ক্রীড়া প্রতিবেদক: চট্টগ্রামের বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ফ্লা. লে. মতিউর রহমান ক্রিকেট স্টেডিয়ামে শনিবার ২৬ এপ্রিল দুপুরের সূর্য তখনো মাথার ওপরে ওঠেনি। পূর্ব পাশে জিম্বাবুয়ে দলের হালকা অনুশীলন চলছে। অথচ মাঠের পশ্চিম প্রান্তে তখন ব্যস্ততা একটু বেশি। মাঠকর্মীরা উইকেটের ওপরের কভার সরিয়ে দিচ্ছেন। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল পরিচিত এক মুখ মুশফিকুর রহিম। সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সহকারী, কাঁধে কিট-ব্যাগ। বাংলাদেশ দলের নির্ধারিত অনুশীলন শুরু হতে তখনো বাকি প্রায় দুই ঘণ্টা। কিন্তু মুশফিক এসেছেন আগেভাগেই, একা। যেন নিজের সঙ্গে নিজের যুদ্ধ লড়তে।
গত এক যুগে মুশফিককে এমন দৃশ্যের সঙ্গে বারবার দেখা গেছে। চুপচাপ, মনোযোগী, এবং নিবেদিত। তবে এবারের প্রেক্ষাপট আলাদা। দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যানের জন্য সময়টা দুঃস্বপ্নের মতো। বয়সের কাঁটা যেখানে প্রায় ৩৯ ছুঁইছুঁই, সেখানে রানের খরায় যেন আরও ভারি হয়ে উঠছে তার ব্যাট। সিলেট টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দুই ইনিংসে মুশফিকের রান ছিল মাত্র ৪। তার আগের ম্যাচেও খুব একটা ভিন্ন চিত্র ছিল না। সবশেষ ১২ ইনিংসে কোনো ফিফটি নেই, এমনকি ৪০ রানের কোটা পার করতে পারেননি একবারও। প্রায় দুই দশকের ক্যারিয়ারে এমন সময় কখনোই আসেনি তার।
২০১৪-১৫ মৌসুমে একবার টানা ১১ ইনিংসে ফিফটি না পাওয়ার পর এই প্রথম এতটা কঠিন সময় পার করছেন মুশফিক। বাংলাদেশ দলের সামনে এখন এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত দেশের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে মুশফিকের শততম টেস্ট খেলার সম্ভাবনা। অথচ ঠিক এই সময়ে তার ব্যাটের নীরবতা বড় এক প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে। ফর্মহীনতা শুধু ব্যক্তিগত নয়, দলের জন্যও চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে যখন টেস্ট ব্যাটিং লাইনআপের ভিত্তির ওপরই দাঁড়িয়ে রয়েছে বাংলাদেশের আশাবাদ। তবে অভিজ্ঞতার মূল্য কম নয়। তাই এখনো মুশফিকের ওপর আস্থা রাখছে দল। সিলেট টেস্টের পর অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত যেমন বলেছিলেন, “আমরা জানি, মুশফিক ভাই যে কোনো সময় ঘুরে দাঁড়াতে পারেন। তার প্রতি আমাদের পূর্ণ আস্থা আছে।”
এই আস্থার প্রতিদান দিতেই যেন দ্বিগুণ উদ্যমে প্রস্তুতি নিচ্ছেন মুশফিক। চট্টগ্রামে দলের অনুশীলনের আগে একাই প্রায় ঘণ্টাখানেক নেট সেশন করেন। সাধারণ নেট বোলারদের দিয়ে একের পর এক বল খেলতে থাকেন, নিজের ভুল খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। ফ্রন্ট ফুট, ব্যাক ফুট, কাট, পুল, ড্রাইভ সব কিছুতেই নিজেকে ঝালিয়ে নিচ্ছেন তিনি। যেন প্রতিটি স্ট্রোকের ভেতর দিয়ে নিজের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে চান। এমন নিবেদন নতুন কিছু নয় মুশফিকের জন্য। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই পরিশ্রমই তার মূল হাতিয়ার। মাঠের বাইরে সবচেয়ে বেশি ঘাম ঝরানো ক্রিকেটার হিসেবেই তাকে চেনে সতীর্থরা। তবে প্রশ্ন হলো, এত পরিশ্রমের ফল এবার আসবে তো? বাংলাদেশ দলে এই মুহূর্তে ব্যাটিং গভীরতা বড় একটা সমস্যা।
তাই শুধু মুশফিক নন, সবারই রান করা জরুরি। এই বাস্তবতা তুলে ধরেছেন তরুণ ব্যাটসম্যান জাকের আলি। শনিবার অনুশীলনের আগে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “দলে তো একজন খেলোয়াড় একা খেলছে না। সবারই রান করতে হবে। মুশফিক ভাই না করলেও অন্যদের করতে হবে। প্রত্যেকের দায়িত্ব আছে।” সিলেট টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে জাকের ও হাসান মাহমুদের লড়াইয়ের কথাও সামনে আনেন তিনি। অষ্টম উইকেটে তারা গড়েছিলেন ৩৫ রানের একটি গুরুত্বপূর্ণ জুটি। যেখানে হাসান মাহমুদ, মূলত একজন বোলার হয়েও ৫৮ বল মোকাবিলা করেন। এই মানসিকতা এবং লড়াইয়ের ইচ্ছাই চান জাকের পুরো দলের কাছ থেকে।
অন্যদিকে, মুশফিকের সংগ্রাম একেবারে ব্যক্তিগত পর্যায়েও পৌঁছে গেছে। প্রায় ২০ বছরের ক্যারিয়ারে, যখন সবাই ভাবছিলেন হয়তো এখন একটু চাপমুক্ত, উপভোগের ক্রিকেট খেলবেন—ঠিক তখনই তাকে রীতিমতো অস্তিত্বের লড়াইয়ে নামতে হচ্ছে। ব্যর্থতা যেন গলায় ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরেকটু ব্যর্থতা মানেই হয়তো একাদশ থেকে ছিটকে পড়ার আশঙ্কা। তবে মুশফিক বরাবরই লড়াকু। ক্যারিয়ারের শুরুতেই বহুবার কঠিন সময় পার করেছেন। জাতীয় দল থেকে বাদ পড়েছেন, আবার ফিরে এসেছেন। এবারও হয়তো সেই পুরোনো জেদই তাকে টেনে তুলবে। অনুশীলনে বাড়তি সময় কাটানো, ব্যাটিং নিয়ে নিজের সঙ্গে নিজের যুদ্ধ—সবকিছুই সেই প্রত্যাবর্তনের প্রস্তুতির অংশ।
চট্টগ্রাম টেস্টই হতে পারে সেই ফেরার মঞ্চ। মাঠের নীরব ঘাম ঝরানোর ফল যদি ব্যাটে কথা বলে, তবে হয়তো আবারও দেখা যাবে সেই পুরোনো মুশফিককে—যিনি দলের জন্য লড়েন, যিনি ভরসার প্রতীক। আর যদি না পারেন, তাহলে নিঃসন্দেহে শুরু হবে বড় আলোচনা। বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসে মুশফিকের নাম ইতোমধ্যেই উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা। তার অর্জন, তার অবদান ভুলে যাওয়ার নয়। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নির্মম। এখানে অতীতের কীর্তি নয়, চলমান ফর্মই মুখ্য। তাই চট্টগ্রামে শুরু হবে মুশফিকের আরেকটি নতুন লড়াই—এই লড়াই শুধু রানের জন্য নয়, নিজের সম্মান, নিজের অবস্থান রক্ষা করার জন্যও। ভক্তরাও চাইবে, মুশফিক যেন হাসিমুখেই তার শততম টেস্ট উদযাপন করেন, রানের জোয়ারে ভাসিয়ে দেন নিজেদের প্রিয় ব্যাটসম্যানকে। সবকিছুর আগে এখন শুধু প্রয়োজন-একটি বড় ইনিংস, একটা সাহসী প্রত্যাবর্তন। আর সেই প্রত্যাবর্তনের গল্প হয়তো শুরু হয়েছে চট্টগ্রামের মাঠে, দুপুরের আগেই নেমে আসা একাকী অনুশীলনের মধ্য দিয়ে।