ঢাকা ১২:০২ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৯ জানুয়ারী ২০২৫
গাজীপুর শিল্পাঞ্চলে একের পর এক কারখানা বন্ধ, বিপদে অর্ধলক্ষাধিক শ্রমিক ও তাদের পরিবার

বেকারের বহর বিস্তৃত হচ্ছে

  • আপডেট সময় : ০৮:৪৮:৫১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৭ জানুয়ারী ২০২৫
  • ৩৩ বার পড়া হয়েছে

এক সময় কারখানাটিতে ছিল কর্মচাঞ্চল্য, সেখানে আজ সুনসান নীরবতা-ছবি সংগৃহীত

বিশেষ সংবাদদাতা: শিল্পাঞ্চল গাজীপুরে একের পর এক বন্ধ হচ্ছে পোশাক কারখানা। ফলে বাড়ছে বেকারত্ব। অনেকে এই বেকারত্ব ঘুচাতে না পেরে পরিবার নিয়ে কষ্টে দিন পার করছেন। কেউ জড়িয়ে পড়ছেন অপরাধে। বৃহত্তর এই শিল্পাঞ্চলে বাড়ছে চুরি-ছিনতাই ও ডাকাতির মতো ঘটনা। কারখানা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাজের অর্ডার না থাকা, অর্থের অভাব, ব্যাংকিং জটিলতা ও শ্রমিক অসন্তোষসহ নানান কারণে তাদের কারখানা বন্ধ করতে হচ্ছে।

কারখানা বন্ধ হওয়ায় শুধু শ্রমিকরাই যে সমস্যায় পড়েছেন তা নয়। তাদের আন্দোলনের কারণে প্রায়ই বন্ধ থাকছে মহাসড়ক। এতে যাত্রীসহ আশপাশের বাসিন্দাদের দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। শ্রমিকরা বলছেন, এখন তারা পাওনাও ঠিকমতো পাচ্ছেন না। আবার বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার নারী শ্রমিকরা কোথাও কোথাও চাকরি পেলেও পুরুষরা পড়েছেন বিপাকে। অধিকাংশ কারখানায় পুরুষ শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না।

এদিকে পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, গাজীপুরে চুরি-ডাকাতি ও ছিনতাই সংক্রান্ত মামলা বেড়েছে। এসব অপরাধের পেছনে বেকার কিছু লোকের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।

সূত্রমতে, জুলাই-আগস্টে দেশের পট পরিবর্তনের পর পাঁচ মাসে গাজীপুরে ৫১টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। এর মধ্যে ৪১টি স্থায়ী এবং ১০টি অস্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। আগামী মে মাসে আরও সাতটি কারখানা বন্ধ হবে।

গাজীপুর শিল্প পুলিশ জানায়, জেলায় ছোটবড় মিলিয়ে মোট নিবন্ধিত কারখানা ২ হাজার ১৭৬টি। এর মধ্যে তৈরি পোশাক কারখানার সংখ্যা ১ হাজার ১৫৪টি। গত বছরের নভেম্বর থেকে ৩৫টি তৈরি পোশাক কারখানা তাদের কর্মীদের বেতন দিতে পারেনি, যা মোট কারখানার ২ শতাংশ।

এছাড়া ডিসেম্বর থেকে বেতন দেয়নি ৪৫ শতাংশ কারখানা। বর্তমানে গাজীপুরে ৫ শতাংশ কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ রয়েছে। ৯ শতাংশ কারখানায় ইনক্রিমেন্ট নিয়ে জটিলতা চলছে। এমন বাস্তবতায় ১ হাজার ১৫৪টি তৈরি পোশাক কারখানার মধ্যে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে ৪১টি, আর অস্থায়ীভাবে ১০টি।

বন্ধ কারখানাগুলোর মধ্যে মহানগরীর সারাবো এলাকার বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের ১৬টি, টঙ্গীর সাতাইশ এলাকার টিএমএস অ্যাপারেলস, চন্দ্রা এলাকার নায়াগ্রা টেক্সটাইল ও মাহমুদ জিনস উল্লেখযোগ্য।

কারখানা বন্ধ হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন অর্ধলক্ষাধিক শ্রমিক। কর্মসংস্থান হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। শ্রমিকরা কারখানা খুলে দেওয়া ও বকেয়া বেতনের দাবিতে প্রায়ই রাস্তায় নেমে আন্দোলন করছেন।

এদিকে মে মাস থেকে কেয়া গ্রুপের সাতটি কারখানা বন্ধ হচ্ছে। ২ জানুয়ারি নোটিশ দিয়ে বিষয়টি জানায় মালিকপক্ষ। এতে উল্লেখ করা হয়, কেয়া কসমেটিকস লিমিটেড (নিট কম্পোজিট গার্মেন্টস ডিভিশন, নিটিং বিভাগ, স্পিনিং ডিভিশন, কটন ডিভিশন) ও কেয়া ইয়ার্ন মিলস লিমিটেডের (জরুন, কোনাবাড়ী, গাজীপুর) শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের জানানো যাচ্ছে যে, বাজার অস্থিতিশীলতা, ব্যাংকের সঙ্গে হিসাবের অমিল, কাঁচামাল অপর্যাপ্ততা ও কারখানার উৎপাদন কার্যক্রমের অপ্রতুলতার জন্য ১ মে কারখানার সব কার্যক্রম স্থায়ীভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হলো। শ্রমিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সব পাওনা কারখানা বন্ধের পরবর্তী ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে পরিশোধ করা হবে।

ওই ঘোষণার পর ফের একই গ্রুপের আরও দুটি প্রতিষ্ঠান-নিট কম্পোজিট ডিভিশন, ডাইং ও ইউটিলিটি বিভাগ বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়। ২০ মে থেকে এই বিভাগগুলো বন্ধ হয়ে যাবে।

এ বিষয়ে কেয়া গ্রুপের মানবসম্পদ বিভাগের ব্যবস্থাপক সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ১ মে থেকে ৫টি এবং ২০ মে থেকে দুটি- মোট সাতটি কারখানা বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কয়েক ধাপে শ্রমিকদের সব পাওনা শ্রম আইন অনুযায়ী পরিশোধ করা হবে।

শুধু কেয়া গ্রুপ নয়, এর মতো আরও কারখানা বন্ধ হয়েছে। এরমধ্যে বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের ১৬টি কারখানা অন্যতম। গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে বেক্সিমকোর প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রম ও ব্যবসায় পরিস্থিতি পর্যালোচনা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের কমিটির সভায় এই সিদ্ধান্ত হয়।

প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। বন্ধের কারণ হিসেবে সরকার জানায়, কারখানাগুলোতে অর্ডার না থাকা ও ব্যাংকে ঋণখেলাপি থাকায় এগুলো পরিচালনা সম্ভব হচ্ছে না।

বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কারখানাগুলোতে এখন ভুতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করছে। পড়ে আছে কোটি কোটি টাকার মেশিনপত্র। কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করছেন প্রায় ৪২ হাজার শ্রমিক।

বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার (প্রশাসন) এস এম আব্দুল লতিফ জানান, তাদের কারখানায় ৪২ হাজার শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারী বেকার হয়েছেন। শ্রমিকরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আমরা লে অফ তুলে নিয়ে সরকারের সহযোগিতা চাইছি। প্রধান উপদেষ্টাসহ সবার কাছে অনুরোধ, ব্যাক টু ব্যাক এলসি ওপেন করে সব ব্যাংকিং সুবিধাসহ লে অফ তুলে নেওয়ার।

সুমন নামে এক পোশাক শ্রমিক জানান, গাজীপুরের নওজোর এলাকায় তিনি একটি কারখানায় চাকরি করতেন। তুচ্ছ কারণে তার চাকরি চলে যায়। চাকরির জন্য বিভিন্ন কারখানায় ঘুরলেও চাকরি হচ্ছে না। দুই মাস ধরে বেকার। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকেন। কঠিন অবস্থার মধ্যে পড়েছে তার পরিবার।

দক্ষিণ ভোগড়া বাসন সড়ক এলাকায় মিম ডিজাইন কারখানায় প্রায় ১৫ বছর ধরে চাকরি করেন শাহীনা বেগম। তিনি বলেন, কাজ নেই অজুহাতে দুই মাস ধরে কারখানাটি বন্ধ। কবে কারখানা খুলবে তা নিশ্চিত করে কিছু বলছে না কর্তৃপক্ষ। কর্মকর্তারা দু-তিন মাসের করে বেতন পাওনা। কর্তৃপক্ষ বেতন পরিশোধ করছে না।

গাজীপুর শিল্প পুলিশ-২ এর পুলিশ সুপার এ কে এম জহিরুল ইসলাম বলেন, জেলায় ৫১টি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এরমধ্যে ১০টি কারখানা অস্থায়ীভাবে বন্ধ। তারা হয়তো যে কোনো সময় খুলে দিতে পারে। ব্যাংক সমস্যাসহ বিভিন্ন কারণে কারখানাগুলো বন্ধ হচ্ছে বলে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। আমরা বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের কাজ করছি। তিনি আরও বলেন, কর্মহীন শ্রমিকদের অনেকেই কারখানা খুলে দেওয়া ও বকেয়া বেতনের দাবিতে রাস্তায় নেমে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রায়ই বন্ধ থাকছে ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-ময়মনসিংহ ও চন্দ্রা-নবীনগর মহাসড়ক।

জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক জোট বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আশরাফুজ্জামান বলেন, একের পর এক কারখানা বন্ধ হচ্ছে। বেকারত্বের সংখ্যাও বাড়ছে। তবে কারখানা বন্ধের কারণ শ্রমিক আন্দোলনকে দায়ী করা যাবে না। কারণ বিগত দিনেও শ্রমিকরা তাদের বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধের দাবিতে আন্দোলন করেছেন। কিন্তু এভাবে কারখানা বন্ধ হয়নি। মালিকদের কৃতকর্মের দায়ে শ্রমিকদের বেকার করে দেওয়া হচ্ছে।

 

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

গাজীপুর শিল্পাঞ্চলে একের পর এক কারখানা বন্ধ, বিপদে অর্ধলক্ষাধিক শ্রমিক ও তাদের পরিবার

বেকারের বহর বিস্তৃত হচ্ছে

আপডেট সময় : ০৮:৪৮:৫১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৭ জানুয়ারী ২০২৫

বিশেষ সংবাদদাতা: শিল্পাঞ্চল গাজীপুরে একের পর এক বন্ধ হচ্ছে পোশাক কারখানা। ফলে বাড়ছে বেকারত্ব। অনেকে এই বেকারত্ব ঘুচাতে না পেরে পরিবার নিয়ে কষ্টে দিন পার করছেন। কেউ জড়িয়ে পড়ছেন অপরাধে। বৃহত্তর এই শিল্পাঞ্চলে বাড়ছে চুরি-ছিনতাই ও ডাকাতির মতো ঘটনা। কারখানা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাজের অর্ডার না থাকা, অর্থের অভাব, ব্যাংকিং জটিলতা ও শ্রমিক অসন্তোষসহ নানান কারণে তাদের কারখানা বন্ধ করতে হচ্ছে।

কারখানা বন্ধ হওয়ায় শুধু শ্রমিকরাই যে সমস্যায় পড়েছেন তা নয়। তাদের আন্দোলনের কারণে প্রায়ই বন্ধ থাকছে মহাসড়ক। এতে যাত্রীসহ আশপাশের বাসিন্দাদের দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। শ্রমিকরা বলছেন, এখন তারা পাওনাও ঠিকমতো পাচ্ছেন না। আবার বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার নারী শ্রমিকরা কোথাও কোথাও চাকরি পেলেও পুরুষরা পড়েছেন বিপাকে। অধিকাংশ কারখানায় পুরুষ শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না।

এদিকে পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, গাজীপুরে চুরি-ডাকাতি ও ছিনতাই সংক্রান্ত মামলা বেড়েছে। এসব অপরাধের পেছনে বেকার কিছু লোকের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।

সূত্রমতে, জুলাই-আগস্টে দেশের পট পরিবর্তনের পর পাঁচ মাসে গাজীপুরে ৫১টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। এর মধ্যে ৪১টি স্থায়ী এবং ১০টি অস্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। আগামী মে মাসে আরও সাতটি কারখানা বন্ধ হবে।

গাজীপুর শিল্প পুলিশ জানায়, জেলায় ছোটবড় মিলিয়ে মোট নিবন্ধিত কারখানা ২ হাজার ১৭৬টি। এর মধ্যে তৈরি পোশাক কারখানার সংখ্যা ১ হাজার ১৫৪টি। গত বছরের নভেম্বর থেকে ৩৫টি তৈরি পোশাক কারখানা তাদের কর্মীদের বেতন দিতে পারেনি, যা মোট কারখানার ২ শতাংশ।

এছাড়া ডিসেম্বর থেকে বেতন দেয়নি ৪৫ শতাংশ কারখানা। বর্তমানে গাজীপুরে ৫ শতাংশ কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ রয়েছে। ৯ শতাংশ কারখানায় ইনক্রিমেন্ট নিয়ে জটিলতা চলছে। এমন বাস্তবতায় ১ হাজার ১৫৪টি তৈরি পোশাক কারখানার মধ্যে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে ৪১টি, আর অস্থায়ীভাবে ১০টি।

বন্ধ কারখানাগুলোর মধ্যে মহানগরীর সারাবো এলাকার বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের ১৬টি, টঙ্গীর সাতাইশ এলাকার টিএমএস অ্যাপারেলস, চন্দ্রা এলাকার নায়াগ্রা টেক্সটাইল ও মাহমুদ জিনস উল্লেখযোগ্য।

কারখানা বন্ধ হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন অর্ধলক্ষাধিক শ্রমিক। কর্মসংস্থান হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। শ্রমিকরা কারখানা খুলে দেওয়া ও বকেয়া বেতনের দাবিতে প্রায়ই রাস্তায় নেমে আন্দোলন করছেন।

এদিকে মে মাস থেকে কেয়া গ্রুপের সাতটি কারখানা বন্ধ হচ্ছে। ২ জানুয়ারি নোটিশ দিয়ে বিষয়টি জানায় মালিকপক্ষ। এতে উল্লেখ করা হয়, কেয়া কসমেটিকস লিমিটেড (নিট কম্পোজিট গার্মেন্টস ডিভিশন, নিটিং বিভাগ, স্পিনিং ডিভিশন, কটন ডিভিশন) ও কেয়া ইয়ার্ন মিলস লিমিটেডের (জরুন, কোনাবাড়ী, গাজীপুর) শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের জানানো যাচ্ছে যে, বাজার অস্থিতিশীলতা, ব্যাংকের সঙ্গে হিসাবের অমিল, কাঁচামাল অপর্যাপ্ততা ও কারখানার উৎপাদন কার্যক্রমের অপ্রতুলতার জন্য ১ মে কারখানার সব কার্যক্রম স্থায়ীভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হলো। শ্রমিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সব পাওনা কারখানা বন্ধের পরবর্তী ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে পরিশোধ করা হবে।

ওই ঘোষণার পর ফের একই গ্রুপের আরও দুটি প্রতিষ্ঠান-নিট কম্পোজিট ডিভিশন, ডাইং ও ইউটিলিটি বিভাগ বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়। ২০ মে থেকে এই বিভাগগুলো বন্ধ হয়ে যাবে।

এ বিষয়ে কেয়া গ্রুপের মানবসম্পদ বিভাগের ব্যবস্থাপক সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ১ মে থেকে ৫টি এবং ২০ মে থেকে দুটি- মোট সাতটি কারখানা বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কয়েক ধাপে শ্রমিকদের সব পাওনা শ্রম আইন অনুযায়ী পরিশোধ করা হবে।

শুধু কেয়া গ্রুপ নয়, এর মতো আরও কারখানা বন্ধ হয়েছে। এরমধ্যে বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের ১৬টি কারখানা অন্যতম। গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে বেক্সিমকোর প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রম ও ব্যবসায় পরিস্থিতি পর্যালোচনা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের কমিটির সভায় এই সিদ্ধান্ত হয়।

প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। বন্ধের কারণ হিসেবে সরকার জানায়, কারখানাগুলোতে অর্ডার না থাকা ও ব্যাংকে ঋণখেলাপি থাকায় এগুলো পরিচালনা সম্ভব হচ্ছে না।

বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কারখানাগুলোতে এখন ভুতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করছে। পড়ে আছে কোটি কোটি টাকার মেশিনপত্র। কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করছেন প্রায় ৪২ হাজার শ্রমিক।

বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার (প্রশাসন) এস এম আব্দুল লতিফ জানান, তাদের কারখানায় ৪২ হাজার শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারী বেকার হয়েছেন। শ্রমিকরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আমরা লে অফ তুলে নিয়ে সরকারের সহযোগিতা চাইছি। প্রধান উপদেষ্টাসহ সবার কাছে অনুরোধ, ব্যাক টু ব্যাক এলসি ওপেন করে সব ব্যাংকিং সুবিধাসহ লে অফ তুলে নেওয়ার।

সুমন নামে এক পোশাক শ্রমিক জানান, গাজীপুরের নওজোর এলাকায় তিনি একটি কারখানায় চাকরি করতেন। তুচ্ছ কারণে তার চাকরি চলে যায়। চাকরির জন্য বিভিন্ন কারখানায় ঘুরলেও চাকরি হচ্ছে না। দুই মাস ধরে বেকার। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকেন। কঠিন অবস্থার মধ্যে পড়েছে তার পরিবার।

দক্ষিণ ভোগড়া বাসন সড়ক এলাকায় মিম ডিজাইন কারখানায় প্রায় ১৫ বছর ধরে চাকরি করেন শাহীনা বেগম। তিনি বলেন, কাজ নেই অজুহাতে দুই মাস ধরে কারখানাটি বন্ধ। কবে কারখানা খুলবে তা নিশ্চিত করে কিছু বলছে না কর্তৃপক্ষ। কর্মকর্তারা দু-তিন মাসের করে বেতন পাওনা। কর্তৃপক্ষ বেতন পরিশোধ করছে না।

গাজীপুর শিল্প পুলিশ-২ এর পুলিশ সুপার এ কে এম জহিরুল ইসলাম বলেন, জেলায় ৫১টি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এরমধ্যে ১০টি কারখানা অস্থায়ীভাবে বন্ধ। তারা হয়তো যে কোনো সময় খুলে দিতে পারে। ব্যাংক সমস্যাসহ বিভিন্ন কারণে কারখানাগুলো বন্ধ হচ্ছে বলে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। আমরা বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের কাজ করছি। তিনি আরও বলেন, কর্মহীন শ্রমিকদের অনেকেই কারখানা খুলে দেওয়া ও বকেয়া বেতনের দাবিতে রাস্তায় নেমে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রায়ই বন্ধ থাকছে ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-ময়মনসিংহ ও চন্দ্রা-নবীনগর মহাসড়ক।

জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক জোট বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আশরাফুজ্জামান বলেন, একের পর এক কারখানা বন্ধ হচ্ছে। বেকারত্বের সংখ্যাও বাড়ছে। তবে কারখানা বন্ধের কারণ শ্রমিক আন্দোলনকে দায়ী করা যাবে না। কারণ বিগত দিনেও শ্রমিকরা তাদের বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধের দাবিতে আন্দোলন করেছেন। কিন্তু এভাবে কারখানা বন্ধ হয়নি। মালিকদের কৃতকর্মের দায়ে শ্রমিকদের বেকার করে দেওয়া হচ্ছে।