নিঝুম মজুমদার : গত ১২ নভেম্বর বিবিসি বাংলা ফরিদপুরে বিএনপির সমাবেশ নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে সেখানে বিএনপি নেত্রী শামা ওবায়েদের এক অদ্ভুত বক্তব্য আমরা দেখতে পেলাম। প্রতিবেদনে বিএনপি নেত্রী শামা ওবায়েদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ কেন মাঠে আছে? আওয়ামী লীগের মাঠে থাকার তো কোনো কারণ নাই’।
এই বক্তব্য শেষ হতে না হতেই ওই একই প্রতিবেদনে বিএনপির আরেক নেতা ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘সরকার হুমকি দিচ্ছে, পাল্টা কর্মসূচি দিচ্ছে। যদি কোনো রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে দেশ আগায়, তাহলে তার দায়-দায়িত্ব আওয়ামী লীগকে নিতে হবে, সরকারকে নিতে হবে’ [সূত্র: বিবিসি বাংলা প্রতিবেদন, ইউটিউব,১২-১১-২০২২]
ওপরের দুটি বক্তব্যের প্রথমটি বিস্ময়কর রকমের ‘ফ্যাসিস্ট’ বক্তব্য এবং অন্য বক্তব্যটি অগণতান্ত্রিক বক্তব্যের স্পষ্ট উদাহরণ। আমি বিএনপি নেতাদের আরও কয়েকটি বক্তব্য এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে কোট করতে চাই। ৭ নভেম্বর চ্যানেল ২৪-এর একটি সাক্ষাৎকারে বিএনপি নেত্রী ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, ‘৭০ হাজার লোকও কি আওয়ামী লীগ জোগাড় করতে পারলো না বিরিয়ানি দিয়ে, নিরাপত্তা দিয়ে, সবকিছু দিয়ে?’
ওই একই অনুষ্ঠানে উপস্থাপক জনাব মতিন যখন ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানাকে প্রশ্ন করেন, ‘আর ঘুরে-ফিরে যে সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে বিএনপি যদি বেশি বাড়াবাড়ি করে বেগম জিয়াকে আবারও জেলখানায় যেতে হবে। এটাকে কি আপনারা একটু হুমকি হিসেবে বা চাপ হিসেবে দেখছেন, নাকি এটার প্রভাব পড়বে না আন্দোলনে?’
এই প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, ‘এটা একটা, আমি বলবো স্বীকারোক্তি আমি মনে করি। স্বীকারোক্তিটা এই যে এই কথার মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী স্বীকার করে নিচ্ছেন, যেই মামলায় বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে রাখা হয়েছে সেটা অ্যাবসোলিউটলি একটা পলিটিক্যাল মামলা, যেটা তার অঙ্গুলি হেলনে চলছে। এবং তিনি চাইলে বেগম খালেদা জিয়া জেলে থাকবেন এবং চাইলে বেগম খালেদা জিয়া বাইরে থাকবেন।’
আবার গত ৮ অক্টোবরে ঢাকায় এক সমাবেশে বিএনপি নেতা আমানউল্লাহ আমান বলেছেন, ‘বাংলাদেশ এই ঢাকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। আগামী ১০ ডিসেম্বরের পরে হাসিনার কথায় দেশ চলবে না। আগামী ১০ ডিসেম্বরের পরে খালেদা জিয়ার কথায় দেশ চলবে।’ [সূত্র: চ্যানেল ২৪ প্রতিবেদন, ইউটিউব, ৮-১০-২০২২]।
গত ২৬ সেপ্টেম্বর ঢাকায় আরেক সমাবেশে বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘পুলিশের গুলিতে যে মারা যাবে ওই পুলিশের বাড়িঘর নাই? আমাদের ঘরে আগুন দেবে ওদের ঘরে আগুন দিতে পারবো না?’ [সূত্র: সময় টিভি সংবাদ, ইউটিউব, ২৬-০৯-২০২২]
৯ অক্টোবরে বাংলাভিশন টিভির এক সাক্ষাৎকারে বিএনপি নেত্রী সেলিমা রহমান বলেছেন, ‘আমাদের তো অস্ত্র নাই। আমরা গণতান্ত্রিক আন্দোলন করছি। আমাদের কথা হচ্ছে আমরা রাজপথে থাকবো। হ্যাঁ, আমাদের সঙ্গে থাকবে পতাকা লাঠি। এটা সত্য কথা, কারণ যেহেতু লাঠি ছাড়া আমাদের কাছে কিচ্ছু নাই। যত অত্যাচার হবে তত বেশি তারা ঘুরে দাঁড়াবে এবং আমাদের এই একমাত্র পতাকা লাঠি, এটাই আমাদের একমাত্র অস্ত্র। এছাড়া কোনো উপায় নেই। কারণ, আমরা তো কোনো বন্দুক নেবো না, কোনো কিছু করবো না। আমরা গণতান্ত্রিক ওয়েতে রাজনীতি করবার চেষ্টা করছি।’ [সূত্র: বাংলাভিশন চ্যানেল, ৯ অক্টোবর, ২০২২]
বিএনপির নেতা প্রয়াত হান্নান শাহকে নিয়ে একটি আলোচনা সভায় গত ২৭ সেপ্টেম্বর রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট রুহুল কবীর রিজভী বলেছেন, ‘বিএনপির বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে, পতাকার যে লাঠি সেই লাঠি আরও লম্বা করতে হবে। আরও লম্বা লাঠি নিয়ে প্রতিরোধ করতে হবে। আপনি দেখেছেন গণমানুষ কীভাবে বিএনপির সাথে আসছে, বিএনপির বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে।’
ওপরের প্রত্যেকটি বক্তব্য যদি আমি একটা একটা করে বিবেচনায় আনি তাহলে নিঃসন্দেহে এটা পরিষ্কার যে বিএনপির এই নব ‘বৈপ্লবিক পরিবর্তন’ খুব গোলমেলে এক পরিবর্তন। এই পরিবর্তনে যেমন বিএনপির নেতাকর্মীদের বক্তব্যে সমন্বয় নেই, তেমনি নেই আসলে যুক্তিও। একদিকে বিএনপি নেত্রী শামা ওবায়েদ কোনোভাবেই চান না আওয়ামী লীগ রাজপথে গণতান্ত্রিকভাবে জনতার কাছে যাক, জনতার সাথে সংযোগ স্থাপন করুক, অন্যদিকে বিএনপির আরেক নেত্রী ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা চাইছেন আওয়ামী লীগ যাতে ‘বিরিয়ানি খাইয়ে’ হলেও নেতাকর্মীদের সমাবেশে আনুক। একই দলের দুই নেত্রীর ভাবনার এমন গোলযোগ কি বিএনপির নতুন বৈপ্লবিক পরিবর্তনের অংশ? এই প্রশ্ন এসেই যায়।
একইভাবে বিএনপি নেত্রী সেলিমা রহমান বলছেন, তারা গণতান্ত্রিক আন্দোলন করছেন, আবার একই দিকে বলছেন তাদের অস্ত্র লাঠি ও পতাকা। একটি গণতান্ত্রিক দল বলে দাবি করা রাজনৈতিক দলের ঠিক কী কারণে লাঠির মতো অস্ত্র নিয়ে সমাবেশ করতে হবে এবং সেই সমাবেশকে শান্তিপূর্ণ বলতে হবে, এটিও আসলে বোধগম্য নয়। একইভাবে বলা যায় বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভীর বক্তব্য। তিনি বিএনপির সমাবেশে সাধারণ মানুষের এই হঠাৎ আগমন দেখে বিস্মিত হয়েছেন এবং এটিকে তিনি ‘বৈপ্লবিক পরিবর্তন’ বলে অভিহিত করেছেন। রিজভীর এই বক্তব্যে এটা খুবই পরিষ্কার যে বিএনপির সমাবেশে আগে কখনোই সাধারণ জনতা আসেনি এবং ফলে সাধারণ মানুষের দল হিসেবে বিএনপিকে অন্তত তার সেই বক্তৃতার আগ পর্যন্ত বলা যেতো না।
কিন্তু প্রশ্ন এসেই যায়, যেই সাধারণ মানুষের আগমনে রিজভী সাহেব এত উদ্ভাসিত ও উল্লাসিত সেই দলটির কেন তাহলে পতাকার লাঠি লম্বা করার প্রয়োজন হচ্ছে? কেন এই লম্বা লাঠিকেই আবার বিএনপি নেত্রী একটি মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে বিবেচনা করছেন? তাহলে কি সাধারণ জনতার এই ‘হঠাৎ’ আসাতেও বিএনপি আশ্বস্ত হচ্ছে না। ফলে লাটজির মতো অস্ত্র এই সাধারণ জনতার কাছে তুলে দিয়ে সহিংস রাজনীতির পাঠ দিচ্ছে? শামা ওবায়েদ ও ব্যারিস্টার রুমিনের পাল্টাপাল্টি বিপরীতধর্মী ও সাংঘর্ষিক বক্তব্যের পর কিংবা সেলিমা রহমান ও রুহুল কবির রিজভীর এই অস্ত্র ব্যবহারের উপদেশের পর গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের পুলিশের বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘোষণা আমাদের বিস্মিত ও মর্মাহত করে। নেতারাই দাবি করছেন বিএনপি এখন গণমানুষের দল, বিএনপিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার সেই নেতারাই যখন বলেন পুলিশের বাড়িতে গিয়ে আগুন দেবার জন্য কিংবা পতাকার লাঠি বড় করে আনবার জন্য-তখন আমাদের সামনে ভেসে ওঠে বিএনপির পেট্রোল সন্ত্রাসের কথা, ২১ আগস্টের বোমা হামলার কথা।
যেই দলটি অভ্যস্ত পেট্রোলবোমা ছুড়ে মারাতে, যেই দলটি অভ্যস্ত ট্রাকের পর ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানিতে (১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা দ্রষ্টব্য), যেই দল অভ্যস্ত জোর করে ক্ষমতা দখলে সেই দলে সাধারণ মানুষের পদচারণা হলেও তাদের সেই বিশ্বাস আগের মতোই। লাঠি, অস্ত্র ইত্যাদি। কিন্তু আশ্চর্যের কথাও এখানে দুটি। যেই দুই আলাপে আসলে আইন এসে পড়ে এবং বিএনপি’র নেতাকর্মীদের আইন-কানুন সম্পর্কে অজ্ঞতা ও অশ্রদ্ধা পরিলক্ষিত হয়। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বেগম খালেদা জিয়া দ-প্রাপ্ত। বর্তমানে ফৌজদারি কার্যবিধি ৪০১ ধারা মোতাবেক সরকার প্রধানের ‘বিশেষ বিবেচনায়’ জেলের বাইরে অবস্থান করছেন। তিনি সরকারের প্রধান তো ননই, এমনকি বিরোধী দলের প্রধানও নন। তাহলে নিজেদের গণতান্ত্রিক ও বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দল হিসেবে ঘোষণা দেওয়া বিএনপি ঠিক কোন আইন বা বিধিতে দাবি করতে পারেন যে আগামী ১০ ডিসেম্বরের পর এই দ-প্রাপ্ত কয়েদির কথায় দেশ চলবে?
একইভাবে বিএনপি নেত্রী ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা যখন বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার জেলের বাইরে থাকা ও না থাকার ব্যাপার সরকার প্রধানের কথায় হচ্ছে, তখন তিনি ভুলে যান আমাদের দেশের বিদ্যমান ফৌজদারি কার্যবিধিতে কী লেখা রয়েছে। সেখানে লেখা রয়েছে–
‘(১) কোনো ব্যক্তি কোনো অপরাধের জন্য দ-িত হলে সরকার যে কোনো সময় বিনা শর্তে বা দ-িত ব্যক্তি যা মেনে নেয়, সেই শর্তে তার দ- কার্যকরীকরণ স্থগিত রাখতে বা সম্পূর্ণ দ- বা দ-ের অংশবিশেষ মওকুফ করতে পারবেন’
ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা খুব সম্ভবত এই ধারা সম্পর্কে অবগত নন। যদি অবগত হতেন তাহলে তিনি বুঝতে ও জানতে পারতেন বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনেই আসলে বলা রয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী (সরকার প্রধান/সরকার) আইন দ্বারা ক্ষমতার ফলশ্রুতিতে খালেদা জিয়াকে বিশেষ বিবেচনায় সাময়িক মুক্তি দিয়ে ঘরে থাকবার জন্য তাঁর দয়া দেখিয়েছেন। ফলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রধানের ওপর বিদ্যমান ক্ষমতার ফলশ্রুতিতে ব্যারিস্টার রুমিনের দলীয় প্রধানকে মুক্তি দেওয়ার পরেও যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে এসব অযাচিত সমালোচনা শুনতে হয় তখন ধরে নিতে হবে কৃতজ্ঞতাবোধ বলতে এই দলটির নেতাকর্মীদের আসলেই কিছু নেই।
এই আইন তো বর্তমান সরকার আজকে করেনি কিংবা করেনি ১৪ বছর আগেও। এমনকি বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থাতেও এই আইন ছিল।
বিএনপি এখন পর্যন্ত বলে যাচ্ছে খালেদা জিয়া তাদের নেত্রী এবং প্রতিটি সমাবেশে খালেদা জিয়ার জন্য একটি শূন্য আসন রেখে এই কথার সত্যতাও প্রমাণ করে যাচ্ছে। এখন একটি দল যখন একজন দ-প্রাপ্ত ব্যক্তিকে নেতা হিসেবে মানে, সেই নেতার নামে যখন পতাকার লাঠি বড় করতে বলা হয় এবং সেই লাঠি দিয়ে যখন প্রশাসনের ওপর আঘাত করতে নির্দেশ দেওয়া হয় কিংবা ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ফেলার আদেশ দেওয়া হয় কিংবা ১০ ডিসেম্বরের পর দ-প্রাপ্ত বেগম খালেদার নাম ধরে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের হুমকি দেওয়া হয়, তখন যৌক্তিকভাবে সব দায় সেই নেত্রীর ওপর গিয়েই প্রথমে পড়ে। ফলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন বেগম খালেদা জিয়াকে পুনরায় জেলে পাঠানো হবে বলে সতর্ক করেন তখন খুব স্বাভাবিকভাবে বলতেই হয়, প্রধানমন্ত্রী তা পূর্ণ আইনের ভেতর থেকেই সেটি বলেন। এখানে না হয় আইনের ভঙ্গ, না হয় বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ। বিএনপির এমন বিভ্রান্তকারী বক্তব্য, আদেশ, নির্দেশ, হুমকি, সংঘাতের রাজনীতি দেখে একটি প্রশ্নই আমাদের সামনে উঠে আসে। আর সেটি হচ্ছে, বিভ্রান্ত বিএনপি কী চায়?
লেখক : ব্যারিস্টার অ্যান্ড সলিসিটর
বিভ্রান্ত বিএনপি আসলে কী চায়?
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ
























