ঢাকা ০২:৫৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫
আবুল বারকাতের শুনানিতে আদালত

ব্যাংক বোর্ডের সহায়তায় অর্থপাচার নজিরবিহীন

  • আপডেট সময় : ০৯:১৪:৪১ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫
  • ৩ বার পড়া হয়েছে

আদালতে পুলিশ প্রহরায় আবুল বারাকাত -ছবি সংগৃহীত

নিজস্ব প্রতিবেদক: জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল বারকাতের জামিন শুনানিতে আদালত বলেছে, ব্যাংকের বোর্ডের সহায়তায় বিদেশে অর্থপাচার হয়েছে, যা নজিরবিহীন।

বুধবার (২৩ জুলাই) ঢাকার মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ জাকির হোসেন গালিব এ মন্তব্য করেন। এদিন সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে আবুল বারকাতকে মহানগর দায়রা জজ আদালতের হাজতখানায় নেওয়া হয়। ১১টা ৭ মিনিটে তোলা হয় আদালতে। কাঠগড়ায় একটি বেঞ্চে বসেন তিনি, তখন তাকে বেশ চিন্তিত দেখা যায়। অ্যাননটেক্সের ২৯৭ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির মামলায় তার জামিন চেয়ে আদালতে শুনানি করেন আইনজীবী শাহিনুর ইসলাম।
তিনি বলেন, ২০১৩ সালের ঋণ আবেদন করে এননটেক্স গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান সুপ্রভা স্পিনিং মিলস। পরে তাদের আবেদনটি যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ব্যাংকের বোর্ড সভায় উপস্থাপন করা হয়। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইড লাইন মেনে সুপ্রভা স্পিনিং মিলসকে ঋণ মঞ্জুর করা হয়। এখানে ড. আবুল বারকাত দায়িত্বের অবহেলা করেননি। তিনি কোনো নীতিমালাও ভঙ্গ করেননি। আইনজীবী শাহিনুর বলেন, এর আগে একই বিষয়ে দুদক অনুসন্ধান করে কোনো দুর্নীতি হয়নি মর্মে ক্লিয়ারেন্স দেয়। এখন একই বিষয়ে নতুন করে মামলা করার বিষয়টি দ্বিচারিতা ছাড়া কিছুই না। তাই দুদক আবুল বারকাতের বিরুদ্ধে যে সব অ্যালিগেশন এনেছে, তার কোনো যৌক্তিকতা নেই। সার্বিক দিক বিবেচনায় আমরা তার (আবুল বারকাত) জামিন চাইছি।

জামিনের বিরোধিতা করে দুদকের কৌঁসুলি মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর বলেন, জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় উনার কর্মচারীরা কোনো অপরাধ বা অনিয়ম করলে তার দায়িত্ব তাকেই (বারকাত) নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনরকেও এ মামলায় আসামি করা হয়েছে। তার জামিনের বিরোধিতা করছি।

এ সময় বিচারক বলেন, সোনালী ব্যাংকের পাঁচ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি নিয়ে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছিলেন, ‘পাঁচ হাজার কোটি টাকা কোনো টাকায় না’। এরপর থেকেই পাঁচ হাজার, দশ হাজার কোটি, বিশ হাজার কোটি, পঞ্চাশ হাজার, এক লাখ কোটি টাকা লোপাট হতে থাকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে। এসব টাকা পাচার হয়ে চলে যায় বিভিন্ন দেশে। বিগত ওয়ান ইলেভেন সরকারের সময় ট্রুথ কমিশন গঠন করা হয়েছিল। যারা দুর্নীতি করেছিল, তারা ওই কমিশনে গিয়ে নিজেদের দুর্নীতির কথা স্বীকার করে অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে জমা দেয়। ভেবেছিলাম এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়েও এমন কিছু উদ্যাগ নেয়া হবে। পাচার করা টাকা এই সরকার ফেরত এনে রাষ্ট্রের কাছে জমা দিবে, কিন্তু সেটি হয়নি।
দুর্নীতির মামলায় সাজা আরো বাড়ানোর প্রয়োজন: বিচারক গালিব বলেন, এখন দুদকের মতো সংস্থার পক্ষে এতো এতো দুর্নীতি বিচারের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব না। এছাড়া দুদক যেসব মামলা করে, সেসব মামলায় শাস্তিও হয় কম। দুর্নীতি করে পাঁচ হাজার কোটি টাকার; শাস্তি হয় পাঁচ বছরের। এসব মামলায় সাজা কিন্তু একই রয়েছে। আমি মনে করি দুর্নীতির মামলায় সাজা আরো বাড়ানো দরকার। বিচারক বলেন দুর্নীতি এখন মহামারী আকার ধারণ করেছে। আগে দুর্নীতি হতো ৫০ কোটি টাকার, এখন সেখানে দুর্নীতি হচ্ছে ৫ হাজার কোটি টাকার। সাজা একই আছে। তাই আমি মনে করি দুর্নীতির মামলার সাজা আরো বাড়ানো প্রয়োজন। তা না হলে দুর্নীতির লাগাম টানা সম্ভব হবে না। এরপর তিনি এই মামলার রিমান্ড বিষয়ে শুনানি মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হবে বলে শুনানি শেষ করেন। গত ১০ জুলাই রাত সাড়ে ১১টার দিকে ধানমন্ডির ৩ নম্বর সড়ক এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। পরদিন তার জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
এর আগে, মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ শাহজাহান মিরাজ গত ১১ জুলাই আসামির তিন দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। ওইদিন তাকে কারাগারে পাঠিয়ে রিমান্ড শুনানির জন্য বুধবার দিন ধার্য করেন আদালত। শুনানিকালে পুলিশের কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী মধ্যে দিয়ে সকাল ১১টা ৫ মিনিটের দিকে তাকে এজলাসে ওঠানো হয়। মিনিট দশেক পর এই মামলার শুনানি হয়।

রাষ্ট্রপক্ষে দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর রিমান্ডের পক্ষে শুনানি করেন। তিনি বলেন, আসামি আবুল বারকাত জনতা ব্যাংকের অভিভাবক হিসাবে তার দায়িত্ব ছিল। আসামির দায়িত্ব থাকা অবস্থায় সব কিছুই তার অনুমতি লাগতো। এত বড় দায়িত্বে থেকে তিনি এসব কিছু করেছেন। এ ঘটনার সাথে আরো কারা জড়িত রয়েছে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। আসামির জামিনের ঘোর বিরোধিতা জানাচ্ছি।

এরপর আসামি আবুল বারকাতের আইনজীবী মো. শাহীনুর ইসলাম তার রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিনের আবেদন করেন। শুনানিতে তিনি বলেন, গত ৪২ বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। চার বার অর্থনীতি সমিতির সেক্রেটারি ছিলেন। তিনি একজন অর্থনীতিবিদ। তার লেখা বইগুলো শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা করেন ও গবেষণাও কাজে ব্যবহৃত হয়। তিনি একটি কোম্পানির চেয়ারম্যান।
তখন এই আইনজীবীকে থামিয়ে মামলার বিষয়ে শুনানি করতে বলেন। এরপর এ আইনজীবী বলেন, আসামির বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা সঠিক নয়। আসামি কোনো দুর্নীতি করেননি। আসামি একজন বয়স্ক ব্যক্তি, দুই বার হার্টের রিং পরানো হয়েছে। উচ্চরক্তচাপসহ একাধিক সমস্যা রয়েছে। সার্বিক দিক বিবেচনা করে রিমান্ড বাতিলপূর্বক জামিনের প্রার্থনা করছি।

এরপর বিচারক বলেন, আপনার সময়ে জনতা ব্যাংক সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে ছিল। সোনালী ব্যাংকের অবস্থাও ভালো ছিল না। বিভিন্ন দুর্নীতির মাধ্যমে লোন পাস করিয়ে ব্যাংকের খারাপ পরিণত করা হয়েছে।

শুনানিতে নাসা গ্রুপের কর্ণধার ও এক্সিম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের প্রসঙ্গে তুলে ধরে এই বিচারক বলেন, নজরুল সাহেব জামিন পেলে নাকি সব টাকাই শোধ করে দিবেন। আগে কেন টাকা পরিশোধ করেননি। আগে কেন মনে হয়নি টাকা পরিশোধের কথা। আগে কী করেছিলেন। কারাগার থেকেই টাকা পরিশোধ করা যায়। ওয়ান ইলেভেনের সময় ট্রুথ কমিশন হয়েছিল, সেখানে কিছু লোক অপরাধ স্বীকার করেছিল।

আবুল বারকাত ও দুদকের কৌঁসুলিকে উদ্দেশ্য করে বিচারক বলেন, জনতা ব্যাংকের অ্যালিগেশন আরো অনেক বড় থাকার কথা। তবে সব অ্যালিগেশনের সঙ্গেই আপনি জড়িত- এটি আমি বলছি না। আপনি ধৈর্য ধরেন। ব্যাংকের বোর্ডের সহায়তায় বিদেশে অর্থপাচার করছে- এটা নজিরবিহীন। আমাদের দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে।

এরপর আবুল বারকাতের জামিন নামঞ্জুর করেন তিনি। একইসঙ্গে এ মামলায় আবুল বারকাতকে তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদনের শুনানির জন্য মামলাটি সিএমএম আদালতে পাঠানোর আদেশ দেন। পরে আসামিকে আদালত থেকে হাজতখানায় নেয়া হয়।

জালিয়াতির মাধ্যমে জনতা ব্যাংক থেকে অ্যাননটেক্স গ্রুপের নামে ২৯৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগে গত ২০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান, আবুল বারকাতসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন দুদকের উপপরিচালক নাজমুল হুসাইন।

মামলার বিবরণ অনুযায়ী, অ্যাননটেক্স গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান মেসার্স সুপ্রভ স্পিনিং লিমিটেড ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন সময় জনতা ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়। তবে মূলত বড় অঙ্কের বিতরণ ঘটে ২০১৩-১৪ সময়কালে, যখন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি আবুল বারকাত জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক আবুল বারকাত প্রথম ওই দায়িত্ব পান ২০০৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। দ্বিতীয় মেয়াদে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন। এক সময় ভালো ব্যাংকের কাতারে থাকা জনতা ব্যাংক বারাকাতের অধীনে আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে বলে অভিযোগ রয়েছে।

মামলার অন্য আসামিদের মধ্যে আছেন- জনতা ব্যাংকের সাবেক পরিচালক জামাল উদ্দিন আহমেদ, মেসার্স সুপ্রভ স্পিনিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আনোয়ার হোসেন ও পরিচালক মো. আবু তালহা; জনতা ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক ও মহাব্যবস্থাপক (পরবর্তীতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও) আব্দুছ ছালাম আজাদ, সাবেক উপমহাব্যবস্থাপক আজমুল হক, সাবেক সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) অজয় কুমার ঘোষ, সাবেক ব্যবস্থাপক (শিল্প ঋণ-১) মো. গোলাম আজম, এসএমই বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহজাহান, এসইও মো. এমদাদুল হক, সাবেক উপমহাব্যবস্থাপক মো. আব্দুল জব্বার, সাবেক মহাব্যবস্থাপক ও সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মো. গোলাম ফারুক, সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর ফারুক, এফসিএ মো. ইমদাদুল হক, নাগিবুল ইসলাম দীপু, আর এম দেবনাথ, মো. আবু নাসের, মিসেস সঙ্গীতা আহমেদ, নিতাই চন্দ্র নাথ। এছাড়া আসামির তালিকায় আছেন অ্যাননটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইউনুছ বাদল এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক সহকারী পরিচালক মোছাম্মৎ ইসমত আরা বেগম, সাবেক ডেপুটি গভর্নর-২ আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান।

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

আবুল বারকাতের শুনানিতে আদালত

ব্যাংক বোর্ডের সহায়তায় অর্থপাচার নজিরবিহীন

আপডেট সময় : ০৯:১৪:৪১ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫

নিজস্ব প্রতিবেদক: জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল বারকাতের জামিন শুনানিতে আদালত বলেছে, ব্যাংকের বোর্ডের সহায়তায় বিদেশে অর্থপাচার হয়েছে, যা নজিরবিহীন।

বুধবার (২৩ জুলাই) ঢাকার মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ জাকির হোসেন গালিব এ মন্তব্য করেন। এদিন সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে আবুল বারকাতকে মহানগর দায়রা জজ আদালতের হাজতখানায় নেওয়া হয়। ১১টা ৭ মিনিটে তোলা হয় আদালতে। কাঠগড়ায় একটি বেঞ্চে বসেন তিনি, তখন তাকে বেশ চিন্তিত দেখা যায়। অ্যাননটেক্সের ২৯৭ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির মামলায় তার জামিন চেয়ে আদালতে শুনানি করেন আইনজীবী শাহিনুর ইসলাম।
তিনি বলেন, ২০১৩ সালের ঋণ আবেদন করে এননটেক্স গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান সুপ্রভা স্পিনিং মিলস। পরে তাদের আবেদনটি যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ব্যাংকের বোর্ড সভায় উপস্থাপন করা হয়। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইড লাইন মেনে সুপ্রভা স্পিনিং মিলসকে ঋণ মঞ্জুর করা হয়। এখানে ড. আবুল বারকাত দায়িত্বের অবহেলা করেননি। তিনি কোনো নীতিমালাও ভঙ্গ করেননি। আইনজীবী শাহিনুর বলেন, এর আগে একই বিষয়ে দুদক অনুসন্ধান করে কোনো দুর্নীতি হয়নি মর্মে ক্লিয়ারেন্স দেয়। এখন একই বিষয়ে নতুন করে মামলা করার বিষয়টি দ্বিচারিতা ছাড়া কিছুই না। তাই দুদক আবুল বারকাতের বিরুদ্ধে যে সব অ্যালিগেশন এনেছে, তার কোনো যৌক্তিকতা নেই। সার্বিক দিক বিবেচনায় আমরা তার (আবুল বারকাত) জামিন চাইছি।

জামিনের বিরোধিতা করে দুদকের কৌঁসুলি মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর বলেন, জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় উনার কর্মচারীরা কোনো অপরাধ বা অনিয়ম করলে তার দায়িত্ব তাকেই (বারকাত) নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনরকেও এ মামলায় আসামি করা হয়েছে। তার জামিনের বিরোধিতা করছি।

এ সময় বিচারক বলেন, সোনালী ব্যাংকের পাঁচ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি নিয়ে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছিলেন, ‘পাঁচ হাজার কোটি টাকা কোনো টাকায় না’। এরপর থেকেই পাঁচ হাজার, দশ হাজার কোটি, বিশ হাজার কোটি, পঞ্চাশ হাজার, এক লাখ কোটি টাকা লোপাট হতে থাকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে। এসব টাকা পাচার হয়ে চলে যায় বিভিন্ন দেশে। বিগত ওয়ান ইলেভেন সরকারের সময় ট্রুথ কমিশন গঠন করা হয়েছিল। যারা দুর্নীতি করেছিল, তারা ওই কমিশনে গিয়ে নিজেদের দুর্নীতির কথা স্বীকার করে অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে জমা দেয়। ভেবেছিলাম এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়েও এমন কিছু উদ্যাগ নেয়া হবে। পাচার করা টাকা এই সরকার ফেরত এনে রাষ্ট্রের কাছে জমা দিবে, কিন্তু সেটি হয়নি।
দুর্নীতির মামলায় সাজা আরো বাড়ানোর প্রয়োজন: বিচারক গালিব বলেন, এখন দুদকের মতো সংস্থার পক্ষে এতো এতো দুর্নীতি বিচারের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব না। এছাড়া দুদক যেসব মামলা করে, সেসব মামলায় শাস্তিও হয় কম। দুর্নীতি করে পাঁচ হাজার কোটি টাকার; শাস্তি হয় পাঁচ বছরের। এসব মামলায় সাজা কিন্তু একই রয়েছে। আমি মনে করি দুর্নীতির মামলায় সাজা আরো বাড়ানো দরকার। বিচারক বলেন দুর্নীতি এখন মহামারী আকার ধারণ করেছে। আগে দুর্নীতি হতো ৫০ কোটি টাকার, এখন সেখানে দুর্নীতি হচ্ছে ৫ হাজার কোটি টাকার। সাজা একই আছে। তাই আমি মনে করি দুর্নীতির মামলার সাজা আরো বাড়ানো প্রয়োজন। তা না হলে দুর্নীতির লাগাম টানা সম্ভব হবে না। এরপর তিনি এই মামলার রিমান্ড বিষয়ে শুনানি মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হবে বলে শুনানি শেষ করেন। গত ১০ জুলাই রাত সাড়ে ১১টার দিকে ধানমন্ডির ৩ নম্বর সড়ক এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। পরদিন তার জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
এর আগে, মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ শাহজাহান মিরাজ গত ১১ জুলাই আসামির তিন দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। ওইদিন তাকে কারাগারে পাঠিয়ে রিমান্ড শুনানির জন্য বুধবার দিন ধার্য করেন আদালত। শুনানিকালে পুলিশের কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী মধ্যে দিয়ে সকাল ১১টা ৫ মিনিটের দিকে তাকে এজলাসে ওঠানো হয়। মিনিট দশেক পর এই মামলার শুনানি হয়।

রাষ্ট্রপক্ষে দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর রিমান্ডের পক্ষে শুনানি করেন। তিনি বলেন, আসামি আবুল বারকাত জনতা ব্যাংকের অভিভাবক হিসাবে তার দায়িত্ব ছিল। আসামির দায়িত্ব থাকা অবস্থায় সব কিছুই তার অনুমতি লাগতো। এত বড় দায়িত্বে থেকে তিনি এসব কিছু করেছেন। এ ঘটনার সাথে আরো কারা জড়িত রয়েছে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। আসামির জামিনের ঘোর বিরোধিতা জানাচ্ছি।

এরপর আসামি আবুল বারকাতের আইনজীবী মো. শাহীনুর ইসলাম তার রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিনের আবেদন করেন। শুনানিতে তিনি বলেন, গত ৪২ বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। চার বার অর্থনীতি সমিতির সেক্রেটারি ছিলেন। তিনি একজন অর্থনীতিবিদ। তার লেখা বইগুলো শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা করেন ও গবেষণাও কাজে ব্যবহৃত হয়। তিনি একটি কোম্পানির চেয়ারম্যান।
তখন এই আইনজীবীকে থামিয়ে মামলার বিষয়ে শুনানি করতে বলেন। এরপর এ আইনজীবী বলেন, আসামির বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা সঠিক নয়। আসামি কোনো দুর্নীতি করেননি। আসামি একজন বয়স্ক ব্যক্তি, দুই বার হার্টের রিং পরানো হয়েছে। উচ্চরক্তচাপসহ একাধিক সমস্যা রয়েছে। সার্বিক দিক বিবেচনা করে রিমান্ড বাতিলপূর্বক জামিনের প্রার্থনা করছি।

এরপর বিচারক বলেন, আপনার সময়ে জনতা ব্যাংক সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে ছিল। সোনালী ব্যাংকের অবস্থাও ভালো ছিল না। বিভিন্ন দুর্নীতির মাধ্যমে লোন পাস করিয়ে ব্যাংকের খারাপ পরিণত করা হয়েছে।

শুনানিতে নাসা গ্রুপের কর্ণধার ও এক্সিম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের প্রসঙ্গে তুলে ধরে এই বিচারক বলেন, নজরুল সাহেব জামিন পেলে নাকি সব টাকাই শোধ করে দিবেন। আগে কেন টাকা পরিশোধ করেননি। আগে কেন মনে হয়নি টাকা পরিশোধের কথা। আগে কী করেছিলেন। কারাগার থেকেই টাকা পরিশোধ করা যায়। ওয়ান ইলেভেনের সময় ট্রুথ কমিশন হয়েছিল, সেখানে কিছু লোক অপরাধ স্বীকার করেছিল।

আবুল বারকাত ও দুদকের কৌঁসুলিকে উদ্দেশ্য করে বিচারক বলেন, জনতা ব্যাংকের অ্যালিগেশন আরো অনেক বড় থাকার কথা। তবে সব অ্যালিগেশনের সঙ্গেই আপনি জড়িত- এটি আমি বলছি না। আপনি ধৈর্য ধরেন। ব্যাংকের বোর্ডের সহায়তায় বিদেশে অর্থপাচার করছে- এটা নজিরবিহীন। আমাদের দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে।

এরপর আবুল বারকাতের জামিন নামঞ্জুর করেন তিনি। একইসঙ্গে এ মামলায় আবুল বারকাতকে তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদনের শুনানির জন্য মামলাটি সিএমএম আদালতে পাঠানোর আদেশ দেন। পরে আসামিকে আদালত থেকে হাজতখানায় নেয়া হয়।

জালিয়াতির মাধ্যমে জনতা ব্যাংক থেকে অ্যাননটেক্স গ্রুপের নামে ২৯৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগে গত ২০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান, আবুল বারকাতসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন দুদকের উপপরিচালক নাজমুল হুসাইন।

মামলার বিবরণ অনুযায়ী, অ্যাননটেক্স গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান মেসার্স সুপ্রভ স্পিনিং লিমিটেড ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন সময় জনতা ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়। তবে মূলত বড় অঙ্কের বিতরণ ঘটে ২০১৩-১৪ সময়কালে, যখন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি আবুল বারকাত জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক আবুল বারকাত প্রথম ওই দায়িত্ব পান ২০০৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। দ্বিতীয় মেয়াদে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন। এক সময় ভালো ব্যাংকের কাতারে থাকা জনতা ব্যাংক বারাকাতের অধীনে আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে বলে অভিযোগ রয়েছে।

মামলার অন্য আসামিদের মধ্যে আছেন- জনতা ব্যাংকের সাবেক পরিচালক জামাল উদ্দিন আহমেদ, মেসার্স সুপ্রভ স্পিনিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আনোয়ার হোসেন ও পরিচালক মো. আবু তালহা; জনতা ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক ও মহাব্যবস্থাপক (পরবর্তীতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও) আব্দুছ ছালাম আজাদ, সাবেক উপমহাব্যবস্থাপক আজমুল হক, সাবেক সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) অজয় কুমার ঘোষ, সাবেক ব্যবস্থাপক (শিল্প ঋণ-১) মো. গোলাম আজম, এসএমই বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহজাহান, এসইও মো. এমদাদুল হক, সাবেক উপমহাব্যবস্থাপক মো. আব্দুল জব্বার, সাবেক মহাব্যবস্থাপক ও সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মো. গোলাম ফারুক, সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর ফারুক, এফসিএ মো. ইমদাদুল হক, নাগিবুল ইসলাম দীপু, আর এম দেবনাথ, মো. আবু নাসের, মিসেস সঙ্গীতা আহমেদ, নিতাই চন্দ্র নাথ। এছাড়া আসামির তালিকায় আছেন অ্যাননটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইউনুছ বাদল এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক সহকারী পরিচালক মোছাম্মৎ ইসমত আরা বেগম, সাবেক ডেপুটি গভর্নর-২ আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান।