড়: ভারতের ওড়িশায় ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় আহতদের রক্ত দিতে হাসপাতালে ভিড় করেছেন শত শত মানুষ। ওড়িশার বালেশ্বরে হওয়া স্মরণকালের সবচেয়ে বড় এ দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২৮৮ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। এছাড়া আহত হয়েছেন প্রায় ৯০০ জন। আহতদের স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
ভারতীয় বার্তাসংস্থা এএনআই শনিবার (৩ জুন) এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার পরই অনেকে রক্ত দানে ছুটে আসেন। ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী প্রদীপ জেনা সাধারণ মানুষের এগিয়ে আসার ব্যাপারে বলেছেন, ‘মানুষ স্বেচ্ছায় রক্ত দিতে আসছেন। আমি অনেকের কাছ থেকে অনুরোধ পাচ্ছি, এটি ভালো। দুর্ঘটনার পরই স্থানীয়রা উদ্ধারকাজে আমাদের অনেক সহায়তা করেছেন।’
স্বতস্ফূর্তভাবে মানুষ রক্ত দিতে আসার ব্যাপারে ডক্টর রবি দিয়োরা নামের এক ব্যক্তি টুইটারে লিখেছেন, ‘এজন্যই ভারত বসবাসের জন্য অন্যতম সেরা একটি দেশ। সংস্কৃতি, নীতি এবং সহায়তার মনোভাব ভারতীয়দের রক্তে আছে। যারা রক্ত দেওয়ার জন্য লাইন ধরেছেন তাদের সবার জন্য অনেক গর্বিত।’ পাবন মালোহোত্রা নামে একজন লিখেছেন, ‘বালেশ্বরের মানুষের জন্য গর্বিত এমন সংকটময় সময়ে তাদের নিঃস্বার্থতা ও সহানুভূতির জন্য। ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার পর রক্তদাতাদের দীর্ঘ সারি আমার মনকে ভরিয়ে দিয়েছে। আপনাদের এই রক্তদান জীবন বাঁচাবে এবং যাদের প্রয়োজন তাদের মধ্যে আশার সঞ্চার করবে।’