ঢাকা ০১:৩৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৫ অগাস্ট ২০২৫

বিশ্বকাপ ফুটবল ও বাংলাদেশের হয়ে কিছু কথা

  • আপডেট সময় : ১০:৩১:০৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৩ অক্টোবর ২০২২
  • ৮৫ বার পড়া হয়েছে

আদম তমিজী হক : আগামী ২০ নভেম্বর থেকে মাঠে গড়াচ্ছে ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবল। অলিম্পিক গেমস এই জগতের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া আসর, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু, জনপ্রিয়তায় ফুটবল বিশ্বকাপের ধারেকাছে নেই আর কিছু। এমনি এমনি তো আর ফুটবল বিশ্বকাপকে ‘গ্রেটেস্ট শো অন দ্য আর্থ’ বলা হয় না। আমাদের দেশেই ফিফা বিশ্বকাপ নিয়ে যে উন্মাদনা দেখা যায়, সেটির সঙ্গে তুলনা হয় না কোনোকিছুর। প্রতি চার বছর পর এই বিশ্বকাপের এক মাসে যেন বাংলাদেশের মানুষ ভুলে যায় সবকিছু। বুঁদ হয়ে থাকে টেলিভিশনের পর্দায় ২২ জন মানুষের একটি চামড়ার গোলক নিয়ে শ্বাসরুদ্ধ লড়াই দেখার জন্য । নিজেরা বিশ্বকাপ ফুটবলের ধারেকাছে নেই। কিন্তু, তবু ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানি আর হালের পর্তুগাল নিয়ে আমাদের উচ্ছ্বাস কারোর চেয়ে কম না।
অধীর আগ্রহে অপেক্ষা আছে আমারও কাতার বিশ্বকাপের জন্য। আশা করছি, ব্যবসায়িক, সামাজিক আর রাজনৈতিক ব্যস্ততার মাঝেও যত বেশি সম্ভব খেলা টিভি স্ক্রিনে দেখার। তবে, বিশ্বকাপ শুরুর আগে আমার মন কিছুটা খারাপও। বারবার মন প্রশ্ন করছে, আর কতকাল বিশ্বকাপে অন্য দেশকে সমর্থক করব? আর কতকাল অন্যের সমর্থনে মিথ্যে খুশিতে মনকে সান্ত¡না দেবো? আমার বাংলাদেশ, প্রিয় জন্মভূমি কি কোনোদিন বিশ্বকাপ ফুটবল খেলবে না? বিশ্বের সেরা শক্তিগুলো পারলে বাংলাদেশ কেন পারবে না?
শোনা যাচ্ছে, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হামজা চৌধুরী খেলতে চান বাংলাদেশের হয়ে। মায়ের সূত্রে বাংলাদেশি হওয়ায় তার সে সুযোগ আছে। নাইজেরিয়ার এলিটা কিং অনেকদিন ধরে বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে অপেক্ষায় আছেন লাল সবুজের দেশের হয়ে খেলার। এরইমধ্যে সুইডেন প্রবাসী জামাল ভুঁইয়া বাংলাদেশের বড় তারকায় পরিণত হয়েছেন। ফিনল্যান্ডে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশি বাবার সন্তান তিনি। তিনি বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে যাত্রা শুরু করেছেন। ২০২২ সাল থেকে ব্রাজিলের রবসন রবিনিও খেলছেন বাংলাদেশের পেশাদার লীগে। তিনিও বাংলাদেশের প্রেমে পড়েছেন। সুযোগ পেলে খেলতে চান বাংলাদেশ জাতীয় দলে, এমনটাই শুনেছি। সাবেক কোচ জেমি ডে জাতীয় দলের জন্য প্রবাসী ফুটবলারদের খুঁজে বের করার একটা দায়িত্ব নিয়েছিলেন। জেমি ডে‘র বিদায়ের পর সেই কার্যক্রম কতটা গতিশীল আছে, কে জানে।
বিদেশ থেকে কম বয়সী ফুটবলারদের নাগরিকত্ব দিয়ে জাতীয় দলের জন্য তৈরি করা অন্যায় কিছু নয়। শুধু ফুটবল কেন, ক্রিকেটসহ অন্য প্রায় সব খেলায় এই রীতি চালু আছে। পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা আর আর্থিক নিশ্চয়তা পেলে নিজ দেশের জাতীয় দলের সম্ভাবনার বাইরে থাকা প্রতিভাবান ফুটবলারদের এনে বাংলাদেশ কাজে লাগাতে পারে। এটি ফুটবলে এগিয়ে যাওয়ার একটা শর্টকাট পথ। এছাড়া, নিজেদের ঘরোয়া ফুটবলের কাঠামো শক্তিশালী করা, পেশাদার ক্লাবগুলোর একাডেমি আর বয়সভিত্তিক দল থাকার বাধ্যবাধকতা থাকলে নতুন নতুন প্রতিভা উঠে আসতে বাধ্য, যা বাংলাদেশের ফুটবলকে একটি সময় দাঁড় করাবে শক্ত ভিতের ওপর। এছাড়া, প্রতিটা জেলায় প্রথম, দ্বিতীয় আর তৃতীয় বিভাগের সঙ্গে স্কুল-কলেজ পর্যায়ে ফুটবল আসর জরুরি, যা একসময় নিয়মিত হয়েছে। কয়েক বছর যাবত বাংলাদেশে হচ্ছে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব ফুটবল টুর্নামেন্ট। এই আসরে খেলেছেন মার্জিয়া, সানজিদা খাতুন, শিউলি আজিম, মারিয়া মান্ডা, শামসুন্নাহার সিনিয়র ও শামসুন্নাহার জুনিয়র। যারা এখন জাতীয় দলের সদস্য। কিছু দিন আগে যারা নেপালের কাঠমান্ডু থেকে প্রথমবারের মতো নারী সাফ ফুটবলের শিরোপা জিতে সারা দেশকে ভাসিয়েছেন উল্লাসে। বহুদিন ধরে পুরুষ ফুটবল দলের টানা ব্যর্থতার মাঝে মেয়েদের সাফল্য যেন দমবন্ধ করা দাবদাহের পর এক পশলা বৃষ্টি।
মেয়েদের সাফল্য নিয়ে আমি আগেও লিখেছি। বলেছি, মেয়েদের পক্ষে এশিয়ান লেভেলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে জায়গা করে নেওয়া খুবই সম্ভব। সাফের সাফল্যে বাংলাদেশের মেয়েরা আট ধাপ এগিয়ে উঠে এসেছে ফিফা র‌্যাংকিং-এর ১৪০তম অবস্থানে। এশিয়ায় সেরা পঞ্চাশের বাইরে বাংলাদেশের মেয়েদের ওপরে আছে সিঙ্গাপুর , মঙ্গোলিয়া, নেপাল, কাজাখস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, হংকং, ইরান আর ভারত। এদের মধ্যে সবার আগে ৬১তম অবস্থানে আছে ভারত। চলতি বছরেই বাংলাদেশের মেয়েরা র‌্যাংকিংয়ে এগিয়ে থাকা মালয়েশিয়া, নেপাল আর ভারতকে নাস্তানাবুদ করেছে। স্বপ্ন দেখিয়েছে, মাঠে নিয়মিত আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলার সুযোগ পেলে নারী ফুটবলের র‌্যাংকিংয়ে উন্নতি কেউ ঠেকাতে পারবে না। এতে মেয়েদের এশিয়া কাপের মূল পর্বেও জায়গা পাওয়া সম্ভব সাবিনা খাতুনদের পক্ষে।
বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে কথা হয়েছিল বাংলাদেশের ক্রীড়াসংবাদ মাধ্যমের পথিকৃৎ ‘ক্রীড়ালোক’-এর প্রধান সম্পাদক কামরুল হাসান নাসিমের সঙ্গে। ভদ্রলোকের দুটি প্রস্তাব আমার খুব মনে ধরেছে। এক. ফুটবলের জন্য আলাদা একটা মন্ত্রণালয়। বাফুফে থাকবে সেই মন্ত্রণালয়ের অধীনে। ফুটবলের সামগ্রিক নির্দেশনা আর বাজেট আসবে মন্ত্রণালয় থেকে। সেই ক্ষেত্রে বাফুফে সভাপতি পদে কাজী সালাহউদ্দিন বহাল থাকলেও কোনো সমস্যা নেই। কারণ, যে যত সমালোচনা করুক, সালাহউদ্দিন ফুটবলের ভালো চান, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু, ফুটবলে অর্থায়ন একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তাছাড়া, বিদেশি ফুটবলারদের বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে খেলাবার বিষয়টিও মন্ত্রণালয়ের সাহায্য পেলে সহজ হয়ে যায়। আর একটু আলাদা ফুটবল মন্ত্রণালয় পেলে কাজী সালাহউদ্দিন আর বাফুফের কাজ অনেক সহজ হয় যায়।
কামরুল হাসান নাসিমের দ্বিতীয় প্রস্তাব ছিল—স্কুল ফুটবল থেকে ১০-১২ বছর বয়সী বাচ্চাদের বাছাই করে কয়েক বছরের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া যেতে পারে বিদেশের কোনো একাডেমিতে। চীনেই এমন একাডেমি আছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায়, দু-একজন উঠতি ফুটবলারকে মাঝে মাঝে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনায়। ২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো ব্রাজিলের সোসিয়াদে স্পোরটিভা ডো গামা ক্লাবের অধীনে এক মাসের অনুশীলন করার সুযোগ পেয়েছিল বাংলাদেশের ৪ ফুটবলার। চলতি বছর ১১ জনকে পাঠানো হয়েছিল ব্রাজিলেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনূর্ধ্ব-১৭ টুর্নামেন্ট থেকে তাদের বাছাই করা হয়। এই উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু, এতে লাভ হবে না আসলে। কারণ, এই প্রশিক্ষণ স্বল্প মেয়াদের। আর বয়সটাও নতুন করে শেখার জন্য একটু বেশি। আসলে ব্যবস্থা করতে হবে শিশু ফুটবলারদের জন্য। কয়েক বছরের জন্য তাদের সমস্ত খরচ আর পড়াশুনার দায়িত্ব নিয়ে কাজটি করতে পারে মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা ফুটবল ফেডারেশন। এখন থেকেই অন্তত ৫০-৬০ শিশু ফুটবলারকে কাজটি করা গেলে এক যুগের মধ্যে বাংলাদেশের ফুটবলের চেহারা বদলে দেওয়া সম্ভব।
আমি ফুটবল বিশেষজ্ঞ নই। আমি একজন সমাজকর্মী, রাজনীতিবিদ। তবু দেশের ফুটবলের জন্য আমার মমত্ববোধ অসীম। আমি চাই, সঠিক পরিকল্পনা আর উদ্যোগে বাংলাদেশের ফুটবল একদিন বিশ্ব দরবারে মাথা তুলে দাঁড়াক। কাতার যদি বিশ্বকাপের স্বাগতিক হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার এক যুগের মধ্যে তরুণ খেলোয়াড়দের পেছনে সঠিক অর্থ বিনিয়োগ আর বিদেশি ফুটবলারদের নাগরিকত্ব দিয়ে এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন হতে পারে, আমরা কেন পারব না? বিশ্বকাপ না হোক, বাংলাদেশের ফুটবলকেও এশিয়ান লেভেলে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। সেই জন্য চাই শুধু ফুটবলের কর্তাব্যক্তিদের সদিচ্ছা আর সরকারের আন্তরিকতা। একটি আলাদা ফুটবল মন্ত্রণালয় গড়ে দিয়ে সেই কাজটি করতে পারে বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মতো ‘ক্রীড়াপাগল’ সরকারপ্রধান খুঁজে পাওয়া যাবে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে রাষ্ট্রীয় নানা ক্ষেত্রে অনেক বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ফুটবল মন্ত্রণালয় তৈরি করে তিনি আরেকটি চেষ্টা করতে পারেন দেশের মৃতপ্রায় ফুটবলকে বাঁচিয়ে তোলার। সেটা সফল হলে বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশের ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাসেও থাকবেন বৈপ্লবিক চরিত্র হয়ে।
লেখক : রাজনীতিক ও সমাজকর্মী।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

বিশ্বকাপ ফুটবল ও বাংলাদেশের হয়ে কিছু কথা

আপডেট সময় : ১০:৩১:০৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৩ অক্টোবর ২০২২

আদম তমিজী হক : আগামী ২০ নভেম্বর থেকে মাঠে গড়াচ্ছে ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবল। অলিম্পিক গেমস এই জগতের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া আসর, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু, জনপ্রিয়তায় ফুটবল বিশ্বকাপের ধারেকাছে নেই আর কিছু। এমনি এমনি তো আর ফুটবল বিশ্বকাপকে ‘গ্রেটেস্ট শো অন দ্য আর্থ’ বলা হয় না। আমাদের দেশেই ফিফা বিশ্বকাপ নিয়ে যে উন্মাদনা দেখা যায়, সেটির সঙ্গে তুলনা হয় না কোনোকিছুর। প্রতি চার বছর পর এই বিশ্বকাপের এক মাসে যেন বাংলাদেশের মানুষ ভুলে যায় সবকিছু। বুঁদ হয়ে থাকে টেলিভিশনের পর্দায় ২২ জন মানুষের একটি চামড়ার গোলক নিয়ে শ্বাসরুদ্ধ লড়াই দেখার জন্য । নিজেরা বিশ্বকাপ ফুটবলের ধারেকাছে নেই। কিন্তু, তবু ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানি আর হালের পর্তুগাল নিয়ে আমাদের উচ্ছ্বাস কারোর চেয়ে কম না।
অধীর আগ্রহে অপেক্ষা আছে আমারও কাতার বিশ্বকাপের জন্য। আশা করছি, ব্যবসায়িক, সামাজিক আর রাজনৈতিক ব্যস্ততার মাঝেও যত বেশি সম্ভব খেলা টিভি স্ক্রিনে দেখার। তবে, বিশ্বকাপ শুরুর আগে আমার মন কিছুটা খারাপও। বারবার মন প্রশ্ন করছে, আর কতকাল বিশ্বকাপে অন্য দেশকে সমর্থক করব? আর কতকাল অন্যের সমর্থনে মিথ্যে খুশিতে মনকে সান্ত¡না দেবো? আমার বাংলাদেশ, প্রিয় জন্মভূমি কি কোনোদিন বিশ্বকাপ ফুটবল খেলবে না? বিশ্বের সেরা শক্তিগুলো পারলে বাংলাদেশ কেন পারবে না?
শোনা যাচ্ছে, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হামজা চৌধুরী খেলতে চান বাংলাদেশের হয়ে। মায়ের সূত্রে বাংলাদেশি হওয়ায় তার সে সুযোগ আছে। নাইজেরিয়ার এলিটা কিং অনেকদিন ধরে বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে অপেক্ষায় আছেন লাল সবুজের দেশের হয়ে খেলার। এরইমধ্যে সুইডেন প্রবাসী জামাল ভুঁইয়া বাংলাদেশের বড় তারকায় পরিণত হয়েছেন। ফিনল্যান্ডে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশি বাবার সন্তান তিনি। তিনি বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে যাত্রা শুরু করেছেন। ২০২২ সাল থেকে ব্রাজিলের রবসন রবিনিও খেলছেন বাংলাদেশের পেশাদার লীগে। তিনিও বাংলাদেশের প্রেমে পড়েছেন। সুযোগ পেলে খেলতে চান বাংলাদেশ জাতীয় দলে, এমনটাই শুনেছি। সাবেক কোচ জেমি ডে জাতীয় দলের জন্য প্রবাসী ফুটবলারদের খুঁজে বের করার একটা দায়িত্ব নিয়েছিলেন। জেমি ডে‘র বিদায়ের পর সেই কার্যক্রম কতটা গতিশীল আছে, কে জানে।
বিদেশ থেকে কম বয়সী ফুটবলারদের নাগরিকত্ব দিয়ে জাতীয় দলের জন্য তৈরি করা অন্যায় কিছু নয়। শুধু ফুটবল কেন, ক্রিকেটসহ অন্য প্রায় সব খেলায় এই রীতি চালু আছে। পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা আর আর্থিক নিশ্চয়তা পেলে নিজ দেশের জাতীয় দলের সম্ভাবনার বাইরে থাকা প্রতিভাবান ফুটবলারদের এনে বাংলাদেশ কাজে লাগাতে পারে। এটি ফুটবলে এগিয়ে যাওয়ার একটা শর্টকাট পথ। এছাড়া, নিজেদের ঘরোয়া ফুটবলের কাঠামো শক্তিশালী করা, পেশাদার ক্লাবগুলোর একাডেমি আর বয়সভিত্তিক দল থাকার বাধ্যবাধকতা থাকলে নতুন নতুন প্রতিভা উঠে আসতে বাধ্য, যা বাংলাদেশের ফুটবলকে একটি সময় দাঁড় করাবে শক্ত ভিতের ওপর। এছাড়া, প্রতিটা জেলায় প্রথম, দ্বিতীয় আর তৃতীয় বিভাগের সঙ্গে স্কুল-কলেজ পর্যায়ে ফুটবল আসর জরুরি, যা একসময় নিয়মিত হয়েছে। কয়েক বছর যাবত বাংলাদেশে হচ্ছে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব ফুটবল টুর্নামেন্ট। এই আসরে খেলেছেন মার্জিয়া, সানজিদা খাতুন, শিউলি আজিম, মারিয়া মান্ডা, শামসুন্নাহার সিনিয়র ও শামসুন্নাহার জুনিয়র। যারা এখন জাতীয় দলের সদস্য। কিছু দিন আগে যারা নেপালের কাঠমান্ডু থেকে প্রথমবারের মতো নারী সাফ ফুটবলের শিরোপা জিতে সারা দেশকে ভাসিয়েছেন উল্লাসে। বহুদিন ধরে পুরুষ ফুটবল দলের টানা ব্যর্থতার মাঝে মেয়েদের সাফল্য যেন দমবন্ধ করা দাবদাহের পর এক পশলা বৃষ্টি।
মেয়েদের সাফল্য নিয়ে আমি আগেও লিখেছি। বলেছি, মেয়েদের পক্ষে এশিয়ান লেভেলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে জায়গা করে নেওয়া খুবই সম্ভব। সাফের সাফল্যে বাংলাদেশের মেয়েরা আট ধাপ এগিয়ে উঠে এসেছে ফিফা র‌্যাংকিং-এর ১৪০তম অবস্থানে। এশিয়ায় সেরা পঞ্চাশের বাইরে বাংলাদেশের মেয়েদের ওপরে আছে সিঙ্গাপুর , মঙ্গোলিয়া, নেপাল, কাজাখস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, হংকং, ইরান আর ভারত। এদের মধ্যে সবার আগে ৬১তম অবস্থানে আছে ভারত। চলতি বছরেই বাংলাদেশের মেয়েরা র‌্যাংকিংয়ে এগিয়ে থাকা মালয়েশিয়া, নেপাল আর ভারতকে নাস্তানাবুদ করেছে। স্বপ্ন দেখিয়েছে, মাঠে নিয়মিত আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলার সুযোগ পেলে নারী ফুটবলের র‌্যাংকিংয়ে উন্নতি কেউ ঠেকাতে পারবে না। এতে মেয়েদের এশিয়া কাপের মূল পর্বেও জায়গা পাওয়া সম্ভব সাবিনা খাতুনদের পক্ষে।
বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে কথা হয়েছিল বাংলাদেশের ক্রীড়াসংবাদ মাধ্যমের পথিকৃৎ ‘ক্রীড়ালোক’-এর প্রধান সম্পাদক কামরুল হাসান নাসিমের সঙ্গে। ভদ্রলোকের দুটি প্রস্তাব আমার খুব মনে ধরেছে। এক. ফুটবলের জন্য আলাদা একটা মন্ত্রণালয়। বাফুফে থাকবে সেই মন্ত্রণালয়ের অধীনে। ফুটবলের সামগ্রিক নির্দেশনা আর বাজেট আসবে মন্ত্রণালয় থেকে। সেই ক্ষেত্রে বাফুফে সভাপতি পদে কাজী সালাহউদ্দিন বহাল থাকলেও কোনো সমস্যা নেই। কারণ, যে যত সমালোচনা করুক, সালাহউদ্দিন ফুটবলের ভালো চান, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু, ফুটবলে অর্থায়ন একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তাছাড়া, বিদেশি ফুটবলারদের বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে খেলাবার বিষয়টিও মন্ত্রণালয়ের সাহায্য পেলে সহজ হয়ে যায়। আর একটু আলাদা ফুটবল মন্ত্রণালয় পেলে কাজী সালাহউদ্দিন আর বাফুফের কাজ অনেক সহজ হয় যায়।
কামরুল হাসান নাসিমের দ্বিতীয় প্রস্তাব ছিল—স্কুল ফুটবল থেকে ১০-১২ বছর বয়সী বাচ্চাদের বাছাই করে কয়েক বছরের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া যেতে পারে বিদেশের কোনো একাডেমিতে। চীনেই এমন একাডেমি আছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায়, দু-একজন উঠতি ফুটবলারকে মাঝে মাঝে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনায়। ২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো ব্রাজিলের সোসিয়াদে স্পোরটিভা ডো গামা ক্লাবের অধীনে এক মাসের অনুশীলন করার সুযোগ পেয়েছিল বাংলাদেশের ৪ ফুটবলার। চলতি বছর ১১ জনকে পাঠানো হয়েছিল ব্রাজিলেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনূর্ধ্ব-১৭ টুর্নামেন্ট থেকে তাদের বাছাই করা হয়। এই উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু, এতে লাভ হবে না আসলে। কারণ, এই প্রশিক্ষণ স্বল্প মেয়াদের। আর বয়সটাও নতুন করে শেখার জন্য একটু বেশি। আসলে ব্যবস্থা করতে হবে শিশু ফুটবলারদের জন্য। কয়েক বছরের জন্য তাদের সমস্ত খরচ আর পড়াশুনার দায়িত্ব নিয়ে কাজটি করতে পারে মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা ফুটবল ফেডারেশন। এখন থেকেই অন্তত ৫০-৬০ শিশু ফুটবলারকে কাজটি করা গেলে এক যুগের মধ্যে বাংলাদেশের ফুটবলের চেহারা বদলে দেওয়া সম্ভব।
আমি ফুটবল বিশেষজ্ঞ নই। আমি একজন সমাজকর্মী, রাজনীতিবিদ। তবু দেশের ফুটবলের জন্য আমার মমত্ববোধ অসীম। আমি চাই, সঠিক পরিকল্পনা আর উদ্যোগে বাংলাদেশের ফুটবল একদিন বিশ্ব দরবারে মাথা তুলে দাঁড়াক। কাতার যদি বিশ্বকাপের স্বাগতিক হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার এক যুগের মধ্যে তরুণ খেলোয়াড়দের পেছনে সঠিক অর্থ বিনিয়োগ আর বিদেশি ফুটবলারদের নাগরিকত্ব দিয়ে এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন হতে পারে, আমরা কেন পারব না? বিশ্বকাপ না হোক, বাংলাদেশের ফুটবলকেও এশিয়ান লেভেলে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। সেই জন্য চাই শুধু ফুটবলের কর্তাব্যক্তিদের সদিচ্ছা আর সরকারের আন্তরিকতা। একটি আলাদা ফুটবল মন্ত্রণালয় গড়ে দিয়ে সেই কাজটি করতে পারে বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মতো ‘ক্রীড়াপাগল’ সরকারপ্রধান খুঁজে পাওয়া যাবে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে রাষ্ট্রীয় নানা ক্ষেত্রে অনেক বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ফুটবল মন্ত্রণালয় তৈরি করে তিনি আরেকটি চেষ্টা করতে পারেন দেশের মৃতপ্রায় ফুটবলকে বাঁচিয়ে তোলার। সেটা সফল হলে বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশের ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাসেও থাকবেন বৈপ্লবিক চরিত্র হয়ে।
লেখক : রাজনীতিক ও সমাজকর্মী।