নিজস্ব প্রতিবেদক : সড়কের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার বিভিন্ন ঘটনা ব্যঙ্গচিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরে প্রতিবাদ জানিয়েছেন নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত একদল শিক্ষার্থী।
গতকাল রোববার বেলা ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত তারা ঢাকার রামপুরা ব্রিজে মানববন্ধনে দাঁড়িয়ে নানা ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন করেন এবং নিরাপদ সড়কের দাবিতে স্লোগান দেন। বাস মালিক ও কর্তৃপক্ষের নানা অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি নিরাপদ সড়কের দাবি নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের চিত্র তুলে ধরা হয় এসব ব্যঙ্গচিত্রে। এছাড়া নিরাপদ সড়ক এবং সারাদেশে শিক্ষার্থীদের জন্য ‘শর্তহীন হাফ ভাড়া’সহ নয় দফা দাবিতে শাহবাগে কফিন নিয়ে মিছিল করেছে একদল শিক্ষার্থী।
রামপুরায় মানববন্ধনের পর বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে পরবর্তি কর্মসূচি ঘোষণা করেন আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা খিলগাঁও মডেল কলেজের শিক্ষার্থী সোহাগী সামিয়া। তিনি বলেন, সম্প্রতি বাসচাপায় নিহত নটর ডেম শিক্ষার্থী নাঈম হাসান এবং রামপুরা একরামুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাঈনউদ্দিনসহ অন্যদের স্মরণে রামপুরা ব্রিজেই সোমবার দুপুর ১২টায় কালো ব্যাজ ধারণ ও মুখে কালো কাপড় বেঁধে অবস্থান নেবেন শিক্ষার্থীরা। এর আগে একই জায়গায় শনিবার সড়ক দুর্নীতিতে জড়িতদের উদ্দেশ্যে ‘লাল কার্ড’ প্রদর্শন করেছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের এই দলটি।
এর আগে কয়েক দিন রামপুরা ব্রিজ এলাকাসহ রাজধানীর বেশ কিছু এলাকায় শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে অবস্থান কর্মসূচি পালন করলেও এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর থেকে ধরন বদলে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
রোববার তাদের কর্মসূচিতে এক শিক্ষার্থীর হাতের ব্যঙ্গচিত্রে দেখা যায়, এক বাস মালিক প্রশাসনের এক লোকের গলায় দড়ি লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। একই ছবিতে শিক্ষার্থীদের স্লোগান দেওয়ার চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তারা স্লোগান দিচ্ছেন- ‘আমার ভাই মরল কেন? প্রশাসন জবাব চাই।’
আরেক ব্যঙ্গচিত্রে দেখা যায়, পুলিশ লাঠি হাতে বলছে, “আয়রে তোকে জাস্টিজে দিই, আমার মাথার ওপর কাহার হাত জানিস?” ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিজ’ বলে এক শিক্ষার্থীর স্লোগান দেওয়ার চিত্রও তুলে ধরা হয় সেখানে।
গত সোমবার রাতে রামপুরায় অনাবিল ও রাইদা পরিবহনের দুই বাসের প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ে শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনাও তুলে ধরা হয়েছে একটি প্রতিবাদী ছবিতে। সেখানে লেখা হয়েছে, “মা আজ রাতে বাসায় ফিরবো না।” আরেক চিত্রে দেখা যায়, পুলিশের ইউনিফর্ম পরা এক ব্যক্তি বলছেন, “কিছু দেখি নাই, কিছু শুনি নাই, কিছু বুঝি নাই, কিছু বলি নাই।”
গত বৃহস্পতিবার রামপুরা ব্রিজেই পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। পুলিশের ভাষ্য ছিল, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ‘বহিরাগতরা ঢুকে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে’ বলে তাদের কাছে খবর আছে। এর জবাবে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি সোহাগী সামিয়া শুক্রবার বলেছিলেন, “আমাদের ভেতরে যদি কোনো বহিরাগত ঢোকে, তারা যদি রাজনৈতিক সুবিধা নিতে চায়, তাহলে আমাদের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব পুলিশের। আমাদের যৌক্তিক দাবিতে বাধা দেওয়ার অধিকার নাই।”
সরকার বাসের ভাড়া বাড়ানোর পর থেকে শিক্ষার্থীরা আগের মত অর্ধেক ভাড়া দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। এর মধ্যে ২৪ নভেম্বর সিটি করপোরেশনের গাড়ির ধাক্কায় নটর ডেম কলেজের এক শিক্ষার্থী এবং ২৯ নভেম্বর রাতে রামপুরায় বাসের চাপায় এক এসএসসি পরীক্ষার্থী নিহত হওয়ায় আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়। পরিবহন মালিকরা ঢাকাসহ সব মহানগরে শিক্ষার্থীদের ‘হাফ’ ভাড়ার দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দিলেও আন্দোলনকারীরা বলছে, ‘হাফ’ ভাড়া চালু করতে হবে সারা দেশে এবং সকাল ৭টা থেকে রাত ৮টার বদলে তা হতে হবে ২৪ ঘণ্টার জন্য।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে শাহবাগে কফিন মিছিল : এদিকে নিরাপদ সড়ক এবং সারাদেশে শিক্ষার্থীদের জন্য ‘শর্তহীন হাফ ভাড়া’সহ নয় দফা দাবিতে শাহবাগে কফিন নিয়ে মিছিল করেছে একদল শিক্ষার্থী।
গতকাল রোববার বেলা পৌনে ১টার দিকে শাহবাগ মোড় থেকে ‘সাধারণ শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে এ বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। আধা ঘণ্টা পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে গিয়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ ও পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণার মাধ্যমে এ কর্মসূচি শেষ হয়।
বিক্ষোভ মিছিলে ‘আমার ভাই মরল কেন, প্রশাসন জবাব চাই’, ‘বিচার বিচার চাই, সড়ক হত্যার বিচার চাই,’ ‘জাস্টিস জাস্টিস, উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘আইন করে হাফপাস, দিতে হবে দিয়ে দাও’- ইত্যাদি স্লোগান দেন শিক্ষার্থীরা। রাজু ভাস্কর্যের সমাবেশ থেকে সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন ও প্রতিবাদী গানের আসর আয়োজনের কর্মসূচি দেওয়া হয়।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ইনজামুল হক বলেন, “নয় দফা দাবিতে আমরা গত কয়েকদিন যাবৎ আন্দোলন করছি। নিরাপদ সড়ক ও হাফ পাসের দাবিতে আজকে দেশের ১৮টি জেলায় বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। বরিশালে আমাদের শিক্ষার্থীদের বাধা দেওয়া হয়েছে।
” বৃষ্টির কারণে আজকে আমাদের কর্মসূচি সংক্ষিপ্ত করেছি। কিন্তু আমাদের আন্দোলন চলবে। আজকে আমরা রেল মন্ত্রণালয় ও নৌ মন্ত্রণালয়ে হাফ পাসের দাবিতে স্মারকলিপি প্রদান করব।”
পরবর্তী কর্মসূচির ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, “সড়ক ব্যবস্থায় আলোর পথ দেখানোর জন্য আগামীকাল আমরা শহীদ মিনারে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন কর্মসূচি পালন করব। পাশাপাশি সেখানে প্রতিবাদী গানের আসর হবে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে।”
ইনজামুল হক বলেন, “আমাদের দাবি ও আন্দোলন নিয়ে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। উনাদের এ বিষয়গুলো জাতির সামনে ক্লিয়ার করার অনুরোধ করছি।”
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবি হল-
১. বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো ড্রাইভারকে ফাঁসি দিতে হবে এবং এই বিধান সংবিধানে সংযোজন করতে হবে। ২. নৌপরিবহন মন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহার করে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে। ৩. ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলাচল বন্ধ ও লাইসেন্স ছাড়া চালকরা গাড়ি চালাতে পারবেন না। ৪. বাসে অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়া যাবে না। ৫. শিক্ষার্থীদের চলাচলে এমইএস ফুটওভারব্রিজ বা বিকল্প নিরাপদ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ৬. প্রত্যেক সড়কে দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় স্পিডব্রেকার দিতে হবে। ৭. সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্রছাত্রীদের দায়ভার সরকারকে নিতে হবে। ৮. শিক্ষার্থীরা বাস থামানোর সিগন্যাল দিলে থামিয়ে তাদের নিতে হবে। ৯. শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য নিঃশর্ত হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
ডিজেলের দাম ২৩ শতাংশ বাড়ানোর পর পরিবহন মালিকদের চাপে গত ৭ নভেম্বর সরকার বাসের ভাড়া ২৭ শতাংশ বাড়ায়। এর পর থেকেই বাসে অর্ধেক ভাড়া দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন করে আসছে শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে ২৪ নভেম্বর ঢাকা সিটি করপোরেশনের গাড়ির ধাক্কায় নটর ডেম কলেজের এক শিক্ষার্থী এবং তারপর রামপুরায় এক এসএসসি পরীক্ষার্থীর মৃত্যু হলে আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়।
এই প্রেক্ষাপটে ঢাকা পরিবহন মালিক সমিতি গত ৩০ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে ঢাকা মহানগরে শিক্ষার্থীদের ‘হাফ’ ভাড়ার দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেন। এরপর রোববার চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সংবাদ সম্মেলনে দেশের সব মহানগরে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বাসে ‘হাফ’ ভাড়া নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। বাস মালিকরা বলছেন, সকাল ৭টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বাসে অর্ধেক ভাড়া দিতে পারবে শিক্ষার্থীরা। সেজন্য যার যার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দেওয়া ছবিসব পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বা সরকারি ছুটির দিনে অর্ধেক ভাড়া প্রযোজ্য হবে না। মহানগর ছাড়া দেশের অন্য কোনো জেলা বা উপজেলায় কিংবা দূর পাল্লার বাসে হাফ ভাড়া নেওয়া হবে না। অন্যদিকে শিক্ষার্থদের দাবি, সারা দেশে ২৪ ঘণ্টার জন্য বিনাশর্তে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বাসে অর্ধেক ভাড়া নিতে হবে।
ব্যঙ্গচিত্রে সড়কে অব্যবস্থাপনার প্রতিবাদ, কফিন মিছিল
জনপ্রিয় সংবাদ