নিজস্ব প্রতিবেদক: বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া প্রতি ১০০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় ৪২ জনকেই নানা বৈষম্যের শিকার হতে হয়। তাঁদের মধ্যে ৫১ শতাংশ নারী এবং পুরুষ শিক্ষার্থী ৪৯ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হন তৃতীয় এবং চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীরা, যা প্রায় ৪০ শতাংশ।
এ বছরের মার্চ থেকে মে, তিন মাসব্যাপী পরিচালিত একটি জরিপের ফলাফলে এসব তথ্য জানিয়েছে বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশন। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এই শিক্ষার্থীরা নানা রকম মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। নেই কার্যকার কোনো ব্যবস্থা।
শনিবার (৩০ আগস্ট) অনলাইনে আয়োজিত বৈষম্যের শিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়। আঁচল ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পর দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বৈষম্যের অবস্থা বুঝতে সারা দেশের ১ হাজার ১৭৩ জন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীর তথ্য নিয়ে জরিপটি পরিচালনা করা হয়েছে।
জরিপে কারা অংশ নেন: জরিপে অংশগ্রহণকারী বৈষম্যের শিকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫৬ শতাংশ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন ১৯ শতাংশ এবং ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়ছেন মেডিকেল কলেজে। বৈষম্যের শিকার হওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষ এবং নারী শিক্ষার্থী উভয়ের অবস্থানই কাছাকাছি।
কারা বেশি দায়ী: জরিপ অনুযায়ী, সহপাঠীরাই সবচেয়ে বেশি বৈষম্যমূলক আচরণ করে, যা প্রায় ৫৮ শতাংশ। পরীক্ষায় ফলাফলের ক্ষেত্রে শিক্ষকের দ্বারা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন প্রায় ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী। এ ছাড়া শিক্ষকের খারাপ আচরণের শিকার হতে হয়েছে ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থীকে। লিঙ্গভিত্তিক কারণে ৩০ শতাংশ এবং ধর্মীয় বৈষম্যের শিকার হয়েছেন ১৯ শতাংশ শিক্ষার্থী। শারীরিক অক্ষমতার কারণে ৭ শতাংশ এবং জাতিগত পার্থক্যের কারণে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী। এ ছাড়া অর্থনৈতিক কারণে প্রায় ২৩ শতাংশ, শারীরিক অবয়বের কারণে ২৯ শতাংশ এবং রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থীর বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে। বৈষম্যের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে দায়ী করেছেন ৩২ শতাংশ শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীকে শিক্ষার্থী দায়ী করেন প্রায় ১৫ শতাংশ।
কোথায় বেশি বৈষম্য: জরিপে বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্যের জায়গাগুলো বিশ্লেষণ করেছে আঁচল ফাউন্ডেশন। দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে, যা মোট হিসেবের ৬০ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বা ডরমিটরিতে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন ১৯ শতাংশ শিক্ষার্থী, ক্যাম্পাসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ৩৭ শতাংশ এবং, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডায় বৈষম্যের শিকার ৩৮ শতাংশ শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহনে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন প্রায় ১৮ শতাংশ শিক্ষার্থী। এর বাইরে লাইব্রেরি, ক্যাফে, পরীক্ষার হলেও বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন শিক্ষার্থী। ক্যাম্পাসের বাইরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার ৩১ শতাংশ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে নারী শিক্ষার্থী ৪৮ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ এবং পুরুষ শিক্ষার্থী ৫০ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
বাড়ছে মানসিক সমস্যা: বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্যের শিকার ৯০ শতাংশই শিক্ষার্থীই মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে মানসিক সমস্যার বিভিন্ন ধরনের লক্ষণ দেখা গিয়েছে। ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বিষণ্নতার লক্ষণ অনুভব করছেন, উদ্বিগ্নতা অনুভব করেছেন ৪৯ শতাংশ, ৩০ শতাংশ ভুগছেন ঘুমের সমস্যায়। ২২ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন তাঁদের প্যানিক অ্যাটাকের তীব্রতা বেড়েছে। স্ট্রেস বা চাপ অনুভব করছেন ৪৭ শতাংশ। একাকিত্ব অনুভব করেছেন ৪৩ শতাংশ এবং ৪১ শতাংশ শিক্ষার্থী জানান, তাঁরা হীনম্মন্যতায় ভুগছেন।
এসব কারণে ঠিকমতো ক্লাস করতে পারছেন না ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী আর ক্লাস করেও পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারছেন না ৫১ শতাংশ শিক্ষার্থী।
প্রশাসনিক পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়: বৈষম্যের শিকার হওয়ার পর মাত্র ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেছেন। অন্যদিকে ৭৫ শতাংশই জানান যে তাঁরা কোনো ধরনের অভিযোগ দেননি। অভিযোগ দেওয়ার পর প্রশাসন সঠিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে বলে জানিয়েছেন ১১ শতাংশ শিক্ষার্থী। ৪৪ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় সহায়তা করলেও তাদের পদক্ষেপ ছিল অকার্যকর। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা সহায়ক ছিল না বলে জানিয়েছেন ১৭ শতাংশ শিক্ষার্থী।
মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিতে চান না শিক্ষার্থীরা: বৈষম্যের শিকার হয়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা, যেমন কাউন্সেলিং ও থেরাপি নিয়েছেন মাত্র ২২ শতাংশ শিক্ষার্থী এবং তাঁদের সমস্যাও কমেছে। তবে বাকি ৭৮ শতাংশই কোনো ধরনের সেবা গ্রহণ করেননি। সেবা না নেওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ যেমন, মানসিক সেবা সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকা, সামাজিক ট্যাবু বা লজ্জা, কোথায় সেবা পাওয়া যাবে, তা না জানা এবং আর্থিক সামর্থ্যের অভাবের কথা জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মেডিকেলের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সায়েদুল ইসলাম সায়েদ বলেন, জীবন কখনো একভাবে চলবে না। এটি মানতে হবে যে আনন্দের পাশাপাশি সমস্যাও আসবে। ভেঙে পড়লে চলবে না। মানসিকভাবে নিজেকে ঠিক মনে না হলে কোনো দ্বিধা না করে সাহায্য নিতে হবে। সমস্যাকে বাড়তে দেওয়া যাবে না। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও মানসিক সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
ছাত্র সংসদের প্রতি আহ্বান: ব্যক্তিপর্যায়ে বৈষম্যের ক্ষেত্রে কোনো আইন নেই উল্লেখ করেন ঢাকা বার অ্যাসোসিয়েশনের আইনজীবী হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, যেহেতু আইন নেই, সেহেতু বৈষম্য দূর করার কাজ আমাদের প্রত্যেকের। বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্য দূর করতে ছাত্র সংসদগুলো খুব শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে। আসন্ন নির্বাচনে পদপ্রার্থীরা এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে পারেন। শিক্ষার্থীদের একটি নিরাপদ ক্যাম্পাস তারা দিতে পারেন।
আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রস্তাব: সম্মেলনে আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রস্তাবে বলা হয়, শিক্ষার্থীদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে মেন্টরিংয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করা, ছয় মাস অন্তর শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য স্ক্রিনিং করা, বৈষম্য ও হয়রানি প্রতিরোধে মনিটরিং টিম গঠন ও কঠোর আইন প্রয়োগ, প্রতিটি বিভাগে অভিযোগ বক্স রাখা ও নারী শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা কমপ্লেইন সেল গঠন, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে সম্পর্ক তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা, উচ্চশিক্ষা ও কর্মসংস্থান দিকনির্দেশনায় ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং সেন্টার চালু, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করা গেলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বৈষম্য রোধ করা যাবে।
সংবাদ সম্মেলনে আরো বক্তব্য দেন আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা তানসেন রোজ, পারসপেক্টিভের নির্বাহী সম্পাদক সিবগাতুল্লাহ সিবগা এবং যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ মো. সোহেল মামুন।
সানা/আপ্র/৩০/০৮/২০২৫