অর্থনৈতিক ডেস্ক: দেশে জুলাই-আগেস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ব্যাংক খাতে তারল্য নিয়ে ব্যাপক হই চই শুরু হয়। মূলত এস আলমের নিয়ন্ত্রণাধীন কয়েকটি শরিয়াহ পরিচালিত ব্যাংকসহ প্রায় দেড় ডজন ব্যাংক নগট টাকার সংকটে পড়ে। কিন্তু গত জুন শেষে ব্যাংক খাতে ব্যাপক উদ্বৃত্ত তারল্য ছিল। ওই সময়ে ব্যাংকগুলোর উদ্বৃত্ত তারল্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদার প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
দেশের অর্থনীতির প্রধান কয়েকটি খাত নিয়ে প্রকাশিত তথ্য বলছে, গত জুন পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর মোট তারল্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৭০ হাজার ৬১১ কোটি টাকা। আর সর্বনিম্ন তারল্য থাকা দরকার ৩ লাখ ৪ হাজার ৮৪৪ কোটি টাকা। সেই হিসাবে ব্যাংকগুলোর কাছে জুন পর্যন্ত বাড়তি তারল্য রয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকা। আবার ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর কাছে তারল্য ছিল ৪ লাখ ৭৩ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা। তা গত জুনে এসে হয়েছে ৫ লাখ ৭০ হাজার ৬১১ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকে তারল্য বেড়েছে ৯৭ হাজার ২০৭ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে ব্যাংক এশীয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আরফান আলী বলেন, গত আগেস্টে সরকারের পালা বদলের পর ব্যাংক খাতে সংকট নিরসনে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি এক প্রকার অস্থিরতার মধ্য দিয়ে গেছে। এমন অবস্থায় বিনিয়োগ কমেছে। এতে উচ্চ সুদের হার এবং বিনিয়োগ করতে নানা হিসাব নিকাশ-করে ঋণ নেন ব্যবসায়ীরা। সবমিলিয়ে বিনিয়োগ কম হওয়ায় ব্যাংকে তারল্য বেড়েছে। তবে কয়েকটি ব্যাংকের তারল্য সংকট এখনো রয়েগেছে। সব মিলিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়লে ঋণ বেশি নেবেন ব্যবসায়ীরা। তখন বিনিয়োগে বাড়বে। ফলে তারল্য কমে আসবে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী গত জুনে সরকারি ব্যাংকগুলোর তারল্য ছিল এক লাখ ৬৬ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা। সর্বনিম্ন তারল্য প্রয়োজন ছিল ৮ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা। সেই হিসাবে উদ্বৃত্ত ৮৮ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা। গত জুনে বেরসরকারি ব্যাংকগুলোর তারল্য ছিল ৩ লাখ ১৪ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকা। তারল্য প্রয়োজন ছিল ১ লাখ ৭০ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা। সেই হিসাবে উদ্বৃত্ত ১ লাখ ৪৩ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর তারল্য গত জুনে ছিল ২ হাজার ১১৩ কোটি। প্রয়োজন ছিল ২ হাজার ১৭৫ কোটি। সেই হিসাবে ঘাটতি ৬২ কোটি টাকা। বিদেশি ব্যাংকগুলোর কাছে গত জুনে তারল্য ছিল ৪৮ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা। এসব ব্যাংকের প্রয়োজনীয় তারল্য ১৫ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা। সেই হিসাবে উদ্বৃত্ত রয়েছে ৩৩ হজার ৯৭ কোটি। আর ইসলামী ব্যাংকগুলোর গত জুনে তারল্য ছিল ৩৭ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা। তারল্য প্রয়োজন ছিল ৩৭ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪৩৩ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুন মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ২ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার। যা তার আগের অর্থ বছরের জুনের তুলনায় ১১ দশমিক ১৩ শতাংশ বেশি। আর গত অর্থ বছরে মোট রেমিট্যান্স এসেছে ৩০ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার। যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ২৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ বেশি। এদিকে গত অর্থ বছরে বাংলাদেশ ব্যাংক ৫০৩ মিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। গত জুনে প্রতি ডলারের সর্বোচ্চ রেট ছিল ১২২ টাকা ৭৭ পয়সা। যা তার আগের বছর একই সময়ে ছিল ১১৮ টাকা। এছাড়া গত জুন শেষ মোট রিজার্ভ ছিল ৩১ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২৪ সালের জুনে ছিল ২৬ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, গত এক বছরে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে। আবার বিভিন্ন বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ আসায় রিজার্ভ বেড়েছে। আর হুন্ডি কমায় ডলারের ওপর চাপ কমেছে। সবমিলে সম্প্রতি ডলারের বাজার স্থিতিশীল হয়েছে। এটা অর্থনীতির জন্য একটা সুবজ সংকেত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, গত অর্থ বছরের জুলাই থেকে মে সময়ে সঞ্চয়পত্রের বিক্রির স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৬৮৬ কোটি টাকা। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৩ হাজার ৪২ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা। আর ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের জুন থেকে মে পর্যন্ত সময়ে সরকারের নিট ঋণ দাড়িয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা। যা তার আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১ লাখ ৬ হাজার ৭১৪ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে উন্নতি দেখা গেছে। গৃহীত পদক্ষেপ শতভাগ বাস্তবায়ন হলে তার ইতিবাচক ফলাফল আরও বেশি দৃশ্যমান হবে। এখন ব্যাংকগুলোর তারল্য বেড়েছে। একসময় তারল্য নিয়ে কত নেতিবাচক ঘটনা ঘটেছে। সামনে বিনিয়াগ বাড়লে অর্থ উদ্বৃত্ত কমে আসবে এমন প্রত্যাশা করা যায়। অপরদিকে রিজার্ভ বেড়েছে। ডলারের বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরেছে। বাজার ভিত্তিক রেট করায় ডলার মার্কেট ভাইব্রেন্ট হচ্ছে।
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ