নিজস্ব প্রতিবেদক : পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে বাজারে অন্যান্য পণ্যের দাম স্বস্তিদায়ক হলেও চার মাস ধরে চলা ভোজ্যতেলের সরবরাহ সংকট কাটেনি, বরং তীব্র হচ্ছে। মিলছে না বোতলজাত সয়াবিন তেল। এছাড়া চালের দামেও রয়েছে অস্বস্তি। গত বছর রোজা শুরুর আগে ও বর্তমান বাজারদর বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছর রোজা শুরুর আগেই নিত্যপ্রয়োজনীয় আটটি পণ্য যেমন: পেঁয়াজ, ছোলা, চিনি, ডাল, খেজুর, গরুর মাংস, রসুন ও আলুর দাম ৪ থেকে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছিল।
ওই বছর সয়াবিন তেল চিনি ও খেজুরের দাম বেড়েছিল অস্বাভাবিক হারে। সে তুলনায় এ বছর এখন পর্যন্ত চিনি, খেজুর, ডাল, পেঁয়াজ ও আলুর দাম বরং কম রয়েছে। এছাড়া ব্রয়লার মুরগি, ছোলা, আদা-রসুন, মসলা ও কাঁচা মরিচের মতো পণ্যগুলোর দাম স্থিতিশীল বা সামান্য কম বা বেশি হয়েছে। বিক্রেতারা বলছেন, বেশ কিছু পণ্যের ভরা মৌসুম, নতুন সরকারের শুল্কছাড়, পর্যাপ্ত আমদানির কারণে বেশিরভাগ পণ্যের দামে স্থিতিশীলতা আছে। যদিও প্রতি বছরের মতো চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম হওয়ায় বেগুন, লেবু, ধনেপাতার মতো পণ্যগুলোর দাম বেশি মনে হচ্ছে, যদিও সেটা প্রতি বছরই হয়। রাজধানীর সেগুনবাগিচা বাজারের আল্লার দান স্টোরের মুদি ব্যবসায়ী ইছাহাক আলী বলেন, শুধু তেলের সমস্যা না হলে এ বছরের বাজার একদম স্থিতিশীল বলা যেত। বরং গত কয়েক মাসের তুলনায় এখন জিনিসপত্রের দাম কম। কিছু পণ্যের সরবরাহ কমার কারণে ২-১ টাকা কম বা বেশি হচ্ছে, যেহেতু এখন মানুষ কিনছে বেশি। এটা দু-চারদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। বাজারে পণ্যের স্বস্তির কথা বলছেন ক্রেতা জেবুন্নেছা। তিনি বলেন, আগে রোজা শুরু হলেই যে হুলুস্থুল কাণ্ড পড়ে যেত, এটার দাম বাড়ে, ওটা বাড়ে, এমনটা এ বছর নেই। বরং এবার সবকিছুর দাম নাগালের মধ্যে মনে হচ্ছে।
এ বছর রমজানের বাজারে অস্থিরতার সবচেয়ে বড় কারণ বাজারে সয়াবিন তেলের মিলছে না বললেই চলে। এ সংকট শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই। অথচ ভোজ্যতেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো রোজার আগে তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। রোজা শুরুর আগে শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) বাজারে দেখা গেছে, ভোজ্যতেলের সংকট আরও প্রকট। সাত-আট দোকান ঘুরেও তেল মিলছে না। আবার সেসব দোকানে এক বা দুই লিটারের বোতলও নেই। ক্রেতাদের কিনলে পাঁচ লিটারের তেল কিনতে হচ্ছে। খোলা সয়াবিনের সরবরাহ থাকলেও ক্রেতাকে গুণতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। সরকার নির্ধারিত তেলের দাম ১৭৫ টাকা হলেও ২০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হতে দেখা গেছে খোলা তেল। মূলত বোতলজাত তেলের এই সংকট প্রায় চার মাস ধরে চলছে। নভেম্বরে এ সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছিল। এরপর সরকার সয়াবিন তেল আমদানিতে শুল্ক-কর কমায়। যাতে আগের চেয়ে প্রতি লিটারে ১১ টাকা কম খরচ হচ্ছে তেল আমদানিতে।
এরপরও আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কথা বলে লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছিল সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো। বাধ্য হয়ে গত ৯ ডিসেম্বর তাদের সঙ্গে সভা করে প্রতি লিটারে আট টাকা দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। দাম বাড়িয়ে নেওয়ার পরেও আবারও জানুয়ারি থেকে তেলের কৃত্রিম সংকট তৈরি করেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। নড়ে-চড়ে বসার জন্য সরকারের ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন ভোজ্যতেল সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে বসে। ওই সময় কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিরা দাবি করেন, তেলের কোনো সংকট নেই। বরং আগের চেয়ে সরবরাহ বেশি। এরপরও বাজারের চিত্র ভিন্ন হওয়ায় আবারও এক সপ্তাহ বাদে তেল সরবরাহকারীদের ডাকে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এবার কিছুটা সুর পাল্টে সংকটের কথা বলে কোম্পানিগুলো। সভায় টিকে গ্রুপের পরিচালক শফিউল আতহার তসলিম তখন বলেন, তেল সরবরাহে কিছুটা বিঘ্ন ঘটেছে। কারণ সরকার এর আগে মূল্য কমিয়ে দাম নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল, এজন্য কিছু কমানো হয়। তসলিম বলেন, বিদেশ থেকে সয়াবিন আসতে ৫০-৬০ দিন ও পাম তেল ১০-১২ দিন সময় লাগে। বর্তমানে সবাই গতানুগতিক সরবরাহ করছে।
এমনকি সরকারি দরের চেয়ে ১৫ টাকা কম দামে পাম তেল বিক্রি হচ্ছে। রোজার জন্য কোম্পানিগুলো দ্বিগুণ এলসি করেছে। সেপ্টেম্বরের এলসি অক্টোবরে করা হয়েছে। এসব পণ্য ডিসেম্বরে আসার কথা ছিল। কিন্তু ব্রাজিলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তা দেরি হয়েছে। রোজার আগে সব তেল চলে আসবে। এর আগে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন বলেছিল, পবিত্র রমজান সামনে রেখে বাজারে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি ভোজ্যতেল সরবরাহ করা হচ্ছে। তাই রমজানে বাজারে ভোজ্যতেল সরবরাহে কোনো সংকটের আশঙ্কা নেই।

























