নিজস্ব প্রতিবেদক : মহামারি করোনার ক্ষতি কাটাতে ব্যবসায়ীদের সরকার থেকে একাধিক বার আর্থিক সুবিধা দেয়ার পরও একটি ‘বিশেষ ব্যবসায়ী’ গোষ্ঠিকে ঋণ মওকুফের সুবিধা দেয়া হয়েছে। ৬১টি ব্যাংক শুধু গত বছরেই ঋণের সুদ মওকুফ করেছে ৪ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা। এ ঋণ মওকুফের তালিকায় পরিমাণের শীর্ষে রয়েছে রাষ্ট্রায়াত্ব ছয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংক। সোমবার প্রকাশিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, তফসিলভুক্ত ব্যাংকগুলো প্রাণঘাতী মহামারি করোনা শুরু হওয়া ২০২০ সালে মওকুফ করে চার হাজার ৯২১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। অন্যদিকে ২০১৯ সালে মওকুফ করা সুদের পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৬৩৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকা, ২০১৮ সালে ২ হাজার ২৩৬ কোটি ২৭ লাখ টাকা ও ২০১৭ সালে ১ হাজার ৯০০ কোটি ৯৭ লাখ টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২১ সালে ব্যাংকগুলো সুদ মওকুফ করেছে ৪ হাজার ৮৭৭ কোটি ২১ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মওকুফ করা সুদের পরিমাণ ৩ হাজার ৩৭০ কোটি ৯৪ লাখ টাকা, বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ১২২ কোটি ১৪ লাখ টাকা, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ১ হাজার ৩৫০ কোটি ২০ লাখ টাকা এবং বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ৩৩ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। আর ২০২০ সালে ৪ হাজার ৯২১ কোটি ৫৭ লাখ টাকার মওকুফ করা সুদের মধ্যে সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ২ হাজার ৯৮৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকা, বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ৭০৫ কোটি ৬৭ লাখ টাকা, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ১ হাজার ২১৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা, বিদেশি ব্যাংকগুলোর ১০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।
আরো দেখা গেছে, ২০১৯ সালে ৩ হাজার ৬৩৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকার মওকুফকৃত সুদের মধ্যে রাষ্ট্রপরিচালিত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ২ হাজার ২১৬ কোটি ৭১ লাখ টাকা, বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ৩৬৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকা, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ১ হাজার ৪০ কোটি ৮৪ লাখ টাকা ও বিদেশি ব্যাংকগুলোর ১২ কোটি ৬১ লাখ টাকা।
ব্যাংকিং কোম্পানি আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক গত বছরের ৭ অক্টোবর এক নির্দেশনায় জানায়, প্রতিটি ব্যাংক তাদের নিজস্ব নীতিমালার আলোকে সুদ মওকুফ করতে পারবে, তবে আসল মওকুফ করতে পারবে না। আর সহায়ক জামানতের (কোলেটারেল সিকিউরিটি) বাজারমূল্য ঋণের অঙ্কের চেয়ে বেশি হলে সে ক্ষেত্রে গ্রাহকদের সুদ মওকুফ-সুবিধা দেওয়া যাবে না। সে নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজন মোতাবেক সুদ মওকুফ করে আসছে। কোনো কোনো ব্যাংক শ্রেণিকৃত ঋণের কিংবা মামলাধীন ঋণের স্থগিত সুদের অর্ধেক মওকুফ করে এবং ক্ষেত্রবিশেষে স্থগিত সুদের পুরোটাই মওকুফ করে দেয়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘অধিকাংশ ব্যাংকের মালিক ও খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে এক ধরনের বিশেষ সম্পর্ক দেখা যায়। কিছু ব্যক্তি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের পদে আছেন ও তারাই শিল্পমালিক হিসেবে ঋণ গ্রহণ করেন। এভাবেই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে ঋণগ্রহীতাদের যোগসাজশে বিশেষ গোষ্ঠী সুদ মওকুফের সুবিধা নেয়। যার ফলে অনেক ব্যাংক দুর্বল হচ্ছে।’
সুদ মওকুফের প্রবণতা বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ঋণগ্রহীতাদের ব্যবসা চলমান থাকলে কোনো অবস্থাতেই ঋণ মওকুফ করা উচিত নয়। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যতীত যেন কোনো বিশেষ গোষ্ঠী ঋণের সুদ মওকুফ না পায়, সেদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের নজরদারি বাড়াতে হবে।’
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন এ বিষয়ে বলেন, ‘যে প্রতিষ্ঠান মানুষের সঞ্চিত আমানত থেকে ঋণ দিয়ে সুদ আদায় করতে পারে না এবং শেষ পর্যন্ত মাফ করে দেয়, সেইসব প্রতিষ্ঠান কাদের ঋণ মওকুফ করে তা নিয়ে প্রয়োজনে বিশেষ তদন্ত হতে পারে। পরবর্তী সময়ে ঋণ বিতরণ ও আদায়ে স্বচ্ছতা ও কৌশলগত বিষয়ে নজরদারি রাখা দরকার।’
ব্যাংকের ৪৮৭৭ কোটি টাকা সুদ মওকুফ পেলেন ‘বিশেষ ব্যবসায়ীরা’
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ