ঢাকা ০৯:০৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৫

বিবাহিত জীবন যন্ত্রণাদায়ক করে তোলে শৈশবের ফেলে আসা ট্রমা

  • আপডেট সময় : ০৭:৩৪:৪৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৫
  • ২ বার পড়া হয়েছে

ছবি সংগৃহীত

বিয়ের পর প্রাথমিক দিনগুলোয় সম্পর্কটি নিয়ে দম্পতির মধ্যে নানা ধরনের আশা থাকে। এটিকে বলা হয় হানিমুন পিরিয়ড। এ সময় দু’জনে স্বপ্ন বোনেন, নানা পরিকল্পনা করেন, চলে অন্তহীন কথোপকথন। মনে হয়, অতীতের অভিজ্ঞতা ফিরে আসবে না। সেসব বাদ দিয়েই জীবন কেটে যাবে। কিন্তু অতীত ফিরে আসেই। অনেক সময় সঙ্গীদের একজন তার সহকর্মীর সঙ্গে কথা বললেও অন্যজন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। সময়ের সঙ্গে পরিস্থিতি এমন হয় যে, একজনের মনে হয়- তার সঙ্গী তাকে আর ভালোবাসছেন না। আর ঠিক এ সময়ই ফিরে আসে শৈশবের ওই ভয়। যার আছে শৈশবের ট্রমা, তিনি নিজেকে হারিয়ে ফেলেন। এ বিষয় নিয়েই এবারের লাইফস্টাইল পাতার প্রধান ফিচার

আমরা যারা প্রাপ্তবয়স্ক এখন, তাদের মধ্যে বেশির ভাগই জন্মের পর থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত একটা নির্দিষ্ট পথ অনুসরণ করে এসেছি। প্রথমে শব্দ উচ্চারণ করেছি, এরপর হাঁটতে শিখেছি, স্কুলে ভর্তি হয়েছি, স্নাতক করেছি, এরপর কর্মক্ষেত্রে যোগ দিয়েছি এবং সবশেষে বিয়ে করে সংসারী হয়েছি।

অনেকের জন্যই এ ধারাবাহিকতায় বিবাহিত জীবন সুখে-শান্তিতে কাটানোর এক অদৃশ্য চাপ থাকে; যা তারা অনেকটা উত্তরাধিকার সূত্রে পান। আর জীবনের ঠিক এই পর্যায়ে এসে খুলে যায় শৈশব থেকে আটকে রাখা এক অন্ধকার কুঠুরি; যা বিবাহিত জীবনে নিয়ে আসে ঝগড়া, চিৎকার, লড়াই কিংবা একেবারে নিস্তব্ধতা। নিজেদের সেরা ভার্সনটা হতে গিয়ে আমরা প্রায়ই শৈশবে ফেলে আসা এক অস্থিরতার মুখোমুখি হই। অতীতের ভয়াবহ সেসব ট্রমা বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করে ফাটল তৈরি করতে চায়। যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি ওই ট্রমার মুখোমুখি হচ্ছেন, ততক্ষণ এটি আপনার পারিবারিক জীবনকে অস্থির করেই রাখবে। অথচ একটি সুখী পরিবার তো সবার জন্যই প্রত্যাশিত।

শিশুর মানসিক গঠন বা মানচিত্রটি তৈরি হয় বিভিন্ন ধরনের অনুভূতি দেখা ও তার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে। সেখানে যদি সে মানসিক যন্ত্রণা পেতে দেখে, মা-বাবার মধ্যে ঝগড়া দেখে, নিজেকে অবাঞ্ছিত মনে করতে থাকে, কারো অন্যায় আচরণের শিকার হয় কিংবা অবহেলার শিকার হয়; তাহলে তার মানসিক গঠনটি হয় যন্ত্রণাভিত্তিক। সাধারণত একজন মানুষ যে বিশ্বাস নিয়ে বড় হয়, সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই পৃথিবীকে দেখে। আর তার বিশ্বাস তৈরি হয় শৈশবে সে কেমন শৃঙ্খলিত পরিবেশে বড় হয়েছে তার ওপর। তা সেটি সঠিক হোক আর না হোক।

তাদের মানসিক মানচিত্র এমনভাবে তৈরি হয় যা তাদের প্রথম সম্পর্কের অস্থিরতা মোকাবিলা করতে সহায়তা করে। এটিই নির্ধারণ করে যে, পরবর্তী জীবনে কীভাবে প্রেম, বিশ্বাস এবং বিশ্বস্ততার প্রতি তাদের বোঝাপড়া তৈরি হবে। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু তাদের মানসিক মানচিত্র বদলে যায় না। বরং ধীরে ধীরে হলেও তা ফিরে আসে এবং অবশ্যই ফিরে আসে। বহু বছর আগে বিয়ে বা দাম্পত্য সম্পর্কে যে ধারণা তাদের মধ্যে গেঁড়ে বসেছিল, তারা সেটির মধ্যেই নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। অথচ এই ধারণা তখন তৈরি হয়েছিল যখন বিয়ে বা দাম্পত্য বোঝার মতো বয়সই হয়তো তাদের হয়নি।

মনোবিকাশ ফাউন্ডেশনের মনোচিকিৎসক ডা. আব্দুল হামিদ বিষয়টি বুঝিয়ে বলেন। তিনি বলেন, শৈশবের অমীমাংসিত ট্রমা নীরবে বিভিন্ন মানসিক প্রতিক্রিয়াগুলোকে পরিচালিত করে। এটা এমনভাবে কাজ করে যে একজন মানুষ তা বুঝতেই পারেন না। মানুষ তার পুরোনো মানসিক মানচিত্রের সঙ্গেই নতুন সম্পর্কটিকে খাপ খাইয়ে নিতে চেষ্টা করে। নতুন সম্পর্কে যখন মতবিরোধ দেখা দেয় তখন পুরোনো ট্রমা তার যুদ্ধক্ষেত্র খুঁজে পায়। তা দম্পতিদের এমন এক দ্বন্দ্বের চক্রে ফেলে দেয়- যেটি তাদের কাছে অপরিচিত মনে হয়, আবার হয় ভীষণ বেদনাদায়কও। বাইরে থেকে দাম্পত্যের এই সংকট সব সময় বোঝা যায় না। ঢাকার মতো শহরে যেখানে সামাজিক প্রত্যাশা অনেক বেশি এবং প্রায়ই বর্ধিত পরিবারের মতামত নবদম্পতির ব্যক্তিগত সময়ের ওপর হস্তক্ষেপ করে, সেখানে মানসিক দুর্বলতা স্বীকার করে নেওয়া অনেকটা পরাজয় বরণের মতোই মনে হয়।

দাম্পত্যে তৈরি হওয়া এই দূরত্বকে অনেকেই খুব সাবধানে লুকিয়ে রাখেন। তারা স্বাভাবিকভাবে ঘরের কাজ করেন, সন্তানকে স্কুলে আনা-নেওয়া করেন, খুব সাবধানে চলেন যেন আত্মীয়স্বজনের সামনে দুজনের মধ্যকার দূরত্বটা প্রকাশ না হয়ে যায়। নীরবে চলার ফলে দেখা যায়, সঙ্গীদের মধ্যে মানসিক বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে। অবিশ্বাস থেকে নয়, বরং আশ্বস্ত হওয়ার জন্য সঙ্গীদের মধ্যে একজন মরিয়া হয়ে ওঠেন। তখন অনেকটা শিশুসুলভভাবেই তিনি অন্য সঙ্গীর সোশ্যাল মিডিয়া মোবাইল ফোনের পাসওয়ার্ড চেয়ে বসতে পারেন।

এ ধরনের দাম্পত্যে বিপরীত পাশে যিনি থাকেন, তিনি বেশিরভাগ সময় জানেনই না যে তার সঙ্গী কেন এই আচরণ করছেন বা তার ভেতরে কেমন ক্ষত তৈরি হয়ে রয়েছে। তার কাছে বরং সঙ্গীর আচরণ নিয়ন্ত্রণমূলক মনে হয়। তাই সেখান থেকে তিনি সরে আসতে চান।

ডা. হামিদ বলেন, ‘যারা ছোটবেলা থেকে অবহেলার মধ্যে বড় হয়েছেন, নিরাপত্তাহীনতার সঙ্গে লড়াই করেছেন তার জন্য সম্পর্কের মধ্যে নিয়ন্ত্রণের প্রবণতা, স্বচ্ছতা বা অতি দৃশ্যমানতাই ভালোবাসার প্রমাণ হয়ে ওঠে। সঙ্গীর ঘনিষ্ঠ হওয়ার আকুতি থেকে যা শুরু হয় এবং এক পর্যায়ে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। যেখানে পাশাপাশি কয়েক ইঞ্চি দূরত্বে শুয়েও দু’জন সঙ্গী আদতে বাস করেন আলাদা পৃথিবীতে।’

শৈশবের প্রভাব: কিশোর বয়সে মানসিক আঘাতের মুখোমুখি হওয়া বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় বিরল নয়। নানাভাবেই এটি হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে আর্থিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, লিঙ্গবৈষম্য এবং পুরুষতন্ত্র। পিতৃতান্ত্রিক রীতিনীতি অনেক পরিবারের স্বাভাবিক গতিকেই বাধাগ্রস্ত করতে পারে। অনেক শিশুই এই ধারণা নিয়ে বড় হয় যে তাদের চাহিদা সংসারে গৌণ। কারো কারো কাছে মনে হয় তার অস্তিত্বই বুঝি পরিবারের জন্য বোঝা। তাদের মনের এই ক্ষতগুলোর যদি চিকিৎসা না করা হয় তাহলে তা ব্যক্তির মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। কেবল যখন ওই শিশু প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে কারও সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়ায় তখন ক্ষতগুলো হিংস্রভাবে প্রকাশিত হয়। এই ধরনের বিশ্বাসের ফলে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে একজন ব্যক্তি কোনো সম্পর্কে জড়ালে সেখানে পরিত্যক্ত হওয়ার ভয় পান। বিশেষ করে তাদের মধ্যে এ সংকট দেখা যায়, যারা শৈশবে মা-বাবার মধ্যে বিরোধ দেখে বড় হয়েছেন।

ডা. হামিদ বলেন- ‘শিশুরা এটা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, মা-বাবার কষ্ট এবং ত্যাগের কারণ তারা। বাবা-মায়ের দ্বন্দ্বের পেছনের কারণ বোঝার জন্য তারা আকুল হয়ে চেষ্টা করে এবং প্রতিবারই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে এসব সংকটের জন্য তারাই দায়ী।’

এখান থেকেই হারিয়ে ফেলার বা পরিত্যক্ত হওয়ার অনুভূতির শুরু। এ সময় মানুষ তার নিজের মূল্য এবং পরিচয়ের বোধ হারিয়ে ফেলতে শুরু করে। সময়ের সঙ্গে তার ধারণা আরও বাস্তব হয়ে উঠতে থাকে। শৈশবের এই অমীমাংসিত ট্রমা তার প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের নতুন সম্পর্কের ওপর আঘাত হানে। পরিত্যক্ত হওয়ার তীব্র ভয় থেকে তারা সম্পর্কে নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করে। তাদের এই আচরণের পেছনে লুকিয়ে থাকে একটি আহত শিশু। যে কারো ছেড়ে যাওয়ার কারণ হতে ভয় পায়।

বাংলাদেশের নারীরা পুরুষদের তুলনায় ভিন্ন ধরনের মানসিক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হন। এর মধ্যে রয়েছে বডি শেমিং, বর্ণবাদী আচরণ এবং সমাজের অতিরিক্ত প্রত্যাশা। অন্যদিকে পুরুষদের সামাজিকভাবে শক্ত থাকার ভান করতে হয়, নিজের দুর্বলতা দমন করতে হয় এবং পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে হয়; এমনকি এ জন্য যদি জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে হয়, তাহলেও তাদের পিছপা হওয়ার উপায় নেই। এই দমন-পীড়নের জীবনে যখন দাম্পত্য সম্পর্ক আসে, তখন সেখানে দুজনের মধ্যে এক দেয়াল দাঁড়িয়ে যায়; যা ভেঙে ফেলার উপায় দুজনের কেউই জানে না।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, দুনিয়া যখন কোনো দম্পতির ঝকঝকে ছবি দেখছে, আনন্দময় ক্যাপশন দেখছে আর তাদের দাম্পত্য উদযাপনের খবর পড়ছে তখন হয়তো তাদের মধ্যেই কেউ কেউ বন্ধ দরজার আড়ালে নীরবে কষ্ট করছেন, অতীতের যন্ত্রণায় কাতর হয়ে দিন কাটাচ্ছেন। তাদের না আছে কথা বলার জায়গা, না আছে ক্ষত নিরাময়ের সুযোগ। দাম্পত্যে যোগাযোগের অভাব কেবল ঝগড়ার কারণেই হয় এমন নয়, নীরবতার কারণেও হয়। একে অন্যের প্রতি রাগ, অভিমান জমা হতে হতে ঘৃণা নয় বরং একসময় দ্বিধা চলে আসে। জীবন মাঝে মাঝে এমন নাটকের মতো হয় যেখানে অভিনেতারা তাদের ডায়লগ ভুলে গেলেও নিখুঁতভাবে অভিনয় চালিয়ে যান।

যে সমাজে মানসিক স্বাস্থ্যকে এখনো বিলাসবস্তু হিসেবে দেখা হয়, সেখানে খেরাপি খোঁজা অনেকের জন্য কঠিন। এখাদে দুর্বলতাকে ভুল বোঝা হয়, থেরাপিকে তো দেখা হয় একেবারেই অপ্রয়োজনীয় বিষয় হিসেবে।

আরোগ্যের পথ: ডা. আব্দুল হামিদ জোর দিয়ে বলেন, সত্যিকার অগ্রগতি তখনই শুরু হয় যখন দম্পতিরা একে অন্যকে শত্রু হিসেবে দেখা বন্ধ করে এবং আসল প্রতিপক্ষ বা শৈশবের ওই ক্ষতকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখতে শুরু করে; যা হয়তো তারা দু’জনেই বহন করে চলছিল। একটু অন্যভাবে কথা বলা শুরুর মধ্য দিয়েই এই ক্ষত নিরাময় সম্ভব। অভিযোগ দিয়ে নয়, বরং কৌতূহলের সঙ্গে এবং সততার মাধ্যমে তা সম্ভব। সঙ্গীর সঙ্গে যখন মতবিরোধ তুঙ্গে উঠবে, তখন আপনাকে ভেবে নিতে হবে এই কান্না বা রাগ আসলে বিয়ে বার্ষিকীর ডিনার ভুলে যাওয়ার কারণে নয়; বরং এর পেছনে রয়েছে একটি আহত শিশু, যে আরও একবার পরিত্যক্ত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে। যে আশঙ্কা থেকেই তার রাগের সৃষ্টি।

আকাশচুম্বী অট্টালিকা তৈরির পাশাপাশি ঢাকার সংস্কৃতির বিবর্তন হচ্ছে, বিয়ের সংস্কৃতিতেও আসছে পরিবর্তন। সবকিছুকে চাপা দেওয়ার পুরোনা সংস্কৃতিকে পেছনে ফেলে বিকশিত হচ্ছে প্রশ্ন করার বা বোঝার সংস্কৃতি। দম্পতিরা বুঝতে শুরু করেছে যে, যদি অতীতের কোনো ক্ষত থাকে তাহলে কেবল ভালোবাসাই সুন্দর দাম্পত্যের জন্য যথেষ্ট নয়। এই সমস্যা সমাধানের একক কোনো উপায় নেই, সহজ কোনো পন্থাও নেই। শৈশবের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত দাম্পত্য সম্পর্ক ঠিক করার পথটি অরৈখিক, অগোছালো এবং অত্যন্ত ব্যক্তিগতও বটে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন সততা। আর তা কেবল সঙ্গীর প্রতি নয়, নিজের প্রতিও।

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

বিবাহিত জীবন যন্ত্রণাদায়ক করে তোলে শৈশবের ফেলে আসা ট্রমা

আপডেট সময় : ০৭:৩৪:৪৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৫

বিয়ের পর প্রাথমিক দিনগুলোয় সম্পর্কটি নিয়ে দম্পতির মধ্যে নানা ধরনের আশা থাকে। এটিকে বলা হয় হানিমুন পিরিয়ড। এ সময় দু’জনে স্বপ্ন বোনেন, নানা পরিকল্পনা করেন, চলে অন্তহীন কথোপকথন। মনে হয়, অতীতের অভিজ্ঞতা ফিরে আসবে না। সেসব বাদ দিয়েই জীবন কেটে যাবে। কিন্তু অতীত ফিরে আসেই। অনেক সময় সঙ্গীদের একজন তার সহকর্মীর সঙ্গে কথা বললেও অন্যজন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। সময়ের সঙ্গে পরিস্থিতি এমন হয় যে, একজনের মনে হয়- তার সঙ্গী তাকে আর ভালোবাসছেন না। আর ঠিক এ সময়ই ফিরে আসে শৈশবের ওই ভয়। যার আছে শৈশবের ট্রমা, তিনি নিজেকে হারিয়ে ফেলেন। এ বিষয় নিয়েই এবারের লাইফস্টাইল পাতার প্রধান ফিচার

আমরা যারা প্রাপ্তবয়স্ক এখন, তাদের মধ্যে বেশির ভাগই জন্মের পর থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত একটা নির্দিষ্ট পথ অনুসরণ করে এসেছি। প্রথমে শব্দ উচ্চারণ করেছি, এরপর হাঁটতে শিখেছি, স্কুলে ভর্তি হয়েছি, স্নাতক করেছি, এরপর কর্মক্ষেত্রে যোগ দিয়েছি এবং সবশেষে বিয়ে করে সংসারী হয়েছি।

অনেকের জন্যই এ ধারাবাহিকতায় বিবাহিত জীবন সুখে-শান্তিতে কাটানোর এক অদৃশ্য চাপ থাকে; যা তারা অনেকটা উত্তরাধিকার সূত্রে পান। আর জীবনের ঠিক এই পর্যায়ে এসে খুলে যায় শৈশব থেকে আটকে রাখা এক অন্ধকার কুঠুরি; যা বিবাহিত জীবনে নিয়ে আসে ঝগড়া, চিৎকার, লড়াই কিংবা একেবারে নিস্তব্ধতা। নিজেদের সেরা ভার্সনটা হতে গিয়ে আমরা প্রায়ই শৈশবে ফেলে আসা এক অস্থিরতার মুখোমুখি হই। অতীতের ভয়াবহ সেসব ট্রমা বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করে ফাটল তৈরি করতে চায়। যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি ওই ট্রমার মুখোমুখি হচ্ছেন, ততক্ষণ এটি আপনার পারিবারিক জীবনকে অস্থির করেই রাখবে। অথচ একটি সুখী পরিবার তো সবার জন্যই প্রত্যাশিত।

শিশুর মানসিক গঠন বা মানচিত্রটি তৈরি হয় বিভিন্ন ধরনের অনুভূতি দেখা ও তার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে। সেখানে যদি সে মানসিক যন্ত্রণা পেতে দেখে, মা-বাবার মধ্যে ঝগড়া দেখে, নিজেকে অবাঞ্ছিত মনে করতে থাকে, কারো অন্যায় আচরণের শিকার হয় কিংবা অবহেলার শিকার হয়; তাহলে তার মানসিক গঠনটি হয় যন্ত্রণাভিত্তিক। সাধারণত একজন মানুষ যে বিশ্বাস নিয়ে বড় হয়, সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই পৃথিবীকে দেখে। আর তার বিশ্বাস তৈরি হয় শৈশবে সে কেমন শৃঙ্খলিত পরিবেশে বড় হয়েছে তার ওপর। তা সেটি সঠিক হোক আর না হোক।

তাদের মানসিক মানচিত্র এমনভাবে তৈরি হয় যা তাদের প্রথম সম্পর্কের অস্থিরতা মোকাবিলা করতে সহায়তা করে। এটিই নির্ধারণ করে যে, পরবর্তী জীবনে কীভাবে প্রেম, বিশ্বাস এবং বিশ্বস্ততার প্রতি তাদের বোঝাপড়া তৈরি হবে। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু তাদের মানসিক মানচিত্র বদলে যায় না। বরং ধীরে ধীরে হলেও তা ফিরে আসে এবং অবশ্যই ফিরে আসে। বহু বছর আগে বিয়ে বা দাম্পত্য সম্পর্কে যে ধারণা তাদের মধ্যে গেঁড়ে বসেছিল, তারা সেটির মধ্যেই নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। অথচ এই ধারণা তখন তৈরি হয়েছিল যখন বিয়ে বা দাম্পত্য বোঝার মতো বয়সই হয়তো তাদের হয়নি।

মনোবিকাশ ফাউন্ডেশনের মনোচিকিৎসক ডা. আব্দুল হামিদ বিষয়টি বুঝিয়ে বলেন। তিনি বলেন, শৈশবের অমীমাংসিত ট্রমা নীরবে বিভিন্ন মানসিক প্রতিক্রিয়াগুলোকে পরিচালিত করে। এটা এমনভাবে কাজ করে যে একজন মানুষ তা বুঝতেই পারেন না। মানুষ তার পুরোনো মানসিক মানচিত্রের সঙ্গেই নতুন সম্পর্কটিকে খাপ খাইয়ে নিতে চেষ্টা করে। নতুন সম্পর্কে যখন মতবিরোধ দেখা দেয় তখন পুরোনো ট্রমা তার যুদ্ধক্ষেত্র খুঁজে পায়। তা দম্পতিদের এমন এক দ্বন্দ্বের চক্রে ফেলে দেয়- যেটি তাদের কাছে অপরিচিত মনে হয়, আবার হয় ভীষণ বেদনাদায়কও। বাইরে থেকে দাম্পত্যের এই সংকট সব সময় বোঝা যায় না। ঢাকার মতো শহরে যেখানে সামাজিক প্রত্যাশা অনেক বেশি এবং প্রায়ই বর্ধিত পরিবারের মতামত নবদম্পতির ব্যক্তিগত সময়ের ওপর হস্তক্ষেপ করে, সেখানে মানসিক দুর্বলতা স্বীকার করে নেওয়া অনেকটা পরাজয় বরণের মতোই মনে হয়।

দাম্পত্যে তৈরি হওয়া এই দূরত্বকে অনেকেই খুব সাবধানে লুকিয়ে রাখেন। তারা স্বাভাবিকভাবে ঘরের কাজ করেন, সন্তানকে স্কুলে আনা-নেওয়া করেন, খুব সাবধানে চলেন যেন আত্মীয়স্বজনের সামনে দুজনের মধ্যকার দূরত্বটা প্রকাশ না হয়ে যায়। নীরবে চলার ফলে দেখা যায়, সঙ্গীদের মধ্যে মানসিক বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে। অবিশ্বাস থেকে নয়, বরং আশ্বস্ত হওয়ার জন্য সঙ্গীদের মধ্যে একজন মরিয়া হয়ে ওঠেন। তখন অনেকটা শিশুসুলভভাবেই তিনি অন্য সঙ্গীর সোশ্যাল মিডিয়া মোবাইল ফোনের পাসওয়ার্ড চেয়ে বসতে পারেন।

এ ধরনের দাম্পত্যে বিপরীত পাশে যিনি থাকেন, তিনি বেশিরভাগ সময় জানেনই না যে তার সঙ্গী কেন এই আচরণ করছেন বা তার ভেতরে কেমন ক্ষত তৈরি হয়ে রয়েছে। তার কাছে বরং সঙ্গীর আচরণ নিয়ন্ত্রণমূলক মনে হয়। তাই সেখান থেকে তিনি সরে আসতে চান।

ডা. হামিদ বলেন, ‘যারা ছোটবেলা থেকে অবহেলার মধ্যে বড় হয়েছেন, নিরাপত্তাহীনতার সঙ্গে লড়াই করেছেন তার জন্য সম্পর্কের মধ্যে নিয়ন্ত্রণের প্রবণতা, স্বচ্ছতা বা অতি দৃশ্যমানতাই ভালোবাসার প্রমাণ হয়ে ওঠে। সঙ্গীর ঘনিষ্ঠ হওয়ার আকুতি থেকে যা শুরু হয় এবং এক পর্যায়ে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। যেখানে পাশাপাশি কয়েক ইঞ্চি দূরত্বে শুয়েও দু’জন সঙ্গী আদতে বাস করেন আলাদা পৃথিবীতে।’

শৈশবের প্রভাব: কিশোর বয়সে মানসিক আঘাতের মুখোমুখি হওয়া বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় বিরল নয়। নানাভাবেই এটি হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে আর্থিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, লিঙ্গবৈষম্য এবং পুরুষতন্ত্র। পিতৃতান্ত্রিক রীতিনীতি অনেক পরিবারের স্বাভাবিক গতিকেই বাধাগ্রস্ত করতে পারে। অনেক শিশুই এই ধারণা নিয়ে বড় হয় যে তাদের চাহিদা সংসারে গৌণ। কারো কারো কাছে মনে হয় তার অস্তিত্বই বুঝি পরিবারের জন্য বোঝা। তাদের মনের এই ক্ষতগুলোর যদি চিকিৎসা না করা হয় তাহলে তা ব্যক্তির মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। কেবল যখন ওই শিশু প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে কারও সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়ায় তখন ক্ষতগুলো হিংস্রভাবে প্রকাশিত হয়। এই ধরনের বিশ্বাসের ফলে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে একজন ব্যক্তি কোনো সম্পর্কে জড়ালে সেখানে পরিত্যক্ত হওয়ার ভয় পান। বিশেষ করে তাদের মধ্যে এ সংকট দেখা যায়, যারা শৈশবে মা-বাবার মধ্যে বিরোধ দেখে বড় হয়েছেন।

ডা. হামিদ বলেন- ‘শিশুরা এটা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, মা-বাবার কষ্ট এবং ত্যাগের কারণ তারা। বাবা-মায়ের দ্বন্দ্বের পেছনের কারণ বোঝার জন্য তারা আকুল হয়ে চেষ্টা করে এবং প্রতিবারই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে এসব সংকটের জন্য তারাই দায়ী।’

এখান থেকেই হারিয়ে ফেলার বা পরিত্যক্ত হওয়ার অনুভূতির শুরু। এ সময় মানুষ তার নিজের মূল্য এবং পরিচয়ের বোধ হারিয়ে ফেলতে শুরু করে। সময়ের সঙ্গে তার ধারণা আরও বাস্তব হয়ে উঠতে থাকে। শৈশবের এই অমীমাংসিত ট্রমা তার প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের নতুন সম্পর্কের ওপর আঘাত হানে। পরিত্যক্ত হওয়ার তীব্র ভয় থেকে তারা সম্পর্কে নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করে। তাদের এই আচরণের পেছনে লুকিয়ে থাকে একটি আহত শিশু। যে কারো ছেড়ে যাওয়ার কারণ হতে ভয় পায়।

বাংলাদেশের নারীরা পুরুষদের তুলনায় ভিন্ন ধরনের মানসিক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হন। এর মধ্যে রয়েছে বডি শেমিং, বর্ণবাদী আচরণ এবং সমাজের অতিরিক্ত প্রত্যাশা। অন্যদিকে পুরুষদের সামাজিকভাবে শক্ত থাকার ভান করতে হয়, নিজের দুর্বলতা দমন করতে হয় এবং পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে হয়; এমনকি এ জন্য যদি জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে হয়, তাহলেও তাদের পিছপা হওয়ার উপায় নেই। এই দমন-পীড়নের জীবনে যখন দাম্পত্য সম্পর্ক আসে, তখন সেখানে দুজনের মধ্যে এক দেয়াল দাঁড়িয়ে যায়; যা ভেঙে ফেলার উপায় দুজনের কেউই জানে না।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, দুনিয়া যখন কোনো দম্পতির ঝকঝকে ছবি দেখছে, আনন্দময় ক্যাপশন দেখছে আর তাদের দাম্পত্য উদযাপনের খবর পড়ছে তখন হয়তো তাদের মধ্যেই কেউ কেউ বন্ধ দরজার আড়ালে নীরবে কষ্ট করছেন, অতীতের যন্ত্রণায় কাতর হয়ে দিন কাটাচ্ছেন। তাদের না আছে কথা বলার জায়গা, না আছে ক্ষত নিরাময়ের সুযোগ। দাম্পত্যে যোগাযোগের অভাব কেবল ঝগড়ার কারণেই হয় এমন নয়, নীরবতার কারণেও হয়। একে অন্যের প্রতি রাগ, অভিমান জমা হতে হতে ঘৃণা নয় বরং একসময় দ্বিধা চলে আসে। জীবন মাঝে মাঝে এমন নাটকের মতো হয় যেখানে অভিনেতারা তাদের ডায়লগ ভুলে গেলেও নিখুঁতভাবে অভিনয় চালিয়ে যান।

যে সমাজে মানসিক স্বাস্থ্যকে এখনো বিলাসবস্তু হিসেবে দেখা হয়, সেখানে খেরাপি খোঁজা অনেকের জন্য কঠিন। এখাদে দুর্বলতাকে ভুল বোঝা হয়, থেরাপিকে তো দেখা হয় একেবারেই অপ্রয়োজনীয় বিষয় হিসেবে।

আরোগ্যের পথ: ডা. আব্দুল হামিদ জোর দিয়ে বলেন, সত্যিকার অগ্রগতি তখনই শুরু হয় যখন দম্পতিরা একে অন্যকে শত্রু হিসেবে দেখা বন্ধ করে এবং আসল প্রতিপক্ষ বা শৈশবের ওই ক্ষতকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখতে শুরু করে; যা হয়তো তারা দু’জনেই বহন করে চলছিল। একটু অন্যভাবে কথা বলা শুরুর মধ্য দিয়েই এই ক্ষত নিরাময় সম্ভব। অভিযোগ দিয়ে নয়, বরং কৌতূহলের সঙ্গে এবং সততার মাধ্যমে তা সম্ভব। সঙ্গীর সঙ্গে যখন মতবিরোধ তুঙ্গে উঠবে, তখন আপনাকে ভেবে নিতে হবে এই কান্না বা রাগ আসলে বিয়ে বার্ষিকীর ডিনার ভুলে যাওয়ার কারণে নয়; বরং এর পেছনে রয়েছে একটি আহত শিশু, যে আরও একবার পরিত্যক্ত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে। যে আশঙ্কা থেকেই তার রাগের সৃষ্টি।

আকাশচুম্বী অট্টালিকা তৈরির পাশাপাশি ঢাকার সংস্কৃতির বিবর্তন হচ্ছে, বিয়ের সংস্কৃতিতেও আসছে পরিবর্তন। সবকিছুকে চাপা দেওয়ার পুরোনা সংস্কৃতিকে পেছনে ফেলে বিকশিত হচ্ছে প্রশ্ন করার বা বোঝার সংস্কৃতি। দম্পতিরা বুঝতে শুরু করেছে যে, যদি অতীতের কোনো ক্ষত থাকে তাহলে কেবল ভালোবাসাই সুন্দর দাম্পত্যের জন্য যথেষ্ট নয়। এই সমস্যা সমাধানের একক কোনো উপায় নেই, সহজ কোনো পন্থাও নেই। শৈশবের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত দাম্পত্য সম্পর্ক ঠিক করার পথটি অরৈখিক, অগোছালো এবং অত্যন্ত ব্যক্তিগতও বটে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন সততা। আর তা কেবল সঙ্গীর প্রতি নয়, নিজের প্রতিও।

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ