মোহাম্মদ নূরুল হক : সড়ক-মহাসড়কে যেসব যানবাহন চলে, সেসবের ফিটনেস থাকা জরুরি। তারও বেশি জরুরি যানবাহনের যৌক্তিকতা। অর্থাৎ কী ধরনের বাহন কীভাবে চলবে, এই প্রশ্নের মীমাংসা করা জরুরি। রিকশার যে উচ্চতা, চাকার যে উচ্চতা ও পুরুত্ব, তাতে এর সর্বোচ্চ গতি হওয়া উচিত ১২-১৫ কিলোমিটার। তাহলে প্যাডেলচালিত রিকশাচালক তার শরীর ও বাহনের ভারসাম্য বজায় রেখে চালাতে পারবেন। সম্প্রতি দেখা গেছে, প্যাডেলচালিত রিকাশায় ব্যাটারি সংযুক্ত করা হয়েছে। এসব বাহনের চালকরা আর প্যাডেল চালান না। তারা রিকশার ফ্রেমের ওপর পা রেখে ত্রিশ থেকে পয়ত্রিশ কিলোমিটার গতিতে বাহনটি চালান। এতে ভূমি থেকে রিকশার সিটের দূরত্ব তিন-চার ফুট উপরে থাকায় অনেক সময় যাত্রীরা টাল সামলাতে পারেন না। বিশেষত ওভার স্পিডে চালিয়ে আসার পর হঠাৎ ব্রেক কষলে কিংবা অন্য কোনো বাহনকে সাইড দিতে গিয়ে মোড় নিতে গেলে শরীর ও বাহনের ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। আর দুর্ঘটনা তো নৈমত্তিক ব্যাপার। তবু কেন সড়কে এই অদ্ভুতুড়ে বাহনটির রাজত্ব চলছে?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে কয়েকটি বিষয় সামনে আসবে। সেগুলো হলো:
১. পুলিশ উৎকোচ নেয় কি না
২. স্থানীয় প্রভাবশালীরা চাঁদা নেন কি না
৩. ক্ষতিকর জেনেও কেন বন্ধ হচ্ছে না
অনেকেরই নিশ্চয় মনে আছে— ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন বিচারপতি মামনুন রহমানের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ। একইসঙ্গে এসব রিকশা আমদানি ও ক্রয়-বিক্রয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। এর আগে ২০১৭ সালেও এসব বাহন বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। কিন্তু আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা করে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী নেতা ও পুলিশকে ম্যানেজ করে রাজধানীতে চলছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। আর এসব অটোরিকশায় চড়ে প্রায় দুর্ঘটনার শিকার হয়ে সারাজীবনের জন্য কেউ হচ্ছেন পঙ্গু, কেউ হারাচ্ছেন প্রাণ। এখন প্রশ্ন উঠছে- বারবার আদালত নির্দেশ দেওয়ার পরও কেন ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধ হচ্ছে না? রিকশা নিয়ে কাজ করে- এমন সংগঠনগুলো বলছে, রাজধানীতে প্রায় দুই লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা চলছে। ২০২০ সালের ৭ অক্টোবর নিউজ পোর্টাল সারাবাংলাডটনেটে প্রকাশিত “অবৈধ অটোরিকশায় ‘আয়’ মাসে ২০ কোটি, বড় অংশ পুলিশের পকেটে” শীর্ষক এক প্রতিবেদন বলছে, ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক ও মালিকরা জানিয়েছেন, এসব ব্যাটারিচালিত রিকশা অবৈধ হলেও তারা স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা ও পুলিশকে ‘ম্যানেজ’ করে চলেন। বিনিময়ে উভয় পক্ষের কাছ থেকে বড় অঙ্কের মাসোহারা নেয় প্রভাবশালী নেতা ও পুলিশ। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে-এসব রিকশার চালক ও মালিকদের কাছ থেকে প্রতি মাসে ২০ থেকে ৩০ কোটি টাকা পর্যন্ত মাসোহারা তোলেন প্রভাবশালী নেতা ও পুলিশ কর্মকর্তারা। সে হিসাবে বছরে ২৫০ থেকে ৩৫০ কোটি টাকা চাঁদা দেন এই রিকশাচালক-মালিকরা!
বিস্ময়কর হলেও সত্য- প্রতিবেদেন উল্লেখ করা হয়েছে, এসব অভিযোগ স্বীকার করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সহকারী কমিশনার পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা। তবে তিনি নাম প্রকাশ না কার শর্তে বলেছেন, ‘বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট হয়ে গেছে। সরকারের নজরে না এলে কোটি টাকার চাঁদাবাজির এ প্রক্রিয়া বন্ধ হবে না।’ এই চাঁদাবাজির জন্য কিছু ‘অসাধু’ কর্মকর্তাকে দায়ী করেছেন তিনি। বলেছেন,‘ভাবতে কষ্ট হয় যে, দুই-একজন অসৎ কর্মকর্তার কারণে এই চাঁদাবাজির দুর্নাম পুরো বাহিনীকেই নিতে হচ্ছে।’ উল্লিখিত প্রতিবেদনের তথ্য ও পুলিশ কর্মকর্তার স্বীকারোক্তিই প্রমাণ করে— পুলিশ বাহিনী ব্যাটারিচালিত রিকশার চালক ও মালিকদের কাছ থেকে নিয়মিত উৎকোচ নেয়। সড়ক থেকে এই অদ্ভুতুডে, প্রাণঘাতী, পরিবেশবিধ্বংসী বাহনটি উঠে গেলে পুলিশ বাহিনী বড় অঙ্কের মাসোহারা থেকে বঞ্চিত হবে। ফলে তারাই চায় না রাজধানীর সড়কগুলো ব্যাটারিচালিত রিকশামুক্ত হোক। ব্যাটারিচালিত রিকশা চালানোর জন্য প্রত্যেক এলাকায়ই সুনির্দিষ্ট ‘ব্যবস্থা’ থাকার তথ্যও এখন ওপেন সিক্রেট। এই কথা এখন সবাই জানেন যে, থানা পুলিশ ও স্থানীয় নেতাদের যৌথ উদ্যোগে ‘লাইনম্যান’দের মাধ্যমে প্রতিটি এই অবৈধ-পরিবেশবিধ্বংসী-প্রাণঘাতী বাহনটি সড়কে নির্বিঘেœ চলাচলের জন্য একটি করে কার্ড ইস্যু করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, এই কার্ডের বিপরীতে যে অর্থ দেওয়া হয়, তার ভাগ পান ঐ স্থানীয় নেতা ও থানা পুলিশের কর্মকর্তারা।
সুতরাং এ কথা সহজেই অনুমেয়- ব্যাটারিচালিত রিকশা অবৈধ হলেও কেবল স্থানীয় চাঁদাবাজ ও অসৎ পুলিশ কর্মকর্তাদের খুঁটির জোরেই সড়কে চলাচল করছে। অথচ এই বাহনটি ব্যাটারিচালিত হওয়ার কারণে বিপুল পরিমাণে বিদ্যুতের অপচয় হচ্ছে। সঙ্গে পরিবেশের ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। সবচেয়ে ভয়ানক তথ্যটি হলো, ভূমি থেকে এই বাহনটির আসনের উচ্চতা, চাকার পুরুত্ব, স্পোকের আকার ও পুরুত্ব এর গতির পক্ষে সহায়ক নয়। সাধারণত প্যাডেলচালিত রিকশার গড়গতি ১২ কিলোমিটার হয়ে থাকে। এর বেশি গতি চালক তুলতে পারেন না। অথচ ব্যাটারিচালিত রিকশার গতি ৩৫ কিলোমিটার পর্যন্ত ওঠে। এই রিকশার চাকা, স্পোক, চেইন, ব্রেক, সিটের উচ্চতা; কোনোটাই ৩৫ কিলোমিটার গতির সহায়ক নয়। ১২ কিলোমিটারের বেশি গতি এই বাহনের জন্য বিপজ্জনক। ভূমি থেকে প্রায় তিন-চার ফুট ওপরে এর সিট হওয়ায় ৩৫ কিলোমিটার গতিতে চললে যাত্রীরা প্রায় শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেন না। বিশেষত এত বেশি গতি বাঁকে বাঁকে ডানে-বামে ঘোরার সময় রিকশা যেমন উল্টে যেতে পারে, তেমনি যাত্রীরাও প্রবল ঝাঁকুনি সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে পারেন। তাই অবিলম্বে বন্ধ হোক ব্যাটাারিচালিত রিকশা। সরকারকে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। না হয় দিন যত যাবে, তত পরিবেশ দূষণ বাড়বে, বাড়বে যানজটসহ দুর্ঘটনার পরিমাণও।
ব্যাটারিচালিত রিকশা চলছে কার স্বার্থে
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ