বিদেশের খবর ডেস্ক: যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে তিনি প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তবে পুতিন জানিয়েছেন, পুরোটাই নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর। যদি তারা সুসম্পর্ক চায়, তাহলেই একমাত্র তা সম্ভব। বৃহস্পতিবার রাশিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর কাজানে অনুষ্ঠিত বিশ্বের উন্নয়নশীল অর্থনৈতিক জোট- ব্রিকস শীর্ষ বৈঠকের সমাপ্তি ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন। পুতিনের মতে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কী হবে তা নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর। তারা যদি সম্পর্ক ভালো করতে চায়, তাহলে তিনিও সুসম্পর্ক স্থাপন করবেন। যদি যুক্তরাষ্ট্র না চায়, তাহলে তা হবে না। ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর মস্কো ও ওয়াশিংটনের মধ্যে সম্পর্ক তলানিতে ঠেকে। গতমাসে মার্কিন বিচার মন্ত্রণালয় অভিযোগ করে, রাশিয়ার সরকারি মিডিয়া নেটওয়ার্কের দুই কর্মী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে জনমত প্রভাবিত করার চেষ্টা করছিলেন। ইউক্রেনে আগ্রাসনের পর অনেক দেশই রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞায় সামিল হয়েছে। কিন্তু তারপরেও ব্রিকসের সম্মেলনে ৩৬টি দেশের প্রতিনিধিরা যোগ দিয়েছিলেন। এশিয়া, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি জাতিসংঘের মহাসচিব বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরাও এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বৈঠকে যোগ দেন। অন্যদিকে রাশিয়ার প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। এদিকে সাংবাদ সম্মেলনে পুতিনকে প্রশ্ন করা হয়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিনি ইউক্রেনে যুদ্ধ থামাবেন। এ নিয়ে পুতিন কতটা আশাবাদী? পুতিন বলেন, ‘আমি যা শুনেছি, ট্রাম্প বলেছেন, তিনি ইউক্রেন সংঘাতে ইতি টানার জন্য সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করবেন। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে, ট্রাম্প একান্তভাবে এটা চাইছেন। এই ধরনের বিবৃতিকে আমরা সবসময় স্বাগত জানাই।’
গুতেরেসের রাশিয়া সফর নিয়ে বিতর্ক
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস রাশিয়া গিয়েছিলেন। তিনি পুতিনের সঙ্গেও দেখা করেছেন। দুই বছরের মধ্যে এই প্রথমবার দুজনের সাক্ষাৎ হলো। গুতেরেস পুতিনকে বলেছেন, আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব অনুসারে এবং জাতিসংঘের চার্টার মেনে শান্তি ফেরা উচিত। জাতিসংঘের মুখপাত্র জানিয়েছেন, গুতেরেস আবার বলেছেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন জাতিসংঘের চার্টার ও আন্তর্জাতিক আইনের বিরোধী। গুতেরেসের এই সফরে ইউক্রেন অত্যন্ত অখুশি। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গুতেরেস ভুল করেছেন। এর ফলে শান্তি প্রক্রিয়া এগোবে না। রাশিয়ার বিরোধী নেত্রী এবং অ্যালেক্সি নাভালনির স্ত্রী ইউলিয়া নাভালনায়া এই সফরের নিন্দা করেছেন। তিনি বলেছেন, যুদ্ধের তৃতীয় বছরে গুতেরেস একজন হত্যাকারীর সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন।
শি জিনপিংয়ের ৫ প্রস্তাবে বিশেষজ্ঞদের সমর্থন
‘বিশ্ব যখন অশান্তি ও পরিবর্তনের নতুন যুগে প্রবেশ করছে, তখন আমরা এমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হচ্ছি, যা আমাদের ভবিষ্যৎ রূপরেখা ঠিক করে দেবে। আমাদের কি বিশ্বকে বিশৃঙ্খলার অতল গহ্বরে নামতে দেওয়া উচিত, নাকি আমরা এটিকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবো শান্তি ও উন্নয়নের পথে?’ বুধবার চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং রাশিয়ার কাজানে ১৬তম ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে এই প্রশ্নটি উত্থাপন করেন। পরে অবশ্য তিনি এর উত্তরটাও বাতলে দিয়েছেন। শান্তি, উদ্ভাবন, সবুজ উন্নয়ন, বৈশ্বিক ন্যায়বিচার এবং মানুষের সঙ্গে মানুষের ঘনিষ্ঠ আদান-প্রদানে নেতৃত্ব দেয় এমন একটি সংস্থা হিসেবে ব্রিকসকে গড়ে তোলার জন্য পাঁচটি মূল বিষয়ের প্রস্তাব করেন তিনি। চীনা প্রেসিডেন্ট ব্রিকস দেশগুলোকে গ্লোবাল সাউথ দেশগুলোর মধ্যে সংহতি ও সহযোগিতা জোরদারের জন্য এবং বৈশ্বিক শাসন সংস্কারের অগ্রগতির একটি প্রাথমিক চ্যানেল হিসেবে ব্যবস্থা গড়ে তোলার আহ্বান জানান। ব্রিকস নেতারা যেদিন জাতিসংঘের সংস্কার, আঞ্চলিক উত্তেজনা, আর্থিক নিরাপত্তা, বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল, জলবায়ু পরিবর্তন এবং এআই-এর মতো উদীয়মান প্রযুক্তিসহ বিস্তৃত বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে জড়ো হন, তখনই আসে শি’র এ ভাষণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শি’র ধারণাগুলো গ্লোবাল সাউথ সহযোগিতার জন্য একটি রোডম্যাপ এবং আধুনিকীকরণের আকাঙ্খা লালন করে যেসব দেশ, তাদের জন্য এক নতুন অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। ব্রিকস প্রক্রিয়ার তাৎপর্য তুলে ধরে ইথিওপিয়ার পলিসি স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের গবেষক বালেউ ডেমিসি বলেন, শি’র বক্তৃতা ব্রিকস দেশগুলোর মধ্যে ঐক্যকে শক্তিশালী করতে এবং পারস্পরিক বোঝাপড়া ও বিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করবে। তিনি আরও বলেছেন, এটি ব্রিকস সহযোগিতার দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন নিশ্চিত করবে এবং উদীয়মান বাজার ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর সক্ষমতা বাড়াবে। বিগত ১৮ বছরে ব্রিকস সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছে চীন। জাতিসংঘ ও আইএমএফ-এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সংস্কারের পক্ষে এবং গ্লোবাল সাউথের কণ্ঠস্বর আরও বলিষ্ঠ করতেও ভূমিকা রেখেছে দেশটি। বুধবারের সম্মেলনে, শি জিনপিং ঘোষণা করেন, চীন ইতোমধ্যে একটি চীন-ব্রিকস কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) উন্নয়ন ও সহযোগিতা কেন্দ্র চালু করেছে। একটি ব্রিকস গভীর-সমুদ্র সম্পদ আন্তর্জাতিক গবেষণা কেন্দ্র এবং ব্রিকস দেশগুলোতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য একটি ‘চায়না-সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করবে। এ ছাড়া, একটি চায়না সেন্টার ফর ব্রিকস ইন্ডাস্ট্রিয়াল কম্পিটেন্সি এবং একটি ব্রিকস ডিজিটাল ইকোসিস্টেম কোঅপারেশন নেটওয়ার্কও গড়ে তোলা হবে। এশিয়া প্যাসিফিক রিসার্চ সেন্টারের প্রেসিডেন্ট সের্গেই সানাকোয়েভ বলেছেন, শি’র প্রস্তাবিত উদ্যোগগুলো গ্লোবাল সাউথের সহযোগিতাকে আরও সমন্বিত ও জোরদার করবে। তিনি বলেন, ডিজিটাল অর্থনীতি, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের মতো ক্ষেত্রগুলোয় ব্রিকস দেশগুলোর বর্ধিত সহযোগিতা, গ্লোবাল সাউথ দেশগুলোর জন্য তাদের সমর্থন আরও দৃঢ়ভাবে রূপান্তর প্রক্রিয়াকে সহজতর করবে। আজারবাইজানের নাগরিক এবং দক্ষিণ ককেশাস পলিটিকাল সায়েন্টিস্ট ক্লাবের প্রধান ইলগার ভেলিজাদে বলেছেন, তিনি উদ্ভাবনী ব্রিকস নির্মাণের বিশেষ পদক্ষেপের কথা শুনে বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। তিনি বলেছেন, চীন ডিজিটাল অর্থনীতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং সমৃদ্ধ বাস্তব অভিজ্ঞতার অধিকারী। তার মতে, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের প্রস্তাবিত উদ্যোগ—যেমন ব্রিকস দেশগুলোর মধ্যে একটি গভীর-সমুদ্র সম্পদ আন্তর্জাতিক গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করাটা উদ্ভাবনী সহযোগিতার উন্নয়নে একটি বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম তৈরির জন্য বেশ উপকারী হবে। মিসরের বেনি সুয়েফ ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক নাদিয়া হেলমি বলেছেন, শি তার বক্তৃতায় যে ধারাবাহিক উদ্যোগের কথা উল্লেখ করেছেন, তা ব্রিকস সহযোগিতা প্রক্রিয়াকে আন্তর্জাতিক বিষয়ে ক্রমবর্ধমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে এবং শক্তিশালী ব্রিকস গঠনে নির্দেশনা দেবে।
সূত্র: ডয়চে ভেলে
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ