নিরঞ্জন রায় : আমার এক সময়ের সহকর্মী এবং একজন ভালো ব্যাংকার অনেক পরিশ্রম করে নিজ যোগ্যতাবলে একটি বেসরকারি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী বা ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। আমি যখন তার সঙ্গে একটি ব্যাংকে কাজ করতাম তাকে তখন খুব পরিশ্রমী এবং অভিজ্ঞ হিসেবেই পেয়েছি। জেনে, বুঝে এবং ফলাফল সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে দায়িত্ব পালন করার মতো গুণাবলি তার মধ্যে দেখেছি। তার সঙ্গে আমার খুবই ভালো সম্পর্ক ছিল এবং এখনও আছে। বছর কয়েক আগে কানাডা বেড়াতে এলে অনেক ব্যস্ততার মাঝেও তিনি আমার সঙ্গে ভালো একটা সময় কাটিয়েছিলেন।
দেশের ব্যাংকিং খাতের চ্যালেঞ্জ, অব্যবস্থাপনা এবং সম্ভাবনার অনেক বিষয় নিয়ে বেশ খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। আমি কাছে থেকে যতটুকু দেখেছি তাতে তিনি একজন সৎ এবং পেশাদার ব্যাংকার। যদিও সততা কারও বিশেষ গুণাবলি নয়, কেননা প্রতিটি মানুষ সৎ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের সমাজে অসততা যেভাবে বিস্তার লাভ করেছে, সেখানে সততা একটা বিশেষ গুণাবলি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে গেছে।
আমার এক সময়ের সেই সহকর্মী এমডি হিসেবে যে ব্যাংকের হাল ধরেছিলেন, সেই ব্যাংকও বেশ খারাপের দিকে চলে গিয়েছিল। সেই এমডির অক্লান্ত পরিশ্রম এবং পেশাদারির গুণেই ব্যাংকটি খারাপ অবস্থা থেকে বেশ ভালো অবস্থানের দিকে চলে এসেছিল। কিছুদিন আগেই তার এমডির গত মেয়াদের শেষ দিন ছিল। তার নিয়োগ নবায়ন হবে কি না, সে ব্যাপারে পরিচালনা পর্ষদ আগে থেকে তাকে কিছুই জানায়নি। যেহেতু তার ব্যাংক পরিচালনায় সন্তোষজনক ভূমিকা ছিল, পরিচালনা পর্ষদ সন্তুষ্ট ছিল, অধিকাংশ সহকর্মীও খুশি ছিলেন এবং তার বয়সও কম, তাই তার প্রত্যাশা ছিল এমডি নিয়োগ নবায়ন হবে। বিশেষ করে তার পুনর্নিয়োগের বিষয়ে বোর্ড থেকে নেতিবাচক কিছু না বলায় তিনি ধরেই নিয়েছিলেন তার নিয়োগ নবায়ন হবে, যা খুবই স্বাভাবিক। এ ধারণা থেকে তিনি প্রতিদিনের মতো আগের মেয়াদের শেষ দিনে অফিসে গিয়েছিলেন। কিন্তু দিন শেষে দেখলেন যে তার নিয়োগ নবায়ন হয়নি।
একটি ব্যাংকের এমডির পদ থেকে আমার সেই পরিচিত ব্যাংকার একাই যে এভাবে বিদায় নিয়েছেন, তেমন নয়। বছর দুয়েক আগে আমার আরেক সহকর্মীও একটি বেসরকারি ব্যাংকের এমডির দায়িত্ব সফলভাবে পালন শেষে এভাবেই বিদায় হয়েছিলেন। কয়েক মাস আগে দেশের ব্যাংকিং খাতের আরেকজন এমডি আমার কর্মরত এক ব্যাংকে এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তারও বদ্ধমূল ধারণা ছিল তিনি পুনর্নিয়োগ পাবেন এবং সেই ভেবে শেষ দিন বিকাল ৫টা পর্যন্ত অফিস করে আকস্মিক জানতে পারেন তার পুনর্নিয়োগ হয়নি। যদিও ব্যাংকটির অধিকাংশ সহকর্মীর কাছে সেই এমডি খুবই অজনপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন, কিন্তু সেটি একটি ভিন্ন বিষয়।
এভাবে ব্যাংকের এমডিকে আকস্মিক বিদায় করার দৃষ্টান্ত দিতে গেলে তালিকা অনেক লম্বা হয়ে যাবে এবং লেখার স্থান সংকুলান হবে না। মূল কথা হচ্ছে, বেশ কয়েক বছর ধরে দেশের ব্যাংকিং খাতে একটা প্রবণতাই হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, ব্যাংকের বর্তমান এমডিকে এক ধরনের ধোঁয়াশার মধ্যে রেখে তার এমডি নিয়োগ নবায়নের বিষয়টি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ঝুলিয়ে রেখে তাকে বিদায় করা হয়। সেই সঙ্গে নতুন কাউকে এমডি হিসেবে নিয়োগ বা ভারপ্রাপ্ত এমডি বানিয়ে দেওয়া হয়। একটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীকে এভাবে বিদায় করা কোনোভাবেই পেশাদার মানের পর্যায়ে পড়ে না এবং এটি ব্যাংকের সুশাসন বা করপোরেট গভর্ন্যান্সের পরিপন্থি।
ব্যাংক একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হলেও অন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ব্যাংকের এমডির গুরুত্ব অনেক বেশি। কারণ ব্যাংক শুধু জনগণের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে ব্যবসাই করে না, সেই সঙ্গে জনগণের অর্থের জিম্মাদারও বটে। তা ছাড়া ব্যাংক এমন একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান; যাকে দেশি এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনের একাধিক আইন ও বিধিবিধান মেনে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। এমনকি দেশ এবং দেশের বাইরের একাধিক নিয়ন্ত্রক সংস্থার অধীনে থেকেও কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। যেমন- দেশের অভ্যন্তরের বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানি, স্টক এক্সচেঞ্জসহ অনেক সংস্থার নিয়ন্ত্রণ মেনে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। একইভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স, ব্যাসেল কমিটিসহ অন্য অনেক নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিধিবিধানও মেনে চলার বাধ্যবাধকতা আছে। তাছাড়া একটি ব্যাংক বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যাংক বা পিয়ার গ্রুপের সঙ্গে লেনদেনে অংশ নিয়ে থাকে; যেজন্য একটি মানদণ্ড বজায় রাখতে হয়। এ রকম অনেক গুরুদায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার সক্ষমতা অর্জন করতে হয় একটি ব্যাংকের এমডিকে। এ কারণেই একটি ব্যাংকের এমডি হওয়া সহজ কথা নয়। শুধু তাই নয়, একজন এমডির দেশের অর্থনীতি, মুদ্রানীতি এবং এমনকি বিশ্বের অর্থনীতির ও মানি মার্কেটের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকতে হয়। উন্নত বিশ্ব তো বটেই, অনেক উন্নয়নশীল দেশের ব্যাংকের এমডিরা দেশের সরকার এবং অর্থ মন্ত্রণালয়কে সংকটকালে পরামর্শ এবং সুপারিশ প্রদান করে থাকেন।
দুর্ভাগ্যজনক হলো, আমাদের দেশের ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা নিজেদের সে পর্যায়ে নিতে পারেননি। তাছাড়া সমগ্র বিশ্বেই ব্যাংক খুবই স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত। ব্যাংকসংক্রান্ত সাধারণ একটি খবরও খুবই সতর্কতার সঙ্গে সরবরাহ করা হয়। এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের এমডি নিয়োগ যখন খুশি তখন এবং যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে হওয়া উচিত নয়। ব্যাংকিং সেক্টর পরিচালনা এবং পরিকল্পনা জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে একটি ব্যাংকের এমডি নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন।
ব্যাংকের এমডি পরিবর্তনের ঘটনা একটি মূল্যসংবেদনশীল তথ্যও বটে। কেননা একটি ব্যাংকের এমডি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেই ব্যাংকের ব্যবসা এবং বিনিয়োগ কার্যক্রমেও ব্যাপক পরিবর্তন হতে পারে। একটি ব্যাংকের নন-পারফর্মিং এমডির প্রস্থানের সংবাদে সেই ব্যাংকের আমানতকারীরা তাদের আমানত রাখতে বেশি নিরাপদ বোধ করবেন। ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা চালিয়ে যেতে আগ্রহী হবেন এবং শেয়ার মার্কেটের বিনিয়োগকারীরা বেশি বেশি শেয়ারে বিনিয়োগ করে থাকেন। একইভাবে যদি একটি ব্যাংকের একজন ভালো পারফর্মিং এমডি চলে যান, তাহলে দেখা যাবে যে উল্টা ফল হয়েছে। অর্থাৎ ভালো এমডি চলে যাওয়ার খবরে অনেক আমানতকারী তাদের সঞ্চয় উঠিয়ে নিতে চেষ্টা করবেন, ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার চিন্তা করবেন এবং সেই ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডাররাও তাদের শেয়ার বিক্রি করে দিতে চেষ্টা করবেন।
এ কারণেই একটি ব্যাংকের এমডি পরিবর্তনের সংবাদ অনেক আগে থেকেই জানানোর বাধ্যবাধকতা থাকে। যে ক্ষেত্রে এমডি নিজে পদত্যাগ করেন, সেটি একটি ভিন্ন প্রেক্ষাপট। তারপরও যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে বিষয়টি ম্যানেজ করতে হয়। উন্নত বিশ্বে বিষয়টি কঠোরভাবে মেনে চলা হয়। আমাদের দেশে সে অনুশীলন এখনও সেভবে শুরু হয়নি। কিন্তু এটা হওয়া প্রয়োজন অনতিবিলম্বে।
একটি ব্যাংকের এমডি নিয়োগ এবং পরিবর্তনের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। এমডি নিয়োগ এবং অপসারণের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটা সার্কুলার আছে। কিন্তু সেই সার্কুলারে শুধু এমডি পদে নিয়োগের জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা, নিয়োগের মেয়াদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের বিষয় উল্লেখ আছে। এমডির উত্তরসূরি নির্বাচন, যাকে ব্যাংকিং পরিভাষায় এমডির সাকসেশন প্ল্যান বলা হয়, সে রকম কোনো কিছুই বাংলাদেশ ব্যাংকের সেই সার্কুলারে নেই। এ কারণেই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এমডিদের চলতি মেয়াদের শেষ দিন পর্যন্ত আশা-নিরাশার দোলায় রেখে নীরবে বিদায় করার সুযোগ পায়। এভাবে একজন এমডিকে বিদায় করা সেই ব্যাংকের জন্য যেমন ভালো নয়, তেমনি দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য ভালো ফল বয়ে আনে না।
প্রতিটি ব্যাংকের এমডি নিয়োগের ব্যাপারে বিস্তারিত পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন; যেখানে স্পষ্ট করে যে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ থাকতে পারে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ১. একটি ব্যাংকের পরবর্তী এমডি কীভাবে নিয়োগ করা হবে তা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকা; ২. অগ্রাধিকার দিতে হবে ব্যাংকের অভ্যন্তর থেকে উপযুক্ত কাউকে এমডি নির্বাচনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করা; ৩. যদি ব্যাংকের ভেতর থেকে উপযুক্ত কাউকে না পাওয়া যায় এবং এক্ষেত্রে যদি ব্যাংকের বাইরে থেকে এমডি নিয়োগ করতে হয়, তাহলে সে পরিকল্পনা অন্তত দুই বছর আগে থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বিএসইসিকে জানিয়ে রাখতে হবে এবং ৪. যদি বর্তমান এমডির নিয়োগ নবায়ন করা না হয়, তাহলে সেটি অন্তত ছয় মাস আগে বাংলাদেশ ব্যংক এবং বিএসইসিকে জানিয়ে রাখতে হবে। মোট কথা, ব্যাংকের এমডি নিয়োগের ক্ষেত্রে ইন্ডাস্ট্রিব্যাপী সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন, যা প্রতিটি ব্যাংক মেলে চলবে। দেশের ব্যাংকিং খাতের বৃহত্তর স্বার্থে বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখবে এবং এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নেবেÑএই আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস।
লেখক: সার্টিফায়েড অ্যান্টিমানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা