- আলমগীর খান
অনেক নাটকীয়তার পর স্বঘোষিত ‘শান্তিবাদী’ ও যুদ্ধবিরোধী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ইরানের ওপর হামলা চালালেন। নিজেকে সে প্রমাণ করলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টেদের মধ্যে শান্তির খোলস পরা এক অন্যতম যুদ্ধবাজ হিসেবে। মিডনাইট হ্যামার বা মধ্যরাতের হাতুড়ি নামের এই নারকীয় হামলাও নাকি শান্তির জন্য!
হামলার পরই আবার হুমকি দিলেন, এই বলে যে, ইরান যদি শান্তিচুক্তি না করে তো তাদের জন্য আরো বড় আঘাত অপেক্ষা করছে, আমেরিকার জন্য যা খুবই সহজ। বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রটি মধ্যপ্রাচ্যের একটি দুর্বল রাষ্ট্রের ওপর গভীর রাতে গোপনে হামলা করে সাফল্যের গৌরবে আত্মহারা। হামলার আহপর্যন্ত ট্রাম্প সবাইকে বলছিলেন ইরানকে দুই সপ্তাহের সময় দেওয়া হয়েছে, সবই ধোঁকা দেওয়ার উদ্দেশ্যে, তাদেরকে ফাঁদে ফেলার জন্য।
জর্জ বুশ যেভাবে গণবিধ্বংসী অস্ত্র বা ডব্লিউএমডি থাকার মিথ্যা অভিযোগ তুলে ইরাকে হামলা করে তাকে ধ্বংস করেছিলেন, ট্রাম্পও সেই একই স্ক্রিপ্ট অনুসরণ করছেন, তবে বুশের মত সরাসরি নয়, শান্তিবাদীর মুখোশ পরে। তাদের অভিযোগ- ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরি করে ফেলল বলে। ইরানে হামলার কাজটি শুরু করেছে ইসরায়েল আর তাকে পূর্ণতা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র ও বিপুল সামরিক শক্তিতে বলীয়ান হওয়া সত্ত্বেও ইসরায়েল-আমেরিকার এই মিথ্যাচার ও দ্বিচারিতার কারণ কী?
উভয়েরই প্রধান উদ্দেশ্য দিনদুপুরে বিশ মাস ধরে গাজায় সংঘটিত গণহত্যা থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া। দ্বিতীয় কারণ ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু উভয়েরই জনপ্রিয়তা যখন নিজ নিজ দেশে তলানিতে, তখন সেই ক্রমহ্রাসমান জনসমর্থন যুদ্ধের আতঙ্কের মাঝে টেনে তোলা।
বুশ বোমা মারতেন রাগ করে। ট্রাম্প মারেন ভালোবেসে। নেতানিয়াহু বলেন, যুদ্ধটা আত্মরক্ষার। আর জন বোল্টন তো আগেই শিখিয়ে রেখেছেন–‘ইরানকে বাঁচাতে হলে, আগে ধ্বংসযজ্ঞ চালাও।’
যুদ্ধের মাঝে আফিমের অনেক উপাদান থাকে। মার্ক টোয়েনের লেখা বিখ্যাত ছোটগল্প ‘ওয়ার প্রেয়ার’ বা যুদ্ধের প্রার্থনায় দেখানো হয়েছে খুবই শান্তিপ্রিয় জনগণকেও কীভাবে সহজেই যুদ্ধের উন্মাদনায় ডুবিয়ে দেওয়া যায়। ইসরায়েলে এখন নেতানিয়াহুর সমর্থন বেড়ে গেছে, ট্রাম্পও নিজ দেশে সেই চেষ্টা চালাচ্ছেন। তবে সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য গাজায় চলমান গণহত্যার কথা বিশ্ববাসীকে ভুলিয়ে দিয়ে ইসরায়েলের ফিলিস্তিন দখলের স্বপ্নপূরণের পথ পরিষ্কার করা। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার প্রশ্নে মধ্যপ্রাচ্য কার্যত দোদুল্যমান ভূমিকা রাখছে, আর অনেকগুলো আরব দেশকে ইতোমধ্যে মার্কিন-ইসরায়েল চক্র শক্তিহীন করে ফেলেছে। অন্যদিকে বিশ্বের সব রাষ্ট্র বলতে গেলে চুপ হয়ে দেখছে গাজায় চলমান গণহত্যা। ইরান সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।
গাজায় মার্কিন-ইসরায়েলি গণহত্যা ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে সোচ্চার ইরান। আমেরিকার এই হামলার পরও ইরানের পক্ষে শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সৈয়দ মোহাম্মদ মারান্ডি বলেছেন, গাজায় শহীদ শিশুদের তারা কোনোভাবেই ভুলবেন না। এখানেই পথের বাধা ইরানকে সরিয়ে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা। আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই হামলাকে যতই নাটকীয় ও ট্রাম্পের জন্য এক কঠিন মুহূর্তের সিদ্ধান্ত মনে হোক না কেন, এ পরিকল্পনা অনেক পুরনো। ট্রাম্পের সহযোগী খ্যাতিমান কূটনীতিক ও রিপাবলিক্যান পরামর্শদাতার লেখা ২০১৫ সালের চিত্রনাট্য অনুযায়ী এই হামলা সংঘটিত হচ্ছে।
জন বোল্টন একজন পুরনো ইরানবিদ্বেষী। অনেক বছর ধরে তিনি প্রকাশ্যে ইরানে হামলার জন্য ওকালতি করছেন। ২০০৫-২০০৬ সালে জর্জ ডব্লিউ বুশের আমলে তিনি ছিলেন জাতিসংঘে আমেরিকার প্রতিনিধি। ২০১৩ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ছিলেন আমেরিকার মুসলিমবিদ্বেষী অতিডানপন্থী থিঙ্কট্যাঙ্ক গেটস্টোন ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান। ২০১৮ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাকে নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেন। ইরানের সঙ্গে ওবামা আমলের পারমাণবিক চুক্তিটি বাতিলের জন্য তিনিই এপ্রিলে ট্রাম্পকে চাপ দেন এবং ১ মাসের মধ্যেই এতে সফল হন।
অশ্চর্যের নয় যে এই জন বোল্টনই ২০১৫ সালের ২৬ মার্চ ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে’ একটি চরম উগ্র ইরানবিরোধী উসকানিমূলক নিবন্ধ লিখেছিলেন যার শিরোনাম: “টু স্টপ ইরান’স বোম, বোম ইরান” (ইরানের বোমা তৈরি ঠেকাতে ইরানকে বোমা মারো) তবে আশ্চর্যের হলো আমেরিকার এরকম স্বনামধন্য একটি পত্রিকা নির্লজ্জভাবে এই লেখাটি ছাপে।
বারাক ওবামার উদ্যোগে সম্পাদিত পারমাণবিক চুক্তিটি নিয়ে অনেক বিষোদগার করে এই যুদ্ধবাজ কূটনীতিক লিখেন, “অপরিহার্য সত্য হলো, ইরান চুক্তিতে সই করে পারমাণবিক প্রকল্প থেকে সরে আসবে না। নিষেধাজ্ঞাও এর বিস্তৃত ও গভীর অবকাঠামো তৈরি ঠেকাতে পারবে না। তিক্ত সত্য হলো, ইসরায়েল কর্তৃক ১৯৮১ সালে ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের ওসিরাক রিঅ্যাক্টরে হামলা ও ২০০৭ সালে উত্তর কোরিয়ার সহায়তায় তৈরি সিরিয়ান রিঅ্যাক্টর ধ্বংসের মতো করে একটি সামরিক আক্রমণই কেবল প্রয়োজনীয় কাজটি সম্পন্ন করতে পারে। সময় খুবই অল্প, কিন্তু এটি এক হামলায় সফল হবে।
“অগ্রাধিকারের মধ্যে থাকতে হবে নাতাঞ্জ ও ফোরদো ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ স্থাপনা এবং আরাক হেভি ওয়াটার পারমাণবিক স্থাপনা। একইভাবে থাকতে হবে কম লক্ষণীয় কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ইসপাহানেরটি। হামলা করে ইরানের সমস্ত পারমাণবিক ইউরেনিয়াম রূপান্তর অবকাঠামো ধ্বংস করার প্রয়োজন নেই, কিন্তু পারমাণবিক শক্তি তৈরির মূল চাবিগুলো ভেঙে ফেলতে হবে। তা করা গেলে তাদের পরিকল্পনা তিন থেকে পাঁচ বছর পিছিয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্র এই ধ্বংসের কাজটি পুরোপুরি সম্পাদন করতে পারে। কিন্তু ইসরায়েল একাই দরকারি কাজটি করে ফেলতে পারে। এরকম একটা কাজে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির উত্থানকে যুক্ত করতে হবে যার লক্ষ্য হবে তেহরানে সরকার পরিবর্তন।”
ইরানবিদ্বেষে বোল্টন নেতানিয়াহুর সঙ্গে যৌথভাবে চ্যাম্পিয়ন হতে পারেন। ফ্রান্স ২৪-এ, ২৪ মে ২০১৯ মার্ক ডাওউ লিখেছেন (জন বোল্টন’স ডেঞ্জারাস ‘অবসেশন’ উইথ ইরান) , “২০১৭ সালে প্যারিসে পিপলস মুজাহেদিন অব ইরান নামের একটি ইরানবিরোধী সংস্থা (যা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের চোখেও একটি সন্ত্রাসী সংগঠন) কর্তৃক আয়োজিত একটি সম্মেলনে বোল্টন বক্তৃতা করেন। এই অনুষ্ঠানে তিনি ঘোষণা করেন যে, ইরানের ইসলামি প্রজাতন্ত্র ‘৪০তম জন্মবার্ষিকী পর্যন্ত টিকবে না।’ (এপ্রিল ১, ২০১৯)
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে বোল্টন পেন্টাগনকে বলেন ইরান আক্রমণের একটা সামরিক পরিকল্পনা করার জন্য–যা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ব্রিবতকর অবস্থায় ফেলে দেয়। ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ইরান ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ৪০তম বার্ষিকীতে হোয়াইট হাউজের অফিশিয়াল টুইটার অ্যাকাউন্টে আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, “আমার মনে হয় না আপনি আর বেশি জন্মবার্ষিকী উদযাপন করতে পারবেন।”
এখন শুধু দেখবার বিষয় বোল্টনের এই স্বপ্ন কতদূর পর্যন্ত পূরণ হবে আর ট্রাম্প-নেতানিয়াহুর এই মধ্যরাত্রিকালীন অবৈধ হামলা কোথায় শেষ হয়। মোহাম্মদ মারান্ডি সঠিকভাবেই এদেরকে পশ্চিমা দৈত্য হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন যারা কেবল যাকে-তাকে হুমকি দিয়ে চলেছে কেবল ‘পোড়াও পোড়াও পোড়াও’ (বার্ন, বার্ন, বার্ন) বলে।
তবে তেহরানকে পোড়ানোর এই ধোঁয়ায় গাজা আড়াল হলেই ট্রাম্প-নেতানিয়াহুর জয় নিশ্চিত হবে। বিশ্ববাসীর সামনে চ্যালেঞ্জ-আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত কর্তৃক চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী নেতানিয়াহু ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা যেন গাজায় সংঘটিত গণহত্যার দায় থেকে কিছুতেই ছাড়া না পায়। বিচারে ফাঁসির দড়ির দুঃস্বপ্ন যেন তাদেরকে সবসময় তাড়া করে ফেরে।
লেখক: কলামস্টি