ঢাকা ১২:০০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

বিশাল অর্জন কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগীর যন্ত্রণা

  • আপডেট সময় : ০৯:৪২:৫৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৭ মার্চ ২০২২
  • ১২৫ বার পড়া হয়েছে

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন : ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ স্বাধীনতা অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বীরের বেশে জাতির পিতা হিসেবে স্বদেশে আসেন। দ্রুতগতিতে সাংবিধানিক পরিবর্তন এনে সরকারপ্রধান, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন তিনি। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হতোদ্যম বাংলাদেশে তখন প্রতিটি ক্ষেত্রে সমস্যার পাহাড় আর ৩০ লাখ নারী-পুরুষের শাহাদাত এবং ৩ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির আহাজারি। গুদামে খাদ্য নেই, কিষান-কিষানিরা স্বাধীনতাযুদ্ধে, তাই মাঠে ফসল নেই। ব্যাংক-বিমা, কলকারখানা, সদাগরি অফিস বন্ধ; কারণ (পশ্চিম) পাকিস্তানিরা এসবের মালিক ছিলেন; তারা পালিয়ে গেছেন নিজ দেশে। রেল, সেতু, রাস্তাঘাট, কালভার্ট, বন্দর, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ধ্বংসপ্রাপ্ত অথবা প্রাণসংহারী মাইনে ভরা।
এদিকে পরাজিত শত্রু ও তাদের এদেশীয় অনুচর গোলাম আযম, জুলমত আলী খান, আব্দুল জব্বার খদ্দর, মৌলানা আব্দুল মান্নান, মৌলানা আতাহার আলী এমনকি একদা প্রগতিশীল মাহমুদ আলীরা প্রচারে নামলেন যে ইসলামি জমহুরি পাকিস্তান (মধ্যপ্রাচ্যের সখা) ভেঙে শেখ মুজিব একটি ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দু প্রভাবিত বাংলাদেশ বানিয়েছেন, যেটি ভারতের করদ রাজ্য ছাড়া আর কিছু নয়। শুধু গণচীন বা পাকিস্তান নয়, ইরাক ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের সব স্বৈরতান্ত্রিক রাজতন্ত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানাল।
১৯৭২ সালে জাতিসংঘে প্রবেশে গণচীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভেটো প্রয়োগ করল। হেনরি কিসিঞ্জার তো বটেই, নরওয়ের হিউস্ট ফ্যালান্ড এবং ইংল্যান্ডের অর্থনীতিবিদ জন হেন্ডারসন ফতোয়া দিলেন, ভৌগোলিক দিক থেকে টিকে গেলেও একটি সচল অর্থনীতি হিসেবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এত তমসাচ্ছন্ন যে এর বেঁচে থাকা অর্থনীতির পাঠ্যপুস্তকে ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে জায়গা করে নেবে। এসব প্রতিকূলতার মধ্যে জাতির পিতার প্রত্যাবর্তন সমগ্র জাতিকে উচ্চতম আলোর ঝলকানিতে উদ্বুদ্ধ করে।
দৃঢ় পদক্ষেপের সূচনা
বঙ্গবন্ধুর সরকার একে একে প্রায় যুগপৎভাবে অনেকগুলো কাজ শুরু করে। সংবিধান রচিত হয় নয় মাসে। ধর্মীয় ব্যবসা বন্ধের রাজনীতি আসে, তবে ইসলামিক ফাউন্ডেশন স্থাপিত হয়; বন্ধ হয় মদ, জুয়া, জিমখানা। সংকট মোকাবিলায় বঙ্গবন্ধু প্রথম দিকে গণখাতের (পাবলিক সেক্টর) ওপর নির্ভর করেন, তবে ব্যক্তিগত বাজার অর্থনীতির গতিময় দক্ষতার রাস্তাও খোলা রাখেন। স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের ঢাকা অফিসে রক্ষিত ১৮ মার্কিন ডলারের স্থিতি আয় আর কানাডা ও সুইডেনের নগদে বৈদেশিক অনুদানে শুরু হয় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৩ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলারের সম্মানজনক স্থিতিতে উঠেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধকালে পলায়নপর পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞে সামষ্টিক অর্থনীতির পরিধি ১৯৭০-৭১ সালে আগের অর্থবছরের তুলনায় ৩৫ শতাংশ সংকুচিত হয়ে ৯০০ কোটি মার্কিন ডলারে ধসে যায় (এখন বাংলাদেশের সামষ্টিক আয়, জিডিপি ৩০ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার)। ‘সবার সাথে সখ্য কারও সাথে বৈরী নই’ নীতিতে যাত্রা শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির। তারই পরিম-লে সার্বভৌম স্বাধীনতা ও সমমর্যাদার ভিত্তিতে বৃহৎ ও মহৎ প্রতিবেশী ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনসহ (১৫ মার্চ ১৯৭২) অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সহযোগিতা স্থাপিত হয়। ১৯৭৩ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্স সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের মর্যাদাপূর্ণ যোগদান এবং তার আগে পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতি জাতিসংঘ এবং অন্য সব বিশ্ব সংস্থায় যোগদানের পথ উন্মুক্ত করে।
ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতম হয়ে উদ্ভাসিত
বাংলাদেশ সম্পর্কে যে আশাবাদ গত ১২ বছরে বিশেষ করে অর্থনীতি ক্ষেত্রে প্রবহমান, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণকাজ সমাপ্তির কাছাকাছি এসে দেশটি বিশেষ করে এর সরকারপ্রধান জনবন্ধু শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতম হয়ে উদ্ভাসিত। অন্যান্য বিশাল অবকাঠামো প্রকল্প মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল এবং পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন, টেকসই উন্নয়নের সোনার বাংলার স্বপ্ন রূপায়ণে বৃহৎ বৃহৎ পদক্ষেপ। কোভিড-১৯ ব্যবস্থাপনায় বিশ্বের সবচেয়ে সফল দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি।
শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল সংস্কার জরুরি
সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থায় একটি আপাতদৃষ্টে অজনপ্রিয় হলেও আমূল সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উন্নত দেশের মতো অঞ্চল বা এলাকাভিত্তিক ভর্তি করা, স্কুল ইউনিফর্ম চালু করা, ব্যক্তিগত যানবাহন নয় বরং প্রয়োজন হলে স্কুল-কলেজের বাসে যাতায়াত, খেলাধুলা ও সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ, বেতন-ভাতা সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদা বৃদ্ধি করে শিক্ষকম-লীকে টিউশন থেকে ক্লাসমুখী করা, নোটবই, গাইড ও কোচিং সেন্টারের দৃঢ়হস্ত নিয়ন্ত্রণ তথা কালক্রমে বন্ধ করা না হলে দেশের দৃষ্টিনন্দন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং হৃদয় উষ্ণ করা সামাজিক অগ্রযাত্রা ধরে রাখা এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব না-ও হতে পারে।
শিল্পপ্রতিষ্ঠানে পালাক্রমে তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক হাতে-কলমে শিক্ষা গ্রহণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আদলে কো-অপারেটিভ শিক্ষার প্রচলন করা সঠিক হবে। শীতকালে উচ্চশিক্ষার বিদার্থীদের এক সেমিস্টারের জন্য পল্লিবাংলার কিষান-কিষানির তত্ত্বাবধানে পাঠানোর কথা ভাবা যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইনকিউবেটর স্থাপন করে একদিকে প্রকল্প প্রণয়নে প্রশিক্ষণ ও অন্যদিকে উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে হাতে-কলমে শিক্ষার ব্যবস্থা এখন সময়ের দাবি।
মধ্যস্বত্বভোগীদের শক্তিতে রাষ্ট্রশক্তির রাশ টানা জরুরি
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বহুবিধ অর্জনের ফসলকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ধান-চাল, পেঁয়াজ ও আলুতে উৎপাদন ও বিপণন সমবায় ব্যবস্থা চালু করে মধ্যস্বত্বভোগী দুষ্টচক্র মিলমালিক অসাধু খাদ্য কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের আকাশছোঁয়া মুনাফা কমাতে হবে, নইলে কিষান-কিষানি তার উৎপাদনে ন্যায্য মূল্য পাবে না আর ভোক্তাদের গুনতে হবে অতিরিক্ত দাম। অনুরূপভাবে ব্যাংক-বিমা খাতে বিশেষ করে ব্যক্তিখাতে যে সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে, তার ফলে আমানতে ব্যাংক সুদের হার মূল্যস্ফীতি হারের চেয়ে কম। শক্তিধর মধ্যস্বত্বভোগীরা আইনের ফাঁকফোকর বের করে রাষ্ট্রকে ঠকিয়ে বিদেশে মুদ্রা পাচার করছে আমদানিতে, অভারইনভয়েসিং এবং রপ্তানিতে আন্ডারইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে। এরা রাষ্ট্রযন্ত্রের উল্লেখযোগ্য অংশকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে কেনাকাটায় সাগর চুরি করছে।
এসব বিষয়ে বিশ্বনন্দিত রাষ্ট্রনায়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে এনে যথাবিহিত করা না হলে রাষ্ট্র ও জাতিকে তার লক্ষ্যে পৌঁছানোর গন্তব্য অনেক দূরে চলে যাবে। রাষ্ট্রীয় সম্পদে সব কেনাকাটা ই-টেন্ডারিংয়ে করার নীতি কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হোক। প্রতিটি ক্ষেত্রে, তা রাস্তা নির্মাণ হোক কিংবা বালিশ ক্রয় কিংবা ওষুধ কেনা। বিশেষজ্ঞ পরামর্শে অভিহিত মূল্য নির্ধারণ করে টেন্ডার করা হলে যেসব ঠিকাদার বা সরবরাহকারী ওই মূল্যের বেশি দামে টেন্ডার দেবে, তা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বাদ পড়ে যাবে। যারা সময়মতো প্রকল্পের কাজ শেষ করবেন না, তাদের জরিমানার বিধানে সজাগ ও সচেতন করে দুর্নীতি, অপচয় ও দীর্ঘসূত্রতা কমালেই বিনিয়োগ তার সঠিক উৎপাদনশীলতা দিয়ে প্রবৃদ্ধিকে সমৃদ্ধতর করবে।
লেখক: সমাজকর্মী, শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

বিশাল অর্জন কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগীর যন্ত্রণা

আপডেট সময় : ০৯:৪২:৫৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৭ মার্চ ২০২২

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন : ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ স্বাধীনতা অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বীরের বেশে জাতির পিতা হিসেবে স্বদেশে আসেন। দ্রুতগতিতে সাংবিধানিক পরিবর্তন এনে সরকারপ্রধান, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন তিনি। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হতোদ্যম বাংলাদেশে তখন প্রতিটি ক্ষেত্রে সমস্যার পাহাড় আর ৩০ লাখ নারী-পুরুষের শাহাদাত এবং ৩ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির আহাজারি। গুদামে খাদ্য নেই, কিষান-কিষানিরা স্বাধীনতাযুদ্ধে, তাই মাঠে ফসল নেই। ব্যাংক-বিমা, কলকারখানা, সদাগরি অফিস বন্ধ; কারণ (পশ্চিম) পাকিস্তানিরা এসবের মালিক ছিলেন; তারা পালিয়ে গেছেন নিজ দেশে। রেল, সেতু, রাস্তাঘাট, কালভার্ট, বন্দর, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ধ্বংসপ্রাপ্ত অথবা প্রাণসংহারী মাইনে ভরা।
এদিকে পরাজিত শত্রু ও তাদের এদেশীয় অনুচর গোলাম আযম, জুলমত আলী খান, আব্দুল জব্বার খদ্দর, মৌলানা আব্দুল মান্নান, মৌলানা আতাহার আলী এমনকি একদা প্রগতিশীল মাহমুদ আলীরা প্রচারে নামলেন যে ইসলামি জমহুরি পাকিস্তান (মধ্যপ্রাচ্যের সখা) ভেঙে শেখ মুজিব একটি ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দু প্রভাবিত বাংলাদেশ বানিয়েছেন, যেটি ভারতের করদ রাজ্য ছাড়া আর কিছু নয়। শুধু গণচীন বা পাকিস্তান নয়, ইরাক ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের সব স্বৈরতান্ত্রিক রাজতন্ত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানাল।
১৯৭২ সালে জাতিসংঘে প্রবেশে গণচীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভেটো প্রয়োগ করল। হেনরি কিসিঞ্জার তো বটেই, নরওয়ের হিউস্ট ফ্যালান্ড এবং ইংল্যান্ডের অর্থনীতিবিদ জন হেন্ডারসন ফতোয়া দিলেন, ভৌগোলিক দিক থেকে টিকে গেলেও একটি সচল অর্থনীতি হিসেবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এত তমসাচ্ছন্ন যে এর বেঁচে থাকা অর্থনীতির পাঠ্যপুস্তকে ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে জায়গা করে নেবে। এসব প্রতিকূলতার মধ্যে জাতির পিতার প্রত্যাবর্তন সমগ্র জাতিকে উচ্চতম আলোর ঝলকানিতে উদ্বুদ্ধ করে।
দৃঢ় পদক্ষেপের সূচনা
বঙ্গবন্ধুর সরকার একে একে প্রায় যুগপৎভাবে অনেকগুলো কাজ শুরু করে। সংবিধান রচিত হয় নয় মাসে। ধর্মীয় ব্যবসা বন্ধের রাজনীতি আসে, তবে ইসলামিক ফাউন্ডেশন স্থাপিত হয়; বন্ধ হয় মদ, জুয়া, জিমখানা। সংকট মোকাবিলায় বঙ্গবন্ধু প্রথম দিকে গণখাতের (পাবলিক সেক্টর) ওপর নির্ভর করেন, তবে ব্যক্তিগত বাজার অর্থনীতির গতিময় দক্ষতার রাস্তাও খোলা রাখেন। স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের ঢাকা অফিসে রক্ষিত ১৮ মার্কিন ডলারের স্থিতি আয় আর কানাডা ও সুইডেনের নগদে বৈদেশিক অনুদানে শুরু হয় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৩ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলারের সম্মানজনক স্থিতিতে উঠেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধকালে পলায়নপর পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞে সামষ্টিক অর্থনীতির পরিধি ১৯৭০-৭১ সালে আগের অর্থবছরের তুলনায় ৩৫ শতাংশ সংকুচিত হয়ে ৯০০ কোটি মার্কিন ডলারে ধসে যায় (এখন বাংলাদেশের সামষ্টিক আয়, জিডিপি ৩০ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার)। ‘সবার সাথে সখ্য কারও সাথে বৈরী নই’ নীতিতে যাত্রা শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির। তারই পরিম-লে সার্বভৌম স্বাধীনতা ও সমমর্যাদার ভিত্তিতে বৃহৎ ও মহৎ প্রতিবেশী ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনসহ (১৫ মার্চ ১৯৭২) অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সহযোগিতা স্থাপিত হয়। ১৯৭৩ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্স সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের মর্যাদাপূর্ণ যোগদান এবং তার আগে পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতি জাতিসংঘ এবং অন্য সব বিশ্ব সংস্থায় যোগদানের পথ উন্মুক্ত করে।
ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতম হয়ে উদ্ভাসিত
বাংলাদেশ সম্পর্কে যে আশাবাদ গত ১২ বছরে বিশেষ করে অর্থনীতি ক্ষেত্রে প্রবহমান, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণকাজ সমাপ্তির কাছাকাছি এসে দেশটি বিশেষ করে এর সরকারপ্রধান জনবন্ধু শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতম হয়ে উদ্ভাসিত। অন্যান্য বিশাল অবকাঠামো প্রকল্প মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল এবং পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন, টেকসই উন্নয়নের সোনার বাংলার স্বপ্ন রূপায়ণে বৃহৎ বৃহৎ পদক্ষেপ। কোভিড-১৯ ব্যবস্থাপনায় বিশ্বের সবচেয়ে সফল দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি।
শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল সংস্কার জরুরি
সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থায় একটি আপাতদৃষ্টে অজনপ্রিয় হলেও আমূল সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উন্নত দেশের মতো অঞ্চল বা এলাকাভিত্তিক ভর্তি করা, স্কুল ইউনিফর্ম চালু করা, ব্যক্তিগত যানবাহন নয় বরং প্রয়োজন হলে স্কুল-কলেজের বাসে যাতায়াত, খেলাধুলা ও সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ, বেতন-ভাতা সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদা বৃদ্ধি করে শিক্ষকম-লীকে টিউশন থেকে ক্লাসমুখী করা, নোটবই, গাইড ও কোচিং সেন্টারের দৃঢ়হস্ত নিয়ন্ত্রণ তথা কালক্রমে বন্ধ করা না হলে দেশের দৃষ্টিনন্দন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং হৃদয় উষ্ণ করা সামাজিক অগ্রযাত্রা ধরে রাখা এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব না-ও হতে পারে।
শিল্পপ্রতিষ্ঠানে পালাক্রমে তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক হাতে-কলমে শিক্ষা গ্রহণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আদলে কো-অপারেটিভ শিক্ষার প্রচলন করা সঠিক হবে। শীতকালে উচ্চশিক্ষার বিদার্থীদের এক সেমিস্টারের জন্য পল্লিবাংলার কিষান-কিষানির তত্ত্বাবধানে পাঠানোর কথা ভাবা যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইনকিউবেটর স্থাপন করে একদিকে প্রকল্প প্রণয়নে প্রশিক্ষণ ও অন্যদিকে উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে হাতে-কলমে শিক্ষার ব্যবস্থা এখন সময়ের দাবি।
মধ্যস্বত্বভোগীদের শক্তিতে রাষ্ট্রশক্তির রাশ টানা জরুরি
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বহুবিধ অর্জনের ফসলকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ধান-চাল, পেঁয়াজ ও আলুতে উৎপাদন ও বিপণন সমবায় ব্যবস্থা চালু করে মধ্যস্বত্বভোগী দুষ্টচক্র মিলমালিক অসাধু খাদ্য কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের আকাশছোঁয়া মুনাফা কমাতে হবে, নইলে কিষান-কিষানি তার উৎপাদনে ন্যায্য মূল্য পাবে না আর ভোক্তাদের গুনতে হবে অতিরিক্ত দাম। অনুরূপভাবে ব্যাংক-বিমা খাতে বিশেষ করে ব্যক্তিখাতে যে সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে, তার ফলে আমানতে ব্যাংক সুদের হার মূল্যস্ফীতি হারের চেয়ে কম। শক্তিধর মধ্যস্বত্বভোগীরা আইনের ফাঁকফোকর বের করে রাষ্ট্রকে ঠকিয়ে বিদেশে মুদ্রা পাচার করছে আমদানিতে, অভারইনভয়েসিং এবং রপ্তানিতে আন্ডারইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে। এরা রাষ্ট্রযন্ত্রের উল্লেখযোগ্য অংশকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে কেনাকাটায় সাগর চুরি করছে।
এসব বিষয়ে বিশ্বনন্দিত রাষ্ট্রনায়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে এনে যথাবিহিত করা না হলে রাষ্ট্র ও জাতিকে তার লক্ষ্যে পৌঁছানোর গন্তব্য অনেক দূরে চলে যাবে। রাষ্ট্রীয় সম্পদে সব কেনাকাটা ই-টেন্ডারিংয়ে করার নীতি কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হোক। প্রতিটি ক্ষেত্রে, তা রাস্তা নির্মাণ হোক কিংবা বালিশ ক্রয় কিংবা ওষুধ কেনা। বিশেষজ্ঞ পরামর্শে অভিহিত মূল্য নির্ধারণ করে টেন্ডার করা হলে যেসব ঠিকাদার বা সরবরাহকারী ওই মূল্যের বেশি দামে টেন্ডার দেবে, তা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বাদ পড়ে যাবে। যারা সময়মতো প্রকল্পের কাজ শেষ করবেন না, তাদের জরিমানার বিধানে সজাগ ও সচেতন করে দুর্নীতি, অপচয় ও দীর্ঘসূত্রতা কমালেই বিনিয়োগ তার সঠিক উৎপাদনশীলতা দিয়ে প্রবৃদ্ধিকে সমৃদ্ধতর করবে।
লেখক: সমাজকর্মী, শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর