মহানগর প্রতিবেদন : রাজধানীতে নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে মৃত্যু বা ভবন ধসে মৃত্যু, এমন সংবাদ হরহামেশা শোনা যায়। এসব ঘটনার বেশিরভাগই ঘটে অসাবধানতা ও পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাবে। কিন্তু পথচলতি অবস্থায় মাথায় ইট পড়ে মৃত্যুর ঘটনাও মাঝেমধ্যে ঘটছে। গত বুধবার (১১ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় রাজধানীর মৌচাক এলাকার ফখরুদ্দিন রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড পার্টি সেন্টারের নিচে মাথায় ইট (কংক্রিটের ব্লক) পড়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা দীপান্বিতা বিশ্বাসের (দিপু সানা) মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় মামলা হলেও কাউকে আটক করা যায়নি। তবে এর রহস্য খুঁজছে পুলিশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক দীপান্বিতা বিশ্বাস প্রতিদিনের মতো অফিস শেষে সহকর্মীদের সঙ্গে বের হয়েছিলেন বাসার উদ্দেশে। গাড়ি থেকে নেমে ফুটপাত ধরে হাঁটছিলেন তিনি। আকস্মিক ওপর থেকে একটি ইট (কংক্রিটের ব্লক) তার মাথায় পড়লে, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মারা যান ৩৭ বছর বয়সী ওই নারী। দীপান্বিতার এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না কেউই। মর্মান্তিক এ ঘটনার পর রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে হেঁটে যাওয়ার সময় ভবন থেকে ইট পড়ে মানুষ মারা যাওয়া ও ভবন নির্মাণের সময় নিরাপত্তাব্যবস্থার অবহেলা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পুলিশ বলছে, এই ঘটনায় ৩০২ ধারায় একটি হত্যা মামলা করা হয়েছে। রমনা মডেল থানায় ওই হত্যা মামলা করেন নিহত দীপান্বিতার স্বামী তরুণ কুমার বিশ্বাস। মামলার সূত্র ধরে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কাজ করছে পুলিশ। ঘটনাস্থলে তদন্ত করছেন ডিবি, পিবিআই ও সিটিটিসি কর্মকর্তারাও। তারা বলছেন, ভিডিওতে শুধু ওপর থেকে ব্লক পড়তে দেখা যায়। ফ্লাইওভার থেকে নাকি উঁচু ভবন থেকে পড়েছে, তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) মোজাম্মেল হোসেন বলেন, ঘটনাস্থলের আশপাশে বা ওপরে নির্মাণাধীন কোনও ভবন নেই। ফখরুদ্দিন পার্টি সেন্টার রয়েছে। কিন্তু ব্লকটি কোথা থেকে পড়লো, তা জানা সম্ভব হয়নি ভিডিও দেখে। তিনি আরও বলেন, যেটার আঘাতে মৃত্যু হয়েছে, সেটা ফুটপাত নির্মাণে ব্যবহার করা হয় এমন সিমেন্টের খাঁজ কাটা ব্লক। দেখতে ইট আকৃতির। ভিডিওতে শুধু ওপর থেকে ব্লকটি পড়তে দেখা যায়। ফ্লাইওভার নাকি উঁচু ভবন থেকে পড়েছে, তা বোঝা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, হাতে ব্যাগ নিয়ে রাস্তার ফুটপাত দিয়ে হাঁটছিলেন দীপান্বিতা। হঠাৎ ইট আকৃতির একটি ব্লক ওপর থেকে সরাসরি মাথায় পড়তেই লুটিয়ে পড়েন তিনি। কিন্তু সেই ব্লকটি কোথা থেকে এলো, সে বিষয়ে নিশ্চিত নয় পুলিশ।
মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, দিপান্বিতা বিশ্বাস দিপা (দিপু সানা) ১০ জানুয়ারি ছুটি শেষে অফিসের বাসযোগে শান্তিনগর নেমে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে বাসায় ফিরছিলেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে ১১৭/১ নম্বর নিউ সার্কুলার রোডে ফখরুদ্দিন পার্টি সেন্টারের সামনে আসামাত্র অজ্ঞাতনামা আসামি ওপর থেকে কংক্রিটের একটি ইট হঠাৎ তার মাথার ওপর ফেললে তিনি গুরুতর আঘাত পান। এরপর দিপান্বিতা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তখন স্থানীয় লোকজন তাকে চিকিৎসার জন্য পাশের সিরাজুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ প্রসঙ্গে রমনা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উৎপল বড়ুয়া বলেন, দীপান্বিতা গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে বাসায় ফিরছিলেন। এ সময় ওপর থেকে একটি ইট তার মাথায় পড়লে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান। ইটটি কোথা থেকে পড়েছে, তা নিশ্চিত হতে তদন্ত চলছে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি।
ঘটনার পর যা জানা গেলো: খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চারতালা ওই ভবনটির নাম সুলতান টাওয়ার। নিচে পার্কিং, দ্বিতীয় তলায় ফখরুদ্দিন রেস্টুরেন্ট, তৃতীয় তলায় পার্টি সেন্টার ও চতুর্থ তালায় ভবন মালিকের স্টোর রুম। ভবনটির ছাদে কেউ থাকে না। খোলা ছাদের এক পাশে কিছু পাথর, পরিত্যক্ত কিছু আসবাব রয়েছে। তবে ওই ছাদের চাবিও শুধু মালিক ও ফখরুদ্দিন রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারের কাছে থাকে। রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার রিয়াজ আহমেদ বলেন, ঘটনার সময় আমরা অফিসে ছিলাম। কোনও পার্টি না থাকায় তেমন ভিড়ও ছিল না। হঠাৎ শব্দ শুনে সামনে এসে দেখি এক নারী পড়ে আছেন। আমাদের ছাদ বা অন্য কোনও ভবন থেকে কংক্রিটের কিছু পড়ার সুযোগ নেই। এটা অন্য কোথা থেকে পড়তে পারে।
ভুক্তভোগী দীপান্বিতা বিশ্বাসের কাকা স্বপন কুমার সানা বলেন, আমরা যারা ঢাকায় বসবাস করি, আমাদের সবারই কাজের প্রয়োজনে বের হতে হয়, অফিসে যেতে হয়। এভাবে যদি রাস্তাঘাট অরক্ষিত থাকে, পথ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ভবন থেকে ইট পড়ে মানুষ মারা যায়, তাহলে একজন দেশের নাগরিক হিসেবে আমি ব্যথিত। আমার ভাতিজির এমন মৃত্যু কখনও দেখতে চাইনি। তার মৃত্যুর সঠিক কারণ জানতে সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচার চাই। নিহত দীপান্বিতার সহকর্মী বাংলাদেশ ব্যাংক অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা শ্রাবণ বলেন, আমরা চাই সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হোক। আইনি প্রক্রিয়াটা যাতে ঠিকমতো হয়, এটাও চাই। এই দুর্ঘটনায় অবশ্যই অবহেলা আছে। আমি রাস্তা দিয়ে হাঁটবো, আমি নাগরিক, অবশ্যই আমার নিরাপত্তা চাই।
দীপান্বিতা বিশ্বাসের জন্ম পৈতৃক বাড়ি খুলনার পাইকগাছা উপজেলার সোলাদানা গ্রামে। তার শ^শুরবাড়ি খুলনার তেরখাদা উপজেলায়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানে পড়েছেন। ছয় বছর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকে অফিসার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। সর্বশেষ তিনি সহ-ব্যবস্থাপক হিসেবে সদরঘাট শাখার জড় সামগ্রী ও মনিহারি শাখায় কর্মরত ছিলেন। তাদের তিন বছর বয়সী এক সন্তান রয়েছে।
ব্যাংক কর্মকর্তার মৃত্যু ঘটনাস্থলে নির্মাণাধীন ভবন নেই, তবে কোথা থেকে এলো ইট
জনপ্রিয় সংবাদ