নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ‘সামষ্টিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বিদেশি ব্যাংকগুলো বাংলাদেশের জন্য লাইন অব ক্রেডিট (এলসি) বন্ধ করেনি, বরং আগের অবস্থায় ফিরিয়ে এনেছে। কেউ কেউ আগের চেয়ে এলসি সীমাও বাড়িয়েছে।’
রোববার (১০ আগস্ট) রাজধানীর গুলশানের লেকশোর হোটেলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) আয়োজিত ‘অন্তর্বর্তী সরকারের ৩৬৫ দিন’ শীর্ষক আলোচনায় তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন শ্রম ও নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন। সভাপতিত্ব করেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তফিজুর রহমান। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।
গভর্নর বলেন, ‘আন্তর্জাতিক ব্যাংকারদের সঙ্গে প্রথম বৈঠকে ২০০-এর বেশি বিদেশি ব্যাংক এলসি বন্ধ করে দিয়েছিল। তখন আমরা অনুরোধ করি, এখানেই থামুন, আর বন্ধ করবেন না। যদি উন্নতি করতে না পারি, তখন ব্যবস্থা নেবেন। আমরা কখনো বকেয়া রাখিনি, রাখবোও না। ২.৫ বিলিয়ন ডলারের বকেয়া ধীরে ধীরে পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। রেমিট্যান্স ও রফতানি বাড়ার ফলে এখন সব বিদেশি ব্যাংক আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে।’
ডলার বাজারে কঠোর নীতি
ড. আহসান জানান, গত বছরের ১৪ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক এক ডলারও বিক্রি করেনি। ‘আমরা বুঝেছিলাম, মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে হবে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম—ডলার বিক্রি করবো না। দুবাইভিত্তিক এগ্রিগেটরদেরও জানিয়ে দিয়েছি, আমাদের নির্ধারিত ১২২ টাকার রেটে বিক্রি করতে হবে, না হলে তাদের কাছ থেকে ডলার কেনা হবে না। তারা চাইলে ডলার ধরে রাখতে পারে, কিন্তু আমরা জানতাম, পাঁচ থেকে সাত দিনের বেশি তারা রাখতে পারবে না,’ বলেন তিনি।
অর্থনীতি ও বিনিয়োগ প্রসঙ্গে সতর্কতা
গভর্নর বলেন, ‘আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা এসেছে, তবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এখনো আসেনি। নিরাপত্তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। নির্বাচনের আগে বিনিয়োগে ঝাঁপিয়ে পড়া ঠিক হবে না। নির্বাচিত সরকার এসে কী পরিবর্তন আনে, তা বিনিয়োগকারীরা লক্ষ্য করবে।’
তিনি জানান, বাজারে তরল অর্থের প্রবাহ বাড়ছে এবং শেয়ারবাজার আগামী এক বছরে আরো এক হাজার পয়েন্ট বাড়তে পারে। এ বছর বৈদেশিক লেনদেনে উদ্বৃত্ত হয়েছে।
মূল্যস্ফীতি ও রাজস্ব সংস্কার
ড. আহসান বলেন, ‘মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা কমেছে, তবে আরো কমানো দরকার। প্রতি মাসে কমবে না, তবে অর্থবছরের শেষে তা পাঁচ শতাংশের নিচে নামতে পারে।’ পাশাপাশি তিনি রাজস্ব আহরণ ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সংস্কার দ্রুত বাস্তবায়নের আহ্বান জানান।
ব্যাংকিং খাতের সংস্কার
গভর্নর জানান, ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ সংশোধন করে পরিচালকদের মেয়াদ ৬ বছরে সীমাবদ্ধ করা হবে এবং বোর্ডে অন্তত ৬ জন স্বাধীন পরিচালক থাকতে হবে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ও ব্যাংক অর্ডার ১৯৭২-এ মৌলিক পরিবর্তন আনা হচ্ছে।
নতুন ডিপোজিট ইন্সুরেন্স আইন প্রণয়ন এবং ব্যাংক রেগুলেশন অধ্যাদেশে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরো ক্ষমতাবান করার উদ্যোগ চলছে। সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা কাঠামো এক করা হবে। যেকোনো ব্যাংক নন-পারফর্মিং হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে, অদক্ষ ব্যাংককে জায়গা দেওয়া হবে না।
তিনি আরো জোর দিয়ে বলেন, ‘আইনের প্রয়োগে স্বাধীন ও শক্তিশালী নেতৃত্ব প্রয়োজন, এবং আর্থিক খাতকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখতে হবে।’
এসি/