ঢাকা ০৪:৩৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিদ্রোহী কবিতার ১০০ বছর

  • আপডেট সময় : ১০:২৯:১৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৬ জানুয়ারী ২০২২
  • ৪৮ বার পড়া হয়েছে

রফিক সুলায়মান : বিশ্বের আর কোন ভাষার একক একটি কবিতা এতো পঠিত হয়েছে কিনা আমাদের জানা নেই। নজরুল আর বিদ্রোহী আজ সমার্থক। অথচ কবিতাটি লিখিত হয়েছিলো কবির ২২ বছর বয়সে।
১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কবিতাটি লিখিত হলেও প্রকাশ পায় ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি বিজলী পত্রিকায়। এরপর আরো একাধিক পত্রিকা ও সাময়িকীতে প্রকাশিত হতে থাকে আগস্ট ১৯২২ পর্যন্ত। অভূতপূর্ব ছন্দ আর অনন্য শব্দালংকারের মূর্ছনায় বাঙালি গত ১০০ বছর ধরে বুঁদ হয়ে আছে ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়।
এই কবিতা যখন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তখন নজরুলের কোন কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় নি। তবে বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর কিছু কবিতা এবং গদ্য রচনা ‘বাঁধন হারা’ প্রকাশিত হয়েছিলো। এর মধ্যে ‘বাদল প্রাতের শরাব’ এবং ‘খেয়া পারের তরণী’ কবিতাদুটো নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখে ফেলেছিলেন কবি-প্রাবন্ধিক মোহিতলাল মজুমদার। এই প্রবন্ধের কল্যাণে নজরুলের নামটি রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত পৌঁছায়। ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশের আগে ডক্টর শহিদুল্লাহ’র সাথে নজরুল একবার শান্তিনিকেতনে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশীর্বাদও নিয়ে এসেছিলেন।
আসানসোলের বিশিষ্ট চিকিৎসক ও সাহিত্যিক অরুণাভ সেনগুপ্ত জানান, ‘১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহের একরাতে রচিত হয়েছিল এই বিদ্রোহী কবিতা। সেই রাতে প্রচ- বৃষ্টি নেমেছিল। খুব দ্রুততার সঙ্গে নজরুল এই লেখা সেই রাতে শেষ করেছিলেন। শোনা যায় দোয়াতের কালি শেষ হয়ে আসছিল তাঁর লেখনীর সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে । আর সেই কারণে তিনি পেন্সিলে এই কবিতা লিখেছিলেন। একটি টেলিগ্রাফ কাগজের উপর এই কবিতা রচনা করেন তিনি। ১৯২২ সালের জানুয়ারি মাসে ‘বিজলী’ পত্রিকায় এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। কিন্তু বিজলি পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পরেই তুমুল আলোড়ন উঠেছিল কবিতাটিকে নিয়ে। এমনকী প্রকাশকালে একই সপ্তাহের মধ্যে দু’বার ওই কবিতাটি ছাপতে হয়েছিল। এক সপ্তাহে প্রায় দেড় থেকে দুই লাখ মানুষ এই কবিতাটি পড়েছিলেন। একদিকে যেমন তুমুল জনপ্রিয়তা এনে দেয় নজরুলকে। তেমনি তিনি পরিচিত হন ‘বিদ্রোহী’ কবি হিসেবে।’
কী আছে বিদ্রোহী কবিতায়? কী নেই বিদ্রোহী কবিতায়! এই দ্রোহ কার বিরুদ্ধে? এটিই কী বাংলা ভাষার প্রথম অসাম্প্রদায়িক কবিতা! – এরকম অনেক অনেক প্রশ্নের উদয় হবে কবিতাটি পাঠ করলে। ইংরেজ সরকার কবিতাটির অনুবাদ করিয়েছিলো। অনুবাদক এবং প্রশাসন কিছু হিন্দু মিথ ছাড়া কবিতাটিতেই ‘দ্রোহের’ কিছুই খুঁজে পায় নি! অসাম্প্রদায়িক চেতনা তো কবিতার পরতে পরতে। ক্ষ্যাপা দূর্বাসা’র সাথে ইসরাফিলের সিঙ্গা, তেজী বোরাকের সাথে উচ্চঃশ্রৈবার ব্যবহার কবির অসাম্প্রদায়িক চেতনার তীব্র প্রকাশ।
বিদ্রোহী কবিতার প্রকাশ অভিনব। আল কোরানে শরীফে ‘পড়ো’ এবং ‘বলো’ দিয়ে পাঁচটি সুরা শুরু হয়েছে, আমরা জানি। বিদ্রোহী কবিতাও ‘বলো’ দিয়ে শুরু হয়েছে। পড়ো এবং বলো কোরানে এসেছে কোমল নির্দেশ স্বরূপ, এখানে কবির আত্মা কবিকে নির্দেশনা দিচ্ছেন ‘বলো বীর / বলো উন্নত মম শির।’ এই কবিতা রচনার দশককাল আগেই রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির’ কবিতাটি। বিদ্রোহী কী এই কবিতার তরঙ্গায়িত বিস্তৃত রূপ!
বিদ্রোহী কবিতা যতোটা জনপ্রিয়, বস্তুত ততোটা সহজ অনুধাবনযোগ্য নয়। কোন সাধারণ পাঠক এর শব্দমালার ঝনঝনানিতে যতোটা মুগ্ধ হবেন, ততোটা অনুধাবন করতে পারবেন না। এটি সহজ ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ টাইপ কবিতা নয়। মহাসমুদ্র মন্থন করে রচিত হয়েছে এর ১৩৯টি পঙক্তি। পঙক্তিসমূহ আবার নানান ভাগে ভাগ করা। বিদ্রোহীকে ব্যাখ্যা করতে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন মহাবিশ্বের সকল পুরাণের। ভগবান শিবকে নিয়ে এসেছেন রুদ্র, নটরাজ, ধুর্জটি, পিনাক ইত্যাদি রূপে। হিন্দোল রাগকে ব্যবহার করেছেন তিন তিন বার। ভৃগুর পুত্র জমদগ্নিকে নিয়ে এসেছেন, কারণ তিনি জ্বলন্ত প্রদীপকে কখনো নিভতে দেন না। কবির দ্রোহ যেন আমৃত্যু চলমান থাকে এই একটি পৌরাণিক চরিত্রই তা প্রকাশ করে দিয়েছে।
কবির দ্রোহ কার বিরুদ্ধে? রাজবন্দির জবানবন্দীতে কবি তা স্পষ্ট করেছেন। অবশ্য গোলাম মুর্শিদ তা জানেন না। তবে আশার কথা হলো প-িত শিবনারায়ণ রায় স্পষ্ট করে বলেছেন, সমাজের নির্যাতিত উৎপীড়িতের পক্ষে এর আগে কেউ কলম ধরেন নি। নজরুল এ ক্ষেত্রে অনন্য। ‘যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না’ – এই চরণেই কবি সব বলে দিয়েছেন কেন তিনি ‘বিদ্রোহী।’
বিদ্রোহী কবিতার ১০০ বছর – ২
এ বছর জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনার ১০০ বছর। কিছুদিন আগে এ নিয়ে একটি উপক্রমণিকা পত্রস্থ করেছি। আজ আমরা বাংলা কবিতার দিক পরিবর্তনকারী এই কবিতাটিতে ব্যবহৃত কতিপয় শব্দের অর্থ জেনে নেয়ার চেষ্টা করবো। অনেকেই হয়তো জানেন, তবু একবার আমাদের স্মৃতি নবায়ন করে নিচ্ছি।
আগের লেখায় উল্লেখ করেছিলাম যে বহুলপঠিত কবিতা হলেও ‘বিদ্রোহী’ কোন সহজবোধ্য কবিতা নয়। এটি বেশ জটিল, দীর্ঘ, মিথ ও উপমানির্ভর কবিতা।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

বিদ্রোহী কবিতার ১০০ বছর

আপডেট সময় : ১০:২৯:১৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৬ জানুয়ারী ২০২২

রফিক সুলায়মান : বিশ্বের আর কোন ভাষার একক একটি কবিতা এতো পঠিত হয়েছে কিনা আমাদের জানা নেই। নজরুল আর বিদ্রোহী আজ সমার্থক। অথচ কবিতাটি লিখিত হয়েছিলো কবির ২২ বছর বয়সে।
১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কবিতাটি লিখিত হলেও প্রকাশ পায় ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি বিজলী পত্রিকায়। এরপর আরো একাধিক পত্রিকা ও সাময়িকীতে প্রকাশিত হতে থাকে আগস্ট ১৯২২ পর্যন্ত। অভূতপূর্ব ছন্দ আর অনন্য শব্দালংকারের মূর্ছনায় বাঙালি গত ১০০ বছর ধরে বুঁদ হয়ে আছে ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়।
এই কবিতা যখন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তখন নজরুলের কোন কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় নি। তবে বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর কিছু কবিতা এবং গদ্য রচনা ‘বাঁধন হারা’ প্রকাশিত হয়েছিলো। এর মধ্যে ‘বাদল প্রাতের শরাব’ এবং ‘খেয়া পারের তরণী’ কবিতাদুটো নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখে ফেলেছিলেন কবি-প্রাবন্ধিক মোহিতলাল মজুমদার। এই প্রবন্ধের কল্যাণে নজরুলের নামটি রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত পৌঁছায়। ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশের আগে ডক্টর শহিদুল্লাহ’র সাথে নজরুল একবার শান্তিনিকেতনে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশীর্বাদও নিয়ে এসেছিলেন।
আসানসোলের বিশিষ্ট চিকিৎসক ও সাহিত্যিক অরুণাভ সেনগুপ্ত জানান, ‘১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহের একরাতে রচিত হয়েছিল এই বিদ্রোহী কবিতা। সেই রাতে প্রচ- বৃষ্টি নেমেছিল। খুব দ্রুততার সঙ্গে নজরুল এই লেখা সেই রাতে শেষ করেছিলেন। শোনা যায় দোয়াতের কালি শেষ হয়ে আসছিল তাঁর লেখনীর সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে । আর সেই কারণে তিনি পেন্সিলে এই কবিতা লিখেছিলেন। একটি টেলিগ্রাফ কাগজের উপর এই কবিতা রচনা করেন তিনি। ১৯২২ সালের জানুয়ারি মাসে ‘বিজলী’ পত্রিকায় এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। কিন্তু বিজলি পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পরেই তুমুল আলোড়ন উঠেছিল কবিতাটিকে নিয়ে। এমনকী প্রকাশকালে একই সপ্তাহের মধ্যে দু’বার ওই কবিতাটি ছাপতে হয়েছিল। এক সপ্তাহে প্রায় দেড় থেকে দুই লাখ মানুষ এই কবিতাটি পড়েছিলেন। একদিকে যেমন তুমুল জনপ্রিয়তা এনে দেয় নজরুলকে। তেমনি তিনি পরিচিত হন ‘বিদ্রোহী’ কবি হিসেবে।’
কী আছে বিদ্রোহী কবিতায়? কী নেই বিদ্রোহী কবিতায়! এই দ্রোহ কার বিরুদ্ধে? এটিই কী বাংলা ভাষার প্রথম অসাম্প্রদায়িক কবিতা! – এরকম অনেক অনেক প্রশ্নের উদয় হবে কবিতাটি পাঠ করলে। ইংরেজ সরকার কবিতাটির অনুবাদ করিয়েছিলো। অনুবাদক এবং প্রশাসন কিছু হিন্দু মিথ ছাড়া কবিতাটিতেই ‘দ্রোহের’ কিছুই খুঁজে পায় নি! অসাম্প্রদায়িক চেতনা তো কবিতার পরতে পরতে। ক্ষ্যাপা দূর্বাসা’র সাথে ইসরাফিলের সিঙ্গা, তেজী বোরাকের সাথে উচ্চঃশ্রৈবার ব্যবহার কবির অসাম্প্রদায়িক চেতনার তীব্র প্রকাশ।
বিদ্রোহী কবিতার প্রকাশ অভিনব। আল কোরানে শরীফে ‘পড়ো’ এবং ‘বলো’ দিয়ে পাঁচটি সুরা শুরু হয়েছে, আমরা জানি। বিদ্রোহী কবিতাও ‘বলো’ দিয়ে শুরু হয়েছে। পড়ো এবং বলো কোরানে এসেছে কোমল নির্দেশ স্বরূপ, এখানে কবির আত্মা কবিকে নির্দেশনা দিচ্ছেন ‘বলো বীর / বলো উন্নত মম শির।’ এই কবিতা রচনার দশককাল আগেই রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির’ কবিতাটি। বিদ্রোহী কী এই কবিতার তরঙ্গায়িত বিস্তৃত রূপ!
বিদ্রোহী কবিতা যতোটা জনপ্রিয়, বস্তুত ততোটা সহজ অনুধাবনযোগ্য নয়। কোন সাধারণ পাঠক এর শব্দমালার ঝনঝনানিতে যতোটা মুগ্ধ হবেন, ততোটা অনুধাবন করতে পারবেন না। এটি সহজ ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ টাইপ কবিতা নয়। মহাসমুদ্র মন্থন করে রচিত হয়েছে এর ১৩৯টি পঙক্তি। পঙক্তিসমূহ আবার নানান ভাগে ভাগ করা। বিদ্রোহীকে ব্যাখ্যা করতে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন মহাবিশ্বের সকল পুরাণের। ভগবান শিবকে নিয়ে এসেছেন রুদ্র, নটরাজ, ধুর্জটি, পিনাক ইত্যাদি রূপে। হিন্দোল রাগকে ব্যবহার করেছেন তিন তিন বার। ভৃগুর পুত্র জমদগ্নিকে নিয়ে এসেছেন, কারণ তিনি জ্বলন্ত প্রদীপকে কখনো নিভতে দেন না। কবির দ্রোহ যেন আমৃত্যু চলমান থাকে এই একটি পৌরাণিক চরিত্রই তা প্রকাশ করে দিয়েছে।
কবির দ্রোহ কার বিরুদ্ধে? রাজবন্দির জবানবন্দীতে কবি তা স্পষ্ট করেছেন। অবশ্য গোলাম মুর্শিদ তা জানেন না। তবে আশার কথা হলো প-িত শিবনারায়ণ রায় স্পষ্ট করে বলেছেন, সমাজের নির্যাতিত উৎপীড়িতের পক্ষে এর আগে কেউ কলম ধরেন নি। নজরুল এ ক্ষেত্রে অনন্য। ‘যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না’ – এই চরণেই কবি সব বলে দিয়েছেন কেন তিনি ‘বিদ্রোহী।’
বিদ্রোহী কবিতার ১০০ বছর – ২
এ বছর জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনার ১০০ বছর। কিছুদিন আগে এ নিয়ে একটি উপক্রমণিকা পত্রস্থ করেছি। আজ আমরা বাংলা কবিতার দিক পরিবর্তনকারী এই কবিতাটিতে ব্যবহৃত কতিপয় শব্দের অর্থ জেনে নেয়ার চেষ্টা করবো। অনেকেই হয়তো জানেন, তবু একবার আমাদের স্মৃতি নবায়ন করে নিচ্ছি।
আগের লেখায় উল্লেখ করেছিলাম যে বহুলপঠিত কবিতা হলেও ‘বিদ্রোহী’ কোন সহজবোধ্য কবিতা নয়। এটি বেশ জটিল, দীর্ঘ, মিথ ও উপমানির্ভর কবিতা।