সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা : বেড়েই চলেছে মধ্যবিত্তের বোঝা। অর্থনীতির বেহাল দশার সঙ্গে দোসর এখন উচ্চ মূল্যস্ফীতি। দেশে নানা প্রকার সংকট আছে, তবে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ বাড়িয়েছে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি। বার্ষিক মূল্যস্ফীতির হার ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৮.৭৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এটি তিন মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির হার, যা খাদ্যদ্রব্যের উচ্চ মূল্যের দ্বারা চালিত হয়েছে। নিত্যপণ্যের বাজার বহুবছর ধরেই লাগামহীন। তবে সাম্প্রতিককালে সরকার যখন এক লাফে জ্বালানি তেলের দাম বিভিন্ন স্তরে প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়িয়েছে, গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে এবং বিদ্যুতের দাম মাসে মাসে বাড়িয়ে চলেছে তখন বাজার একদম বেসামাল হয়ে পড়েছে। বেসামাল হয়েছে ডলার সংকটের কারণেও, কারণ সরকার আমদানি নিরুৎসাহিত করছে এবং প্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানি করতে এলসি খোলায় সমস্যায় পড়ছে।
প্রতিবছর রমজান এলে বাজার চাঙ্গা না হয়ে অস্থির হয়। এবার রমজানে নিত্যপণ্যের বাজার তুলনামূলকভাবে বেশি অস্থিতিশীল হবে, সেটাও সবাই আন্দাজ করছিলেন। গণমাধ্যম বিষয়টির পূর্বাভাসও দিয়েছিল। অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকরাও বলছিলেন, সরকারও যে চেষ্টা করেনি তা নয়। কিন্তু কোনোটাই মানুষকে স্বস্তি দিতে পারেনি। ব্যবসায়ীরা বরাবরের মতোই আচরণ করছেন এবং মানুষও ভুগছে। সারাবিশ্বে, এমনকি পাশের দেশ ভারতেও, উৎসবে জিনিসপত্রের দাম কমে, বাংলাদেশে কেন বাড়ে? এমন প্রশ্নে ব্যবসায়ীরা নানাভাবে তাদের মতো করে উত্তর দিবেন। আসলে বাজারে একটা একচেটিয়া ব্যবসায়ী রাজত্ব চলছে এবং তার কোনো প্রতিকার নেই কোথাও। আমাদের দেশে বেশকিছু দিন ধরেই দেশি বৃহৎ পুঁজি খুচরো ব্যবসায় ঢুকেছে। এখন মুড়ি, চানাচুর, মশলার ব্যবসায় একচেটিয়া রাজত্ব বড় বড় কোম্পানির। খুচরো বাজারে বহুজাতিকরা ঢুকলে যে অসংখ্য ছোট ছোট ব্যাপারী হাটে-বাজারে সবজি, চাল-ডাল বিক্রি করেন, তাদের অন্ন মারা যাবে, একথা সরকার তথা নিয়ন্ত্রকরা কখনো ভেবে দেখেননি। এখানে প্রতিযোগিতাটা অসংগঠিত ক্ষেত্রের ছোটখাটো দোকানের সঙ্গে দৈত্যাকার বিপণিদের। ফলে বাজার ব্যবস্থাপনায় সাধারণ মানুষের জন্য ভাবনাটা একেবারেই নাই হয়ে গেছে।
বড়রা খুচরো ব্যবসায় এলে যে পরিবর্তন ঘটে তা হলো—উন্নততর প্রযুক্তি যুক্ত হয় যার সাথে ছোট ব্যবসায়ী আর পেরে উঠে না এবং বাজারে বড় কোম্পানির সর্বগ্রাসী, বিকটাকার উপস্থিতি দৃশ্যমান হয়। সেটাই ঘটেছে বাংলাদেশে। সৃষ্টি হয়েছে এক অতিকায় একচেটিয়া ব্যবসা। অনেকদিন ধরেই খবর হচ্ছে যে, চিনির বাজারের ৭০ শতাংশ দুটি বড় গ্রুপের দখলে। তিন গ্রুপের দখলে ৭৫ শতাংশ ভোজ্যতেলের বাজার। ডিম এবং ব্রয়লার মুরগির বাজারেও তিন থেকে চারটি বড় কোম্পানির একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ। যেকোনো পরিস্থিতিতে এরা পুরো বাজার ব্যবস্থা অস্থির করে জাতিকে সংকটে নিক্ষেপ করতে পারে এবং সেটা তারা করছেও। পুরোনো দিনে আমরা যে মজুতদারির কথা শুনতাম সেটিরই আধুনিক সংস্করণ কিছু কোম্পানির এই একচেটিয়া ব্যবসা। আমাদের প্রতিযোগিতা কমিশন আছে, বাণিজ্যমন্ত্রণালয় আছে, ভোক্তা অধিকার দপ্তর আছে। কিন্তু কেউ কিছু করতে পারছে না বা করছে না। কোম্পানিগুলোই নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং তাদের সহযোগিতার জন্য ব্যবসায়ী মন্ত্রী, এমপিরা তো আছেনই। বলা যায়, বাজারের এই খেলায় খেলোয়াড় আর রেফারি একই দলের, ফলে গোল শুধু জনতাই খাচ্ছে। আমরা কথায় কথায় বলি, বাজার অর্থনীতি মানেই তাই। এখানে টিকে থাকতে হয়। কিন্তু বাজার অর্থনীতি কী নিয়ন্ত্রণহীন একচেটিয়া কারবারের কথা বলে? একচেটিয়া, সিন্ডিকেটের কারসাজির বিরুদ্ধে ব্যবসা। তা নিয়ে বড় বড় বাজার অর্থনীতির দেশেও কত কত আইন আছে। আমাদেরও আছে, কিন্তু শাস্তি হয় না কোনো অপরাধীর। আমরা জানতাম বাজার অর্থনীতি মেধা, প্রতিযোগিতা, পরিশ্রমকে উৎসাহ দেয়। বাংলাদেশে বাজার অর্থনীতি অতি মুনাফার লুটেরা দর্শন মজবুত করেছে।
বাজারে চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে জোগান না থাকলে চাহিদাজনিত মূল্যবৃদ্ধি ঘটতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে তা ঘটছে না। জোগানের কোনো সংকট নেই, যা আছে তা হলো ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের আগ্রাসী কর্মকা-। পণ্যের দাম ওঠানামার পেছনে একটা সিন্ডিকেট সবসময় কাজ করে। কিন্তু সেই সিন্ডিকেটের চেহারা-চরিত্র কী, সেটি জানা যায় না। সিন্ডিকেট বরাবর অধরাই থেকে যায়। কোনো পণ্যের দাম হঠাৎ বেড়ে গেলে মন্ত্রী-আমলাদের কিছু তৎপরতা দেখা যায়। কোথাও কোথাও ব্যবসায়ীদের আড়তে অভিযান চলে, কোনো কোনো খুচরা ব্যবসায়ীর জেল-জরিমানাও হয়। কিন্তু বড় কোম্পানি তথা রাঘব বোয়ালেরা আড়ালে থেকে যায়। মন্ত্রীরা এখন সবসময় আন্তর্জাতিক বাজারের উদাহরণ টানছেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে যেসব পণ্য দাম বাড়েনি, সেসব পণ্যের দাম কেন দেশি বাজারে বাড়ছে, তার কোনো ব্যাখ্যা দিচ্ছেন না। এই কারণেই সবাই মনে করে এখানে সিন্ডিকেটের কারসাজি আছে। আগে ছোট-বড় সব ধরনের ব্যবসায়ীরা আমদানি করতো। এখন গুটি কয়েক বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান সিন্ডিকেট করে পণ্য আমদানি করে এবং ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়ে দেয়। এবারের ডলার সংকটেও সুবিধা পেয়েছে সেই বড় কোম্পানিগুলোই। আপাতত বাজার, জোগান আর চাহিদা নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনায় ঢোকার প্রয়োজন নেই। কারণ মূল কথা হলো, বাজারে শক্তির দাপট আছে, বড় কোম্পানির শক্তি। মনে রাখা দরকার, ক্ষমতা কাঠামোর ভেতরে অবস্থান করে বাজারে প্রতিযোগিতার সংস্কৃতি নষ্ট করে, মানুষকে ঠকিয়ে, বঞ্চিত করে বড় ব্যবসায়ী হলে তা কোনো দেশের অর্থনীতিকে বড় করে না। আমাদের দেশে তাই হচ্ছে।
ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া রাজত্ব
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ