ঢাকা ১০:০২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

বিনোদনের শেকড় যাত্রা শিল্প ও শিল্পীরা

  • আপডেট সময় : ১০:৩৭:১২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৯ জুলাই ২০২১
  • ৩৫৫ বার পড়া হয়েছে

বারী সুমন : “এইতো আমার দেশ/ সোনার বাংলাদেশ/ দোয়েল শ্যামা কোকিল ডাকা/ডাকার নাইতো শেষ”।
এমন কোন দেশের গানের মধ্য দিয়েই শুরু হতো যাত্রাগানের অনুষ্ঠান।
গ্রাম গঞ্জের এক সময়কার এক বিনোদনের নাম যাত্রা। যাত্রাপালায় ছিলোনা এখনকার মতো কোনো অশ্লীলতা। কোন একটি বিষয়কে, বিশেষ করে রাজা জমিদারদের বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে লিখা হতো যাত্রা পালা। সামাজিক, ঐতিহাসিক বিভিন্ন ধরণের যাত্রা পালার প্রচলন ছিলো। স্বপরিবারের দেখার মতো বহু যাত্রা পালা ছিলো আমাদের। একটি নির্দিষ্ট বিষয়কে কেন্দ্র করে রচিত হতো এ পালা। একটি দল বা অপেরাকে ঘিরে কাজ করতো বহুসংখ্যক লোক।
যাত্রাই একমাত্র সাংস্কৃতিক জনমাধ্যম যার মাধ্যমে এক সঙ্গে ১৫/২০ হাজার মানুষের বিনোদন চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। বিনোদনের মাধ্যমে প্রান্তিক মানুষের মাঝে শিক্ষণীয় নানা বার্তা পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রেও যাত্রার যথেষ্ঠ ভূমিকা রয়েছে।
যাদের একমাত্র পেশাই ছিলো যাত্রাপালা। অভিনেতা- অভিনেত্রী, যন্ত্রশিল্পী, মেকাপ ম্যান, স্মারক, সাউন্ড নিয়ন্ত্রণ কারী, সহযোগী লোক সহ অনেক লোকের নেশা এবং পেশা ছিলো এই যাত্রা পালা।
প্রাচীনকালে ধর্মীয় উৎসবে শোভাযাত্রার আবহে পৌরাণিক কাহিনীর গীতিবদ্ধ উপস্থাপনা এক সময় যাত্রাগান হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
কবি তপন বাগচীর রচিত গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘বাংলায় যাত্রাগানের উদ্ভব। ’ বইটিতে বিশ্বকোষ প্রণেতা নগেন্দ্রনাথ বসুর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে- ‘অতি প্রাচীনকাল হইতে ভারতবর্ষের সকল স্থানেই প্রকাশ্য রঙ্গভূমে বেশভূষায় ভূষিত ও নানাসাজে সুসজ্জিত নরনারী লইয়া গীতবাদ্যাদী সহকারে কৃষ্ণপ্রসঙ্গ অভিনয় করিবার রীতি প্রচলিত। গীতবাদ্যাদীযোগে ঐ সকল লীলোৎসব- প্রসঙ্গে যে অভিনয়ক্রম প্রদর্শিত হইয়া থাকে- তাহাই প্রকৃত যাত্রা বলিয়া অভিহিত। ’
ফোকলোরবিদ ড. আশরাফ সিদ্দিকী মনে করেন, ভাষাতত্ত্ববিদদের মতে- প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয় শব্দমূল ‘যা’ ধাতু থেকে, যার অর্থ গমন-যাত্রা শব্দের উৎপত্তি। যাত্রা গবেষকগণ এ শিল্পের উদ্ভবকে দেখেছেন, দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত আদিযুগ, ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত মধ্যযুগ এবং উনবিংশ শতাব্দী থেকে চলমান সময় পর্যন্ত আধুনিক যুগ হিসেবে।

যাত্রার ক্রমবিকাশ সম্পর্কে যাত্রা গবেষক ও কবি ড. তপন কুমার বাগচী লিখেছেন, ‘১৮৬০ সালে ঢাকায় কৃষ্ণকমল গোস্বামী (১৮১১-৮৮) কৃষ্ণ বিষয়ক ঢপ কীর্তন পরিবেশনের পাশাপাশি পৌরাণিক পালা রচনা ও মঞ্চায়নের মাধ্যমে যাত্রার যে গতি সঞ্চার করেন, চারণকবি মুকুন্দ দাসের (১৮৮৭-১৯৩৪) হাতে তা হয়ে ওঠে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের জাগরণী মন্ত্র।
বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ব্রজেন্দ্র কুমার দে’র (১৯০৭-৭৬) হাতে যাত্রা বিকশিত হয়ে পৌরাণিক পালার পাশাপাশি ঐতিহাসিক, লোককাহিনীভিত্তিক ও সামাজিক পালায়।
নামিদামি পালাকারের অভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের যাত্রাশিল্পীরাই এক সময় পালা রচনায় হাত দেন। এর মধ্যে খুলনার পরিতোষ ব্রহ্মচারীর নদীর নাম মধুমতি, ক্লিওপেট্রা, ইসহাক আলীর সুন্দরবনের জোড়াবাঘ, এমএ মজিদের সোনার বাংলা, যশোরের সাধন মুখার্জির শতাব্দীর মহানায়ক, নিচের পৃথিবী, ঢাকার ননী চক্রবর্ত্তীর ডিস্কো ডেঞ্চার, দস্যুরানি, যৌতুক, চট্টগ্রামের মিলন কান্তি দে’র মায়ের ছেলে, দাতা হাতেম তাই, বিদ্রোহী নজরুল, বাংলার মহানায়ক, গাইবান্ধার আব্দুস সামাদের গরীবের আর্তনাদ, ফরিদপুরের হারুনর রশিদের শতাব্দীর মহানায়ক মুজিব, মুন্সিগঞ্জের আরশাদ আলীর সতী কেন কলঙ্কিনী, গৌরীমালা, মানিকগঞ্জের জ্যোসনা বিশ্বাসের রক্তস্নাত একাত্তর উল্লেখযোগ্য।
কিছু কিছু অপেরা মাস ছয়েকের জন্য বিভিন্ন এলাকায় চলে যেতো তাদের যাত্রাদল নিয়ে। সেখানে একটানা রাতের পর রাত পালা পরিবেশন করে মানুষের মনের খোরাক যুগিয়েছে এই যাত্রা শিল্পীরা। কিছু কিছু শিল্পীরা অল্প শিক্ষিত বা নিরক্ষর হলেও অভিনয়ে ছিলো পাকা। নিজস্ব প্যান্ডেলে রাতের পর রাত তারা মানুষের হৃদয় জোড়ানো পালা পরিবেশন করে গেছেন। বাড়িতে রেখে যেতেন স্ত্রী-সন্তান। সে চিন্তা আসলেও তারা সে চিন্তার রেখা দূরে ঠেলে অভিনয়টাকে বুকে লালন করেছেন। সারা রাত মানুষের মন জয় করে দিনের বেলা চাটাই পেতে খড় বিছিয়ে ঘুমিয়ে কিছুটা ক্লান্তি দূর করে আবার রাতের শো করার প্রস্তুতি নিতেন। কত টাকাই বা আয় হতো! টাকার দিকে তারা কখনও খেয়াল করেন নি, বরং কিভাবে পালা দিয়ে মানুষের মন জয় করা যায় সে দিকটায় বেশি সজাগ দৃষ্টি রাখতেন। একেক জায়গায় তারা মাসখানেকের উপরে বিভিন্ন পালা পরিবেশন করতেন। সেখানকার পালা পরিবেশন শেষে সব কিছু গুটিয়ে আবার নতুন কোন জায়গায় স্থাপন করতেন যাত্রার প্যান্ডেল। রাতের নির্দিষ্ট সময়ে রঙিণ আলোর ঝলকানিতে আবার শুরু হতো পালা। রাতভর মানুষের মনে আনন্দ জোগাতো এসব যাত্রা শিল্পীরা।

সমাজে যাত্রা শিল্পীকে কখনও মর্যাদার চোখে দেখতো না। সবসময় ছোট করে দেখতো, নিগৃহীতের একটা বাণী ছুড়ে দিতো তাদের দিকে, এরা যাত্রা শিল্পী। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ভাবলেও রাতের বেলায় এরাই আবার যাত্রার আসরে যেতো নিজের মনের আনন্দ জোগাতে। তবে যাত্রা শিল্পীদের মধ্যে কোন প্রকার হিংসা লক্ষ্য করা যেতোনা। শত হলেও তারাতো নিবেদিত শিল্পী। তাদের কোন হিংসা থাকতে নেই। একটা সময়ে যাত্রার বেশ সুনাম থাকলেও পরবর্তী সময়ে যাত্রায় কিছু পরিবর্তন আসলো। যাত্রার নামে চলতো অশ্লীল নাচানাচি। যা স্বপরিবারে দেখার মতো কখনোই ছিলোনা। এতে করে সত্যিকারের যাত্রা শিল্পীরা কাজে আগ্রহ হারাতে থাকে। পরবর্তীতে প্রযুক্তি যোগ হওয়াতে এখন প্রায় যাত্রা নেই বললেই চলে। কেবল ইন্টারনেট ঘেটে আগের কিছু যাত্রা পাওয়া যায়। ধীরে ধীরে চাহিদা কমতে কমতে এখন প্রায় শূন্যের কোটায় যাত্রা শিল্পীদের অবস্থান। এতে করে যাত্রার শিল্পীরা পড়ে যায় বিপাকে। মন থেকে যাত্রা ছাড়তেও পারছেনা আবার অন্য পেশাতেও নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছেনা। বর্তমান করোনা পরিস্থিতির কারণে যাত্রা সহ সব ধরনের দর্শকসমাগম হতে পারে এমন বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান বন্ধ। এতে করে তারা যাযাবর জীবন যাপন করছে। পাচ্ছেনা সঠিক সরকারি অনুদান যাতে করে তারা নিজেদের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে পারে। আবার যাত্রার জন্যও কোনো সরকারি সহযোগিতা নেই। কথা হয় ময়মনসিংহের গৌরীপুরের যাত্রাপালার ড্রামস বাদক অনীল বাবুর সাথে। তিনি বলেন একসময় এমন কোনোদিন ছিলোনা যে যাত্রার পালা বন্ধ থাকতো। প্রতিদিন ড্রামস বাজিয়ে মন জয় করতেন দর্শকদের। যাত্রার কদর কিছুটা কমে যাওয়ায় ড্রামস ছেড়ে বেছে নেন তবলা, বর্তমান আধুনিক যন্ত্রসঙ্গীতের ছোয়া দেওয়ার জন্য তবলার পাশাপাশি বেছে নেন প্যাড ড্রামস। করোনকালীন বিষয়ে কথা বললে জানান বর্তমানে প্রায় দুই বছর ধরে আমরা বসে আছি। কোনো অনুষ্ঠান নেই আমাদের মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে। কথা হয় যাত্রা শিল্পী স্বপ্নার সাথে তিনি জানান, একসময় প্রতিদিন আমাদের পালার বায়না থাকতো বর্তমানে আমরা খুব খারাপ অবস্থায় আছি। মানবেতর জীবন যাপন করছি দেখার মতো তেমন কেউ নেই। এক সময়কার মঞ্চ কাঁপানো কৃষ্ণার সাথে কথা বলে জানা যায় প্রতিদিনের মঞ্চ কাঁপিয়ে দর্শকদের মন জয় করেছি। মানুষকে বিনোদন দিয়ে তাদের মনে আনন্দ যুগিয়েছি, বর্তমানে আমাদের কোনো কদর নেই। এখন কোন অনুষ্ঠানে আমাদের ডাক পড়েনা। বয়স হয়ে যাওয়াতে অন্য কোন কাজও করতে পারিনা। আমাদের প্রতি সরকারের নজর দেওয়া দরকার। যাত্রার জন্য সরকারের সহযোগিতা থাকলে যাত্রার মান পুনরায় আগের মতো করে দর্শকদের ভালো কিছু উপহার দিতে পারবো।
আমাদের মধ্যে ভালো নাট্যকারের অভাব রয়েছে। তারা যদি আবারও ভালো মানের যাত্রা পালা লিখেন দর্শকরা পুনরায় যাত্রা দেখায় আগ্রহ ফিরে পাবে। অন্যান্য অসুবিধার পাশাপাশি ভালো মানের পালা লিখা হয়না বিধায় আমাদের যাত্রা শিল্প হারাতে বসেছে তার নিজস্ব ঐতিহ্য। যদিও কিছু কিছু এলাকায় নামেমাত্র কিছু যাত্রা শিল্পগোষ্ঠি রয়েছে কিন্তু তাদের তেমন কোন কদর নেই। নেই ভালো মানের নতুন কোন পালা। এক সময়কার গ্রাম গঞ্জের কিছু পালা তারা পরিবেশন করে যা, বর্তমান সময়ে দর্শক নন্দিত নয়। নতুন আঙ্গিকে নতুন কোন পালা রচিত এবং পরিবেশিত হলে লোকজন নতুন করে আবার যাত্রা শিল্পে প্রবেশ করবে বলে বিশ্বাস। নতুন আঙ্গিক না থাকায় আমাদের ঐতিহ্যবাহী যাত্রা শিল্প এবং যাত্রা শিল্পীদের কদর নেই।
আমাদের পাশে এমন শত শত যাত্রা শিল্পী রয়েছেন। সময়ের সাথে সাথে আজ তাদের অবস্থা খুবই সূচনীয়। যাদের সারাটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছে দর্শকদের আনন্দ দেওয়ার মধ্য দিয়ে আজ তারা মানবেতর জীবন যাপন করেন। যাত্রা শিল্পীদের জন্য আমাদের এগিয়ে আসা উচিত। শেষে একটি কথাই বলবো সবাই যাত্রার মান উন্নয়নে যাত্রা শিল্পীদের পুরোনো পেশাকে বাঁচিয়ে রাখতে এগিয়ে আসুন। ভালো নেই আমাদের বিনোদনের শেকড় এই যাত্রা শিল্প ও শিল্পীরা।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

নতুন আপদ ‘মব সন্ত্রাস’, আতঙ্কে সারা দেশ

বিনোদনের শেকড় যাত্রা শিল্প ও শিল্পীরা

আপডেট সময় : ১০:৩৭:১২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৯ জুলাই ২০২১

বারী সুমন : “এইতো আমার দেশ/ সোনার বাংলাদেশ/ দোয়েল শ্যামা কোকিল ডাকা/ডাকার নাইতো শেষ”।
এমন কোন দেশের গানের মধ্য দিয়েই শুরু হতো যাত্রাগানের অনুষ্ঠান।
গ্রাম গঞ্জের এক সময়কার এক বিনোদনের নাম যাত্রা। যাত্রাপালায় ছিলোনা এখনকার মতো কোনো অশ্লীলতা। কোন একটি বিষয়কে, বিশেষ করে রাজা জমিদারদের বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে লিখা হতো যাত্রা পালা। সামাজিক, ঐতিহাসিক বিভিন্ন ধরণের যাত্রা পালার প্রচলন ছিলো। স্বপরিবারের দেখার মতো বহু যাত্রা পালা ছিলো আমাদের। একটি নির্দিষ্ট বিষয়কে কেন্দ্র করে রচিত হতো এ পালা। একটি দল বা অপেরাকে ঘিরে কাজ করতো বহুসংখ্যক লোক।
যাত্রাই একমাত্র সাংস্কৃতিক জনমাধ্যম যার মাধ্যমে এক সঙ্গে ১৫/২০ হাজার মানুষের বিনোদন চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। বিনোদনের মাধ্যমে প্রান্তিক মানুষের মাঝে শিক্ষণীয় নানা বার্তা পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রেও যাত্রার যথেষ্ঠ ভূমিকা রয়েছে।
যাদের একমাত্র পেশাই ছিলো যাত্রাপালা। অভিনেতা- অভিনেত্রী, যন্ত্রশিল্পী, মেকাপ ম্যান, স্মারক, সাউন্ড নিয়ন্ত্রণ কারী, সহযোগী লোক সহ অনেক লোকের নেশা এবং পেশা ছিলো এই যাত্রা পালা।
প্রাচীনকালে ধর্মীয় উৎসবে শোভাযাত্রার আবহে পৌরাণিক কাহিনীর গীতিবদ্ধ উপস্থাপনা এক সময় যাত্রাগান হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
কবি তপন বাগচীর রচিত গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘বাংলায় যাত্রাগানের উদ্ভব। ’ বইটিতে বিশ্বকোষ প্রণেতা নগেন্দ্রনাথ বসুর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে- ‘অতি প্রাচীনকাল হইতে ভারতবর্ষের সকল স্থানেই প্রকাশ্য রঙ্গভূমে বেশভূষায় ভূষিত ও নানাসাজে সুসজ্জিত নরনারী লইয়া গীতবাদ্যাদী সহকারে কৃষ্ণপ্রসঙ্গ অভিনয় করিবার রীতি প্রচলিত। গীতবাদ্যাদীযোগে ঐ সকল লীলোৎসব- প্রসঙ্গে যে অভিনয়ক্রম প্রদর্শিত হইয়া থাকে- তাহাই প্রকৃত যাত্রা বলিয়া অভিহিত। ’
ফোকলোরবিদ ড. আশরাফ সিদ্দিকী মনে করেন, ভাষাতত্ত্ববিদদের মতে- প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয় শব্দমূল ‘যা’ ধাতু থেকে, যার অর্থ গমন-যাত্রা শব্দের উৎপত্তি। যাত্রা গবেষকগণ এ শিল্পের উদ্ভবকে দেখেছেন, দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত আদিযুগ, ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত মধ্যযুগ এবং উনবিংশ শতাব্দী থেকে চলমান সময় পর্যন্ত আধুনিক যুগ হিসেবে।

যাত্রার ক্রমবিকাশ সম্পর্কে যাত্রা গবেষক ও কবি ড. তপন কুমার বাগচী লিখেছেন, ‘১৮৬০ সালে ঢাকায় কৃষ্ণকমল গোস্বামী (১৮১১-৮৮) কৃষ্ণ বিষয়ক ঢপ কীর্তন পরিবেশনের পাশাপাশি পৌরাণিক পালা রচনা ও মঞ্চায়নের মাধ্যমে যাত্রার যে গতি সঞ্চার করেন, চারণকবি মুকুন্দ দাসের (১৮৮৭-১৯৩৪) হাতে তা হয়ে ওঠে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের জাগরণী মন্ত্র।
বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ব্রজেন্দ্র কুমার দে’র (১৯০৭-৭৬) হাতে যাত্রা বিকশিত হয়ে পৌরাণিক পালার পাশাপাশি ঐতিহাসিক, লোককাহিনীভিত্তিক ও সামাজিক পালায়।
নামিদামি পালাকারের অভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের যাত্রাশিল্পীরাই এক সময় পালা রচনায় হাত দেন। এর মধ্যে খুলনার পরিতোষ ব্রহ্মচারীর নদীর নাম মধুমতি, ক্লিওপেট্রা, ইসহাক আলীর সুন্দরবনের জোড়াবাঘ, এমএ মজিদের সোনার বাংলা, যশোরের সাধন মুখার্জির শতাব্দীর মহানায়ক, নিচের পৃথিবী, ঢাকার ননী চক্রবর্ত্তীর ডিস্কো ডেঞ্চার, দস্যুরানি, যৌতুক, চট্টগ্রামের মিলন কান্তি দে’র মায়ের ছেলে, দাতা হাতেম তাই, বিদ্রোহী নজরুল, বাংলার মহানায়ক, গাইবান্ধার আব্দুস সামাদের গরীবের আর্তনাদ, ফরিদপুরের হারুনর রশিদের শতাব্দীর মহানায়ক মুজিব, মুন্সিগঞ্জের আরশাদ আলীর সতী কেন কলঙ্কিনী, গৌরীমালা, মানিকগঞ্জের জ্যোসনা বিশ্বাসের রক্তস্নাত একাত্তর উল্লেখযোগ্য।
কিছু কিছু অপেরা মাস ছয়েকের জন্য বিভিন্ন এলাকায় চলে যেতো তাদের যাত্রাদল নিয়ে। সেখানে একটানা রাতের পর রাত পালা পরিবেশন করে মানুষের মনের খোরাক যুগিয়েছে এই যাত্রা শিল্পীরা। কিছু কিছু শিল্পীরা অল্প শিক্ষিত বা নিরক্ষর হলেও অভিনয়ে ছিলো পাকা। নিজস্ব প্যান্ডেলে রাতের পর রাত তারা মানুষের হৃদয় জোড়ানো পালা পরিবেশন করে গেছেন। বাড়িতে রেখে যেতেন স্ত্রী-সন্তান। সে চিন্তা আসলেও তারা সে চিন্তার রেখা দূরে ঠেলে অভিনয়টাকে বুকে লালন করেছেন। সারা রাত মানুষের মন জয় করে দিনের বেলা চাটাই পেতে খড় বিছিয়ে ঘুমিয়ে কিছুটা ক্লান্তি দূর করে আবার রাতের শো করার প্রস্তুতি নিতেন। কত টাকাই বা আয় হতো! টাকার দিকে তারা কখনও খেয়াল করেন নি, বরং কিভাবে পালা দিয়ে মানুষের মন জয় করা যায় সে দিকটায় বেশি সজাগ দৃষ্টি রাখতেন। একেক জায়গায় তারা মাসখানেকের উপরে বিভিন্ন পালা পরিবেশন করতেন। সেখানকার পালা পরিবেশন শেষে সব কিছু গুটিয়ে আবার নতুন কোন জায়গায় স্থাপন করতেন যাত্রার প্যান্ডেল। রাতের নির্দিষ্ট সময়ে রঙিণ আলোর ঝলকানিতে আবার শুরু হতো পালা। রাতভর মানুষের মনে আনন্দ জোগাতো এসব যাত্রা শিল্পীরা।

সমাজে যাত্রা শিল্পীকে কখনও মর্যাদার চোখে দেখতো না। সবসময় ছোট করে দেখতো, নিগৃহীতের একটা বাণী ছুড়ে দিতো তাদের দিকে, এরা যাত্রা শিল্পী। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ভাবলেও রাতের বেলায় এরাই আবার যাত্রার আসরে যেতো নিজের মনের আনন্দ জোগাতে। তবে যাত্রা শিল্পীদের মধ্যে কোন প্রকার হিংসা লক্ষ্য করা যেতোনা। শত হলেও তারাতো নিবেদিত শিল্পী। তাদের কোন হিংসা থাকতে নেই। একটা সময়ে যাত্রার বেশ সুনাম থাকলেও পরবর্তী সময়ে যাত্রায় কিছু পরিবর্তন আসলো। যাত্রার নামে চলতো অশ্লীল নাচানাচি। যা স্বপরিবারে দেখার মতো কখনোই ছিলোনা। এতে করে সত্যিকারের যাত্রা শিল্পীরা কাজে আগ্রহ হারাতে থাকে। পরবর্তীতে প্রযুক্তি যোগ হওয়াতে এখন প্রায় যাত্রা নেই বললেই চলে। কেবল ইন্টারনেট ঘেটে আগের কিছু যাত্রা পাওয়া যায়। ধীরে ধীরে চাহিদা কমতে কমতে এখন প্রায় শূন্যের কোটায় যাত্রা শিল্পীদের অবস্থান। এতে করে যাত্রার শিল্পীরা পড়ে যায় বিপাকে। মন থেকে যাত্রা ছাড়তেও পারছেনা আবার অন্য পেশাতেও নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছেনা। বর্তমান করোনা পরিস্থিতির কারণে যাত্রা সহ সব ধরনের দর্শকসমাগম হতে পারে এমন বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান বন্ধ। এতে করে তারা যাযাবর জীবন যাপন করছে। পাচ্ছেনা সঠিক সরকারি অনুদান যাতে করে তারা নিজেদের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে পারে। আবার যাত্রার জন্যও কোনো সরকারি সহযোগিতা নেই। কথা হয় ময়মনসিংহের গৌরীপুরের যাত্রাপালার ড্রামস বাদক অনীল বাবুর সাথে। তিনি বলেন একসময় এমন কোনোদিন ছিলোনা যে যাত্রার পালা বন্ধ থাকতো। প্রতিদিন ড্রামস বাজিয়ে মন জয় করতেন দর্শকদের। যাত্রার কদর কিছুটা কমে যাওয়ায় ড্রামস ছেড়ে বেছে নেন তবলা, বর্তমান আধুনিক যন্ত্রসঙ্গীতের ছোয়া দেওয়ার জন্য তবলার পাশাপাশি বেছে নেন প্যাড ড্রামস। করোনকালীন বিষয়ে কথা বললে জানান বর্তমানে প্রায় দুই বছর ধরে আমরা বসে আছি। কোনো অনুষ্ঠান নেই আমাদের মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে। কথা হয় যাত্রা শিল্পী স্বপ্নার সাথে তিনি জানান, একসময় প্রতিদিন আমাদের পালার বায়না থাকতো বর্তমানে আমরা খুব খারাপ অবস্থায় আছি। মানবেতর জীবন যাপন করছি দেখার মতো তেমন কেউ নেই। এক সময়কার মঞ্চ কাঁপানো কৃষ্ণার সাথে কথা বলে জানা যায় প্রতিদিনের মঞ্চ কাঁপিয়ে দর্শকদের মন জয় করেছি। মানুষকে বিনোদন দিয়ে তাদের মনে আনন্দ যুগিয়েছি, বর্তমানে আমাদের কোনো কদর নেই। এখন কোন অনুষ্ঠানে আমাদের ডাক পড়েনা। বয়স হয়ে যাওয়াতে অন্য কোন কাজও করতে পারিনা। আমাদের প্রতি সরকারের নজর দেওয়া দরকার। যাত্রার জন্য সরকারের সহযোগিতা থাকলে যাত্রার মান পুনরায় আগের মতো করে দর্শকদের ভালো কিছু উপহার দিতে পারবো।
আমাদের মধ্যে ভালো নাট্যকারের অভাব রয়েছে। তারা যদি আবারও ভালো মানের যাত্রা পালা লিখেন দর্শকরা পুনরায় যাত্রা দেখায় আগ্রহ ফিরে পাবে। অন্যান্য অসুবিধার পাশাপাশি ভালো মানের পালা লিখা হয়না বিধায় আমাদের যাত্রা শিল্প হারাতে বসেছে তার নিজস্ব ঐতিহ্য। যদিও কিছু কিছু এলাকায় নামেমাত্র কিছু যাত্রা শিল্পগোষ্ঠি রয়েছে কিন্তু তাদের তেমন কোন কদর নেই। নেই ভালো মানের নতুন কোন পালা। এক সময়কার গ্রাম গঞ্জের কিছু পালা তারা পরিবেশন করে যা, বর্তমান সময়ে দর্শক নন্দিত নয়। নতুন আঙ্গিকে নতুন কোন পালা রচিত এবং পরিবেশিত হলে লোকজন নতুন করে আবার যাত্রা শিল্পে প্রবেশ করবে বলে বিশ্বাস। নতুন আঙ্গিক না থাকায় আমাদের ঐতিহ্যবাহী যাত্রা শিল্প এবং যাত্রা শিল্পীদের কদর নেই।
আমাদের পাশে এমন শত শত যাত্রা শিল্পী রয়েছেন। সময়ের সাথে সাথে আজ তাদের অবস্থা খুবই সূচনীয়। যাদের সারাটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছে দর্শকদের আনন্দ দেওয়ার মধ্য দিয়ে আজ তারা মানবেতর জীবন যাপন করেন। যাত্রা শিল্পীদের জন্য আমাদের এগিয়ে আসা উচিত। শেষে একটি কথাই বলবো সবাই যাত্রার মান উন্নয়নে যাত্রা শিল্পীদের পুরোনো পেশাকে বাঁচিয়ে রাখতে এগিয়ে আসুন। ভালো নেই আমাদের বিনোদনের শেকড় এই যাত্রা শিল্প ও শিল্পীরা।