প্রত্যাশা ডেস্ক: ছিন্নমূল, ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষের মাঝে দলিলসহ জমি-ঘর হস্তান্তর অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে সরাসরি অনলাইন কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসময় লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ থানার মহিষামুড়ি আশ্রয়ণ প্রকল্পের সুবিধাভোগী এক বৃদ্ধা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলা শুরু করেন। ওই বৃদ্ধার কথা শেষ হওয়ার আগেই মাইক কেড়ে নেন স্থানীয় কালীগঞ্জ থানার ইউএনও জহির ইমাম। এ ঘটনায় গণভবন থেকে সরাসরি যুক্ত থাকা প্রধানমন্ত্রী উষ্মা প্রকাশ করেন। বলেন-হোয়াট ইজ দিস। এটা কী? একইসাথে বৃদ্ধার হাতে মাইক্রোফোন দেওয়ার নির্দেশও দেন।
গতকাল মঙ্গলবার (১১ জুন) বেলা ১২টার দিকে সারা দেশের ১৮ হাজার ৫৬৬টি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারের মাঝে জমি ও ঘর হস্তান্তর অনুষ্ঠানে এ ঘটনা ঘটে। যা ইতোমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ভাইরাল হয়েছে। ওই অনুষ্ঠানে থাকা প্রত্যক্ষদর্শীদের সূত্রে জানা গেছে, লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার মহিষামুড়ি আশ্রয়ণ প্রকল্পে বিধবা বৃদ্ধা শাহেরুন মাইক্রোফোন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছিলেন। এ সময় তিনি প্রধানমন্ত্রীকে এলাকায় আসার দাওয়াত দেন। পরে প্রধানমন্ত্রীকে ‘মা’ সম্বোধন করে ভাতার টাকার পরিমাণ বাড়ানোর জন্য অনুরোধ করেন। পরে প্রধানমন্ত্রী স্থানীয় ইউএনওকে ওই বৃদ্ধার ওষুধের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেন। এরপর ওই বৃদ্ধা প্রধানমন্ত্রীর জন্য মোনাজাত শুরু করেন।
এসময় মাইক্রোফোনটি কেড়ে নেন কালীগঞ্জ থানার উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) জহির ইমাম। এ ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী বলে ওঠেন ‘এটা কী, একজন মানুষ মোনাজাত করছেন, আর হাত থেকে সেটা (মাইক্রোফোন) কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। হোয়াট ইজ দিস। এটা কী?’ প্রধানমন্ত্রী আবারও বলেন, এই এই এটা কী করো, এটা কেমন কথা হলো। মোনাজাত করছে আর তার হাতে থেকে মাইক্রোফোনটি কেড়ে নিল। হোয়াট ইজ দিস? এরপর ওই বৃদ্ধার কাছে মাইক্রোফোনটি আবার ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তখন তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন এবং প্রধানমন্ত্রীকে আবারও এই এলাকায় ঘুরে যাওয়ার দাওয়াত দিয়ে কথা শেষ করেন।
এর আগে, বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আজকে আমরা আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর অধীনে ১৮ হাজার ২৬৬টি ভূমিহীন গৃহহীন পরিবারকে জমিসহ ঘর হস্তান্তর করছি। যারা ঘর পাচ্ছে তাদের আমি অভিনন্দন জানাই। সেইসাথে আমি আরেকটি কথা বলবো, সেটা হচ্ছে- যে ঘরগুলো আমরা করে দিচ্ছি সেগুলো এখন আপনাদের সম্পত্তি। যিনি নিচ্ছেন বা পাচ্ছেন সেটি আপনার নিজের সম্পত্তি। কাজেই এই ঘরগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ এবং যত্ন করার দায়িত্ব আপনার। এখানে বিদ্যুৎ ব্যবহারে অবশ্যই সাশ্রয়ী ও মিতব্যয়ী হতে হবে। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, যে জিনিস আপনি পাচ্ছেন তার জন্য কোন অর্থ খরচ করতে হচ্ছে না। কিন্তু নিজের সম্পদ হিসেবে আপনাকেই যত্ন নিতে হবে।
দেশের ৫৮ জেলা ভূমি ও গৃহহীনমুক্ত: দেশের আরও ২৬টি জেলা এবং ৭০টি উপজেলাকে ভূমি ও গৃহহীনমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে এখন পর্যন্ত মোট ৫৮টি জেলা ও ৪৬৪টি উপজেলা ভূমি ও গৃহহীনমুক্ত হলো। গতকাল মঙ্গলবার সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের পঞ্চম পর্যায়ের দ্বিতীয় ধাপে আরও ১৮ হাজার ৫৬৬ ভূমি ও গৃহহীন পরিবারকে বিনামূল্যে জমিসহ ঘর বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এদিন ঢাকা, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, নেত্রকোনা, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ফেনী, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, নীলফামারী, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, সাতক্ষীরা, যশোর, খুলনা, নড়াইল, বাগেরহাট, বরগুনা, বরিশাল, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ- এই ২৬ জেলাকে ভূমি ও গৃহহীনমুক্ত ঘোষণা করা হয়।
যে ৭০ উপজেলা ভূমি ও গৃহহীনমুক্ত হলো: ঢাকা জেলার ধামরাই; গোপালগঞ্জের গোপালগঞ্জ সদর; শরীয়তপুরের নড়িয়া, জাজিরা; ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলা; নেত্রকোনার খালিয়াজুরী; কক্সবাজারের কক্সবাজার সদর, মহেশখালী, ঈদগাঁও; চট্টগ্রামের চন্দনাইশ, সন্দ্বীপ, সীতাকুন্ড; চাঁদপুরের হাইমচর, চাঁদপুর সদর; লক্ষীপুরের রামগতি, কমলনগর; নোয়াখালীর হাতিয়া, কোম্পানীগঞ্জ, সুবর্ণচর; কুমিল্লার আদর্শ সদর, মুরাদনগর; ফেনীর সোনাগাজী; গাইবান্ধার ফুলছড়ি, সাঘাটা; কুড়িগ্রামের কুড়িগ্রাম সদর, উলিপুর, নাগেশ্বরী, রাজারহাট, চররাজিবপুর, রৌমারী; রংপুরের গংগাচড়া, মিঠাপুকুর, পীরগঞ্জ; লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ, লালমনিরহাট সদর, পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, আদিতমারী; নীলফামারীর সৈয়দপুর, সিরাজগঞ্জের চৌহালী; বগুড়ার শেরপুর; সাতক্ষীরার আশাশুনি; যশোরের মনিরামপুর; খুলনার পাইকগাছা, কয়রা, দাকোপ; নড়াইলের লোহাগড়া, নড়াইল সদর; বাগেরহাটের বাগেরহাট সদর, শরণখোলা, রামপাল, মোল্লাহাট, ফকিরহাট, চিতলমারী, মোরেলগঞ্জ, মোংলা, কচুয়া; ভোলার বোরহানউদ্দিন, চরফ্যাশন, মনপুরা; বরগুনার বরগুনা সদর, আমতলী; বরিশালের বরিশাল সদর, হিজলা, গৌরনদী; হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ; সুনামগঞ্জের দিরাই, ছাতক, জগন্নাথপুর, জামালগঞ্জ এই ৭০ উপজেলাকে সম্পূর্ণ ভূমিহীন এবং গৃহহীনমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। আসন্ন ঈদুল আজহার আগে শেখ হাসিনার ঈদ উপহার হিসেবে ঘর পেলেন অসহায় এসব পরিবার। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপকারভোগীদের হাতে জমির দলিল এবং ঘরের চাবি হস্তান্তর করেন। পরে প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ, ভোলার চরফ্যাশন ও কক্সবাজারের ঈদগাঁও এলাকার উপকারভোগীদের সঙ্গে কথা বলেন।
ঘূর্ণিঝড়ে আশ্রয়হারাদের ঘর করে দেবো: ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে যাদের ঘরবাড়ি একেবারে ভেঙে গেছে, তাদের ঘর তৈরি করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, “গত কয়েকদিন আগে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস হয়ে গেল। সেখানে হাজার হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। ইতোমধ্যে আমরা তালিকা করেছি কোন কোন এলাকায় কতগুলো ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কতগুলো আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে।
“যেগুলো সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে, তাদেরকে আমরা ঘর তৈরি করে দেব। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ঘরগুলো নির্মাণে উপকরণ দিয়ে সহায়তা করব। প্রাকৃতিক দুর্যোগে যারা ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের পাশে আমরা আছি। প্রাথমিকভাবে যা যা প্রয়োজন তা করে যাচ্ছি।” মঙ্গলবার লালমনিরহাট, ভোলা ও কক্সবাজারে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর হস্তান্তর অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি এ কথা বলেন। গত ২৬ মে রাতে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আঘাত হানে প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমাল। সরকারি হিসাবে, ঝড়ের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসে, ঘর ভেঙে ও দেয়াল ধসে পটুয়াখালী, সাতক্ষীরা, ভোলা, বরিশাল, খুলনা ও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় অন্তত ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। ঘরবাড়ি যাদের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদেরকে চিন্তার কোনো কারণ নাই মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, “প্রত্যেকে যেন ঘর নির্মাণ করতে পারেন, সেই ব্যবস্থা আমি করে দেব। ইতোমধ্যে সেভাবে আমার প্রস্তুতি নিয়েছি। প্রত্যেক এলাকা থেকে আমরা তথ্য সংগ্রহ করেছি। সেই অনুযায়ী আমরা সহায়তা পাঠাব।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “জাতির পিতাকে হত্যা করার পর অবৈধভাবে ক্ষমতার দখলকারীরা এদেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে ব্যস্ত ছিল। ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে জনগণের সেবক হিসেবে যাত্রা শুরু করে। “তখন থেকেই ভূমিহীন মানুষদের জন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছিলাম। তখন বাংলাদেশের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। তারপরও ভূমিহীন মানুষদের মাঝে ঘর তৈরি করার জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প নামে একটি প্রকল্প নিয়ে আমরা ঘর বানাতে শুরু করি।”
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, এখন পর্যন্ত ৪৩ লাখ ৪০ হাজার ভূমি ও গৃহহীন মানুষকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এর মধ্যে কেবল আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে পুনর্বাসিত হয়েছেন ২৯ লাখ ১০ হাজার ২৬৫ জন।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর পেয়ে অসহায় মানুষে জীবন বদলে গেছে মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, “দেশের মানুষের সেবক হিসেবেই বাবার মতো সেবা করে যাব। এই দেশের মানুষ ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত উন্নত জীবন পাবে, সেটাই আমাদের লক্ষ্য। “আশ্রয়ণের মাধ্যমে মানুষের যে পরিবর্তন হয়েছে, তাতে মানুষের মাঝে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছে। ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।” বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “তিনি দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোঁটাতে চেয়েছিলেন। সেটিই আমাদের কর্তব্য বলে মনে করি। এজন্যই আমাদের এই প্রচেষ্টা। বঙ্গবন্ধুর মতো আজীবন দেশের মানুষের কল্যাণে ও তাদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে চাই।”
শেখ হাসিনা বলেন, “প্রত্যেকটা গ্রামকে আমরা নাগরিক সুবিধার আওতায় নিয়ে আসব। সেই নাগরিক সুবিধা আমরা নিশ্চিত করে যাচ্ছি। পাশাপাশি রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা, দেশের মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করছি; যার সুফল মানুষ ভোগ করছে।”