মো. জাকির হোসেন : গত কয়েক বছরে আমি বেশ কিছু কলামে উল্লেখ করেছি ভুল ও বিপজ্জনক পথে ভারত এবং এই পথচলা বাংলাদেশের জন্যও বিপদ ডেকে আনছে। ধর্মনিরপেক্ষ ভারত এখন বিশ্বের প্রথম সারির ধর্মীয় অসহিষ্ণু রাষ্ট্রের তকমায় চিহ্নিত হচ্ছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান অঈঘ ১৯৬টি রাষ্ট্রের ওপর ধর্মীয় স্বাধীনতা কিংবা ধর্মীয় কারণে নিপীড়ন-নির্যাতনের ওপর ২০২১ সালে ‘জবষরমরড়ঁং ঋৎববফড়স রহ ঃযব ডড়ৎষফ’ শিরোনামে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে রাষ্ট্রসমূহকে জবফ, ঙৎধহমব ও ‘ঁহফবৎ ড়নংবৎাধঃরড়হ’ শ্রেণিতে ভাগ করেছে। এর মধ্যে ২৬টি রাষ্ট্র লাল, ৩৬টি রাষ্ট্র কমলা ও বাকি রাষ্ট্রসমূহ ‘পর্যবেক্ষণের অধীন’ তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে ভারতকে রেড তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
২০২১ সালে প্রকাশিত টহরঃবফ ঝঃধঃবং ঈড়সসরংংরড়হ ড়হ ওহঃবৎহধঃরড়হধষ জবষরমরড়ঁং ঋৎববফড়স শিরোনামের বার্ষিক প্রতিবেদনে ১৪টি রাষ্ট্রকে সুসংগঠিত, চলমান এবং গুরুতর ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘন তথা ধর্মীয় নির্যাতনের জন্য বিশেষ উদ্বেগের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই ১৪টি রাষ্ট্র হচ্ছে– মিয়ানমার, চীন, ইরিত্রিয়া, ভারত, ইরান, নাইজেরিয়া, উত্তর কোরিয়া, পাকিস্তান, রাশিয়া, সৌদি আরব, সিরিয়া, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান এবং ভিয়েতনাম।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আরেকটি প্রতিষ্ঠান ঙঢ়বহ উড়ড়ৎং এর প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বের ৫০টি দেশ ধর্মীয় স্বাধীনতা অনুশীলনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতিবেদনের র্যাংকিংয়ে ভারতের অবস্থান ১০ম। বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে ভারতের এই অবনমন রাতারাতি হয়নি।
বিজেপির মুখপাত্র নূপুর শর্মা ও বিজেপির দিল্লি ইউনিটের মিডিয়া প্রধান নাভিন জিন্দাল কর্তৃক মুসলমানদের প্রাণপ্রিয় রাসুল (সা.) ও তাঁর পতœী আয়েশা (রা.) সম্পর্কে কুরুচি ও অবমাননাকর মন্তব্য বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা নয়। এটি ভয়ঙ্কর মুসলিম বিদ্বেষ রোগের বহিঃপ্রকাশ। কল্পকাহিনির ওপর ভিত্তি করে ভারতের শাসক দলের হঠাৎ করে আমদানি করা বৈধ নাগরিকত্বের ধারণা জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) ও সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) ভারতের নাগরিক সমাজের বন্ধনে নজিরবিহীন ভাঙন সৃষ্টি করেছে। হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের ফলে সৃষ্টি হয়েছে ঘৃণা, আর ঘৃণা থেকে দাঙ্গা-সহিংসতা। ২০২০-এর ফেব্রুয়ারিতে দিল্লিতে সাম্প্রদায়িক ঘটনা তার একটি উদাহরণ মাত্র। ভারতের একটি বড় অংশে প্রায় তিনশ’ বছর রাজত্ব করেছিল মুঘল সাম্রাজ্য। মুঘল শাসন ভারতের ইতিহাসের একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ভারতের বেশিরভাগ সৌধ মুঘল আমলে তৈরি হয়েছিল। অথচ ভারতের মহারাষ্ট্রের স্কুলের সিলেবাস থেকে পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয়েছে মুঘল আমলের ইতিহাস। সেখানে নিয়ে আসা হয়েছে হিন্দু শাসক ছত্রপতি শিবাজীর প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যের ইতিহাস। কমিটির চেয়ারম্যান সদানন্দ মোরে বলেছেন, বইয়ে পৃষ্ঠা সংখ্যা সীমিত। তাই দুটো ইতিহাসই রাখা কঠিন। প্রশ্ন হলো, মুসলমানদের ইতিহাস বাদ না দিয়ে, কয়েক পৃষ্ঠার মুঘল ইতিহাস পড়ানো হলে খুব কি ক্ষতি হয়ে যেত? কেবল স্কুলের সিলেবাসে নয়, মুসলিম বিদ্বেষের প্রভাব পড়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ভারতের আদালতেও। অকাট্য প্রমাণ ও প্রামাণ্য নথিপত্রের ভিত্তিতে নয়, বরং হিন্দু ধর্মের কিছু মানুষের বিশ্বাসকে মান্যতা দিয়ে বাবরি মসজিদ মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট মসজিদের জায়গায় মন্দির নির্মাণের বিতর্কিত রায় দিয়েছেন।
পরস্পরবিরোধী, পক্ষপাতমূলক রায়টি ছিল অসঙ্গতিপূর্ণ। আদালত নিজেই স্বীকার করেছেন, মসজিদের নিচে যে কাঠামোর সন্ধান মিলেছিল, তা কোনও মন্দিরেরই কাঠামো ছিল– এমনটা আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার (এএসআই)-এর রিপোর্টে স্পষ্ট হয়নি। তাহলে বিতর্কিত জায়গায় মন্দির নির্মাণের পক্ষে রায়ের ভিত্তি কী? আদালত বলেছেন, ‘তবে ওই স্থানকে যে হিন্দুরা ভগবান রামের জন্মস্থান হিসেবে বিশ্বাস করেন, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই।’ আদালতের আরেকটি যুক্তি ছিল, ‘তবে বিতর্কিত জমির ওপর রামলালার অধিকার স্বীকার করে নেওয়াটা আইনশৃঙ্খলা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বহাল রাখার প্রশ্নের সঙ্গে সম্পৃক্ত।’
বাবরি মসজিদ মামলার রায়ে একটি ভয়ঙ্কর ‘বিপজ্জনক তত্ত্ব’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যদি কেউ প্রশ্ন তোলেন যে অমুক মসজিদের নিচে মন্দির কিংবা অমুক মন্দিরের নিচে মসজিদের কাঠামো আছে, তাহলে এই রায়ের তত্ত্ব অনুযায়ী মাটির ওপর খাড়া ভবন ভেঙে পরীক্ষা করতে হবে এবং বিশ্বাসকে মান্যতা দিতে কিংবা আইনশৃঙ্খলা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বহাল রাখার স্বার্থে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী গোষ্ঠীর পক্ষে রায় দিতে হবে, তাতে প্রামাণ্য নথিপত্র থাকুক আর না থাকুক। সুপ্রিম কোর্টের এই বিপজ্জনক তত্ত্বের প্রয়োগ শুরু হয়েছে ভারতে।
ভারতে রামমন্দির আন্দোলনের সময় হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলোর খুব জনপ্রিয় স্লোগান ছিল, ‘ইয়ে তো সিরফ ঝাঁকি হ্যায়, কাশী-মথুরা বাকি হ্যায়!’ হিন্দুদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে উত্তর প্রদেশের জ্ঞানবাপী মসজিদটি ষোড়শ শতকের একটি বিশাল হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের ওপর নির্মিত। তারা বলছেন, ১৬৬৯ সালে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব মন্দিরটি ধ্বংস করেছিলেন। এ কারণ দেখিয়ে হিন্দুদের কেউ কেউ এখন জ্ঞানবাপী মসজিদ কমপ্লেক্সের মধ্যে প্রার্থনা করার জন্য আদালতের অনুমতি চাইছেন।
সম্প্রতি ভারতের বারানসির একটি আদালত নির্দেশ দিয়েছে যে জ্ঞানবাপী মসজিদ কোনও মন্দির ভেঙে গড়া হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে প্রতœতাত্ত্বিক জরিপ চালাতে হবে। এ ঘটনার এক সপ্তাহ পর উত্তর প্রদেশের মথুরার একটি আদালতে আরেকটি পিটিশন দায়ের করা হয়েছে। যেখানে রাজ্যটির আগ্রায় অবস্থিত জাহানারা মসজিদের নিচে হিন্দু দেবতা কৃষ্ণের মূর্তি আছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে একই ধরনের জরিপ চালানোর অনুমতি চাওয়া হয়েছে। মসজিদটি আগ্রা জামে মসজিদ নামেই বেশি পরিচিত। পিটিশনে বলা হয়েছে, মথুরা জামানস্থান মন্দিরে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে সেখান থেকে কৃষ্ণের মূর্তি নিয়ে আসেন মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব। পরে আগ্রায় জাহানারা মসজিদের নিচে সেটিকে পুঁতে রাখেন তিনি।
জ্ঞানবাপী মসজিদে প্রতœতাত্ত্বিক জরিপ চালানোর বিষয়ে বারানসির আদালতের রেফারেন্স দিয়ে পিটিশনে বলা হয়েছে, জাহানারা মসজিদের নিচে দেব-দেবীর মূর্তি আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা জরুরি। ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের বরাবাঁকিতে যোগী আদিত্যনাথের সরকার ১০০ বছরের প্রাচীন একটি মসজিদ সম্প্রতি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। প্রশাসন দাবি করছে, ওই মসজিদের কাঠামোটি অবৈধভাবে নির্মিত হয়েছিল। বৈশ্বিক ঐতিহ্য তাজমহল নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। দাবি করা হচ্ছে তাজমহলের নিচে মন্দির রয়েছে। মন্দির-মসজিদ বিতর্কে নতুন সংযোজন কুতুবমিনার। মামলা হয়েছে কুতুবমিনার নিয়েও। মামলায় দাবি করা হয়েছে, মোট ২৭টি মন্দির ভেঙে সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেক কুতুব মিনারসংলগ্ন স্থাপত্য গড়েছিলেন। তাদের আরও দাবি, ওই চত্বরে থাকা দেব-দেবীর মূর্তি মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করে পূজার অনুমতি দেওয়া হোক। এদিকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদও দাবি জানিয়েছে, কুতুবমিনার যে জায়গায় তৈরি, একসময় সেখানে ছিল বিষ্ণুর মন্দির। অতএব ওই মিনারকে ‘বিষ্ণু স্তম্ভ’ ঘোষণা করা হোক। এসব এখনই সামাল দেওয়া না গেলে সামনে দাবি উঠবে, মামলা হবে অমুক মুসলমানের বাড়ির নিচে মন্দির আছে। বাড়ি ভেঙে তা অনুসন্ধান করা হোক।
মসজিদ ভাঙার টার্গেটের পাশাপাশি ভারতীয় মুসলমানরা নানা আক্রোশ ও হেনস্থা শিকার হচ্ছে। উদাহরণস্বরুপ, গরুর মাংস খাওয়ার জন্য হত্যা করা, প্রকাশ্য জনসভায় মুসলমানদের গণহত্যার আহ্বান, মুসলিম নারীদের গণধর্ষণের আহ্বান, নামাজ পড়তে-আজান দিতে বাধা দেওয়া, বোরকা নিষিদ্ধ করা, রাম-হনুমানের নামে মিছিল করে মুসলমান সম্প্রদায়কে অশ্লীল-আক্রমণাত্মক গানের মাধ্যমে উত্ত্যক্ত করে হামলা করা, মুসলিম নারীদের অনলাইনে অবমাননা করার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ নামমাত্র ব্যবস্থা নিলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় থেকেছে। দিল্লির মুস্তাফাবাদে দাঙ্গায় আহতদের অনেকে স্থানীয় ছোট্ট একটি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। পুলিশের থেকে কোনও সাহায্য না পেয়ে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে বিচারপতি মুরলীধরের বাড়িতে যান চিকিৎসক ও মানবাধিকার কর্মীরা। রাতেই তাদের আর্জি শুনতে রাজি হন বিচারপতি মুরালিধর। বিচারপতি মুরলিধরের বাড়িতেই রাত সাড়ে বারোটার দিকে শুনানি শেষে তিনি নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে আদেশ জারি করেন। দীর্ঘদিন উত্তরপ্রদেশ পুলিশের মহাপরিচালক পদে থাকা ড. সিং বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘যে কোনও সভ্য সমাজে এরকম মেরুকরণের চেষ্টা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ও হতাশার– এগুলো কখনওই হওয়া উচিত নয়।’
২০১৪ সালে ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে নানা পদক্ষেপ ক্রমশ বৃদ্ধি পেলেও ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষ থেকে এক ধরনের নীরব সমর্থনের দ্বারা উৎসাহিত হয়েছে। এরপরও অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্র এসব কর্মকা-ের বিরুদ্ধে তেমন সোচ্চার হয়নি। কিন্তু সম্প্রতি হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতাদের অবমাননাকর মন্তব্যের জেরে ক্ষোভে ফেটে পড়েছে মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম প্রধান রাষ্ট্রসমূহ। ইতোমধ্যে ইরাক, ইরান, কুয়েত, সৌদি আরব, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাহরাইন, মালদ্বীপ, লিবিয়া, তুর্কিয়ে এবং ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াসহ অন্তত ১৫টি দেশ ভারতের বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়েছে।
এছাড়াও নানা ধরনের কড়া পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি আরব দেশ ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে তলব করে কড়া ভাষায় এর প্রতিবাদ জানিয়েছে। কাতার দাবি করেছে, ভারত সরকারকে এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে। কুয়েতে শুরু হয়েছে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক। বিভিন্ন মার্কেট থেকে ভারতীয় পণ্য সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। টুইটারে একটি পোস্ট ট্যাগ করে কংগ্রেস নেতা শশী থারুর লেখেন, ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতাদের অবমাননাকর বক্তব্যের পরে সৌদি আরব, বাহরাইনসহ উপসাগরীয় দেশগুলোর সুপারমার্কেট থেকে ভারতীয় পণ্য সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। এর সঙ্গে নতুনভাবে শুরু হয়েছে ভারতীয় শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত ও বহিষ্কারের বিষয়টি।
সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় ব্যবসায়ীদের কোম্পানিগুলো থেকে অমুসলিম ভারতীয় কর্মীদের সরিয়ে দেওয়ার ঘটনা সামনে আসছে। স্থগিত করা হচ্ছে তাদের ভিসা এবং লেনদেন মিটিয়ে তাদেরকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে দুই নেতাকে বহিষ্কারের ঘোষণা দিয়ে এক বিবৃতিতে বিজেপি বলেছে, কোনও সম্প্রদায় বা ধর্মের মর্যাদাহানি করে– এমন যেকোনও মতাদর্শের বিরুদ্ধে বিজেপির শক্ত অবস্থান। বিজেপি এ ধরনের ব্যক্তি ও দর্শনকে উৎসাহিত করে না। বিজেপির এই পদক্ষেপ মুসলিম রাষ্ট্রসমূহকে শান্ত করতে পারেনি। এমনকি বিজেপির বিবৃতি নাকচ করে দিয়ে ভারতীয় কংগ্রেস দলও। কংগ্রেস বলেছে, ‘এটি ধোঁকাবাজি ছাড়া কিছুই নয়। এটি সুস্পষ্টভাবে প্রহসন এবং পরিস্থিতি সামলানোর আরেকটি নির্লজ্জ প্রচেষ্টা।’
কেন এমন বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে গেলো সবখানে? একজন মুমিনের কাছে রাসুল (সা.) পৃথিবীর সবকিছুর চেয়ে বেশি প্রিয়। তিনি মুমিনের আত্মার আত্মীয়। রাসুল (সা.) উম্মতের জন্য তাদের মা-বাবার চেয়েও বেশি স্নেহশীল। এমনকি ব্যক্তির নিজের চেয়েও তার জন্য তিনি বেশি কল্যাণকামী। কঠিন কেয়ামতের দিন সবাই শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, কেউ কাউকে পরিচয় দেবে না। কিন্তু প্রিয় নবী (সা.) সেদিনও তাঁর উম্মতের জন্য মহান আল্লাহর দরবারে সিজদায় পড়ে থাকবেন। তাই প্রকৃত মুমিন পৃথিবীর সব সম্পর্কের ওপর রাসুল (সা.)-এর সম্পর্ককে প্রাধান্য দেয়। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘তোমাদের কোনও ব্যক্তি ততক্ষণ মুমিন হতে পারে না যতক্ষণ না রাসুল (সা.) তার কাছে তার পিতা, তার সন্তান-সন্ততি ও সব মানুষের চেয়ে বেশি প্রিয় হয়।’ (বুখারি, ১৪)
স্বয়ং মহান আল্লাহ রাসুল (সা.)-এর মর্যাদাকে দুনিয়ার সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর আমি আপনার খ্যাতিকে সমুচ্চ করেছি।’ (সুরা ইনশিরাহ: আয়াত ৪) যেখানে আল্লাহর নাম আসে সেখানে নবী (সা.)-এর নামকেও মহান আল্লাহ প্রাসঙ্গিক করে দিয়েছেন। যেমন, আজান, নামাজসহ অন্যান্য বহু জায়গায়। পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহেও নবী (সা.)-এর নাম এবং গুণ বিস্তারিতভাবে বর্ণনা হয়েছে। নবী (সা.)-এর আনুগত্যকে মহান আল্লাহ নিজের আনুগত্যরূপে শামিল করেছেন এবং নিজের আদেশ পালন করার সঙ্গে সঙ্গে রাসুল (সা.)-এর আদেশও পালন করতে মানব সম্প্রদায়কে নির্দেশ দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘(হে রাসুল! আপনি) বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও, তবে আমার অনুসরণ করো; তাহলেই আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাশীল দয়ালু।’ (সুরা আল-ইমরান: আয়াত ৩১)
সরকার প্রধানের ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত এবং দেশে-বিদেশে উচ্চশিক্ষিত দলের জাতীয় মুখপাত্র যখন মুসলমানদের প্রাণপ্রিয় নবী (সা.) সম্পর্কে ভয়ঙ্কর বিদ্বেষমূলক ও অবমাননাকর কথা বলতে পারে তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে, উগ্র হিন্দুত্ববাদ ভারতের রাষ্ট্র ও সমাজে কতটা জেঁকে বসেছে। এমন বক্তব্য হিন্দু ধর্মের অহিংস নীতি, ভারতের সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের পরিপন্থী।
মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কর্মরত ভারতীয়দের সংখ্যা প্রায় এক কোটি। রেমিট্যান্স ছাড়াও, জ্বালানি ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মুসলিম দেশগুলোর সাথে ভারতের রয়েছে গভীর সম্পর্ক। বহিষ্কার-বিবৃতির পাশাপাশি ভারত সরকারকে উগ্রবাদবিরোধী আরও দৃশ্যমান ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তথাকথিত ইসলামভীতি অবসানের পাশাপাশি শান্তি-স্থিতিশীলতার স্বার্থে উসকানিমূলক কর্মকা- বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশ্বের বৃহত্তম সংখ্যালঘু গোষ্ঠী মুসলিমদের প্রতি রাষ্ট্রীয় বৈষম্যমূলক নীতির অবসান ঘটাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, ভারতের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিয়ে আমার মাথা ব্যথা কেন? উত্তর খুব সোজা, ভারত ও বাংলাদেশের ভাগ্য ভৌগলিক ও ঐতিহাসিক কারণে একইসূত্রে গ্রন্থিত। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টিতে বাংলাদেশ-ভারত রক্তের সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছে। এটি অনেকটা একই শরীরের দু’টি অঙ্গের মতো। একটিকে বাদ দিয়ে আরেকটি কল্পনা করা যায় না। একটি রোগাক্রান্ত হলে আরেকটির ওপর প্রভাব পড়তে বাধ্য। ওপারের ঢেউ এপারে আছড়ে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। তদুপরি, আমি ব্যক্তিগতভাবে ‘এশিয়ান সেঞ্চুরি’র ঘোর সমর্থক। ঊনবিংশ শতাব্দী ছিল ইউরোপীয়দের, বিংশ শতাব্দী আমেরিকানদের আর একবিংশ শতাব্দী এশিয়ানদের। ‘নেক্সট এশিয়া’ কিংবা ‘এশিয়ান সেঞ্চুরি’ নিয়ে জোর আলোচনা শুরু হয়েছে বেশ অনেক বছর ধরে। সাড়ে তিনশ’ বছর পর অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা হতে সরে এশিয়া অভিমুখী হচ্ছে। এর ফলে চীন হবে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি, আর ঐক্যবদ্ধ দক্ষিণ এশিয়া হবে ২য় বৃহত্তম অর্থনীতি। বিশ্ব সভ্যতায় শুরু হবে এশিয়ান সেঞ্চুরি। ঘবি গপকরহংবু এষড়নধষ ওহংঃরঃঁঃব-এর গবেষণা দেখিয়েছে কীভাবে এশিয়ামুখী হয়েছে অর্থনীতির কেন্দ্র। দশ বছর আগেও বৈশ্বিক বাণিজ্যে এশিয়ার অবদান ছিল এক চতুর্থাংশ, যা এখন এক তৃতীয়াংশ। ডড়ৎষফ ঊপড়হড়সরপ ঋড়ৎঁস এর গবেষণা অনুযায়ী এক প্রজন্মের মধ্যেই এশিয়া নি¤œ থেকে মধ্যম আয়ের অঞ্চলে উন্নীত হয়েছে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০৪০ সালের মধ্যে এশিয়া মোট বৈশ্বিক উৎপাদনের ৫০ শতাংশ উৎপাদন করবে। এশিয়ান সেঞ্চুরি বাস্তবে রুপদানের অন্যতম নেতৃত্ব দেবে ভারত। উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ও বিভাজনের রাজনীতি যদি ভারতকে অস্থিতিশীলতার পথে ঠেলে দেয়, আর মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সাথে বিভেদের সম্পর্ক তৈরি হয় তাহলে এশিয়ান সেঞ্চুরীর স্বপ্ন হোঁচট খাবে নাকি? ধর্মীয় উগ্রবাদ একটি রাষ্ট্রকে কীভাবে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয় তার উদাহরণ পাকিস্তান ও আফগানিস্তান। এরপরও ভারত যদি উগ্র হিন্দুত্ববাদকেই বেছে নেয় তাহলে কেবল র্যাংকিংয়ে অবনমন নয়, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের পরিণতির জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে।
লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।


























