বাজার, টারমিনাল ও সড়কে ভবঘুরে মানসিক ভারসাম্যহীন নারীদের অনেকেই শিকার হন ধর্ষণের। কিন্তু বিচার তো দূরের কথা, এসব ধর্ষণের মামলাই হয় না। ধর্ষণের শিকার হয়ে অন্তঃসত্ত্বা হওয়া এসব নারীরা সন্তান জন্ম দেওয়ার পর তাকে দত্তক নিতে অনেক দম্পতিকে আদালতে দৌড়ঝাঁপ করতে দেখা যায়। অথচ, ওই নারীর বিচার পাওয়া কিংবা চিকিৎসার দায়ভার নিতে চায় না কেউ।
পুলিশ বলছে, ধর্ষণের শিকার মানসিক রোগী নিজে বা অন্য কেউ অভিযোগ না করলে মামলাও হয় না। অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর বিষয়টি জানাজানি হয়। সন্তান প্রসবের পর একটি জিডি করে মা ও নবজাতককে সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র বা সেফ হোমে পাঠানো হয়। এ নিয়েই এবারের নারী ও শিশু পাতার প্রধান প্রতিবেদন।
২০১৯ সাল থেকে ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত দেশে ২৪ জন মানসিক ভারসাম্যহীন ভবঘুরে নারী ধর্ষণের শিকার হয়ে মা হয়েছেন। বাংলা ট্রিবিউন-এর অনুসন্ধানে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এসব ঘটনায় মাত্র দুটি মামলা হয়েছে। একটিতে আসামিকে অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ। অপরটি বিচারাধীন। এমন ঘটনায় জন্ম হওয়া ২৪ নবজাতকের মধ্যে ৮ জনকে আদালতের নির্দেশে দত্তক দেওয়া হয়েছে।
কোথাও নিরাপদ নন তারা : দেশের সবকটি বিভাগে ভবঘুরে মানসিক ভারসাম্যহীন নারীদের ওপর নির্যাতন, ধর্ষণের তথ্য মিলেছে। অনেককে প্রকাশ্যে মারধরও করা হয়। মার্কেটের করিডোর, পরিত্যক্ত ভবন ও সড়কের পাশে ধর্ষণ করা হয়েছে অনেককে। এ নারীরা অভিযোগও দিতে পারেন না। গুছিয়ে কাউকে ঘটনাও বলতে পারেন না। উল্টো বেশিরভাগ লোকজন তাদের নিয়ে হাসিঠাট্টা করে। ২০১৯ সালে বান্দরবান সদরে এক মানসিক ভারসাম্যহীন নারী আসেন। শাহী মসজিদ মার্কেট এলাকায় থাকতেন তিনি। ২০২০ সালের মাঝামাঝিতে মার্কেটের ব্যবসায়ীরা বুঝতে পারেন ওই নারী অন্তঃসত্ত্বা। একজন ব্যবসায়ী তার দোকানে থাকা সিসিটিভির ফুটেজ দেখা শুরু করেন। এক পর্যায়ে তিনি দেখেন ওই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর রাতে ওই নারীকে ধর্ষণ করেছেন এক ব্যক্তি। ধর্ষকের পরিচয় শনাক্ত করেন ব্যবসায়ীরা। তার নাম জামাল হোসেন। খবর দেওয়া হয় থানায়। মামলা করে পুলিশ। জামাল ধরাও পড়ে। পুলিশ ওই নারীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। এরপর হস্তান্তর করতে চাইলে ওই নারীর পরিবার তাকে নিতে অস্বীকার করে। এরপর সমাজসেবা অধিদফতরের আশ্রয়ন কেন্দ্রে রাখা হয় তাকে। ২০২০ সালের ২৪ অক্টোবর ওই নারী এক কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। বান্দরবান থানা পুলিশ জামালকে আসামি করে এ বছরের ২ মে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছিল। আদালত ডিএনএ টেস্ট করে সন্তানের পিতৃপরিচয় নির্ধারণ করার আদেশও দিয়েছিলেন। মা ও নবজাতক এখনও সমাজসেবা অধিদফতরে সেফ হোমে রয়েছেন।
২০২০ সালের এপ্রিলের ঘটনা। বরিশালের উজিরপুরে এক মানসিক ভারসাম্যহীন মা পথচারীদের সহযোগিতায় উজিরপুরের একটি সেতুর কাছে সন্তান প্রসব করেন। উজিরপুর বাজারে থাকতেন তিনি। পুলিশ নবজাতকসহ তাকে হাসপাতালে নিলেও তিনি সেখান থেকে বের হয়ে চলে যান। তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। নবজাতকের জায়গা হয় আগৈলঝড়া ছোটমনি নিবাসে। ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন রবিউল নামে এক তরুণ। তিনি বলেন, ‘ওই নারী কয়েক মাস ধরে উজিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় ঘোরাফেরা করেছেন। মানুষ দিলে খেতেন। না দিলে চুপচাপ থাকতেন। হঠাৎ একদিন তাকে অন্তঃসত্ত্বা মনে হয়। এরপর সন্তানও জন্ম দিলেন। আমরা ধারণা ওই নারী ধর্ষণের শিকার।’
এই ঘটনায় উজিরপুর থানার পুলিশ একটি জিডি করে। তবে কোনও মামলা হয়নি। উজিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিয়াউল আহসান বলেন, ‘মানসিক ভারসাম্যহীন ওই নারী রাস্তাতেই থাকতেন। ধর্ষণের মামলা করতে হলে ঘটনাস্থল, ঠিকানা এসব বলতে হবে। তিনি কিছুই বলতে পারেন না। তাই শুধু জিডি করা হয়েছে।’
দেশের সবকটি বিভাগেই এমন বর্বরতা প্রমাণ মিলছে। গত আড়াই বছরে ঢাকায় ছয়জন, চট্টগ্রামে চারজন, রাজশাহীতে পাঁচজন, খুলনায় দুইজন, সিলেটে তিনজন এবং বরিশালে চারজন ধর্ষণের শিকার হয়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সহযোগিতায় ভবঘুরে নারীদের ঘরে ফেরাতে কাজ করেন মাহসান স্বপ্ন। তিনি বলেন, ‘আমি যতটা পারি এসব নারীদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে সহযোগিতা করি। কারণ বাইরে থাকলে তারা নানাভাবে নিগ্রহের শিকার হন।’
বান্দরবানের মসজিদ মার্কেটে ধর্ষণের শিকার হওয়া নারী প্রায় দেড় বছর ধরে চট্টগ্রামের হাটহাজারি সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন। তিনি সুস্থ হলেও তার পরিবার সামাজিক মর্যাদার নামে তাকে আশ্রয় দিচ্ছে না। তার বাড়ি নোয়াখালীর সুবর্ণচর এলাকায়। তার ভাই বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার বোন বেশ কয়েক বছর ধরে অসুস্থ। তিনি নোয়াখালী থেকে কীভাবে বান্দরবান গেলেন বুঝতে পারছি না। আমরা দরিদ্র। মামলা মোকদ্দমায় জড়াতে চাই না। পুলিশকে বলে এসেছি সে চট্টগ্রামেই থাকুক।’
চিকিৎসায় সুস্থ হচ্ছেন : সুনামগঞ্জ সদরে মানসিক ভারসাম্যহীন এক নারী মা হন। ২০২০ সালের ২ জানুয়ারি মা ও নবজাতককে সিলেটের সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যায় পুলিশ। ওই নারী তার নিজের নাম-ঠিকানা পরিষ্কার বলতে পারেননি। সেফহোমে আসার পর এই নারীর চিকিৎসা শুরু হয়। এখন তিনি আগের চেয়ে সুস্থ বলে জানান কর্তব্যরত চিকিৎসকরা। নিজের মেয়েকে আদর করা ও কিছুটা দেখভাল করতে শিখেছেন। তবে ঠিকানা বলতে পারেননি এখনও।
নিঃসন্তান দম্পতিদের আগ্রহ বেশি যে কারণে : মানসিক ভারসাম্যহীন নারীদের সন্তান দত্তক নেওয়ার আগ্রহ বেশি নিঃসন্তান দম্পতিদের। কারণ এতে দত্তক প্রক্রিয়ায় জটিলতা কম ও পরে কোনও সমস্যা হয় না। পুলিশ জানিয়েছে, এসব ভবঘুরে মানসিক রোগীদের সন্তান প্রসবের খবর প্রচার হলেই নিঃসন্তান দম্পতিরা দেশ-বিদেশ থেকে ফোন দেওয়া শুরু করে। পুলিশ তাদের আদালতের মাধ্যমে দত্তক নেওয়ার পরামর্শ দেয়। বাংলাদেশে সন্তান দত্তক নেওয়ার আইন নেই। তবে অভিভাবকত্ব পাওয়া যায়। তবে এজন্য আদালত কিছু শর্ত দেয়। পারিবারিক অবস্থা, অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা এসব বিবেচনা করা হয়। মানসিক ভারসাম্যহীন নারীর সন্তান দত্তক পেয়েছেন এমন এক দম্পতির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দত্তক নিতে পেরে তারা খুশি। কারণ তাদের ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়েছে কম। সিলেট সেফ হোম ও ছোটমনি নিবাসের তত্ত্বাবধায়ক রূপন দেব। তিনি বলেন, ‘২০১৯-২০২১ সাল পর্যন্ত তিনজন মানসিক ভারসাম্যহীন নারীর নবজাতক পাওয়া গেছে। একটি নবজাতক দত্তক দেওয়া হয়েছে। বাকিগুলো প্রক্রিয়াধীন।’
রাজশাহীর বিভিন্ন জেলায় পাঁচ নবজাতকের দুজন, খুলনার দুই নবজাতকের মধ্যে দুজন, সিলেটে তিন নবজাতকের মধ্যে একজন এবং বরিশালে চার নবজাতকের একজনকে দত্তক দেওয়া হয়েছে। খুলনার মহেশ্বরপাশা ছোটমনি নিবাসের উপতত্ত্বাবধায়ক আফরোজা সুলতানা বলেন, ‘দুটি নবজাতককেই আদালতের মাধ্যমে নিঃসন্তান দম্পতির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।’
ঘটনা অজস্র, মামলা দুটি : গত আড়াই বছরে ২৪ জন অপ্রকৃতিস্থ ভবঘুরে নারীর ধর্ষণের শিকার হলেও প্রকৃত ঘটনা আরও বেশি বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মীরা। এসব ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে। একটি বরগুনায়, অপরটি বান্দরবানে। বরগুনার বামনা থানায় দায়ের করা মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। বান্দরবানের মামলাটির অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। ২০২০ সালের জুনে বরগুনার বামনার কালিকাবাড়ী এলাকায় এক মানসিক ভারসাম্যহীন নারী ধর্ষণের শিকার হন। এই ঘটনায় তিনি অন্তঃস্বত্তা হলে থানায় তার ভাই হাশেম মল্লিক নামে একজনকে আসামি করে মামলা করেন। তবে পুলিশ তদন্ত শেষে আসামিকে অব্যাহতি দিয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়।
চিকিৎসা কোথায় হবে? মানসিক স্বাস্থ্য সেবার অপ্রতুলতা রয়েছে ভবঘুরেদের জন্য। বিশেষায়িত হাসপাতাল রয়েছে মাত্র দুটি। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের হিসাবে, দেশে ১৮ কোটি মানুষের জন্য এই মুহূর্তে ২৭০ জন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। কাউন্সেলিংয়ের জন্য সাইকোলজিস্ট রয়েছেন মাত্র ২৫০ জন।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, চিকিৎসক ও চিকিৎসা কেন্দ্রের সংকটে এরা চিকিৎসা পায় না। মানসিক অসুস্থতার চিকিৎসা দীর্ঘদিনের হয়। অনেকে ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলেন।’
সমাজসেবা অধিদফতর যা জানালো : এসব নারীদের নিরাপত্তা ও সুস্থ জীবনে প্রদানে সমাজসেবা অধিদফতরের অর্থসহায়তা, চিকিৎসা ও আশ্রয় প্রদান করার বিভিন্ন প্রকল্প রয়েছে। তবে সেসব সেবা দেশে অপ্রতুল। অধিদফতরের (সামাজিক নিরাপত্তা শাখা) অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম বলেন, ‘আমরা আমাদের বিভাগ থেকে তাদের ভাতা দিয়ে থাকি। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠান শাখা তাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কোথাও যদি এমন নারী দেখা যায়, তবে আমাদের খবর দিলে আমরা তাদের আমাদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসবো।’
প্রতিটি ঘটনার তদন্ত হওয়া দরকার : সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, ‘প্রতিটি নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং এসব ছিন্নমূল নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা উচিৎ। প্রতিটি ঘটনায় মামলা হলে অনেকে ধরা পড়তো। এক্ষেত্রে পুলিশ নবজাতকের ডিএনএ টেস্ট করে অভিযুক্তদের খুঁজে বের করে বিচারের মুখোমুখি করতে পারে। তবে এ অপরাধ অনেকটা কমে আসবে।’
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের জনসংযোগ ও গণমাধ্যম শাখার সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) সোহেল রানা বলেন, ‘ধর্ষণের যেকোনও অভিযোগ পেলে পুলিশ তা গ্রহণ করে। তবে, এ সকল ক্ষেত্রে অনেক সময়ই কেউ অভিযোগ করতে চান না। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ, সিসিটিভি ফুটেজ বা উপযুক্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ না থাকায় কোনও ক্ষেত্রে মামলার আসামি শনাক্ত করা চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়ায়।’