‘অরবিটাল’ উপন্যাসের জন্য ব্রিটিশ লেখক সামান্থা হার্ভে এ বছর বুকার প্রাইজ পেলেন। ২০১৯ সালের পর প্রথম কোনো নারী এই পুরস্কার পেয়েছেন। কোভিড-১৯ মহামারিকালে ‘অরবিটাল’ লিখেছেন বলে জানান তিনি। ১৩৬ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসে আমেরিকা, রাশিয়া, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের ছয় মহাকাশচারীর গল্প বলা হয়েছে। পৃথিবী থেকে এত দূরে থাকার সময় তারা কীভাবে নিজের অস্তিত্বের সঙ্গে লড়াই করেছেন, তা নিয়েই ‘অরবিটাল’
সামান্থা হার্ভের ছোট উপন্যাস ‘অরবিটাল’ পড়ে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলাম, যা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। মহাকাশের প্রতি আমার যে গভীর আগ্রহ, এবং সেই সঙ্গে হার্ভের মনোমুগ্ধকর গদ্যের টানে বইটি হাতে নিয়েই বুঝতে পেরেছিলাম যে শেষ না করে ওঠা যাবে না। ছোট আকারের এই বইটিতে জীবন যেন তার সম্পূর্ণতা নিয়ে বিরাজ করছে। এটি এমনই এক গল্প, যা গভীর মানবিকতার ছোঁয়া দিয়ে নির্মিত। হার্ভে এই গল্পটিকে একদম ভিন্ন একটি পরিসরে নির্মাণ করেছেন, যেখানে ছয়জন মহাকাশচারী পৃথিবীর কক্ষপথে একটি মহাকাশ স্টেশনে বসবাস করছে। এই সীমাবদ্ধ পরিসর আর অনন্ত মহাশূন্যের বিপরীতে তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ যেন মানবজাতির জ্ঞান, জিজ্ঞাসা, এবং নিঃসঙ্গতার গভীর অনুভূতিকে তুলে ধরে, যেখানে পৃথিবী থেকে দূরে মহাকাশের নীরবতায় থাকা মহাকাশচারীদের মনোজগৎ উন্মোচিত হয়েছে।
কিছুদিন আগে খবরে পড়েছিলাম, পাইলট সুনিতা উইলিয়ামস এবং কমান্ডার ব্যারি উইলমোর স্টারলাইনারে চড়ে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন। এই মিশনের মূল লক্ষ্য স্টারলাইনারে নিরাপদে মহাকাশে যাতায়াত নিশ্চিত করা। কিন্তু তাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে তারা দ্রুত পৃথিবীতে ফিরতে পারবে না। দীর্ঘকালীন এই মিশনে স্বেচ্ছাসেবকরা জানতেন যে তাদের জীবনের অনেক সময়ই পৃথিবী থেকে বহুদূরে কাটাতে হবে। আমি অবাক হই যে এই তরুণ মহাকাশচারীর যারা এই মিশনে স্বেচ্ছায় অংশ নিয়েছিল কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল যে মানবজাতির বৃহত্তর কল্যাণে তাদের জীবন উৎসর্গ করা যেতে পারে। এমন একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া যে কারও পক্ষে সহজ নয়, এবং সেই কারণেই হার্ভের ‘অরবিটাল’ আমার কাছে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে।
এ গল্পটি শুধু বৈজ্ঞানিক গবেষণা বা মহাকাশচারীদের দৈনন্দিন দায়িত্বে আবদ্ধ নয়, বরং পৃথিবীকে দূর থেকে দেখার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছে। প্রতিটি চরিত্রের মধ্যে যেন এক ধরনের অন্তর্দৃষ্টি জন্ম নিয়েছে, পৃথিবীর দিকে তারা যেভাবে তাকায়, সেটি শুধুই কৌতূহল নয়-একটি আবেগময় সংযোগ। পৃথিবী যেন তাদের কাছে ধরা দেয় একসাথে ক্ষুদ্র এবং মহিমান্বিত, যা তাদের মানবিক চেতনা ও বৈজ্ঞানিক মননকে অন্য এক স্তরে পৌঁছে দেয়। মহাকাশ থেকে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে তারা সেই ক্ষণিক অনুভূতিকে উপভোগ করে, যেখানে আমাদের গ্রহটি তাদের কাছে একদিকে ভঙ্গুর ও সুরক্ষিত, অন্যদিকে এক অপার রহস্যময় শক্তির আধার। তাদের নতুন ‘স্বাভাবিক’ জীবন মহাকাশের সেই সীমাবদ্ধ জগতে বাঁধা পড়েছে, যেখানে পৃথিবী তাদের কাছে আরও দূরে, আরও রহস্যময়।
পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে মহাকাশ থেকে এই ক্ষুদ্র গ্রহটিকে যেন হঠাৎ করেই বড় বেশি নাজুক আর ভঙ্গুর মনে হয়। পরিবেশগত সংকটের এই সময়ে, হার্ভের উপন্যাস যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমরা একা, অথচ পরস্পর নির্ভরশীল। এই দূরত্বের মধ্যেও সেই বন্ধন অটুট থাকে-একটি সম্মিলিত মানবিকতা; যা পৃথিবী ও তার বাইরের সীমাহীন অন্ধকারে জুড়ে থাকা মানুষের জীবনকে আক্ষরিক অর্থেই বেঁধে রাখে।
কিছুদিন আগেই গ্রিক পুরাণ নিয়ে নেটফ্লিক্সে একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখছিলাম, যা আবারও মনে করিয়ে দিল, এই মহাকাশচারীরা যেন অলিম্পাসের দেবতাদের মতোই দূর থেকে আমাদের এই পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে আছেন। পৃথিবীর অগণিত সীমারেখা, সংঘর্ষ আর তুচ্ছ বিভেদ তাদের কাছে কতটাই না অপ্রয়োজনীয়। এই মহাকাশচারীরা বিভিন্ন দেশের হলেও মহাকাশ স্টেশনের ছোট্ট পরিবেশে জাতীয়তার সীমানা একপ্রকার হাস্যকর মনে হয়। বিজ্ঞান আর মানবতার প্রতি সমান মুগ্ধতাই এখানে আসল, যা জাতীয়তার সীমানার ঊর্ধ্বে উঠে একসঙ্গে কাজ করার শক্তি জোগায়। হার্ভে সেই যাত্রাকে এমনভাবে তুলে ধরেছেন, যেন মনে হয় মানুষের সংযোগের অদৃশ্য বন্ধনকেই আমরা নতুন করে উপলব্ধি করছি।
উপন্যাসে এক মহাকাশচারী পৃথিবীর সাথে এক ক্ষণস্থায়ী রেডিও সংযোগ তৈরি করেন। স্পেস স্টেশনের গতির কারণে সেই সংযোগ খুব দ্রুতই ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু এই ক্ষণস্থায়ী যোগাযোগ যেন এক অনন্য অনুভূতির জন্ম দেয়। অন্যদিকে, এক মহাকাশচারী মায়ের মৃত্যুর শোকে নতুন দৃষ্টিকোণে দূরত্ব ও মৃত্যুকে উপলব্ধি করে। সেই প্রেক্ষাপট থেকে হার্ভের উপন্যাস যেন শোক আর নিঃসঙ্গতাকে মহাজাগতিক উচ্চতায় নিয়ে যায়।
আমি সাধারণত বইয়ের গল্পের স্থানগুলোয় গিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে বইয়ের নির্দিষ্ট অংশ পড়তে ভালোবাসি। তবে ‘অরবিটাল’ নিয়ে তা সম্ভব নয়। কারণ এই গল্পের স্থান পৃথিবীর বাইরে, যা আমার সাধ্যের বাইরে। সম্প্রতি স্পেস সেন্টার হিউস্টনে গিয়েছিলাম, যেখানে বড় পর্দায় নাসার মহাকাশ থেকে নেওয়া পৃথিবীর কিছু দৃশ্য প্রদর্শিত হতে দেখেছিলাম। সেই পর্দাগুলির সামনে দাঁড়িয়ে একরকম ভার্চুয়াল অভিজ্ঞতায় মগ্ন হয়েছিলাম, যেন হার্ভের গদ্যের প্রতিটি শব্দ ভেসে আসছে মহাকাশের গভীরতা থেকে।
হার্ভে এই বইটিকে এক নিরিবিলি গদ্যের ছন্দে সাজিয়েছেন। বইয়ের প্রতিটি শব্দ মনে হয় খুব সচেতনভাবে ব্যবহৃত হয়েছে; যেন প্রতিটি বাক্যের পিছনে গভীর ভাবনার নিদর্শন রয়েছে। এই উপন্যাসটি রাজনৈতিক ফিকশনের জন্য অরওয়েল পুরস্কারের তালিকায়ও অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, কারণ এটি গভীরভাবে জাতিগত বিভেদের কথাও বলে। মহাকাশ থেকে পৃথিবীকে দেখলে এমন কিছু বিষয়ের গুরুত্ব হারিয়ে যায়, যা পৃথিবীতে থাকা অবস্থায় অপরিহার্য বলে মনে হয়। দেশের সীমানা, সংঘাতের কৃত্রিম কারণগুলো এমন উচ্চতা থেকে তুচ্ছ মনে হয়। মহাকাশচারীদের নিজেদের জীবনেও যেন এই ধরনের পরিবর্তন এসেছে।
এই উপন্যাস পড়তে পড়তে মনে হয়েছিল মহাকাশচারীরা যেন নিজেদের মধ্যে একটি অদৃশ্য সংযোগ খুঁজে পেয়েছেÑ পৃথিবীর বাইরের জীবন যা তাদেরকে শুধু বিজ্ঞান নয়, মানবতার প্রতিও নতুন দৃষ্টিকোণ দিয়েছে। তাদের কাছে সময় যেন অন্যরকম অর্থ বহন করে আর সময়ের এই একঘেয়ে গতিময়তায় তারা একে অপরের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। বইটি মাঝে মাঝে আমাদের মহাকাশচারীদের ব্যক্তিগত অনুভূতির কিছু ঝলক দেখায়, যেখানে তাদের মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা স্মৃতি বা প্রিয়জনের জন্য অপেক্ষা সবই ধরা পড়ে। অথচ একই সময়ে, সেই স্মৃতিগুলো তাদের পৃথিবীর সঙ্গে এক দূরত্ব বজায় রাখতে সাহায্য করে। হার্ভের গল্পে এই ক্ষণিক সংযোগ আর বিচ্ছিন্নতার মেলবন্ধন যেন এক নিঃশব্দ ভাষায় জীবন্ত হয়ে ওঠে।
হার্ভের বর্ণনায় পৃথিবী যেন এক জীবন্ত দৃশ্যপট-মেঘমুক্ত অ্যান্টার্কটিকা থেকে শুরু করে মালয়েশিয়ার উপকূলে মাছ ধরার নৌকার ক্ষীণ আলো পর্যন্ত সবকিছু এতই স্পষ্ট। আর সেই গ্রহের চারপাশে ভাসমান অরোরা আলোর মতো মহাজাগতিক দৃশ্য যেন আমাদের চোখের সামনে খুলে দেয়। তার লেখা যেন পাঠককে সরাসরি মহাকাশে নিয়ে যায়, যেখানে পৃথিবী ও মানুষের সম্পর্ক এক মহাজাগতিক উচ্চতায় প্রতিফলিত।
‘অরবিটাল’ একটি মনোমুগ্ধকর বই। এটি আমাকে মনে করিয়ে দেয় কেন আমি পড়তে ভালোবাসি-ভাষার মাঝে হারিয়ে গিয়ে পৃথিবীকে নতুনভাবে দেখা আর নিজেকে নতুন করে উপলব্ধি করার এক অতুলনীয় অভিজ্ঞতা। ছোট বই হলেও মনে হয়েছিল জীবনের সবকিছুই যেন এতে অন্তর্ভুক্ত।
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ