নিজস্ব প্রতিবেদক : খেলাপি ঋণ নবায়নের নীতি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর হাতে ছেড়ে দেওয়া ঠিক হয়নি-এমন মন্তব্য করেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা। তাদের মতে, এতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ওপর ঋণখেলাপিদের চাপ ভয়ানকভাবে বেড়ে যাবে। আগে যে চাপ সামাল দিত কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন সেটি সামাল দিতে হবে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও পরিচালকদের। এই চাপের বিপরীতে সুযোগ নেবে ব্যাংক পরিচালকরা। তারা নিজেদের ঋণ সর্বোচ্চ সুবিধা নিয়ে নবায়নের সুযোগ পাবে। তাদের পছন্দের গ্রাহকরাও এই সুযোগ পাবেন। ভালো গ্রাহকরা বঞ্চিত হবেন। সবমিলিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ওপর রাজনৈতিক চাপ বেড়ে যাবে। ফরে ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়বে। তাদের আরও অভিমত-বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের যে সংস্কৃতি বেড়ে উঠেছে তা মোকাবিলা করা ব্যাংকগুলোর পক্ষে সম্ভব নয়। এটি মোকাবিলা করতে হবে রাষ্ট্রীয়ভাবে। যেটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে সম্ভব। বাণিজ্যিক ব্যাংকের পক্ষে সম্ভব নয়। ব্যাংকগুলোর যে দুরবস্থা এই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকির বিষয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের হাতে ছেড়ে দেওয়া একেবারেই ঠিক হয়নি। প্রসঙ্গত, সোমবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি ঋণ নবায়ন ও পুনর্গঠনের বিষয়ে একটি সার্কুলার জারি করেছে। এতে খেলাপি ঋণ নবায়ন ও পুনর্গঠনের নীতিমালা ও তা বাস্তবায়ন করার ক্ষমতা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পর্ষদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতিমালায় কি কি থাকবে সে বিষয়ে বেশকিছু শর্ত আরোপ করে দিয়েছে। এতে খেলাপি ঋণ নবায়নের ডাউন পেমেন্ট জমা দেওয়ার হার কমানো হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে ঋণ পরিশোধের মেয়াদ। কিছু ঋণের মেয়াদ ৫০ শতাংশ সময় পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। খেলাপি ঋণ পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে কোনো ডাউন পেমেন্ট দিতে হবে না বলে উল্লেখ রয়েছে। অথচ আগে খেলাপি ঋণ নবায়নের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব নীতিমালা করত। এগুলো বাণিজ্যিক ব্যাংক বাস্তবায়ন করলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর এর চূড়ান্ত অনুমোদন দিতেন। এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তা শক্ত হাতে মোকাবিলা করতে হবে। যেটা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পক্ষে সম্ভব নয়। কেননা, ব্যাংকের পরিচালকরাই বড় ঋণগ্রহীতা। এই নীতি প্রণয়নের ক্ষমতা ব্যাংকের হাতে ছেড়ে দেওয়ার ফলে পরিচালকরা তাদের সুবিধামতো নীতিমালা করবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ ধরনের নীতি স্ববিরোধী। এতে খেলাপি ঋণের প্রবণতা আরও বেড়ে যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমানে ব্যাংক খাতে একটি বড় সমস্যা হচ্ছে খেলাপি ঋণ ও ঋণ পরিশোধ না করা। যে কারণে এটি নিয়েই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে রাজনৈতিক পর্যায়ে যত আলোচনা। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের হাত থেকে আগ বাড়িয়ে ব্যাংকগুলোর হাতে ছেড়ে দেওয়া একেবারেই ঠিক হয়নি। এতে ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ বাড়বে। আগে যে চাপ কেন্দ্রীয় ব্যাংক মোকাবিলা করত সেটি এখন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে করতে হবে। যেটি সামাল দেওয়া তাদের পক্ষে বেশ কঠিন। একই সঙ্গে এই চাপ মোকাবিলা করতে গিয়ে ব্যাংকগুলোর সুশাসন ব্যবস্থা নষ্ট হবে। খেলাপি ঋণ সহজভাবে নবায়ন হবে। ফলে খেলাপি ঋণের প্রবণতা কমবে। কিন্তু ঋণ আদায় হবে না। এতে ব্যাংকগুলো নতুন সংকটে পড়বে। একটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বলেন, খেলাপি ঋণ নবায়ন, ঋণখেলাপিদের নতুন ঋণ দেওয়া, ঋণের সুদ মওকুফের বিষয়ে আমরা সব সময়ই চাপে থাকতাম। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা আমাদের ওই চাপ থেকে সুরক্ষা দিত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দোহাই দিয়ে চাপ মোকাবিলা করতে পারতাম। এখন খেলাপি ঋণ নবায়নের নীতিমালা ব্যাংকের হাতে ছেড়ে দেওয়ার ফলে আমাদের ওপর চাপ অনেক বেশি বেড়ে যাবে।

























