ঢাকা ০২:২৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৫ অগাস্ট ২০২৫

বিশ্বকাপ ফাইনাল কড়চা

  • আপডেট সময় : ০২:২৩:১৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২২
  • ১০০ বার পড়া হয়েছে

ক্রীড়া ডেস্ক : বিশ্বকাপের ইতিহাসে কিছু ফাইনাল জন্ম দিয়েছে অবিশ্বাস্য, দুর্দান্ত ও স্মরণীয় মুহূর্তের। মাঠে ও মাঠের বাইরে নানা ঘটনা শিরোপা নির্ধারণের মঞ্চে যোগ করেছে ভিন্ন মাত্রা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা প্রভাব ফেলেছে ম্যাচেও। কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে আগামী রোববার মুখোমুখি হবে ফ্রান্স ও আর্জেন্টিনা। ফুটবলের এই দুই পরাশক্তির লড়াইয়ের আগে ফিরে দেখা যাক আগের কয়েকটি আসরের ফাইনালে ঘটে যাওয়া বিচিত্র কিছু ঘটনা।
১৯৩০ বিশ্বকাপ : প্রথম বিশ্বকাপ শুরুর আগেই আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ে ঠিক করে নিয়েছিল যে, টুর্নামেন্টে খেলবে নিজেদের আনা বল নিয়ে। এই দুই দল জায়গা করে নেয় ফাইনালে। কার আনা বল নিয়ে খেলা হবে, এ নিয়ে রীতিমতো কুরুক্ষেত্র তৈরি হয়। ফাইনালের রেফারি বেলজিয়ামের জান লানজেনাস পরে বলেছিলেন ওই ম্যাচে নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে। তিনি ম্যাচ পরিচালনা করেছিলেন, শার্ট, ব্লেজার, টাই ও নিকারকার্স পরে। “যখন ম্যাচের জন্য বল বেছে নেওয়ার সময় এলো, তখন দুই দেশের মধ্যে অবিশ্বাস্য বিদ্বেষ প্রকাশ্য হয় গেল। দুই দলই দাবি তুলল, খেলতে হবে তাদের আনা বল দিয়ে।” বাধ্য হয়ে হস্তক্ষেপ করতে হয় তৎকালীন ফিফা প্রধান জুলে রিমেকে। ঠিক হয় দুই অর্ধে খেলা হবে দুই দলের আনা বল দিয়ে। ম্যাচের ফল থেকে দৃশ্যমান যে, এই সিদ্ধান্ত প্রভাব ফেলেছিল ফাইনালে। স্কটল্যান্ড থেকে আমদানি করা বল দিয়ে খেলে প্রথমার্ধে ২-১ গোলে এগিয়ে ছিল আর্জেন্টিনা। দ্বিতীয়ার্ধে ম্যাচ ঘুরিয়ে দেয় উরুগুয়ে। ইংল্যান্ড থেকে কিনে আনা বলে খেলে বিশ্বকাপ জিতে নেয় ৪-২ গোলে জিতে!
১৯৫০ বিশ্বকাপ : ফাইনালের দিন ও মুন্দো পত্রিকা হেড লাইন করে, ‘এই যে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা।’ নিচে ছাপায় ব্রাজিল দলের ছবি। আর একটি মন্দিরের ভেতর ঝুলিয়ে রাখে, যেটা তারা বানিয়েছিল ঠিক এই কাজের জন্যই। উরুগুয়ের ক্ষিপ্ত অধিনায়ক ওব্দুলিয়ো ভারেলা ২০ কপি কিনে আনেন। এরপর সেগুলো তাদের থাকার হোটেলের টয়লেটের মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে রাখেন। আয়নার ওপর চক দিয়ে লেখেন ‘এই খবরের কাগজে প্রস্রাব করুন ও মাড়িয়ে যান।’ ভারেলা এরপর সতীর্থদের টয়লেটে যেতে বলেন ও তার নির্দেশ অনুসরণ করতে বলেন। শিরোপা জিততে ব্রাজিলের স্রেফ ড্র প্রয়োজন ছিল। এক পর্যায়ে ১-০ গোলে এগিয়েও গিয়েছিল তারা। অধিনায়ক ভারেলার মন্ত্রে উজ্জ্বীবিত উরুগুয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে জিতে যায় ২-১ গোলে। ব্রাজিলের হৃদয় ভেঙে পুনরুদ্ধার করে শিরোপা। ম্যাচের পর কঠোর সতর্ক বার্তা উপেক্ষা করে রিও-এর একটি পানশালায় যান ভারেলা। ধারণা করা হচ্ছিল তার উপর চড়াও হতে পারে ব্রাজিলিয়ানরা। কিন্তু আদতে হয়েছিল তার উল্টোটা, জানান ভারেলা নিজেই। “আমি একটি পানীয় অর্ডার দিয়েছিলাম এবং আশা করছিলাম যে কেউ আমাকে চিনবে না। আমি ভেবেছিলাম তারা যদি চিনতে পারে তাহলে তারা হয়তো আমাকে মেরেই ফেলবে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে বিধ্বস্ত হওয়ার পরও তারা আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছিল এবং আমার সঙ্গে মদ্যপানও করেছিল।”
১৯৫৪ বিশ্বকাপ : ১৯৫৪ বিশ্বকাপের ফাইনালের দিনটা যে খুব সুখকর হতে যাচ্ছে না, তা একরকম মেনেই নিয়েছিলেন জার্মান রেডিওতে কাজ করা ধারাভাষ্যকার হেরবার্ত জিমারমান। কারণ ফাইনালের প্রতিপক্ষ হাঙ্গেরি যে গ্রুপ পর্বে জার্মানিকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল ৮-৩ গোলে। অসহায় জিমারমান ব্যস্ত সময় পার করতে হয়েছিল হাঙ্গেরিয়ানদের গোলের বর্ণনায়। ফাইনালেও তার পুনরাবৃত্তি হওয়ার জোর সম্ভাবনাই ছিল, কারণ দারুণ ছন্দে থাকা দলটি ফাইনালে খেলেছিল ৩০ ম্যাচে অপরাজিত থেকে। ফাইনালে ৮ মিনিটের মধ্যে জিমারমানকে হতাশ করে ২-০ গোলে এগিয়ে যায় হাঙ্গেরি। ওই সময়ের অনূভুতি জানাতে গিয়ে তিনি পরে বলেন, “আশা করছিলাম আমরা ব্যবধানটা যাতে কম রাখতে পারি।” কিন্তু হার না মানা জার্মানরা দুর্দান্তভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে ম্যাচে সমতা ফেরায়। ৮৪তম মিনিটে জয়সূচক গোল করেন জার্মানির হেলমুট হ্রান। ধারাভাষ্যে চিৎকার করে ওঠেন জিমারমান “হ্রান এর শট! গোল! গোল! গোল! গোল!” এরপর ক্ষণিকের জন্য চুপ হয়ে যান তিনি। এদিকে পশ্চিম জার্মানির শ্রোতারা অস্থির হয়ে ভাবছিলেন, রেডিওতে তাদের সংযোগে কোনো বিঘœ ঘটল কি-না। আট সেকেন্ডের নীরবতার পর জিমারম্যান তাল খুঁজে পান। “জার্মানির গোল! জার্মানি ৩-২ ব্যবধানে এগিয়ে। আমাকে পাগল বলতে পারেন, আমাকে উন্মাদও বলতে পারেন!” কিকার, লা গাজ্জেত্তা দেল্লো স্পোর্ত ও দা গার্ডিয়ান এটিকে ফুটবলের ইতিহাসের সবচেয়ে আইকনিক ধারাভাষ্য হিসেবে মর্যাদা দিয়েছে।
১৯৭০ বিশ্বকাপ : ইতালির বিপক্ষে ফাইনালের শেষের ২০ মিনিটে যেন আবেগ ধরে বসেছিল ব্রাজিলের তোস্তাকে। আসরে মেকশিফট ‘৯ নম্বর’ হিসেবে খেলা এই ফুটবলার চোখে জল নিয়েই খেলা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তবে তা হতাশার নয়, আনন্দের। অবিশ্বাস্যভাবে বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়ে তিনি যে এগিয়ে যাচ্ছিলেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দিকে।
বিশ্বকাপ শুরুর আগে চোখের রেটিনা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর তোস্তাওকে বলা হয়েছিল যে মাত্র ২৬ বছর বয়সেই তার ফুটবল ক্যারিয়ার শেষ। তবে জরুরি অস্ত্রোপচারের পর এবং কিংবদন্তি পেলের অনুরোধে বিশ্বকাপ স্কোয়াডে জায়গা পান তোস্তাও। ওই ম্যাচ নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ফিফাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, চোখের আঘাত, অস্ত্রোপচার, ক্যারিয়ার নিয়ে অনিশ্চয়তার পর বিশ্বকাপ জেতার অনুভূতি তার কিছু খুব বিশেষ কিছুই ছিল। “তৃতীয় গোলের পর, যে গোলটি ম্যাচটি ইতালির নাগালের বাইরে নিয়ে গিয়েছিল, আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে পরেছিলাম। আমি কাঁদতে শুরু করলাম এবং নিজেকে থামাতে পারলাম না। আমি ওই বিশ্বকাপে যাওয়ার জন্য যা যা করেছি তা নিয়ে ভাবছিলাম যে, আমি এটি থেকে ছিটকে পড়ার কতটা কাছাকাছি ছিলাম।” “আমি আমার চোখের অস্ত্রোপচারের জন্য বিশ্বজুড়ে ভ্রমণ করেছি। আমি আর খেলতে না পারার খুব কাছাকাছি ছিলাম এবং বিশ্বকাপে ডাক না পাওয়ার কাছাকাছি ছিলাম। আবার খেলায় অভ্যস্ত হওয়া সত্যিই কঠিন ছিল। যখন বুঝলাম আমরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হব, তখন আমি কান্না থামাতে পারিনি।” ম্যাচের পর পর দর্শকদের ভালবাসার সিক্ত তোস্তাও তার জার্সি, জুতো, প্যান্ট সব হারিয়ে কোনোমতে মাঠ ছাড়েন। “তারা এমনকি আমাকে তাদের দিকে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল।” তোস্তাও বিশ্বকাপে জেতা মেডেল পরে দিয়ে দিয়েছিলেন সেই চক্ষু বিশেষজ্ঞকে, যিনি তার চোখের অস্ত্রোপচার করেছিলেন।
১৯৮৬ বিশ্বকাপ : পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে ফাইনালে হেডে আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে নেন হোসে লুইস ব্রাউন। দ্বিতীয়ার্ধের একটু পরে কাঁধে চোট পান এই ডিফেন্ডার। চোটের ধরনের জন্য তার জন্য ম্যাচ শেষ বলেই ধরে নেওয়া হচ্ছিল। তবে কোনোভাবেই মাঠ ছাড়তে রাজি ছিলেন না ‘এল তাতা’ নামে পরিচিত ব্রাউন। যদিও ব্যথা ছিল চূড়ান্ত রকমের অসহনীয়। চিকিৎসককে তিনি বলেন, “আমাকে সরিয়ে নেওয়ার কথা ভাববেন না। আমি আমার জার্সিতে একটি ছিদ্র করেছি, এটির মধ্যে দিয়ে আমার আঙুল দিয়ে রেখেছি এবং এটিকে একটি স্লিং হিসাবে ব্যবহার করেছি।” ওই চোটের পর অবিশ্বাস্যভাবে মাত্র ২৮ সেকেন্ড পর মাঠে ফেরেন ব্রাউন এবং আর্জেন্টিনার ৩-২ গোলে জয়ের ম্যাচের পুরোটাই খেলেন। বিশ্বকাপের ইতিহাসে তিনিই একমাত্র খেলোয়াড় যিনি দুই পায়েই পেনাল্টিতে গোল করেছিলেন।
১৯৯০ বিশ্বকাপ : ১৯৯০ বিশ্বকাপে চেকোস্লোভাকিয়ার বিপক্ষে সেমি-ফাইনালে লোথার মাথেউসের পেনাল্টি থেকে করা গোলেই জিতেছিল জার্মানি। তবে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ফাইনালে গোলশূন্য অবস্থায় ৮৫তম মিনিটে যখন পেনাল্টি পেল জার্মানি, তখন সবাইকে অবাক করে দিয়ে স্পট কিক নিতে মাথেউস নয়, এগিয়ে যান আন্দ্রেয়াস ব্রেহমে। শেষ পর্যন্ত তার করা পেনাল্টি থেকে গোলেই জিতে চ্যাম্পিয়ন হয় জার্মানরা। নিজে পেনাল্টি না নেওয়ার কারণ পরে ব্যাখ্যা করেন মাথেউস। “প্রথমার্ধে আমার বুট ফেটে গিয়েছিল। আমার কাছে কোনো অতিরিক্ত বুট ছিল না, তাই আমাকে কিটম্যানের একমাত্র অতিরিক্ত বুটজোড়া ব্যবহার করতে হয়েছিল। সেগুলো সঠিকভাবে আমার পায়ে মানানসই ছিল না।” “আমরা যখন পেনাল্টি পাই, আমি অ্যান্ডিকে তা নিতে বলেছিলাম। আমাদের কাছে অন্যান্য বিকল্পও ছিল, যারা দারুণ পেনাল্টি নিতে পারে, কিন্তু অ্যান্ডি আমার রুমমেট ছিল এবং আমি জানতাম যে সেই সঠিক ব্যক্তি।”
১৯৯৪ বিশ্বকাপ : ১৯৭০ সালের পর ২৪ বছরের বিশ্বকাপ জিততে না পারা ব্রাজিল ফাইনালে ইতালির মুখোমুখি হয়েছিল। নির্ধারিত ও অতিরিক্ত সময়ে সমতার পর ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে। পেনাল্টি শুটআউটের আগে ব্রাজিলের খেলোয়াড়রা হাতে হাত রেখে প্রার্থনা করছিল। ওই সময়ে দলকে চাঙ্গা করার জন্য বিচিত্র টোটকা দেন ডিফেন্ডার রিকার্দো রোচা। দলের উদ্দেশ্যে তিনি বলে ওঠেন, “আমরা কঠোর লড়াই করেছি, আমরা এই পর্যায়ে পৌঁছেছি- এসো আমরা সেই জাপানি কাওয়াসাকিদের মতোই লড়াই করি।” অতি উত্তেজনাতেই কিনা, রোচা তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিখ্যাত পাইলট কামিকাজেদের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন মোটরসাইকেল নির্মাতা কাওয়াসাকিকে। রোচার সতীর্থ টাফারেল এই প্রসঙ্গে পরে বলেন, “কেউ হাসি থামাতে পারছিল না। সে এটি বলার সঙ্গে সঙ্গে আবহ পরিবর্তন হয়ে যায়, আমাদের পুরোপুরি হালকা করে দিয়েছিল।” এরপর টাইব্রেকারে ৩-২ ব্যবধানে জিতে চতুর্থবারের মতো বিশ্বকাপ জেতে ব্রাজিল।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

বিএনপি নেতা ফজলুর রহমানকে গ্রেপ্তারের দাবিতে বাসার সামনে বিক্ষোভ

বিশ্বকাপ ফাইনাল কড়চা

আপডেট সময় : ০২:২৩:১৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২২

ক্রীড়া ডেস্ক : বিশ্বকাপের ইতিহাসে কিছু ফাইনাল জন্ম দিয়েছে অবিশ্বাস্য, দুর্দান্ত ও স্মরণীয় মুহূর্তের। মাঠে ও মাঠের বাইরে নানা ঘটনা শিরোপা নির্ধারণের মঞ্চে যোগ করেছে ভিন্ন মাত্রা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা প্রভাব ফেলেছে ম্যাচেও। কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে আগামী রোববার মুখোমুখি হবে ফ্রান্স ও আর্জেন্টিনা। ফুটবলের এই দুই পরাশক্তির লড়াইয়ের আগে ফিরে দেখা যাক আগের কয়েকটি আসরের ফাইনালে ঘটে যাওয়া বিচিত্র কিছু ঘটনা।
১৯৩০ বিশ্বকাপ : প্রথম বিশ্বকাপ শুরুর আগেই আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ে ঠিক করে নিয়েছিল যে, টুর্নামেন্টে খেলবে নিজেদের আনা বল নিয়ে। এই দুই দল জায়গা করে নেয় ফাইনালে। কার আনা বল নিয়ে খেলা হবে, এ নিয়ে রীতিমতো কুরুক্ষেত্র তৈরি হয়। ফাইনালের রেফারি বেলজিয়ামের জান লানজেনাস পরে বলেছিলেন ওই ম্যাচে নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে। তিনি ম্যাচ পরিচালনা করেছিলেন, শার্ট, ব্লেজার, টাই ও নিকারকার্স পরে। “যখন ম্যাচের জন্য বল বেছে নেওয়ার সময় এলো, তখন দুই দেশের মধ্যে অবিশ্বাস্য বিদ্বেষ প্রকাশ্য হয় গেল। দুই দলই দাবি তুলল, খেলতে হবে তাদের আনা বল দিয়ে।” বাধ্য হয়ে হস্তক্ষেপ করতে হয় তৎকালীন ফিফা প্রধান জুলে রিমেকে। ঠিক হয় দুই অর্ধে খেলা হবে দুই দলের আনা বল দিয়ে। ম্যাচের ফল থেকে দৃশ্যমান যে, এই সিদ্ধান্ত প্রভাব ফেলেছিল ফাইনালে। স্কটল্যান্ড থেকে আমদানি করা বল দিয়ে খেলে প্রথমার্ধে ২-১ গোলে এগিয়ে ছিল আর্জেন্টিনা। দ্বিতীয়ার্ধে ম্যাচ ঘুরিয়ে দেয় উরুগুয়ে। ইংল্যান্ড থেকে কিনে আনা বলে খেলে বিশ্বকাপ জিতে নেয় ৪-২ গোলে জিতে!
১৯৫০ বিশ্বকাপ : ফাইনালের দিন ও মুন্দো পত্রিকা হেড লাইন করে, ‘এই যে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা।’ নিচে ছাপায় ব্রাজিল দলের ছবি। আর একটি মন্দিরের ভেতর ঝুলিয়ে রাখে, যেটা তারা বানিয়েছিল ঠিক এই কাজের জন্যই। উরুগুয়ের ক্ষিপ্ত অধিনায়ক ওব্দুলিয়ো ভারেলা ২০ কপি কিনে আনেন। এরপর সেগুলো তাদের থাকার হোটেলের টয়লেটের মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে রাখেন। আয়নার ওপর চক দিয়ে লেখেন ‘এই খবরের কাগজে প্রস্রাব করুন ও মাড়িয়ে যান।’ ভারেলা এরপর সতীর্থদের টয়লেটে যেতে বলেন ও তার নির্দেশ অনুসরণ করতে বলেন। শিরোপা জিততে ব্রাজিলের স্রেফ ড্র প্রয়োজন ছিল। এক পর্যায়ে ১-০ গোলে এগিয়েও গিয়েছিল তারা। অধিনায়ক ভারেলার মন্ত্রে উজ্জ্বীবিত উরুগুয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে জিতে যায় ২-১ গোলে। ব্রাজিলের হৃদয় ভেঙে পুনরুদ্ধার করে শিরোপা। ম্যাচের পর কঠোর সতর্ক বার্তা উপেক্ষা করে রিও-এর একটি পানশালায় যান ভারেলা। ধারণা করা হচ্ছিল তার উপর চড়াও হতে পারে ব্রাজিলিয়ানরা। কিন্তু আদতে হয়েছিল তার উল্টোটা, জানান ভারেলা নিজেই। “আমি একটি পানীয় অর্ডার দিয়েছিলাম এবং আশা করছিলাম যে কেউ আমাকে চিনবে না। আমি ভেবেছিলাম তারা যদি চিনতে পারে তাহলে তারা হয়তো আমাকে মেরেই ফেলবে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে বিধ্বস্ত হওয়ার পরও তারা আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছিল এবং আমার সঙ্গে মদ্যপানও করেছিল।”
১৯৫৪ বিশ্বকাপ : ১৯৫৪ বিশ্বকাপের ফাইনালের দিনটা যে খুব সুখকর হতে যাচ্ছে না, তা একরকম মেনেই নিয়েছিলেন জার্মান রেডিওতে কাজ করা ধারাভাষ্যকার হেরবার্ত জিমারমান। কারণ ফাইনালের প্রতিপক্ষ হাঙ্গেরি যে গ্রুপ পর্বে জার্মানিকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল ৮-৩ গোলে। অসহায় জিমারমান ব্যস্ত সময় পার করতে হয়েছিল হাঙ্গেরিয়ানদের গোলের বর্ণনায়। ফাইনালেও তার পুনরাবৃত্তি হওয়ার জোর সম্ভাবনাই ছিল, কারণ দারুণ ছন্দে থাকা দলটি ফাইনালে খেলেছিল ৩০ ম্যাচে অপরাজিত থেকে। ফাইনালে ৮ মিনিটের মধ্যে জিমারমানকে হতাশ করে ২-০ গোলে এগিয়ে যায় হাঙ্গেরি। ওই সময়ের অনূভুতি জানাতে গিয়ে তিনি পরে বলেন, “আশা করছিলাম আমরা ব্যবধানটা যাতে কম রাখতে পারি।” কিন্তু হার না মানা জার্মানরা দুর্দান্তভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে ম্যাচে সমতা ফেরায়। ৮৪তম মিনিটে জয়সূচক গোল করেন জার্মানির হেলমুট হ্রান। ধারাভাষ্যে চিৎকার করে ওঠেন জিমারমান “হ্রান এর শট! গোল! গোল! গোল! গোল!” এরপর ক্ষণিকের জন্য চুপ হয়ে যান তিনি। এদিকে পশ্চিম জার্মানির শ্রোতারা অস্থির হয়ে ভাবছিলেন, রেডিওতে তাদের সংযোগে কোনো বিঘœ ঘটল কি-না। আট সেকেন্ডের নীরবতার পর জিমারম্যান তাল খুঁজে পান। “জার্মানির গোল! জার্মানি ৩-২ ব্যবধানে এগিয়ে। আমাকে পাগল বলতে পারেন, আমাকে উন্মাদও বলতে পারেন!” কিকার, লা গাজ্জেত্তা দেল্লো স্পোর্ত ও দা গার্ডিয়ান এটিকে ফুটবলের ইতিহাসের সবচেয়ে আইকনিক ধারাভাষ্য হিসেবে মর্যাদা দিয়েছে।
১৯৭০ বিশ্বকাপ : ইতালির বিপক্ষে ফাইনালের শেষের ২০ মিনিটে যেন আবেগ ধরে বসেছিল ব্রাজিলের তোস্তাকে। আসরে মেকশিফট ‘৯ নম্বর’ হিসেবে খেলা এই ফুটবলার চোখে জল নিয়েই খেলা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তবে তা হতাশার নয়, আনন্দের। অবিশ্বাস্যভাবে বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়ে তিনি যে এগিয়ে যাচ্ছিলেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দিকে।
বিশ্বকাপ শুরুর আগে চোখের রেটিনা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর তোস্তাওকে বলা হয়েছিল যে মাত্র ২৬ বছর বয়সেই তার ফুটবল ক্যারিয়ার শেষ। তবে জরুরি অস্ত্রোপচারের পর এবং কিংবদন্তি পেলের অনুরোধে বিশ্বকাপ স্কোয়াডে জায়গা পান তোস্তাও। ওই ম্যাচ নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ফিফাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, চোখের আঘাত, অস্ত্রোপচার, ক্যারিয়ার নিয়ে অনিশ্চয়তার পর বিশ্বকাপ জেতার অনুভূতি তার কিছু খুব বিশেষ কিছুই ছিল। “তৃতীয় গোলের পর, যে গোলটি ম্যাচটি ইতালির নাগালের বাইরে নিয়ে গিয়েছিল, আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে পরেছিলাম। আমি কাঁদতে শুরু করলাম এবং নিজেকে থামাতে পারলাম না। আমি ওই বিশ্বকাপে যাওয়ার জন্য যা যা করেছি তা নিয়ে ভাবছিলাম যে, আমি এটি থেকে ছিটকে পড়ার কতটা কাছাকাছি ছিলাম।” “আমি আমার চোখের অস্ত্রোপচারের জন্য বিশ্বজুড়ে ভ্রমণ করেছি। আমি আর খেলতে না পারার খুব কাছাকাছি ছিলাম এবং বিশ্বকাপে ডাক না পাওয়ার কাছাকাছি ছিলাম। আবার খেলায় অভ্যস্ত হওয়া সত্যিই কঠিন ছিল। যখন বুঝলাম আমরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হব, তখন আমি কান্না থামাতে পারিনি।” ম্যাচের পর পর দর্শকদের ভালবাসার সিক্ত তোস্তাও তার জার্সি, জুতো, প্যান্ট সব হারিয়ে কোনোমতে মাঠ ছাড়েন। “তারা এমনকি আমাকে তাদের দিকে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল।” তোস্তাও বিশ্বকাপে জেতা মেডেল পরে দিয়ে দিয়েছিলেন সেই চক্ষু বিশেষজ্ঞকে, যিনি তার চোখের অস্ত্রোপচার করেছিলেন।
১৯৮৬ বিশ্বকাপ : পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে ফাইনালে হেডে আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে নেন হোসে লুইস ব্রাউন। দ্বিতীয়ার্ধের একটু পরে কাঁধে চোট পান এই ডিফেন্ডার। চোটের ধরনের জন্য তার জন্য ম্যাচ শেষ বলেই ধরে নেওয়া হচ্ছিল। তবে কোনোভাবেই মাঠ ছাড়তে রাজি ছিলেন না ‘এল তাতা’ নামে পরিচিত ব্রাউন। যদিও ব্যথা ছিল চূড়ান্ত রকমের অসহনীয়। চিকিৎসককে তিনি বলেন, “আমাকে সরিয়ে নেওয়ার কথা ভাববেন না। আমি আমার জার্সিতে একটি ছিদ্র করেছি, এটির মধ্যে দিয়ে আমার আঙুল দিয়ে রেখেছি এবং এটিকে একটি স্লিং হিসাবে ব্যবহার করেছি।” ওই চোটের পর অবিশ্বাস্যভাবে মাত্র ২৮ সেকেন্ড পর মাঠে ফেরেন ব্রাউন এবং আর্জেন্টিনার ৩-২ গোলে জয়ের ম্যাচের পুরোটাই খেলেন। বিশ্বকাপের ইতিহাসে তিনিই একমাত্র খেলোয়াড় যিনি দুই পায়েই পেনাল্টিতে গোল করেছিলেন।
১৯৯০ বিশ্বকাপ : ১৯৯০ বিশ্বকাপে চেকোস্লোভাকিয়ার বিপক্ষে সেমি-ফাইনালে লোথার মাথেউসের পেনাল্টি থেকে করা গোলেই জিতেছিল জার্মানি। তবে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ফাইনালে গোলশূন্য অবস্থায় ৮৫তম মিনিটে যখন পেনাল্টি পেল জার্মানি, তখন সবাইকে অবাক করে দিয়ে স্পট কিক নিতে মাথেউস নয়, এগিয়ে যান আন্দ্রেয়াস ব্রেহমে। শেষ পর্যন্ত তার করা পেনাল্টি থেকে গোলেই জিতে চ্যাম্পিয়ন হয় জার্মানরা। নিজে পেনাল্টি না নেওয়ার কারণ পরে ব্যাখ্যা করেন মাথেউস। “প্রথমার্ধে আমার বুট ফেটে গিয়েছিল। আমার কাছে কোনো অতিরিক্ত বুট ছিল না, তাই আমাকে কিটম্যানের একমাত্র অতিরিক্ত বুটজোড়া ব্যবহার করতে হয়েছিল। সেগুলো সঠিকভাবে আমার পায়ে মানানসই ছিল না।” “আমরা যখন পেনাল্টি পাই, আমি অ্যান্ডিকে তা নিতে বলেছিলাম। আমাদের কাছে অন্যান্য বিকল্পও ছিল, যারা দারুণ পেনাল্টি নিতে পারে, কিন্তু অ্যান্ডি আমার রুমমেট ছিল এবং আমি জানতাম যে সেই সঠিক ব্যক্তি।”
১৯৯৪ বিশ্বকাপ : ১৯৭০ সালের পর ২৪ বছরের বিশ্বকাপ জিততে না পারা ব্রাজিল ফাইনালে ইতালির মুখোমুখি হয়েছিল। নির্ধারিত ও অতিরিক্ত সময়ে সমতার পর ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে। পেনাল্টি শুটআউটের আগে ব্রাজিলের খেলোয়াড়রা হাতে হাত রেখে প্রার্থনা করছিল। ওই সময়ে দলকে চাঙ্গা করার জন্য বিচিত্র টোটকা দেন ডিফেন্ডার রিকার্দো রোচা। দলের উদ্দেশ্যে তিনি বলে ওঠেন, “আমরা কঠোর লড়াই করেছি, আমরা এই পর্যায়ে পৌঁছেছি- এসো আমরা সেই জাপানি কাওয়াসাকিদের মতোই লড়াই করি।” অতি উত্তেজনাতেই কিনা, রোচা তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিখ্যাত পাইলট কামিকাজেদের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন মোটরসাইকেল নির্মাতা কাওয়াসাকিকে। রোচার সতীর্থ টাফারেল এই প্রসঙ্গে পরে বলেন, “কেউ হাসি থামাতে পারছিল না। সে এটি বলার সঙ্গে সঙ্গে আবহ পরিবর্তন হয়ে যায়, আমাদের পুরোপুরি হালকা করে দিয়েছিল।” এরপর টাইব্রেকারে ৩-২ ব্যবধানে জিতে চতুর্থবারের মতো বিশ্বকাপ জেতে ব্রাজিল।