নিজস্ব প্রতিবেদক : রমজান মাস উপলক্ষে নিত্যপণ্যের আমদানি দ্রুত বাড়ছে। গত জানুয়ারি মাসে বিপুল পরিমাণ নিত্যপণ্য আমদানি হয়েছে, যা অনেক ক্ষেত্রে পুরো রোজার মাসের চাহিদার সমান। ফলে বাজারে কোনো পণ্যের সরবরাহ ঘাটতি হওয়ার আশঙ্কা নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাজার বিশ্লেষকরা মনে করেন, রোজার সময় আমদানিকারক থেকে ভোক্তা পর্যায় পর্যন্ত আসতে পণ্যের দামের পার্থক্য অনেক বেশি বেড়ে যায়। অনেকে সুযোগ নেন। এ জন্য সরকারের নজরদারি বা তদারকি বাড়াতে হবে।
আমদানিকারকেরা বলছেন, এবছর যে পরিমাণ আমদানি হয়েছে ও হচ্ছে, তা রোজার চাহিদাকে ছাড়িয়ে যাবে। চলতি ফেব্রুয়ারি মাসজুড়েও নিত্যপণ্য আমদানি হবে। ফলে সরবরাহ বাড়বে। নতুন নতুন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নিত্যপণ্য আমদানিতে যুক্ত হয়েছে। বন্দরগুলোতে দিন-রাত পণ্য খালাস চলছে। আমদানি করা কয়েক হাজার টন পণ্য নিয়ে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে সাগরে ভাসছে জাহাজ। তবে দাম বাড়ানোর কৌশল হিসেবে আমদানিকারকরা খালাস না করে সাগরে ভাসমান গুদাম বানিয়ে রেখেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিকে আমদানি বাড়ানো ও মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে অন্তর্বর্তী সরকার ভোজ্যতেল, চিনি, পেঁয়াজ, আলু, খেজুরসহ বিভিন্ন পণ্যে শুল্ক ছাড় দিয়েছিল। পাশাপাশি ঋণপত্র খুলতে এখন মার্কিন ডলারের সংকটও অনেকটা কেটেছে।
সব মিলিয়ে আমদানিতে উৎসাহ বেড়েছে। সুফল হলো, বাজার স্থিতিশীল হয়েছে। দুই-একটি পণ্যের দাম কিছুটা কমেছেও। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও চট্টগ্রাম কাস্টমসের সূত্রে জানা গেছে, রোজায় বাজারে ভোজ্যতেলের চাহিদা থাকে প্রায় ৩ লাখ টন। গত জানুয়ারি মাসে সয়াবিন ও পাম তেল আমদানি হয়েছে প্রায় ৪ লাখ টন। আবার সয়াবিন তেল তৈরির কাঁচামাল সয়াবিনবীজ আমদানি হয়েছে ৩ লাখ টন। এই বীজ মাড়াই করে পাওয়া যাবে প্রায় অর্ধলাখ টন সয়াবিন তেল, অর্থাৎ রোজার চাহিদার চেয়ে বাজারে সরবরাহ বেশি থাকবে। ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, দেশে ভোজ্যতেলের সরবরাহ পর্যাপ্ত রয়েছে, কোনো ঘাটতি নেই। গত দুই মাসে ভোজ্যতেলের আমদানি প্রায় ৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। রমজান উপলক্ষে পাইপলাইনে বেশ কিছু ভোজ্যতেলভর্তি জাহাজ চট্টগ্রামের বন্দরে নোঙ্গর করার অপেক্ষায় আছে। এগুলো অচিরেই স্থানীয় সরবরাহের সাথে যুক্ত হবে। পাইপলাইনে থাকা ভোজ্যতেলের পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। সাবির্কভাবে, ভোজ্যতেলের সরবরাহ পর্যাপ্ত রয়েছে। ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরা আরও বলেন, মাঠ পর্যায়ে কেউ কেউ অতিরিক্ত মজুদ করে থাকতে পারেন। আবার কেউ কেউ অধিক লাভের আশায় বোতল কেটে খোলা তেলে পরিণত করে তা বিক্রি করতে পারেন।
অন্যদিকে, পার্শ্ববর্তী দেশে মূল্য অধিক হওয়ায় অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য হওয়ার আশঙ্কার কথাও বলেন তারা। মেঘনা গ্রুপের প্রতিনিধি জিএম তসলিম শাহরিয়ার জানান, চলতি জানুয়ারিতে মোট ৪৭ হাজার ৬৬৮ হাজার টন সরবরাহ করেছেন। এর মধ্যে ১৫ হাজার টন বোতলজাত। পূর্ববর্তী বছরে মোট সরবরাহের ২৫ হাজার টনের মধ্যে ১২ হাজার টন ছিল বোতলজাত। টিকে গ্রুপের পরিচালক শফিউল আতাহার তসলিম জানান, চলতি বছরের জানুয়ারিতে মোট ১১ হাজার ৮১০ মেট্রিক টন বোতলজাত সয়াবিন তেল সরবরাহ করেছেন, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৯ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। বাংলাদেশ ভেজিটেবল ওয়েল রিফাইনার্স ও বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, পবিত্র রমজানকে সামনে রেখে বাজারে ভোজ্যতেলের বাড়তি চাহিদা বিবেচনায় অ্যাসোসিয়েশনভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অধিক পরিমাণ ভোজ্যতেল সরবরাহ করছে। ভোজ্যতেলের সরবরাহের পরিমাণ বিবেচনায় সংকটের কোনো সুযোগ নেই।
দেশের শীর্ষস্থানীয় ভোজ্যতেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, টিকে গ্রুপ ও বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লি. চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি ভোজ্যতেল আমদানি করেছে, যা আগামী ৭-১০ দিনের ভেতরে বাজারে প্রবেশ করবে। সংগঠনটি আরও জানিয়েছেন, ভোজ্যতেলের সরবরাহ ও মূল্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব যাতে না পড়ে, সেজন্য সরকারিভাবে বাজার মনিটরিং বৃদ্ধি করা, ভোক্তাদের সহযোগিতা ও ধৈর্য একান্ত কাম্য, যা আমাদের এই প্রচেষ্টাকে সফল করতে আরও বেশি বেগবান করবে। রোজায় চিনির চাহিদাও ৩ লাখ টনের মতো। বিগত ১৫ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণ অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছে জানুয়ারি মাসে ১ লাখ ৫৩ হাজার টন। বন্দরে এসে ভিড়েছে আরও প্রায় ১ লাখ টন চিনিসহ জাহাজ। ফেব্রুয়ারি মাসেও চিনি আমদানি হবে। বিশ্ববাজারে পণ্যটির দাম কমছে। চিনি আমদানিতেও সরকার শুল্ক-কর কমিয়েছে। আগে প্রতি কেজি অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে ৩৮-৪০ টাকা শুল্ক-কর দিতে হতো। এখন দিতে হচ্ছে প্রতি কেজি ২৩ টাকা। অর্থাৎ প্রতি কেজিতে শুল্ক-কর কমেছে প্রায় ১৫-১৭ টাকা। শুল্ক-কর কমানোর পর তিনটি প্রতিষ্ঠান চিনি আমদানি করেছে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ (এমজিআই), সিটি গ্রুপ ও আবদুল মোনেম সুগার রিফাইনারি। এখনো খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১২৫ টাকা দরে। এক মাস আগে ছিল ১৩০ টাকা। অর্থাৎ শুল্কছাড়ের সুবিধা আংশিক পাচ্ছেন ভোক্তারা। সিটি গ্রুপের প্রতিনিধি (উপদেষ্টা) অমিতাভ চক্রবর্তী বলেন, রমজানে কোনো সংকট হবে না এটা বলতে পারি। বিশ্ববাজারও মোটামুটি স্থিতিশীল।