মোহাম্মদ নূরুল হক :বর্তমানে দেশে নগরজীবনের জন্য এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম ব্যাটারিচালিত রিকশা। এই বাহনের চালকদের না আছে কোনো প্রশিক্ষণ, না আছে কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স। মানবিক গুণ কিংবা দয়ামায়ার ছিটেফোঁটাও তাদের আচরণে দেখা যায় না। যখন ব্যাটারিচালিত রিকশা সড়কে ছুটে চলে, তখন চালকদের পা থাকে পথচারীদের বুক বরাবর। আর তারা ছুটে চলে ৩৫ থেকে ৪০ কিলোমিটার গতিতে। চাকার আকার ২৮/২৯ ইঞ্চি এবং ব্রেকিং সিস্টেম অত্যন্ত নাজুক। ফলে একদিকে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কার্যকর থাকে না, অন্যদিকে জরুরি প্রয়োজনেও ব্রেক কাজ করে না। ফলে যাত্রীসহ উল্টে পড়ার সমূহ আশঙ্কা থাকে। এতে নগরীর অলিগলিতে অহরহই ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটছে। হাত-পা ভাঙা ছাড়াও চিরদিনের জন্যও কেউ কেউ পঙ্গুত্ব বরণ করতে বাধ্য হচ্ছেন। অথচ কী এক অদৃশ্য-অবৈজ্ঞানিক-অযৌক্তিক শক্তির বশে বাহনটিকে নিষিদ্ধ করা যাচ্ছে না। চালকরাও ট্র্যাফিক আইনলঙ্ঘনের পাশাপাশি পথচারীদের ওপর যখন-তখন চড়াও হচ্ছেন।
সর্বশেষ গত সোমবার (২১ এপ্রিল) রাজধানীর বনানী এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশার চালকরা পথচারী ও মোটরসাইকেল আরোহীদের লাঠিপেটা করেছেন। এই প্রসঙ্গে পুলিশের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, গত কয়েকদিন আগে গুলশানে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে গুলশান সোসাইটি। কিন্তু সোসাইটির ওই সিদ্ধান্ত মেনে নেননি ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা। ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে তারা গত কয়েকদিন ধরে গুলশানের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চালানোর দাবিতে আন্দোলন করে আসছিলেন।
চলমান আন্দোলনের মধ্যে সোমবার সোসাইটির বাসিন্দারা-গুলশানের শেষ মাথায় ও বনানী এলাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত রিকশা আটকে দেয় নিরাপত্তারক্ষীরা। এতে ব্যাটারিচালিত রিকশার চালকরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তারা বনানী ১১ নম্বর এলাকায় আন্দোলন শুরু করেন। এ সময় আন্দোলনের ভিডিও করতে দেখলে কিংবা ছবি তুলতে দেখলেই তারা গণমাধ্যমকর্মীসহ সংশ্লিষ্টদের লাঠিপেটা করেন। এই প্রসঙ্গে বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মেহেদী হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তবে আমরা ঘটনাস্থলে রয়েছি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি।’
পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্যে বিষয়টি পরিষ্কার যে, ব্যাটারিচালিত রিকশার দৌরাত্ম্য এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে। চালকরা আইনলঙ্ঘনের দুঃসাহস দেখাচ্ছে। সাধারণ মানুষের ওপর তারা অত্যাচার শুরু করেছেন। লাঠি নিয়ে পথচারী ও মোটরসাইকেল আরোহীর ওপর চড়াও হচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কয়েকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, একটি মোটরসাইকেলে দুজন আরোহী যাচ্ছেন। এ সময় ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা ওই আরোহীদের লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছেন। মোটরসাইকেলের গতি বাড়িয়ে চালক দ্রুত স্থানত্যাগের চেষ্টা করছেন। কিন্তু ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা বারবার তার গতিরোধ করে তাকে পেটাচ্ছেন। পরিস্থিতি যখন এমন, তখনই প্রশ্ন উঠছে, অবৈজ্ঞানিক-অযৌক্তিক বাহনের চালকরা কোন শক্তির জোরে জনগণের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছেন? কেন এই বাহনটি বন্ধ হচ্ছে না? কেন এই চালকদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না প্রশাসন? উল্লিখিত প্রশ্নগুলোর উত্তর যা-ই হোক, সেগুলো বিশ্লেষণপূর্বক সমাধানে আসতে হবে। একইসঙ্গে দ্রুত ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে রাষ্ট্রকে। শেষ উদ্যোগটি সফল করার জন্য বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিতে হবে।
পদক্ষেপগুলো হলো:
১। কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা
২। যত তাড়াই থাকুক ব্যাটারিচালিত রিকশায় না চড়া
৩। ব্যাটারিচালিত রিকশার মালিক-চালকদের সঙ্গে সব ধরনের সামাজিক সম্পর্ক ছিন্ন করা
৪। সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপনচিত্র, পথনাটক, সভা-সেমিনার, গণসংগীতের আয়োজন করা
৫। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সারাদেশে অভিযান চালিয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশার ব্যাটারি ও মোটরকিট খুলে এসব বাহনকে প্যাডেলচালিত বাহনে রূপান্তর করা
৬। যে-সব বিক্রেতা ব্যাটারিচালিত রিকশার সরঞ্জাম আমদানি, সংরক্ষণ ও বিক্রি করেন, তাদের গ্রেফতার করে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা।
৭। দশ বছরের কারাদণ্ডসহ মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন সংস্কার ও আইন প্রণয়ন
ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের কথা উঠলেই অনেক মেকি মানবতাবাদীই বলেন, গরিবের রুটি-রুজির বন্ধ করা ঠিক হবে না। যারা এমন দাবি করেন, তারা হয়তো ভেবে দেখেন না, তাদের দাবি কেবল হাস্যকরই নয়, একইসঙ্গে মানবতার বিরুদ্ধেও। এমনকি মানুষ হত্যার পক্ষেও। কারণ যারা এই ব্যাটারিচালিত রিকশা চালান, তারা সবাই এই বাহনের মালিক নন। যারা মালিক, তারা দরিদ্র নন। তারা সমাজের প্রভাবশালী, তারা ধরাকে সরাজ্ঞান করেন। তাই দরিদ্রের প্রতি দয়া দেখানোর ছলে প্রাণঘাতী বাহন ব্যাটারিচালিত রিকশার পক্ষে কোনোভাবেই ওকালতি করা যাবে না। বরং চালকদের জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। যেন চালকরা বুঝতে পারেন, তারা যে বাহনটি চালান, সেটি মানুষ ও সমাজের জন্য মোটেও উপকারী নয়। বরং মানুষের পঙ্গুত্ব ও প্রাণহানির কারণ। এসব বাহনের বেপরোয়া গতির কারণে কেবল অচেনা পথচারীই দুর্ঘটনার শিকার হবেন না, কখনো কখনো এই চালকদের সন্তানদেরও মৃত্যু ঘটতে পারে। সুতরাং, তারা যেন দেশের স্বার্থে এবং নিজের সন্তানকে দুর্ঘটনামুক্ত সড়কে চলাচলের জন্য ব্যাটারিচালিত রিকশা ত্যাগ করে প্যাডেলচালিত রিকশা চালান।
চালকদের কাউন্সেলিং করার পাশাপাশি জনসাধারণকেও সচেতন হতে হবে। যত তাড়াই থাকুক, দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য কোনোভাবেই তারা যেন ব্যাটারিচালিত রিকশায় না ওঠেন। অপেক্ষাকৃত ধীরগতির হলেও তারা যেন প্যাডেলচালিত রিকশা বেছে নেন। বিকল্পে মোটরসাইকেল কিংবা সিএনজিচালিত অটো বা বেবিট্যাক্সিতে চলাচল করেন। সাধারণ মানুষ সচেতনভাবে ব্যাটারিচালিত রিকশা এড়িয়ে চললে এই বাহনের চালকরাই একসময় নিরুৎসাহিত হয়ে পড়বেন। বিকল্প বৈধবাহনের দিকে ঝুঁকবেন। মানুষ যে জিনিস ব্যবহার করে না, সমাজে সেই জিনিস বেশিদিন টিকতে পারে না। সুতরাং সচেতন মানুষের উচিত, সর্বতভাবেই ব্যাটারিচালিত রিকশা এড়িয়ে চলা।
শুধু চলাচলের ক্ষেত্রে ব্যাটারিচালিত রিকশা এড়িয়ে চললেই হবে না। একইসঙ্গে ব্যাটারিচালিত রিকশার মালিক-চালকদের সঙ্গেও সব ধরনের সামাজিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। তাদের সঙ্গে সাধারণ লেনদেন, তাদের কাছে পণ্য বিক্রি, তাদের কাছ থেকে কোনো পণ্য কেনা, সব বন্ধ করে দিতে হবে। যখনই কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে জানা যাবে যে, তিনি ব্যাটারিচালিত রিকশার মালিক কিংবা চালক, তখনই তাকে এড়িয়ে চলতে হবে। তার সঙ্গে কথা বলা, একসঙ্গে বসে চা-খাওয়া, আড্ডা দেওয়া কিংবা যে-কোনো ধরনের লেনদেন বন্ধ করে দিতে হবে। তাদের পরিবারের ছেলে-মেয়ের সঙ্গে বিয়ে-শাদির বিষয়ও এড়িয়ে চলতে হবে। অর্থাৎ ব্যাটারিচালিত রিকশার মালিক-চালকদের শতভাগ সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। এভাবে তাকে উপলব্ধি করাতে হবে, প্রাণঘাতী বাহনের মালিক-চালক হলে সমাজে মূল্য হারাতে হবে, স্বজন হারাতে হবে। সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে জীবন-যাপন করতে হবে।
ওপরের পদক্ষেপগুলো শতভাগ কার্যকর না-ও হতে পারে। তবে, এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে নিতে হবে বেশকিছু উদ্যোগ। এর মধ্যে রয়েছে-সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপনচিত্র, পথনাটক, সভা-সেমিনার ও গণসংগীতের আয়োজন করা। হবে। জনগণকে সচেতন করে তুলতে বিজ্ঞাপনচিত্র বেশ কার্যকরী একটি পদক্ষেপ। তাই গণমাধ্যমে নিয়মিত গণসচেতনতামূলক বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণের মাধ্যমে ব্যাটারিচালিত রিকশাসৃষ্ট ভয়াবহতা তুলে ধরতে হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে পথনাটক, সভা-সেমিনার ও গণসংগীতের আয়োজনও করতে হবে। এসব অনুষ্ঠানে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশাজীবীর সঙ্গে রিকশাচালকদেরও সম্পৃক্ত করার প্রয়োজন। এসব কর্মকাণ্ডে তাদের অংশগ্রহণ যত বেশি থাকবে, তারা তত বেশি সচেতন হবে।
উল্লিখিত উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নের পরও যদি সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা দৌরাত্ম্য না থাকে, তাহলে প্রশাসনকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হবে। যেখানে ব্যাটারিচালিত রিকশা পাওয়া যাবে, সেখানেই তাৎক্ষণিকভাবে ব্যাটারিচালিত রিকশার ব্যাটারি ও মোটরকিট খুলে প্যাডেলচালিত বাহনে রূপান্তর করতে হবে। চালককে বোঝাতে হবে, ব্যাটারিচালিত রিকশার চেয়ে প্যাডেলচালিত রিকশা বেশি আরামপ্রদ, নিরাপদ ও দুর্ঘটনার ঝুঁকিমুক্ত। এতেও ব্যাটারিচালিত রিকশার দৌরাত্ম্য বন্ধ না হলে যে-সব বিক্রেতা এই বাহনের সরঞ্জাম আমদানি, সংরক্ষণ ও বিক্রি করেন, তাদের গ্রেফতার করে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। প্রচলিত আইনে কোনো ঘাটতি থাকে প্রয়োজনে আইন সংশোধনসহ নতুন প্রণয়নের উদ্যোগ নিতে হবে রাষ্ট্রকে। প্রয়োজনে দশ বছরের কারাদণ্ডসহ মৃত্যুদণ্ডের বিধান যুক্ত করতে হবে।
‘রিকশা মাত্রই গরিবের বাহন’-এমন ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। নিতে হবে সময়োপযোগী উদ্যোগ। যে উদ্যোগ দেশ ও দেশের নাগরিকদের দেবে স্বস্তির সড়ক, কমিয়ে আনবে দুর্ঘটনা। এই উদ্যোগ এখনই নিতে হবে। না হলে ব্যাটারিচালিত রিকশার এই অশুভ চক্র একদিন মহামারিতে রূপ নেবে। সেদিন পথেঘাটে হাতের কনুই কাটা, আঙুল উপড়ানো, হাঁটুভাঙা পঙ্গু মানুষের ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়বে সড়ক-মহাসড়ক থেকে শুরু করে অলিগলি।
লেখক: সাংবাদিক-কবি-গবেষক।