প্রত্যাশা ডেস্ক: গাজীপুরে টঙ্গীর ইজতেমা মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মাওলানা জুবায়ের ও মাওলানা সাদ কান্ধলভীর অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় আরও দুই জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে এ ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে চারজনে দাঁড়িয়েছে। ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া ব্যক্তির নাম বিল্লাল হোসেন (৬০)।
এই ঘটনার পর গাজীপুরে টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানসহ আশপাশের তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) দুপুরে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার ড. নাজমুল করিম খান স্বাক্ষরিত এক গণ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
ইজতেমা মাঠে হামলা ও সংঘর্ষে চারজন নিহত হয়েছেন জানিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের ছাড় দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই। এ ঘটনায় মামলা হবে জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, মামলার পর জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে। বুধবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষ মাওলানা জুবায়েরপন্থী ও সাদপন্থীদের সঙ্গে আলাদা বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এ কথা বলেন।
পুলিশ ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুরের টঙ্গীর ইজতেমা মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মাওলানা জুবায়ের ও মাওলানা সাদ কান্ধলভীর অনুসারীদের মধ্যে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (ডিসি-টঙ্গী বিভাগ) এন এম নাসিরুদ্দিন বুধবার বেলা দুইটার দিকে বলেন, ‘এ পর্যন্ত তিনজনের মৃত্যুর ঘটনা নিশ্চিত হয়েছি।’
অবশ্য বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মো. মামুনুল হক উল্লেখ করেছেন, নিহত হয়েছেন চারজন। তিনি বলেছেন, এটা সংঘর্ষে নিহত হওয়ার ঘটনা নয়। সাদপন্থীরা হামলা করে চারজনকে হত্যা করেছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাও উল্লেখ করেন, নিহত হয়েছেন চারজন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দুই পক্ষের সঙ্গে আলাদাভাবে বৈঠক করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, জড়িত ব্যক্তিদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে। সাদপন্থীরা বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নিতে পারবেন কি না, এমন এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, তারা দুই পক্ষ যদি আলোচনা করে সমাধান করতে পারে, তাহলে সাদপন্থীরা ইজতেমায় অংশ নিতে পারবেন। ইজতেমার তারিখ সরকার বাতিল করেনি। তারা আলোচনা করুক।
সংঘর্ষের ঘটনায় এখন পর্যন্ত উভয় পক্ষের আহত ৩৫ জন চিকিৎসা নিতে ঢাকা মেডিকেলে এসেছেন বলে হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে।
টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মো. আমিরুল ইসলাম বাচ্চু (৭০) নামের এক ব্যক্তিকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। তার বাড়ি কিশোরগঞ্জে। সংঘর্ষে তাইজুল ইসলাম নামের আরেক মুসল্লি নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন মাওলানা সাদের অনুসারীদের গণমাধ্যম সমন্বয়ক মো. সায়েম। তিনি বলেন, তাইজুলের বাড়ি বগুড়ায়। ঢাকা মেডিকেল সূত্র জানায়, টঙ্গীর স্থানীয় হাসপাতাল হয়ে বিল্লালকে ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ঢাকা মেডিকেল পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক মো. ফারুক বলেন, বিল্লালের মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। ৩৫ জনকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে ৭ জন ভর্তি রয়েছেন। তিনি আরও বলেন, এ ঘটনায় মেডিকেল চত্বরে উভয় পক্ষের মধ্যে হট্টগোলের সৃষ্টি হয়। পরে হাসপাতালে অতিরিক্ত পুলিশ, সেনাবাহিনী ও আনসার সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
গাজীপুর পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আগামী শুক্রবার থেকে টঙ্গীর ইজতেমা মাঠে পাঁচ দিন ইজতেমা করতে চান মাওলানা সাদের অনুসারীরা। মাওলানা জুবায়েরের অনুসারীরা তাদের এখানে ইজতেমা করতে দিতে চান না। এ জন্য আগে থেকে ইজতেমা মাঠ দখলে নেন জুবায়ের অনুসারীরা। এ নিয়ে কয়েক দিন ধরেই দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে চারদিক থেকে মাঠে প্রবেশ করতে থাকেন সাদের অনুসারীরা। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে মাঠ ছেড়ে দেন জুবায়ের অনুসারীরা।
জানা গেছে, বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) দিবাগত ভোররাত ৩টা থেকে ইজতেমা মাঠ দখলে নেওয়ার চেষ্টা করলে সংঘর্ষের শুরু। জুবায়েরপন্থি তাবলিগ জামাত (শুয়ারি নেজাম)-এর মিডিয়া সমন্বয়কারী হাবিবুল্লাহ রায়হান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এর আগে নিহত দুইজন হলেন-কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার এগারসিন্দু গ্রামের আমিনুল ইসলাম বাচ্চু (৭০), রাজধানীর দক্ষিণ খান এলাকার আব্দুস সামাদের ছেলে বেলাল হোসেন (৬০)।
আহতরা হলেন-ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আব্দুর রউফ (৫৫), ময়মনসিংহের মজিবুর রহমান (৫৮), গাজীপুরের আব্দুল হান্নান (৬০), টঙ্গীর জহুরুল ইসলাম (৩৮), প্রান্ত (৫৫), গোপালগঞ্জের আরিফ (৩৪), সাভারের ফয়সাল (২৮), আরিফুল ইসলাম (৫০), আনোয়ার (২৬), নরসিংদীর তরিকুল (৪২), উকিল মিয়া (৫৮), চট্টগ্রামের সাহেদ (৪৪), কেরানীগঞ্জের খোরশেদ আলম (৫০), বেলাল (৩৪), নারায়ণগঞ্জের আনোয়ার (৫০), আবু বক্কর (৫৯), নোয়াখালী সদরের আনোয়ার (৭৬), সাতক্ষীরার ফোরকান আহমেদ (৩৫)। বাকিদের নাম জানা যায়নি। তাদের টঙ্গী আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতাল এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
হাবিবুল্লাহ রায়হান বলেন, ‘মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মাওলানা জুবায়ের সাহেবকে চিঠি দেওয়া হয়। ওই চিঠিতে জানানো হয়, বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা দুপুর ১২টায় আমাদের সঙ্গে (জুবায়েরপন্থি) মিটিংয়ে বসবেন এবং সে সময় বিশ্ব ইজতেমা মাঠের বিষয়ে সুন্দর সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হবে। ভোররাত ৩টার দিকে আমরা খবর পাই, সারা দেশ থেকে সাদপন্থি মুসল্লিরা টঙ্গী ইজতেমা ময়দানের পশ্চিম পাশে বেলাল মসজিদে অবস্থান করছেন। বিভিন্ন এলাকা থেকে তাদের লোকজন ধারাল অস্ত্র-শস্ত্রসহ তুরাগ নদীর পশ্চিম তীর থেকে কামারপাড়া ব্রিজসহ বিভিন্ন সড়ক দিয়ে ময়দানের বিদেশি গেট ভেঙে ময়দানের ভেতরে প্রবেশ করতে থাকে।
‘এ সময় ময়দানের ভেতর থেকে জুবায়েরপন্থি মুসল্লিরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করলে উভয়ের মধ্যে ধাওয়া ও পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা শুরু হয়। এক পর্যায়ে সাদপন্থিরা মাঠে প্রবেশ করলে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। সংঘর্ষে দুজন মুসল্লি নিহত ও শতাধিক আহত হন।’
অপরদিকে, সাদপন্থি মুরুব্বি মুয়াজ বিন নূর এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, ‘আমরা এখন ইজতেমা ময়দানের নিয়ন্ত্রণে আছি। জুবায়ের অনুসারীদের আক্রমণে আমাদের এক ভাই শহীদ হয়েছেন।’ ময়দানে অনেক জুবায়েরপন্থি মুসল্লি চাকু ও ছোরাসহ আটক হচ্ছেন বলে তিনি দাবি করেন।
টঙ্গী আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সিনিয়র নার্স হাফিজুল ইসলাম বলেন, ‘টঙ্গী হাসপাতালে একজন এবং ঢাকায় নেওয়ার পথে রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকার বেলাল নামে দুই মুসল্লির মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।’ টঙ্গী পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাবিব ইস্কান্দার জানান, এ ঘটনায় দুই জন নিহত হয়েছেন। সকাল থেকে ইজতেমা ময়দান ও আশপাশের এলাকায় সেনাবাহিনী, র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
১৪৪ ধারা জারি: গাজীপুরে টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানসহ আশপাশের তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ১৪৪ ধারা জারির বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ আইন ২০১৮ এর ৩০ ও ৩১ ধারায় পুলিশ কমিশনারকে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখ দুপুর ২টা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বিশ্ব ইজতেমা ময়দানসহ আশপাশের ৩ (তিন) কিলোমিটার গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ এলাকায় নিম্নলিখিত আদেশ বলবৎ থাকবে-
বিশ্ব ইজতেমা মাঠে জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ইজতেমা মায়দানসহ আশপাশের ৩ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে দুই বা ততোধিক ব্যক্তি একত্রে ঘোরাফেরা বা জমায়েত এবং মিছিল সমাবেশ করতে পারবে না, কোনো প্রকার অস্ত্র-শস্ত্র, ছুরি, লাঠি, বিস্ফোরক দ্রব্যাদি বা এ জাতীয় কোনো পদার্থ বহনে নিষেধাজ্ঞা, কোনো প্রকার লাউডস্পিকার বা উচ্চস্বরে শব্দ করতে পারবে না। আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। এ বিষয়ে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার ড. নাজমুল করিম খান বলেন, মেট্রোপলিটন এলাকার জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে।