ঢাকা ০৫:০০ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৪ অগাস্ট ২০২৫

বিদেশি নাগরিকদের অভিনব প্রতারণার ফাঁদ, হাতিয়েছে কোটি টাকা

  • আপডেট সময় : ০২:২৪:২৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ১২ জানুয়ারী ২০২২
  • ১০১ বার পড়া হয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক : সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বন্ধুত্ব, এরপর প্রেমের ফাঁদে ফেলে মূল্যবান পার্সেল পাঠানোর প্রলোভনে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে নাইজেরিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার একটি চক্র। তারা ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে এসে এসব প্রতারণার সঙ্গে জড়িত ছিল। ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও তারা বাংলাদেশে অবস্থান করে বিভিন্ন দেশের দুষ্কৃতিকারীদের সঙ্গে যোগসাজশে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছিল। এ পর্যন্ত তারা দুই কোটি টাকারও বেশি হাতিয়ে নিজ দেশে নিয়ে গেছে বলে জানিয়েছে র‌্যাব। এসব অভিযোগে সাত বিদেশি নাগরিকসহ সংঘবদ্ধ আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্রের নয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব।
এলিট ফোর্সটি বলছে, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করে দামি উপহার পাঠানোর লোভ দেখিয়ে অভিনব পদ্ধতিতে সাধারণ জনগণের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিল সংঘবদ্ধ চক্রটি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টা থেকে আজ বুধবার সকাল সাড়ে ৬টা পর্যন্ত র‌্যাব-৪ এর একটি আভিযানিক দল র‌্যাব-৮ এর সহযোগিতায় রাজধানীর পল্লবী, রুপনগর ও দক্ষিণখান থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে।
গ্রেপ্তার বিদেশি নাগরিকরা হলেন- নাইজেরিয়ান নাগরিক টফবুব ঙনরহহধজঁনবহ, দক্ষিণ আফ্রিকার ঘঃড়সনরশযড়হধ এবনুঁধ, নাইজেরিয়ান ওভঁহধহুধ ঠরারধহ ঘহধঁিরশব, নাইজেরিয়ান ঝঁহফধু ঝযবফবৎধপশ ঊলরস, নাইজেরিয়ান ঈযরহবফঁ গড়ংবং ঘহধলর, নাইজেরিয়ান ঈড়ষষরসং ওভবংরহধপযর ঞধষরশব ও ঈযরফরসসধ ঊনবষব ঊুষড়ভড়ৎ।
এছাড়াও তাদের সহযোগী দুই বাংলাদেশি হলেন- ফেনীর মো. নাহিদুল ইসলাম ও নরসিংদীর সোনিয়া আক্তার। তাদের কাছ থেকে আটটি পাসেপোর্ট, ৩১টি মোবাইল, তিনটি ল্যাপটপ, একটি চেক বই, তিনটি পেনড্রাইভ ও নগদ ৯৫ হাজার ৮১৫ টাকা জব্দ করা হয়।
গতকাল বুধবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসব জানান র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক। র‌্যাব কর্মকর্তা বলেন, গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা সংঘবদ্ধভাবে দীর্ঘদিন ধরে অভিনব কায়দায় বিপরীত লিঙ্গের ব্যক্তিদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম-ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ফেসবুকসহ নানা মাধ্যম ব্যবহার করে নিজেদের পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত দেশের নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিতেন। পরে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও প্রেমের সম্পর্ক তৈরির পর এক পর্যায়ে দামি উপহার বাংলাদেশে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণার জাল ছড়াতেন। এক পর্যায়ে বাংলাদেশের কাস্টমস অফিসার পরিচয়ে তাদেরই একজন নারী ভিকটিমকে ফোন করে বলেন, তার নামে একটি পার্সেল বিমানবন্দরে এসেছে। পার্সেলটি ডেলিভারি করতে কাস্টমস চার্জ হিসেবে মোটা অংকের টাকা বিকাশ অথবা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নাম্বারে পরিশোধ করতে বলা হয়।
র‌্যাব অধিনায়ক বলেন, যেহেতু পার্সেলে অতি মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী রয়েছে তাই কাস্টমস চার্জ একটু বেশি হয়েছে বলে তাদের বলা হয়। প্রতারিত ব্যক্তি সরাসরি টাকা প্রদান করতে বা দেখা করতে চাইলে প্রতারকরা এসএমএসের মাধ্যমে জানান, এই মুহূর্তে তারা বিদেশে অবস্থান করছেন কিংবা জরুরি কোনো মিটিংয়ে আছেন। বাংলাদেশি সহজ-সরল মানুষেরা তাদের কথায় প্রলুব্ধ হয়ে সংশ্লিষ্ট বিকাশ অথবা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে প্রতারিত হয়ে আসছিল। প্রতারিত ব্যক্তি অর্থ পরিশোধ করার পর তার নামে প্রেরিত পার্সেলটি সংগ্রহ করার জন্য বিমানবন্দরে সংশ্লিষ্ট অফিসে গিয়ে দেখেন, তার নামে কোনো পার্সেল আসেনি। তখন প্রতারিত ভিকটিম পার্সেল প্রেরণকারী বিদেশি বন্ধুর সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাকে আর পাওয়া যায় না। তখন বুঝতে পারেন, তিনি ভয়াবহ প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
প্রতারণার কৌশল হিসেবে টার্গেট নির্ধারণ : গ্রেপ্তার অভিযুক্তরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মেয়েদের নামে ভুয়া আইডি খুলে বিভিন্ন প্রোফাইল ঘেঁটে বড় বড় ব্যবসায়ী, হাই প্রোফাইল চাকরিজীবীসহ উচ্চবিত্ত ব্যক্তিদেরকে টার্গেট করতেন। ভিকটিম নির্ধারণ করার পর তাদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে ভিকটিমদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করতেন। ভিকটিমদের কাছে নিজেকে পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত দেশের সামরিক বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পরিচয় দিতেন। ভিকটিমকে বিভিন্ন সময়ে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার ভুয়া ছবি পাঠাতেন বিশ্বাস স্থাপনের জন্য। সম্পর্কের এক পর্যায়ে বিভিন্নভাবে ডিকটিমকে তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপনে প্রলুব্ধ করতেন।
নিজের অসহায়ত্বের কথা প্রকাশ : বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার পর প্রতারকরা জানান, তাদের কাছে বিপুল পরিমাণ ডলার বা বৈদেশিক মুদ্রা রয়েছে, কিন্তু তারা তা খরচ কিংবা দেশে নিতে পারছেন না। প্রতারকরা সেই ডলার বা বৈদেশিক মুদ্রা ভিকটিমের কাছে পাঠাতে চান এবং পরবর্তী সময়ে নেবেন বলে জানান। চাকরিজীবীদের বলতেন, তাদের দিয়ে জনসেবামূলক কাজে প্রচুর পরিমাণ অর্থ ব্যয় করবেন এবং এতে তারা একটি নির্দিষ্ট হারে কমিশন পাবেন। আর যারা ব্যবসায়ী তাদের বলা হতো- তার ব্যবসায় অর্থলগ্নি করবেন এবং তিনি ৩৫-৪০ শতাংশ কমিশন পাবেন। যাতে করে সহজ সরল মানুষ প্রলুব্ধ হয়ে তাদের কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে প্রভাবিত হয়।
উপহার প্রদান ও অর্থ সংগ্রহ : ভিকটিমকে আকৃষ্ট করতে প্রতারক চক্রটি বিভিন্ন উপহার পাঠানোর প্রলোভন দেখায় ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভিকটিমের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার নাম ঠিকানা নিয়ে ছোট ছোট উপহার পাঠায়। এতে করে উপহার পেয়ে ভিকটিম বিশ্বাস স্থাপন করে এবং এক পর্যায়ে প্রতারক চক্রের সদস্যরা বলে দামি পার্সেল পাঠিয়ে দিয়েছি।
পার্সেল পাঠানোর কিছুদিন পর তাদের বাংলাদেশি নারী সহযোগী বিমানবন্দর কাস্টমস অফিসার পরিচয়ে ভিকটিমকে ফোন করে বলেন, তার নামে একটি পার্সেল বিমানবন্দরে এসেছে। পার্সেলটি ডেলিভারি করতে কাস্টমস্ চার্জ হিসেবে মোটা অংকের টাকা বিকাশ অথবা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পরিশোধ করতে বলা হয়। যেহেতু পার্সেলে অতি মূল্যবান এবং এভাবে বিদেশ থেকে কোনো পার্সেল দেশে আনা আইনসিদ্ধ নয় তাই চার্জ কিছুটা বেশি দিতে হবে। এজন্য নকল টিন সার্টিফিকেট ও অন্যান্য কাগজ বানাতে অনেক অর্থের প্রয়োজন হবে। কেউ কেউ টাকা না দিতে চাইলে তাদের মামলার ভয়ভীতি দেখাতো হতো। এক পর্যায়ে সহজ সরল ভুক্তভোগীরা তাদের কথায় প্রলুব্ধ হয়ে মামলার ভয়ে সংশ্লিষ্ট বিকাশ অথবা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দিতেন। এভাবে সাধারণ মানুষ প্রতারিত হয়ে আসছিল।
গার্মেন্টস ব্যবসায়ী পরিচয় দিলেও প্রতারণাই তাদের পেশা : র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক আরও বলেন, গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্রের সদস্য। বিদেশি নাগরিকেরা ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে এসে রাজধানীর পল্লবী, রূপনগর ও দক্ষিণখান এলাকায় ভাড়া বাসায় অবস্থান করে গার্মেন্টস ব্যবসা শুরু করেন। গার্মেন্টস ব্যবসার আড়ালে তারা বাংলাদেশি সহযোগীদের নিয়ে এমন অভিনব প্রতারণার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তাদের অনেকেরই ভিসার মেয়াদ শেষ এবং গ্রেপ্তার দুজনের নামে আগেও মামলা রয়েছে। গ্রেপ্তার সোনিয়া আক্তার ও নাহিদুল ইসলাম এই আন্তর্জাতিক চক্রের দেশীয় সহযোগী। মূলত তাদের মাধ্যমেই এই প্রতারক চক্রের বিদেশি নাগরিকরা ভিকটিম সংগ্রহ, বন্ধুত্ব স্থাপন, কাস্টমস্ অফিসার পরিচয় এবং শেষে অর্থ সংগ্রহ করে আসছিল।
গ্রেপ্তার নাইজেরিয়ান নাগরিক টফবুব ঙনরহহধ জঁনবহ ২০১৭ সালে ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে আসেন এবং ২০২০ সালে তার বিরুদ্ধে র‌্যাব-৪ প্রতারণার মামলা দেওয়ায় তার পাসপোর্ট জব্দ করা হয়। তিনি নিজেকে একজন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দেন। প্রকৃতপক্ষে প্রতারণাই তার মূল পেশা। তিনিই এই আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্রের মূলহোতা। গ্রেপ্তার দক্ষিণ আফ্রিকান নাগরিক ঘঃড়সনরশযড়হধ এবনুঁধ ২০২০ সালের ১৫ জানুয়ারি ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে আসেন এবং তার ভিসার মেয়াদ ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত। তিনি টফবুব নরহহধ জঁনবহ এর স্ত্রী বলে পরিচয় দেন। এছাড়া নাইজেরিয়ান নাগরিক ওভঁহধহুধ ঠরারধহ ঘহধঁিষশব ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে আসেন এবং গত ২০২১ সালের জুলাইতে তার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়।
আর নাইজেরিয়ান নাগরিক ঝঁহফধু ঝযবফবৎধপশ ঊলরস ২০১৯ সালের ২২ মে ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে আসে এবং গত ২০২১ সালের ডিসেম্বরে তার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়।
এছাড়া নাইজেরিয়ান নাগরিক ঈযরহবফঁ গড়ংবং ঘহধলর ২০১৯ সালের এপ্রিলে ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে আসেন এবং গত ২০২১ সালের ডিসেম্বরে তার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়। আর নাইজেরিয়ান নাগরিক ঈড়ষষরসং রভবংরহধপযর ঞধষরশব ২০১৯ সালের জুনে ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে আসেন এবং গত ২০২১ সালের ডিসেম্বরে তার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়। তিনি নিজেকে ফুটবলার হিসেবে পরিচয় দেন। নাইজেরিয়ান নাগরিক ঈযরফরসসধ ঊনবষব ঊুষড়ভড়ৎ ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে আসেন এবং ২০২১ সালের ডিসেম্বরে তার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়।
অভিযুক্ত বিদেশিরা প্রত্যেকেই নিজেদের গার্মেন্টস ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পরিচয় ব্যবহার করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রতারণাই তাদের মূল পেশা। এক প্রশ্নের জবাবে র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক মোজাম্মেল হক বলেন, তারা এ পর্যন্ত দুই কোটি টাকার বেশি প্রতারণা করে উপার্জন করেছেন এবং এই টাকা তারা অবৈধভাবে হুন্ডির মাধ্যমে তাদের দেশে নিয়ে গেছেন।

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

একাদশ ভর্তির দ্বিতীয় ধাপের ফল প্রকাশ ২৮ আগস্ট রাতে

বিদেশি নাগরিকদের অভিনব প্রতারণার ফাঁদ, হাতিয়েছে কোটি টাকা

আপডেট সময় : ০২:২৪:২৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ১২ জানুয়ারী ২০২২

নিজস্ব প্রতিবেদক : সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বন্ধুত্ব, এরপর প্রেমের ফাঁদে ফেলে মূল্যবান পার্সেল পাঠানোর প্রলোভনে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে নাইজেরিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার একটি চক্র। তারা ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে এসে এসব প্রতারণার সঙ্গে জড়িত ছিল। ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও তারা বাংলাদেশে অবস্থান করে বিভিন্ন দেশের দুষ্কৃতিকারীদের সঙ্গে যোগসাজশে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছিল। এ পর্যন্ত তারা দুই কোটি টাকারও বেশি হাতিয়ে নিজ দেশে নিয়ে গেছে বলে জানিয়েছে র‌্যাব। এসব অভিযোগে সাত বিদেশি নাগরিকসহ সংঘবদ্ধ আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্রের নয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব।
এলিট ফোর্সটি বলছে, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করে দামি উপহার পাঠানোর লোভ দেখিয়ে অভিনব পদ্ধতিতে সাধারণ জনগণের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিল সংঘবদ্ধ চক্রটি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টা থেকে আজ বুধবার সকাল সাড়ে ৬টা পর্যন্ত র‌্যাব-৪ এর একটি আভিযানিক দল র‌্যাব-৮ এর সহযোগিতায় রাজধানীর পল্লবী, রুপনগর ও দক্ষিণখান থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে।
গ্রেপ্তার বিদেশি নাগরিকরা হলেন- নাইজেরিয়ান নাগরিক টফবুব ঙনরহহধজঁনবহ, দক্ষিণ আফ্রিকার ঘঃড়সনরশযড়হধ এবনুঁধ, নাইজেরিয়ান ওভঁহধহুধ ঠরারধহ ঘহধঁিরশব, নাইজেরিয়ান ঝঁহফধু ঝযবফবৎধপশ ঊলরস, নাইজেরিয়ান ঈযরহবফঁ গড়ংবং ঘহধলর, নাইজেরিয়ান ঈড়ষষরসং ওভবংরহধপযর ঞধষরশব ও ঈযরফরসসধ ঊনবষব ঊুষড়ভড়ৎ।
এছাড়াও তাদের সহযোগী দুই বাংলাদেশি হলেন- ফেনীর মো. নাহিদুল ইসলাম ও নরসিংদীর সোনিয়া আক্তার। তাদের কাছ থেকে আটটি পাসেপোর্ট, ৩১টি মোবাইল, তিনটি ল্যাপটপ, একটি চেক বই, তিনটি পেনড্রাইভ ও নগদ ৯৫ হাজার ৮১৫ টাকা জব্দ করা হয়।
গতকাল বুধবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসব জানান র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক। র‌্যাব কর্মকর্তা বলেন, গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা সংঘবদ্ধভাবে দীর্ঘদিন ধরে অভিনব কায়দায় বিপরীত লিঙ্গের ব্যক্তিদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম-ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ফেসবুকসহ নানা মাধ্যম ব্যবহার করে নিজেদের পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত দেশের নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিতেন। পরে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও প্রেমের সম্পর্ক তৈরির পর এক পর্যায়ে দামি উপহার বাংলাদেশে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণার জাল ছড়াতেন। এক পর্যায়ে বাংলাদেশের কাস্টমস অফিসার পরিচয়ে তাদেরই একজন নারী ভিকটিমকে ফোন করে বলেন, তার নামে একটি পার্সেল বিমানবন্দরে এসেছে। পার্সেলটি ডেলিভারি করতে কাস্টমস চার্জ হিসেবে মোটা অংকের টাকা বিকাশ অথবা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নাম্বারে পরিশোধ করতে বলা হয়।
র‌্যাব অধিনায়ক বলেন, যেহেতু পার্সেলে অতি মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী রয়েছে তাই কাস্টমস চার্জ একটু বেশি হয়েছে বলে তাদের বলা হয়। প্রতারিত ব্যক্তি সরাসরি টাকা প্রদান করতে বা দেখা করতে চাইলে প্রতারকরা এসএমএসের মাধ্যমে জানান, এই মুহূর্তে তারা বিদেশে অবস্থান করছেন কিংবা জরুরি কোনো মিটিংয়ে আছেন। বাংলাদেশি সহজ-সরল মানুষেরা তাদের কথায় প্রলুব্ধ হয়ে সংশ্লিষ্ট বিকাশ অথবা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে প্রতারিত হয়ে আসছিল। প্রতারিত ব্যক্তি অর্থ পরিশোধ করার পর তার নামে প্রেরিত পার্সেলটি সংগ্রহ করার জন্য বিমানবন্দরে সংশ্লিষ্ট অফিসে গিয়ে দেখেন, তার নামে কোনো পার্সেল আসেনি। তখন প্রতারিত ভিকটিম পার্সেল প্রেরণকারী বিদেশি বন্ধুর সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাকে আর পাওয়া যায় না। তখন বুঝতে পারেন, তিনি ভয়াবহ প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
প্রতারণার কৌশল হিসেবে টার্গেট নির্ধারণ : গ্রেপ্তার অভিযুক্তরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মেয়েদের নামে ভুয়া আইডি খুলে বিভিন্ন প্রোফাইল ঘেঁটে বড় বড় ব্যবসায়ী, হাই প্রোফাইল চাকরিজীবীসহ উচ্চবিত্ত ব্যক্তিদেরকে টার্গেট করতেন। ভিকটিম নির্ধারণ করার পর তাদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে ভিকটিমদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করতেন। ভিকটিমদের কাছে নিজেকে পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত দেশের সামরিক বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পরিচয় দিতেন। ভিকটিমকে বিভিন্ন সময়ে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার ভুয়া ছবি পাঠাতেন বিশ্বাস স্থাপনের জন্য। সম্পর্কের এক পর্যায়ে বিভিন্নভাবে ডিকটিমকে তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপনে প্রলুব্ধ করতেন।
নিজের অসহায়ত্বের কথা প্রকাশ : বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার পর প্রতারকরা জানান, তাদের কাছে বিপুল পরিমাণ ডলার বা বৈদেশিক মুদ্রা রয়েছে, কিন্তু তারা তা খরচ কিংবা দেশে নিতে পারছেন না। প্রতারকরা সেই ডলার বা বৈদেশিক মুদ্রা ভিকটিমের কাছে পাঠাতে চান এবং পরবর্তী সময়ে নেবেন বলে জানান। চাকরিজীবীদের বলতেন, তাদের দিয়ে জনসেবামূলক কাজে প্রচুর পরিমাণ অর্থ ব্যয় করবেন এবং এতে তারা একটি নির্দিষ্ট হারে কমিশন পাবেন। আর যারা ব্যবসায়ী তাদের বলা হতো- তার ব্যবসায় অর্থলগ্নি করবেন এবং তিনি ৩৫-৪০ শতাংশ কমিশন পাবেন। যাতে করে সহজ সরল মানুষ প্রলুব্ধ হয়ে তাদের কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে প্রভাবিত হয়।
উপহার প্রদান ও অর্থ সংগ্রহ : ভিকটিমকে আকৃষ্ট করতে প্রতারক চক্রটি বিভিন্ন উপহার পাঠানোর প্রলোভন দেখায় ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভিকটিমের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার নাম ঠিকানা নিয়ে ছোট ছোট উপহার পাঠায়। এতে করে উপহার পেয়ে ভিকটিম বিশ্বাস স্থাপন করে এবং এক পর্যায়ে প্রতারক চক্রের সদস্যরা বলে দামি পার্সেল পাঠিয়ে দিয়েছি।
পার্সেল পাঠানোর কিছুদিন পর তাদের বাংলাদেশি নারী সহযোগী বিমানবন্দর কাস্টমস অফিসার পরিচয়ে ভিকটিমকে ফোন করে বলেন, তার নামে একটি পার্সেল বিমানবন্দরে এসেছে। পার্সেলটি ডেলিভারি করতে কাস্টমস্ চার্জ হিসেবে মোটা অংকের টাকা বিকাশ অথবা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পরিশোধ করতে বলা হয়। যেহেতু পার্সেলে অতি মূল্যবান এবং এভাবে বিদেশ থেকে কোনো পার্সেল দেশে আনা আইনসিদ্ধ নয় তাই চার্জ কিছুটা বেশি দিতে হবে। এজন্য নকল টিন সার্টিফিকেট ও অন্যান্য কাগজ বানাতে অনেক অর্থের প্রয়োজন হবে। কেউ কেউ টাকা না দিতে চাইলে তাদের মামলার ভয়ভীতি দেখাতো হতো। এক পর্যায়ে সহজ সরল ভুক্তভোগীরা তাদের কথায় প্রলুব্ধ হয়ে মামলার ভয়ে সংশ্লিষ্ট বিকাশ অথবা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দিতেন। এভাবে সাধারণ মানুষ প্রতারিত হয়ে আসছিল।
গার্মেন্টস ব্যবসায়ী পরিচয় দিলেও প্রতারণাই তাদের পেশা : র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক আরও বলেন, গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্রের সদস্য। বিদেশি নাগরিকেরা ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে এসে রাজধানীর পল্লবী, রূপনগর ও দক্ষিণখান এলাকায় ভাড়া বাসায় অবস্থান করে গার্মেন্টস ব্যবসা শুরু করেন। গার্মেন্টস ব্যবসার আড়ালে তারা বাংলাদেশি সহযোগীদের নিয়ে এমন অভিনব প্রতারণার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তাদের অনেকেরই ভিসার মেয়াদ শেষ এবং গ্রেপ্তার দুজনের নামে আগেও মামলা রয়েছে। গ্রেপ্তার সোনিয়া আক্তার ও নাহিদুল ইসলাম এই আন্তর্জাতিক চক্রের দেশীয় সহযোগী। মূলত তাদের মাধ্যমেই এই প্রতারক চক্রের বিদেশি নাগরিকরা ভিকটিম সংগ্রহ, বন্ধুত্ব স্থাপন, কাস্টমস্ অফিসার পরিচয় এবং শেষে অর্থ সংগ্রহ করে আসছিল।
গ্রেপ্তার নাইজেরিয়ান নাগরিক টফবুব ঙনরহহধ জঁনবহ ২০১৭ সালে ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে আসেন এবং ২০২০ সালে তার বিরুদ্ধে র‌্যাব-৪ প্রতারণার মামলা দেওয়ায় তার পাসপোর্ট জব্দ করা হয়। তিনি নিজেকে একজন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দেন। প্রকৃতপক্ষে প্রতারণাই তার মূল পেশা। তিনিই এই আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্রের মূলহোতা। গ্রেপ্তার দক্ষিণ আফ্রিকান নাগরিক ঘঃড়সনরশযড়হধ এবনুঁধ ২০২০ সালের ১৫ জানুয়ারি ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে আসেন এবং তার ভিসার মেয়াদ ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত। তিনি টফবুব নরহহধ জঁনবহ এর স্ত্রী বলে পরিচয় দেন। এছাড়া নাইজেরিয়ান নাগরিক ওভঁহধহুধ ঠরারধহ ঘহধঁিষশব ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে আসেন এবং গত ২০২১ সালের জুলাইতে তার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়।
আর নাইজেরিয়ান নাগরিক ঝঁহফধু ঝযবফবৎধপশ ঊলরস ২০১৯ সালের ২২ মে ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে আসে এবং গত ২০২১ সালের ডিসেম্বরে তার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়।
এছাড়া নাইজেরিয়ান নাগরিক ঈযরহবফঁ গড়ংবং ঘহধলর ২০১৯ সালের এপ্রিলে ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে আসেন এবং গত ২০২১ সালের ডিসেম্বরে তার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়। আর নাইজেরিয়ান নাগরিক ঈড়ষষরসং রভবংরহধপযর ঞধষরশব ২০১৯ সালের জুনে ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে আসেন এবং গত ২০২১ সালের ডিসেম্বরে তার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়। তিনি নিজেকে ফুটবলার হিসেবে পরিচয় দেন। নাইজেরিয়ান নাগরিক ঈযরফরসসধ ঊনবষব ঊুষড়ভড়ৎ ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে আসেন এবং ২০২১ সালের ডিসেম্বরে তার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়।
অভিযুক্ত বিদেশিরা প্রত্যেকেই নিজেদের গার্মেন্টস ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পরিচয় ব্যবহার করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রতারণাই তাদের মূল পেশা। এক প্রশ্নের জবাবে র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক মোজাম্মেল হক বলেন, তারা এ পর্যন্ত দুই কোটি টাকার বেশি প্রতারণা করে উপার্জন করেছেন এবং এই টাকা তারা অবৈধভাবে হুন্ডির মাধ্যমে তাদের দেশে নিয়ে গেছেন।