সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা : চোর না শোনে ধর্মের কাহিনী – এই পুরোনো প্রবাদ নাকি বারবারই সত্য প্রমাণিত হয়। কিন্তু আমরা চাই মিথ্যা প্রমাণিত হোক। ধর্মের নামে অধর্ম চর্চাকারীরা ধর্মের পথে আসুক। কথাগুলো বলছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কিছু বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ধর্মের নামে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস সৃষ্টি ও মানুষ হত্যা আমাদের ধর্মের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। ওলামা একরামদের উদ্দেশে তিনি বলেন, এই পথ সর্বনাশা পথ। এই পথ থেকে দেশের যুবসমাজকে রক্ষা করতে হবে। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও মানুষ হত্যা করে কেউ বেহেশতে যাবে না। গত বৃহষ্পতিবার ৫০টি মডেল মসজিদ ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী একথাগুলো বলেন। প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একটি করে মোট ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ করছে সরকার।
এসব মডেল মসজিদ নিয়ে কথা বলছেন অনেকেই। ফেসবুকে অনেকে বলছেন, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও অন্যান্য নৃগোষ্ঠি জাতিগোষ্ঠীর জন্যও নিশ্চয়ই সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের আদলে প্রার্থনালয় নির্মাণ করে দিবে সরকার।
প্রশ্নটি পাল্টাপাল্টির নয়। কিন্তু অনেক কিছু ভাবনার জন্ম দিচ্ছে সরকারের এই উদ্যোগ। সরকারের মনস্তত্বে হয়তো আছে এটা প্রমাণ করা যে, আওয়ামী লীগ কতটা করে ইসলামের জন্য। কিংবা হয়তো এটাও আছে যে, ইসলাম ধর্মের নামে উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদে বিশ্বাসী ধর্ম ব্যবসায়ীরা যেন রাজনৈতিক ইসলাম নিয়ে আর খেলতে না পারে সে জন্য মসজিদ কেন্দ্রিক এই সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলো বড় ভূমিকা রাখবে। রাখতে পারবে কিনা, নাকি এগুলোই এক সময় কাঠমোল্লাদের দখলে চলে যাবে সেটা পরের প্রশ্ন।
আমি মনে করি সরকার যে ভাবনা থেকে এগুলো করেছে এর সাথে নতুন উদ্যম প্রয়োজন। মসজিদ কেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পাশাপাশি সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধের যে মূল চেতনা-অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ-সেই চেতনার আলোকে ইউনিয়ন পর্যন্ত সাংস্কৃতিক একাডেমি হোক যেখানে বাংলার বাউল, জারি সারি গান, আধুনিক গান, নাটক ইত্যাদির আয়োজন থাকবে। চাই সারাদেশে, অন্তত: ৬৪ জেলায় ৬৪টি সিনেপ্লেক্স হোক যেন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত আবার সিনেমামুখি হয়, ভালো চলচ্চিত্র তৈরি হয় এবং সারাবিশ্বের ভাল ভাল ছবি প্রদর্শিত হয়।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র এক জায়গায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন আমাদের বাঙালির মধ্যে দুটা দিক আছে। একটা হলো আমরা মুসলমান, আর একটা হলো, আমরা বাঙালি। বঙ্গবন্ধু বলছেন, ‘দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। আরব দেশের লোকেরা আরবি বলে। পারস্যের লোকেরা ফার্সি বলে, তুরস্কের লোকেরা তুর্কি ভাষা বলে, ইন্দোনেশিয়ার লোকেরা ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় কথা বলে, মালয়েশিয়ার লোকেরা মালয়া ভাষায় কথা বলে, চীনের মুসলমানেরা চীনা ভাষায় কথা বলে। এ সম্বন্ধে অনেক যুক্তিপূর্ণ কথা বলা চলে। শুধু পূর্ব পাকিস্তানের ধর্মভীরু মুসলমানদের ইসলামের কথা বলে ধোঁকা দেওয়া যাবে ভেবেছিল, কিন্তু পারে নাই।’ (পৃষ্ঠা: ৯৮-৯৯)। বঙ্গবন্ধু কন্যা ধর্মের নামে ধর্মব্যবসায়ীর এই ধোঁকাবাজিটা সম্পর্কে অবগত আছেন বলেই কথাগুলো বলেছেন।
এই মডেল মসজিদ এমন একসময় উদ্বোধন করা হল যখন আমাদের এখনও তাড়িয়ে বেড়ায় সাম্প্রতিক হেফাজতী তাণ্ডবের স্মৃতি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে উগ্রবাদী সংগঠন হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডবে সিরিয়ার মত বিধ্বস্ত হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, তাদের সহিংসতার সাক্ষী হয়ে আছে হাটহাজারি, ঢাকা যাত্রাবাড়ি।
বঙ্গবন্ধু নিজেকে গর্ব করেই বাঙালি বলতেন। গবেষক গোলাম মুরশিদ লিখেছেন: ‘পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানে যে রাজনৈতিক আন্দোলন দানা বেঁধেছিল, সেই আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্রে ছিল তাদের এই ‘বাঙালি’ পরিচয়। এই ‘বাঙালি’ পরিচয় যেমন তখনকার রাজনৈতিক আন্দোলনকে শক্তি ও উৎসাহ জুগিয়েছিল, তেমনি সেই রাজনৈতিক আন্দোলনও ‘বাঙালি’ পরিচয়কে মুসলমানদের কাছে আন্তরিক করে তুলেছিল। পরিণতিতে ‘আমরা সবাই বাঙালি’—এই দৃঢ় বিশ্বাস নিয়েই হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান— সবাই মিলে একাত্তরের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এর ফলে বারো-তেরো’শ বছর ধরে যে বঙ্গভূমি ছিল পরাধীন, একাত্তরের সংগ্রামের মাধ্যমে, সেই পরাধীন ভূখণ্ড একটি স্বতন্ত্র ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করল। আমরা প্রথমবারের মতো একটা স্বাধীন দেশের পতাকা ওড়ালাম।’
উগ্রবাদী এসব হেফাজতী চিন্তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্র, নজরুল বা জসীমউদ্দীনের ভাবনার মিল নেই। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা করা, তার ভাস্কর্যে আঘাত করা, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে সহিংসতা সৃষ্টি করা আসলে ধর্মের নামে ক্ষমতা দখলের রাজনীতি যদিও হেফাজত নিজেকে অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে দাবী করে আসছে।
এই সুবর্ণজয়ন্তীতে জাতি নতুনের প্রেরণায়, উন্নয়নের সম্পৃহায় জেগে উঠতে চেয়েছে তখনই প্রবলভাবে প্রকাশ পেলো এই মৌলবাদী বিদ্বেষ। আমাদের মনে রাখা দরকার, এদের যত তোষণ করা হোক না কেন, এদের সাথে যতই আপস করা হোক না কেন, এরা এদের মৌলিক জায়গা থেকে সরে না। তারা যে ধর্মবিদ্বেষের রাজনীতি করে সেটা যতটা না ধর্মীয় কারণে তার চেয়ে বেশি রাষ্ট্রকে চাপে রাখতে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করতে। কাজেই ধর্ম নয়, আসলে ক্ষমতাই হলো এই বিভাজনের মৌলিক কারণ।
ধর্ম বৃহত্তর মিলনের মধ্য দিয়ে মুক্তির পথে নিয়ে যাক সেটাই আমরা চাই। প্রধানমন্ত্রী যে কথাগুলো বলেছেন তার মর্ম কথাও এটাই। আর সে জন্য শাসক দলকে আসল রাজনীতি করতে হবে, যা জনগণকে সর্বদা সজাগ রাখবে উগ্রবাদের বিরুদ্ধে। সহিংস উগ্রবাদী দর্শনের বিপরীতে সাংস্কৃতিক জাগরণ প্রয়োজন, প্রয়োজন কট্টরপন্থার বিরুদ্ধে উদারতার ব্যাপক প্রসার।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি