ঢাকা ১২:২৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৩ জুলাই ২০২৫

বড়দের অসচেতনতায় শিশুদের ডেঙ্গু আরও জটিল হচ্ছে

  • আপডেট সময় : ১২:৪৮:৪৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৮ অগাস্ট ২০২১
  • ১২৬ বার পড়া হয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক : ঢাকা শিশু হাসপাতালে গত শুক্রবার পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে সাত শিশু। এরমধ্যে সবচেয়ে ছোট শিশুটির বয়স ছিল তিন মাস ২৭ দিন। আহমদ নামের শিশুটি ডেঙ্গু শক সিনড্রোম নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় গত ৯ আগস্ট। গত ২২ আগস্টে তার মৃত্যু হয়। এর আগে এই হাসপাতালে মারা যাওয়া ছয় শিশুর মধ্যে দুই শিশুর ছিল ডেঙ্গু হেমোরিজিক ফিভার, এক শিশু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি করোনাতেও আক্রান্ত ছিল, এক শিশু ডেঙ্গু ক্লাসিক্যাল ফিভার আর বাকি তিনটি শিশুই আক্রান্ত ছিল ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে। এই হাসপাতালে মারা যাওয়া সবার বয়স ১০ বছরের নিচে।
গত ৫ আগস্ট আহমদের জ্বর ছিল দুইদিন, নাপা ড্রপস খাওয়ানোর পর জ্বর কমে যায় জানিয়ে আহমদের বাবা নাসির উদ্দিন একটি সংবাদসংস্থাকে ুবলেন, শরীর স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু ঠা-া একটু বেশি ছিল, হাত পা ঠা-া ছিল- এটাকে আমরা তেমন কিছু মনে করিনি।
‘৮ আগস্ট রাতে খিঁচুনি আসে। কিন্তু সেটাও আমরা বুঝতে পারিনি’ বলতে গিয়ে নাসির উদ্দিনের গলা ধরে আসে। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ওই রাতেই ৩টার দিকে খিঁচুনি বেড়ে যায়। তখন আহমদকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকরা জানান খিঁচুনির সঙ্গে আমার ছেলেটার শ্বাসকষ্টও হচ্ছে। তারা প্রাথমিক চিকিৎসক দেওয়ার পর ঢাকা শিশু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। সাধারণ বেডে একদিন থাকার পর ওকে আইসিইউতে দেওয়া হয় ৯ আগস্ট দুপরে।
নাসির উদ্দিন বলেন, আইসিইউতে উন্নতি হচ্ছিল, খিঁচুনি, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে না বলেও জানিয়েছিলেন চিকিৎসকরা। এমনকি অক্সিজেন মাস্কটাও খুলে রেখেছিলেন চিকিৎসকরা। আমার ছেলেটা সুস্থ হচ্ছিল, আশা দেখছিলাম আমরা। এক পর্যায়ে তার আগের ক্যানুলাটা সরিয়ে আরেকটা নতুন দেওয়া হয়। এরপর থেকেই অবস্থা খারাপ হতে থাকে। আমাকে জানানো হয়, ছেলেটার আবার খিঁচুনি হচ্ছে, অক্সিজেন লাগছে, খাবারও বন্ধ করে দেওয়া হয়।
নাসির উদ্দিন বলেন, এরপরের দিন (১০ আগস্ট) আরও খারাপ, তার পরেরদিন লাইফ সাপোর্ট। সেখানে কয়েকদিন থাকার পর ২২ আগস্ট রাত ৩টা ১১ মিনিটে আমাকে ফোন করা হয়। বলা হয়- আপনার বাবুর অবস্থা ভালো না, আপনি সকাল সকাল চলে আসবেন।’
‘পরদিন সকালে আমার শ্বশুরকে পাঠানো হলে জানানো হয়- রাত ৩টার দিকে ছেলেটা সব সাপোর্ট ছাপিয়ে চলে গেছে, আমার ছেলেটা মারা গেছে’, বলেন ঢাকার কল্যাণপুরের একটি মাদ্রাসার শিক্ষক নাসির উদ্দিন।
ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চলতি মাসে এখন পর্যন্ত ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। আর এ মাসে এখন পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছেন ৬ হাজার ৬৪৬ জন।
শুক্রবার (২৭ আগস্ট) স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম এ তথ্য জানায়। কন্ট্রোল রুম আরও জানিয়েছে, দেশে চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট ৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে চলতি মাসের ২৮ জন ছাড়া গত জুলাই মাসে মারা গেছেন ১২ জন।
কন্ট্রোল রুম জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় (২৬ আগস্ট সকাল ৮টা থেকে ২৭ আগস্ট সকাল ৮টা পর্যন্ত) ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১৮৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এদের মধ্যে ঢাকায় ভর্তি হয়েছেন ১৬৯ জন আর ঢাকার বাইরে ১৫ জন।
চিকিৎসকরা বলছেন, এবারে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ খুব তাড়াতাড়ি ‘ড্যামেজ’ হয়ে যাচ্ছে। হার্ট-ব্রেইন আক্রান্ত হয়ে মাল্টি অর্গান ফেইলিওর হয়ে বেশি মারা যাচ্ছে, যেটা কিনা ডেঙ্গুর সবচেয়ে বেশি প্রাদুর্ভাব হয়েছিল যে ২০১৯ সালে তার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে, বলেন সংশ্লিষ্টরা। তারা সঙ্গে এও বলছেন, বড়দের অচেতনায় বাড়ছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত এবং তাদের অসচেতনতাতেই রোগীর অবস্থা জটিল হচ্ছে।
বড়দের অসচেতনতায় আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা : ঢাকা শিশু হাসপাতালের রোগতত্ত্ববিদ কিংকর ঘোষ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এবারে সবচেয়ে বেশি এবং বড় ভুল করছেন অভিভাবকরা। বিশেষ করে শিক্ষিত শ্রেণি। তারা এত বেশি কেয়ারলেস, যে বাড়িতেই সিবিসি (রক্তের পরীক্ষা) এবং ডেঙ্গু পরীক্ষা করাচ্ছে। বাড়িতে বসেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, যখন দেখা যাচ্ছে প্লাটিলেট ভালো, তখন তারা চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছেন না। কিন্তু তারপর যে প্লাটিলেট হুট করে কমে যাচ্ছে, প্রেসার নেমে যাচ্ছে- এগুলো বাড়ি বসে বোঝা যায় না। আলটিমেটলি যখন খারাপ হয়ে যাচ্ছে, তখন হাসপাতালে নিয়ে আসা হচ্ছে, কিন্তু তখন কিছু করার থাকছে না। এটা শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যেই বেশি দেখা যাচ্ছে। কিংকর ঘোষ আরও বলেন, সন্তানের জ্বর হলে অসচেতন হচ্ছে এবং সেই অসচেতনার কারণেই ঘর-বাড়ি পরিষ্কার করছে না। যার কারণে বাড়ির শিশুরা এবারে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। বর্তমান সময়ে ‘ওভার ফোনে’ চিকিৎসা নেওয়াটাও শিশুদের শেষ সময়ে হাসপাতালে আসার আরেকটি কারণ বলে মনে করেন এই চিকিৎসক। তিনি বলেন, ওভার ফোনে যখন চিকিৎসা নেওয়া হচ্ছে, তখন চিকিৎসক জানছেন না, শিশুটির রক্তচাপ কতো, ওয়ার্নিং সাইন রয়েছে কিনা। যার কারণে চিকিৎসায় মিসগাইডেড হচ্ছে।
জ্বর সেরে যাচ্ছে, কিন্তু খারাপ হচ্ছে রোগী : এবারের ডেঙ্গুতে একটি ব্যতিক্রমী ধরন রয়েছে বলেও জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। কিংকর ঘোষ বলেন, এবারে ব্যতিক্রম হচ্ছে, জ্বর সেরে যাচ্ছে। যার কারণে বাবা-মা ভাবছেন সন্তান সুস্থ হয়ে উঠেছে। কিন্তু জ্বর সেরে যাওয়ার পরে রোগী খারাপ হয়ে যাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, খুব সচেতন না হলে সন্তানদের রক্ষা করা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, অভিভাবকরা সন্তানের জ্বর হলে অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করছেন বিশেষ করে জি ম্যাক্স খাওয়াচ্ছেন সন্তানকে। যেটা অত্যন্ত ভয়াবহ হয়ে উঠছে।
জ্বরের সঙ্গে সঙ্গে খারাপ হচ্ছে অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ : জ্বর হবে প্রথম তিন থেকে পাঁচ দিন; এরপর খারাপ হবে, পরে ধীরে ধীরে ডেঙ্গু থেকে সেরে উঠবে- আগে এমনটাই মনে করা হতো। কিন্তু এখন জ্বর অবস্থাতেই রোগী শকে চলে যাচ্ছে জানিয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার পেডিয়াট্রিকস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মাদ মনির হোসেন বলেন, কিডনি-হার্ট-ব্রেইন-লিভারসহ অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ইনভলবমেন্ট (সংশ্লিষ্টতা) গতবার বা তার আগে এত পাইনি, যেটা এবার হচ্ছে। এবার রোগী ভর্তির সংখ্যা এত বেশি কেন এবং রোগীর অবস্থা চট করে এত বেশি খারাপ হয়ে যাচ্ছে কেন-এটা ভাবার বিষয়, বলেন অধ্যাপক মোহাম্মাদ মনির হোসেন।
‘‘রোগী খুব দ্রুত শকে চলে যাচ্ছে, আমাদের কাছে যখন আসছে তখন ব্লাড প্রেসার নাই, পালস নাই, রোগীর রক্তক্ষরণ হচ্ছে অথবা হার্টে কিংবা লিভার ফেইলিওর ডেভলপ করছে, অথবা খিঁচুনি নিয়ে আসছে জানিয়ে তিনি বলেন, ফুসফুসে-হৃদপি-ে পানি জমে যাচ্ছে।’’
‘অভিভাবকদের একটা বার্তা দিতে চাই, যখনি মনে করবেন জ্বর, তখন ধরেই নিতে হবে হয় ডেঙ্গু নয়তো করোনা। দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে আসতে হবে, নিশ্চিত করতে হবে শিশুটি যেন অবশ্যই চিকিৎসকের ‘সুপারভিশনে’ থাকে, নয়তো শেষ রক্ষা হচ্ছে না’, বলেন অধ্যাপক মনির হোসেন।
স্থূলতায় আক্রান্ত শিশুরা ঝুঁকিতে : বিশেষ করে যেসব শিশুদের ওজন বেশি তাদের জন্য ঝুঁকিটা আরও বেশি। এই শিশুদেরই হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার হার বেশি জানিয়ে অধ্যাপক মনির হোসেন বলেন, এসব শিশুরাই আইসিইউতে যাচ্ছে বেশি। এবং যাদের মৃত্যু হচ্ছে তাদের মধ্যে ওবেসিটি বা স্থূলকায় শিশুদের পরিমাণ অনেক বেশি। এই চিকিৎসকের পরামর্শ, ‘বয়সের তুলনায় ওজন যাদের বেশি তাদের জ্বর হলেই যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। যেন রোগীকে আমরা ফলো করতে পারি, নয়তো কিছু করার থাকে না’।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

বড়দের অসচেতনতায় শিশুদের ডেঙ্গু আরও জটিল হচ্ছে

আপডেট সময় : ১২:৪৮:৪৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৮ অগাস্ট ২০২১

নিজস্ব প্রতিবেদক : ঢাকা শিশু হাসপাতালে গত শুক্রবার পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে সাত শিশু। এরমধ্যে সবচেয়ে ছোট শিশুটির বয়স ছিল তিন মাস ২৭ দিন। আহমদ নামের শিশুটি ডেঙ্গু শক সিনড্রোম নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় গত ৯ আগস্ট। গত ২২ আগস্টে তার মৃত্যু হয়। এর আগে এই হাসপাতালে মারা যাওয়া ছয় শিশুর মধ্যে দুই শিশুর ছিল ডেঙ্গু হেমোরিজিক ফিভার, এক শিশু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি করোনাতেও আক্রান্ত ছিল, এক শিশু ডেঙ্গু ক্লাসিক্যাল ফিভার আর বাকি তিনটি শিশুই আক্রান্ত ছিল ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে। এই হাসপাতালে মারা যাওয়া সবার বয়স ১০ বছরের নিচে।
গত ৫ আগস্ট আহমদের জ্বর ছিল দুইদিন, নাপা ড্রপস খাওয়ানোর পর জ্বর কমে যায় জানিয়ে আহমদের বাবা নাসির উদ্দিন একটি সংবাদসংস্থাকে ুবলেন, শরীর স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু ঠা-া একটু বেশি ছিল, হাত পা ঠা-া ছিল- এটাকে আমরা তেমন কিছু মনে করিনি।
‘৮ আগস্ট রাতে খিঁচুনি আসে। কিন্তু সেটাও আমরা বুঝতে পারিনি’ বলতে গিয়ে নাসির উদ্দিনের গলা ধরে আসে। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ওই রাতেই ৩টার দিকে খিঁচুনি বেড়ে যায়। তখন আহমদকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকরা জানান খিঁচুনির সঙ্গে আমার ছেলেটার শ্বাসকষ্টও হচ্ছে। তারা প্রাথমিক চিকিৎসক দেওয়ার পর ঢাকা শিশু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। সাধারণ বেডে একদিন থাকার পর ওকে আইসিইউতে দেওয়া হয় ৯ আগস্ট দুপরে।
নাসির উদ্দিন বলেন, আইসিইউতে উন্নতি হচ্ছিল, খিঁচুনি, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে না বলেও জানিয়েছিলেন চিকিৎসকরা। এমনকি অক্সিজেন মাস্কটাও খুলে রেখেছিলেন চিকিৎসকরা। আমার ছেলেটা সুস্থ হচ্ছিল, আশা দেখছিলাম আমরা। এক পর্যায়ে তার আগের ক্যানুলাটা সরিয়ে আরেকটা নতুন দেওয়া হয়। এরপর থেকেই অবস্থা খারাপ হতে থাকে। আমাকে জানানো হয়, ছেলেটার আবার খিঁচুনি হচ্ছে, অক্সিজেন লাগছে, খাবারও বন্ধ করে দেওয়া হয়।
নাসির উদ্দিন বলেন, এরপরের দিন (১০ আগস্ট) আরও খারাপ, তার পরেরদিন লাইফ সাপোর্ট। সেখানে কয়েকদিন থাকার পর ২২ আগস্ট রাত ৩টা ১১ মিনিটে আমাকে ফোন করা হয়। বলা হয়- আপনার বাবুর অবস্থা ভালো না, আপনি সকাল সকাল চলে আসবেন।’
‘পরদিন সকালে আমার শ্বশুরকে পাঠানো হলে জানানো হয়- রাত ৩টার দিকে ছেলেটা সব সাপোর্ট ছাপিয়ে চলে গেছে, আমার ছেলেটা মারা গেছে’, বলেন ঢাকার কল্যাণপুরের একটি মাদ্রাসার শিক্ষক নাসির উদ্দিন।
ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চলতি মাসে এখন পর্যন্ত ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। আর এ মাসে এখন পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছেন ৬ হাজার ৬৪৬ জন।
শুক্রবার (২৭ আগস্ট) স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম এ তথ্য জানায়। কন্ট্রোল রুম আরও জানিয়েছে, দেশে চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট ৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে চলতি মাসের ২৮ জন ছাড়া গত জুলাই মাসে মারা গেছেন ১২ জন।
কন্ট্রোল রুম জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় (২৬ আগস্ট সকাল ৮টা থেকে ২৭ আগস্ট সকাল ৮টা পর্যন্ত) ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১৮৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এদের মধ্যে ঢাকায় ভর্তি হয়েছেন ১৬৯ জন আর ঢাকার বাইরে ১৫ জন।
চিকিৎসকরা বলছেন, এবারে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ খুব তাড়াতাড়ি ‘ড্যামেজ’ হয়ে যাচ্ছে। হার্ট-ব্রেইন আক্রান্ত হয়ে মাল্টি অর্গান ফেইলিওর হয়ে বেশি মারা যাচ্ছে, যেটা কিনা ডেঙ্গুর সবচেয়ে বেশি প্রাদুর্ভাব হয়েছিল যে ২০১৯ সালে তার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে, বলেন সংশ্লিষ্টরা। তারা সঙ্গে এও বলছেন, বড়দের অচেতনায় বাড়ছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত এবং তাদের অসচেতনতাতেই রোগীর অবস্থা জটিল হচ্ছে।
বড়দের অসচেতনতায় আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা : ঢাকা শিশু হাসপাতালের রোগতত্ত্ববিদ কিংকর ঘোষ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এবারে সবচেয়ে বেশি এবং বড় ভুল করছেন অভিভাবকরা। বিশেষ করে শিক্ষিত শ্রেণি। তারা এত বেশি কেয়ারলেস, যে বাড়িতেই সিবিসি (রক্তের পরীক্ষা) এবং ডেঙ্গু পরীক্ষা করাচ্ছে। বাড়িতে বসেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, যখন দেখা যাচ্ছে প্লাটিলেট ভালো, তখন তারা চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছেন না। কিন্তু তারপর যে প্লাটিলেট হুট করে কমে যাচ্ছে, প্রেসার নেমে যাচ্ছে- এগুলো বাড়ি বসে বোঝা যায় না। আলটিমেটলি যখন খারাপ হয়ে যাচ্ছে, তখন হাসপাতালে নিয়ে আসা হচ্ছে, কিন্তু তখন কিছু করার থাকছে না। এটা শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যেই বেশি দেখা যাচ্ছে। কিংকর ঘোষ আরও বলেন, সন্তানের জ্বর হলে অসচেতন হচ্ছে এবং সেই অসচেতনার কারণেই ঘর-বাড়ি পরিষ্কার করছে না। যার কারণে বাড়ির শিশুরা এবারে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। বর্তমান সময়ে ‘ওভার ফোনে’ চিকিৎসা নেওয়াটাও শিশুদের শেষ সময়ে হাসপাতালে আসার আরেকটি কারণ বলে মনে করেন এই চিকিৎসক। তিনি বলেন, ওভার ফোনে যখন চিকিৎসা নেওয়া হচ্ছে, তখন চিকিৎসক জানছেন না, শিশুটির রক্তচাপ কতো, ওয়ার্নিং সাইন রয়েছে কিনা। যার কারণে চিকিৎসায় মিসগাইডেড হচ্ছে।
জ্বর সেরে যাচ্ছে, কিন্তু খারাপ হচ্ছে রোগী : এবারের ডেঙ্গুতে একটি ব্যতিক্রমী ধরন রয়েছে বলেও জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। কিংকর ঘোষ বলেন, এবারে ব্যতিক্রম হচ্ছে, জ্বর সেরে যাচ্ছে। যার কারণে বাবা-মা ভাবছেন সন্তান সুস্থ হয়ে উঠেছে। কিন্তু জ্বর সেরে যাওয়ার পরে রোগী খারাপ হয়ে যাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, খুব সচেতন না হলে সন্তানদের রক্ষা করা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, অভিভাবকরা সন্তানের জ্বর হলে অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করছেন বিশেষ করে জি ম্যাক্স খাওয়াচ্ছেন সন্তানকে। যেটা অত্যন্ত ভয়াবহ হয়ে উঠছে।
জ্বরের সঙ্গে সঙ্গে খারাপ হচ্ছে অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ : জ্বর হবে প্রথম তিন থেকে পাঁচ দিন; এরপর খারাপ হবে, পরে ধীরে ধীরে ডেঙ্গু থেকে সেরে উঠবে- আগে এমনটাই মনে করা হতো। কিন্তু এখন জ্বর অবস্থাতেই রোগী শকে চলে যাচ্ছে জানিয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার পেডিয়াট্রিকস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মাদ মনির হোসেন বলেন, কিডনি-হার্ট-ব্রেইন-লিভারসহ অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ইনভলবমেন্ট (সংশ্লিষ্টতা) গতবার বা তার আগে এত পাইনি, যেটা এবার হচ্ছে। এবার রোগী ভর্তির সংখ্যা এত বেশি কেন এবং রোগীর অবস্থা চট করে এত বেশি খারাপ হয়ে যাচ্ছে কেন-এটা ভাবার বিষয়, বলেন অধ্যাপক মোহাম্মাদ মনির হোসেন।
‘‘রোগী খুব দ্রুত শকে চলে যাচ্ছে, আমাদের কাছে যখন আসছে তখন ব্লাড প্রেসার নাই, পালস নাই, রোগীর রক্তক্ষরণ হচ্ছে অথবা হার্টে কিংবা লিভার ফেইলিওর ডেভলপ করছে, অথবা খিঁচুনি নিয়ে আসছে জানিয়ে তিনি বলেন, ফুসফুসে-হৃদপি-ে পানি জমে যাচ্ছে।’’
‘অভিভাবকদের একটা বার্তা দিতে চাই, যখনি মনে করবেন জ্বর, তখন ধরেই নিতে হবে হয় ডেঙ্গু নয়তো করোনা। দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে আসতে হবে, নিশ্চিত করতে হবে শিশুটি যেন অবশ্যই চিকিৎসকের ‘সুপারভিশনে’ থাকে, নয়তো শেষ রক্ষা হচ্ছে না’, বলেন অধ্যাপক মনির হোসেন।
স্থূলতায় আক্রান্ত শিশুরা ঝুঁকিতে : বিশেষ করে যেসব শিশুদের ওজন বেশি তাদের জন্য ঝুঁকিটা আরও বেশি। এই শিশুদেরই হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার হার বেশি জানিয়ে অধ্যাপক মনির হোসেন বলেন, এসব শিশুরাই আইসিইউতে যাচ্ছে বেশি। এবং যাদের মৃত্যু হচ্ছে তাদের মধ্যে ওবেসিটি বা স্থূলকায় শিশুদের পরিমাণ অনেক বেশি। এই চিকিৎসকের পরামর্শ, ‘বয়সের তুলনায় ওজন যাদের বেশি তাদের জ্বর হলেই যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। যেন রোগীকে আমরা ফলো করতে পারি, নয়তো কিছু করার থাকে না’।