ঢাকা ০৫:০৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫

বিদায় সিনেমার সুজন

  • আপডেট সময় : ০২:৪৫:২৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ মে ২০২৩
  • ১১৯ বার পড়া হয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক :গত জন্মদিনেও বিদেশের হাসপাতাল থেকে ভিডিও বার্তায় বলেছিলেন, দেশের মানুষই তার ভালোবাসার জায়গা দখল করে আছে, সেইসব মানুষদের কাছে শিগগিরই ফিরবেন তিনি। চিত্রনায়ক আকবর হোসেন পাঠান ফারুকের সেই ফেরা আর হল না। কয়েক বছর ধরে নানা রোগব্যধিতে ভুগে অবশেষে চলে গেলেন ঢাকাই সিনেমার ‘মিয়া ভাই’ ফারুক। ফারুকের ছেলে রওশন হোসেন পাঠান শরৎ সংবাদমাধ্যমকে জানান, গতকাল সোমবার স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে তার বাবার মৃত্যু হয়। তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। রক্তে সংক্রমণজনিত জটিলতা নিয়ে দেড় বছরের বেশি সময় ধরে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন ছিলেন ফারুক। শরৎ জানিয়েছেন, হাসপাতালের আনুষ্ঠানিকতা সেরে তার বাবার মৃতদেহ মঙ্গলবার দেশের আনার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য ২০২১ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহে সিঙ্গাপুরে যান ফারুক। তখন রক্তে সংক্রমণ ধরা পড়লে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ভর্তি হন। সিঙ্গাপুরে নেওয়ার পর প্রায় চার মাস ধরে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রেখে চিকিৎসা দিতে হয়েছিল তাকে। শারীরিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় মাস ছয়েক পরে তাকে কেবিনে নেওয়া হয়। এরপর থেকে হাসপাতালেই ছিলেন তিনি।
কিংবদন্তি এই নায়ক ও রাজনীতিকের মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শোক জানিয়েছেন চলচ্চিত্র ও গানের জগতের বহু তারকাও।
মুক্তিযুদ্ধ-চলচ্চিত্র-রাজনীতি: মুক্তিযুদ্ধের সময়ের সাদা-কালো পর্দা থেকে তিন দশকের বেশি সময় ধরে ঢাকার চলচ্চিত্রে অভিনয়, প্রযোজনা ও পরিচালনায় উজ্জ্বলএকটি নাম ‘ফারুক’। অভিনয় করেছেন ৬০টির বেশি সিনেমায়।
১৯৪৮ সালের ১৮ আগস্ট পুরান ঢাকায় তার জন্ম। পুরো নাম আকবর হোসেন পাঠান দুলু, বাবার নাম আজগার হোসেন পাঠান। পাঠান পরিবারের এই সন্তানের বেড়ে ওঠা পুরান ঢাকায়। ছাত্রবয়সেই জড়িয়ে পড়া ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। দেশ বাঁচাতে মুক্তিযুদ্ধে ধরছিলেন অস্ত্রও। তবে মুক্তিযুদ্ধের আগেই সিনেমায় নাম লিখিয়েছিলেন এই নায়ক, ‘জলছবি’ নামের সেই সিনেমা মুক্তি পায় একাত্তরে। প্রথম সিনেমাতেও তার নায়িকা ‘সারেং বউ’ কবরী। যে জুটি আজও স্মৃতিতে উজ্জ্বল ‘সুজনসখী’ নামে।
ক্যারিয়ারে প্রথম থেকে ফারুক নজর কেড়েছিলেন নির্মাতা খান আতাউর রহমানের। যার হাত ধরে একটু একটু করে এগিয়েছিলেন তিনি। এরপর আমজাদ হোসেন, নারায়ণ ঘোষ মিতা, প্রমোদ করের মত পরিচালকরা তাদের সিনেমায় বেছে নেন ফারুককে।
সারেং বউ, লাঠিয়াল, নয়নমণি, গোলাপী এখন ট্রেনে, দিন যায় কথা থাকে, জনতা এক্সপ্রেস, সাহেব, মিয়াভাই, নাগরদোলা, সুজনসখী’, ঘরজামাই, ভাইভাই, বিরাজবৌ এর মত চলচ্চিত্রে অভিনয় করে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক অনন্য জায়গায় নিজেকে নিয়ে যান খ্যাতিমান এই অভিনেতা।
ফারুক-কবরী, ফারুক-ববিতা জুটি সময়ে সাথে সাথে পাকাপোক্ত জায়গা করে নেয় দর্শক মনে। বিশেষ করে ববিতা-ফারুক জুটিই ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়। তাদের পর্দারসায়ন এত চমৎকার ছিল যে পর্দার বাইরে তাদের প্রেম চলছে এমন গুঞ্জনও আশির দশকের ফিল্মি ম্যাগাজিনগুলোতে প্রকাশিত হয়। যদিও তারা কেউই এ বিষয়ে কখনও মুখ খোলেননি। এছাড়া শাবানা, রোজিনা, সুচরিতা, অঞ্জু ঘোষ, অঞ্জনাও ফারুকের নায়িকা হয়েছেন বিভিন্ন সিনেমায়। মুক্তিযুদ্ধের দুই সিনেমা ‘আবার তোরা মানুষ হ’ এবং আলোর মিছিল’-এ ফারুক মূল ভূমিকায় না থাকলেও প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এই দুটি কাজকে তার টার্নিং পয়েন্ট ধরা হয়। গ্রামের বেকার যুবক, পরিশ্রমী কৃষক, ট্রাকচালক, ট্রেনচালক, ইত্যাদি চরিত্রের মাধ্যমে তিনি সাধারণ দর্শকের মনের নায়কে পরিণত হন। করেছেন বাণিজ্যিক সিনেসাও, এবং সেগুলো সফলও হয়েছিল। তবে কবরীকে নায়িকা করে ‘সাংরেং বউ’, আর ‘সুজনসখী’ সিনেমা ফারুকের ক্যারিয়ের মোড় ঘুড়িয়ে দেয়। ‘লাঠিয়াল’ সিনেমায় শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব চরিত্রে সেরা অভিনয়ের জন্য ১৯৭৫ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পান। এছাড়া চলচ্চিত্রে সামগ্রিক অবদানের জন্য ২০১৬ সালে এই অভিনেতাকে দেওয়া হয় আজীবন সম্মাননা। সিনেমায় আসার আগে ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন ফারুক। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে ছয় দফা আন্দোলনে যোগ দেন। অসংখ্য মামলায় ব্যাপক পুলিশি হয়রানিরে শিকার হন সেসময়।
উনসত্তরের গণ আন্দোলনেরও সক্রিয় কর্মী ছিলেন ফারুক। পরে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে আবার চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন। অভিনয় থেকে অবসরের পর রাজনীতির মাঠে শোনা যায় ফারুকে নাম। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে ঢাকা-১৭ আসনের এমপি হন তিনি।
ফারুকের অসুস্থতা: কোভিড-১৯ মহামারির প্রথম বছর ২০২০ সালে খবর আসে জ্বরে ভুগছেন ফারুক। ওই বছরের অগাস্ট ও সেপ্টেম্বরে দুই দফায় ঢাকার ইউনাইটেড হাসাপালে ভর্তি থাকতে হয় তাকে। দফায় দফায় স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়েও রোগ নির্ণয় না হওয়া তার স্ত্রী ফারহানা ফারুক ও ছেলে শরৎ চাইছিলেন তাকে সিঙ্গাপুরে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে নিতে। কারণ সেখানেই বছর ব্ছর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হত তার। ফারহানা ফারুক সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, “সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে তার চিকিৎসার কাগজপত্র পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে অনুমতি পেলে আমরা তাকে সিঙ্গাপুরে নেবো।”
এরপর পরের বছর ২০২১ সালে মার্চের প্রথম সপ্তাহে সিঙ্গাপুরে যান ফারুক। তখন রক্তে সংক্রমণ ধরা পড়লে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ভর্তি হন। সিঙ্গাপুরে নেওয়ার পর প্রায় চার মাস ধরে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রেখে চিকিৎসা দিতে হয়েছিল ফারুককে। শারীরিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় মাস ছয়েক আগে পরে তাকে কেবিনে নেওয়া হয়। এরমধ্যে মাঝেমধ্যে তার শারীরিক অবস্থা ভালো-মন্দ হয়েছে। তার মধ্যেই্ গত ১৮ আগস্টে ৭৪তম জন্মবার্ষিকী এক ভিডিওবার্তায় দেশবাসীর কাছে দোয়াও চেয়েছিলেন এই অভিনেতা, পরিচালক, প্রযোজক ও রাজনীতিবিদ। এরপরে সিঙ্গাপুরেই তার চিকিৎসা চলছিল। কিন্তু সব চিকিৎসা ব্যর্থ করে চলে গেলেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সোনার হরফে নাম লেখানো এই নায়ক।
মামলা থেকে বাঁচতে চলচ্চিত্রে আসেন ফারুক: ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন সদ্য প্রয়াত অভিনেতা আকবর হোসেন পাঠান ফারুক। তখন তার নামে ৩৬টি মামলায় হয়। ছাত্র রাজনীতিতে তিনি তখন বেশ সক্রিয়, সিনেমা অভিনয় নিয়ে কোনো ভাবনাই ছিল না তার। তবে একের পর এক যখন মামলা হতে থাকল তখন তার বন্ধুরাই বলল, ‘সিনেমায় ঢুকে যাও।’ সেই ঘটনার বিবরণ দিয়ে ফারুক বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, ‘আমার নামে হয়রানিমূলক ৩৬টি মামলা হয়। এগুলো থেকে বাঁচার জন্য আমার কিছু বন্ধুবান্ধব বলে, চলচ্চিত্রে ঢুকে যাও। এরপরই চলচ্চিত্রে আসি।’
ফারুকের প্রথম সিনেমা ‘জলছবি’। ছবিটি নিয়ে তিনি বলেন, ‘১৯৬৮ সালে ছবিটির শুটিং শুরু হয় কিন্তু মুক্তি পায় ১৯৭১-এ। মুক্তির তারিখ ২৫-এ মার্চ বা এর দুই কী তিন দিন আগে, ঠিক মনে নেই। ছবিতে আমার সহকর্মী ছিলেন কবরী। বলা যায়, আমার সিনেমাজীবন শুরুই হয় কবরীর সঙ্গে।’
সাক্ষাৎকারে চলচ্চিত্র অভিনয়শিল্পীদের পারিশ্রমিক নিয়েও আক্ষেপ করতে শোনা যায় অভিনেতাকে। এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়েই তিনি জানান প্রথম সিনেমা ‘জলছবি’র পারিশ্রমিক কত ছিল। ফারুক বলেন, ‘আমাকে যথাযথ সম্মান ও সম্মানী দেওয়া হয়নি। আমাকে প্রথম ছবিতে পাঁচ শ টাকা দেওয়া হয়েছিল।’
ফারুক তার অভিনয়ের জন্য ১৯বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে মনোনীত হয়েছিলেন। কিন্তু তার হাতে পুরস্কার উঠেছিল কেবলই একবার। অবশ্য ২০১৬ সালে তাকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত করা হয়।
আজ শহীদ মিনারে গার্ড অব অনার দেয়া হবে: বীর মুক্তিযোদ্ধা নায়ক ও সংসদ সদস্য ফারুকের মরদেহ আজ মঙ্গলবার সকালে সিঙ্গাপুর থেকে দেশে আসবে। পরে শ্রদ্ধা জানাতে নেয়া হবে শহীদ মিনারে। সেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে গার্ড অব অনারদেয়া হবে তাকে। গতকাল সোমবার ফারুকের খালাতো ভাই আগা খান মিন্টু এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, মরদেহ দেশে পৌঁছানোর পর বেলা ১১টায় শহীদ মিনারে নেয়া হবে। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন ও শেষে দুপুর ২টায় মরদেহ নেয়া হবে এফডিসিতে। পরে গুলশানের আজাদ মসজিদে বাদ আসর জানাজা শেষে গাজীপুরের কালীগঞ্জে পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হবে ফারুককে। আগা খান আরও বলেন, ফারুকের ইচ্ছা অনুযায়ী পারিবারিক কবরস্থানে তার বাবার কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হবে।

 

 

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

বিদায় সিনেমার সুজন

আপডেট সময় : ০২:৪৫:২৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ মে ২০২৩

নিজস্ব প্রতিবেদক :গত জন্মদিনেও বিদেশের হাসপাতাল থেকে ভিডিও বার্তায় বলেছিলেন, দেশের মানুষই তার ভালোবাসার জায়গা দখল করে আছে, সেইসব মানুষদের কাছে শিগগিরই ফিরবেন তিনি। চিত্রনায়ক আকবর হোসেন পাঠান ফারুকের সেই ফেরা আর হল না। কয়েক বছর ধরে নানা রোগব্যধিতে ভুগে অবশেষে চলে গেলেন ঢাকাই সিনেমার ‘মিয়া ভাই’ ফারুক। ফারুকের ছেলে রওশন হোসেন পাঠান শরৎ সংবাদমাধ্যমকে জানান, গতকাল সোমবার স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে তার বাবার মৃত্যু হয়। তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। রক্তে সংক্রমণজনিত জটিলতা নিয়ে দেড় বছরের বেশি সময় ধরে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন ছিলেন ফারুক। শরৎ জানিয়েছেন, হাসপাতালের আনুষ্ঠানিকতা সেরে তার বাবার মৃতদেহ মঙ্গলবার দেশের আনার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য ২০২১ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহে সিঙ্গাপুরে যান ফারুক। তখন রক্তে সংক্রমণ ধরা পড়লে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ভর্তি হন। সিঙ্গাপুরে নেওয়ার পর প্রায় চার মাস ধরে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রেখে চিকিৎসা দিতে হয়েছিল তাকে। শারীরিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় মাস ছয়েক পরে তাকে কেবিনে নেওয়া হয়। এরপর থেকে হাসপাতালেই ছিলেন তিনি।
কিংবদন্তি এই নায়ক ও রাজনীতিকের মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শোক জানিয়েছেন চলচ্চিত্র ও গানের জগতের বহু তারকাও।
মুক্তিযুদ্ধ-চলচ্চিত্র-রাজনীতি: মুক্তিযুদ্ধের সময়ের সাদা-কালো পর্দা থেকে তিন দশকের বেশি সময় ধরে ঢাকার চলচ্চিত্রে অভিনয়, প্রযোজনা ও পরিচালনায় উজ্জ্বলএকটি নাম ‘ফারুক’। অভিনয় করেছেন ৬০টির বেশি সিনেমায়।
১৯৪৮ সালের ১৮ আগস্ট পুরান ঢাকায় তার জন্ম। পুরো নাম আকবর হোসেন পাঠান দুলু, বাবার নাম আজগার হোসেন পাঠান। পাঠান পরিবারের এই সন্তানের বেড়ে ওঠা পুরান ঢাকায়। ছাত্রবয়সেই জড়িয়ে পড়া ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। দেশ বাঁচাতে মুক্তিযুদ্ধে ধরছিলেন অস্ত্রও। তবে মুক্তিযুদ্ধের আগেই সিনেমায় নাম লিখিয়েছিলেন এই নায়ক, ‘জলছবি’ নামের সেই সিনেমা মুক্তি পায় একাত্তরে। প্রথম সিনেমাতেও তার নায়িকা ‘সারেং বউ’ কবরী। যে জুটি আজও স্মৃতিতে উজ্জ্বল ‘সুজনসখী’ নামে।
ক্যারিয়ারে প্রথম থেকে ফারুক নজর কেড়েছিলেন নির্মাতা খান আতাউর রহমানের। যার হাত ধরে একটু একটু করে এগিয়েছিলেন তিনি। এরপর আমজাদ হোসেন, নারায়ণ ঘোষ মিতা, প্রমোদ করের মত পরিচালকরা তাদের সিনেমায় বেছে নেন ফারুককে।
সারেং বউ, লাঠিয়াল, নয়নমণি, গোলাপী এখন ট্রেনে, দিন যায় কথা থাকে, জনতা এক্সপ্রেস, সাহেব, মিয়াভাই, নাগরদোলা, সুজনসখী’, ঘরজামাই, ভাইভাই, বিরাজবৌ এর মত চলচ্চিত্রে অভিনয় করে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক অনন্য জায়গায় নিজেকে নিয়ে যান খ্যাতিমান এই অভিনেতা।
ফারুক-কবরী, ফারুক-ববিতা জুটি সময়ে সাথে সাথে পাকাপোক্ত জায়গা করে নেয় দর্শক মনে। বিশেষ করে ববিতা-ফারুক জুটিই ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়। তাদের পর্দারসায়ন এত চমৎকার ছিল যে পর্দার বাইরে তাদের প্রেম চলছে এমন গুঞ্জনও আশির দশকের ফিল্মি ম্যাগাজিনগুলোতে প্রকাশিত হয়। যদিও তারা কেউই এ বিষয়ে কখনও মুখ খোলেননি। এছাড়া শাবানা, রোজিনা, সুচরিতা, অঞ্জু ঘোষ, অঞ্জনাও ফারুকের নায়িকা হয়েছেন বিভিন্ন সিনেমায়। মুক্তিযুদ্ধের দুই সিনেমা ‘আবার তোরা মানুষ হ’ এবং আলোর মিছিল’-এ ফারুক মূল ভূমিকায় না থাকলেও প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এই দুটি কাজকে তার টার্নিং পয়েন্ট ধরা হয়। গ্রামের বেকার যুবক, পরিশ্রমী কৃষক, ট্রাকচালক, ট্রেনচালক, ইত্যাদি চরিত্রের মাধ্যমে তিনি সাধারণ দর্শকের মনের নায়কে পরিণত হন। করেছেন বাণিজ্যিক সিনেসাও, এবং সেগুলো সফলও হয়েছিল। তবে কবরীকে নায়িকা করে ‘সাংরেং বউ’, আর ‘সুজনসখী’ সিনেমা ফারুকের ক্যারিয়ের মোড় ঘুড়িয়ে দেয়। ‘লাঠিয়াল’ সিনেমায় শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব চরিত্রে সেরা অভিনয়ের জন্য ১৯৭৫ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পান। এছাড়া চলচ্চিত্রে সামগ্রিক অবদানের জন্য ২০১৬ সালে এই অভিনেতাকে দেওয়া হয় আজীবন সম্মাননা। সিনেমায় আসার আগে ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন ফারুক। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে ছয় দফা আন্দোলনে যোগ দেন। অসংখ্য মামলায় ব্যাপক পুলিশি হয়রানিরে শিকার হন সেসময়।
উনসত্তরের গণ আন্দোলনেরও সক্রিয় কর্মী ছিলেন ফারুক। পরে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে আবার চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন। অভিনয় থেকে অবসরের পর রাজনীতির মাঠে শোনা যায় ফারুকে নাম। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে ঢাকা-১৭ আসনের এমপি হন তিনি।
ফারুকের অসুস্থতা: কোভিড-১৯ মহামারির প্রথম বছর ২০২০ সালে খবর আসে জ্বরে ভুগছেন ফারুক। ওই বছরের অগাস্ট ও সেপ্টেম্বরে দুই দফায় ঢাকার ইউনাইটেড হাসাপালে ভর্তি থাকতে হয় তাকে। দফায় দফায় স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়েও রোগ নির্ণয় না হওয়া তার স্ত্রী ফারহানা ফারুক ও ছেলে শরৎ চাইছিলেন তাকে সিঙ্গাপুরে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে নিতে। কারণ সেখানেই বছর ব্ছর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হত তার। ফারহানা ফারুক সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, “সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে তার চিকিৎসার কাগজপত্র পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে অনুমতি পেলে আমরা তাকে সিঙ্গাপুরে নেবো।”
এরপর পরের বছর ২০২১ সালে মার্চের প্রথম সপ্তাহে সিঙ্গাপুরে যান ফারুক। তখন রক্তে সংক্রমণ ধরা পড়লে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ভর্তি হন। সিঙ্গাপুরে নেওয়ার পর প্রায় চার মাস ধরে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রেখে চিকিৎসা দিতে হয়েছিল ফারুককে। শারীরিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় মাস ছয়েক আগে পরে তাকে কেবিনে নেওয়া হয়। এরমধ্যে মাঝেমধ্যে তার শারীরিক অবস্থা ভালো-মন্দ হয়েছে। তার মধ্যেই্ গত ১৮ আগস্টে ৭৪তম জন্মবার্ষিকী এক ভিডিওবার্তায় দেশবাসীর কাছে দোয়াও চেয়েছিলেন এই অভিনেতা, পরিচালক, প্রযোজক ও রাজনীতিবিদ। এরপরে সিঙ্গাপুরেই তার চিকিৎসা চলছিল। কিন্তু সব চিকিৎসা ব্যর্থ করে চলে গেলেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সোনার হরফে নাম লেখানো এই নায়ক।
মামলা থেকে বাঁচতে চলচ্চিত্রে আসেন ফারুক: ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন সদ্য প্রয়াত অভিনেতা আকবর হোসেন পাঠান ফারুক। তখন তার নামে ৩৬টি মামলায় হয়। ছাত্র রাজনীতিতে তিনি তখন বেশ সক্রিয়, সিনেমা অভিনয় নিয়ে কোনো ভাবনাই ছিল না তার। তবে একের পর এক যখন মামলা হতে থাকল তখন তার বন্ধুরাই বলল, ‘সিনেমায় ঢুকে যাও।’ সেই ঘটনার বিবরণ দিয়ে ফারুক বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, ‘আমার নামে হয়রানিমূলক ৩৬টি মামলা হয়। এগুলো থেকে বাঁচার জন্য আমার কিছু বন্ধুবান্ধব বলে, চলচ্চিত্রে ঢুকে যাও। এরপরই চলচ্চিত্রে আসি।’
ফারুকের প্রথম সিনেমা ‘জলছবি’। ছবিটি নিয়ে তিনি বলেন, ‘১৯৬৮ সালে ছবিটির শুটিং শুরু হয় কিন্তু মুক্তি পায় ১৯৭১-এ। মুক্তির তারিখ ২৫-এ মার্চ বা এর দুই কী তিন দিন আগে, ঠিক মনে নেই। ছবিতে আমার সহকর্মী ছিলেন কবরী। বলা যায়, আমার সিনেমাজীবন শুরুই হয় কবরীর সঙ্গে।’
সাক্ষাৎকারে চলচ্চিত্র অভিনয়শিল্পীদের পারিশ্রমিক নিয়েও আক্ষেপ করতে শোনা যায় অভিনেতাকে। এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়েই তিনি জানান প্রথম সিনেমা ‘জলছবি’র পারিশ্রমিক কত ছিল। ফারুক বলেন, ‘আমাকে যথাযথ সম্মান ও সম্মানী দেওয়া হয়নি। আমাকে প্রথম ছবিতে পাঁচ শ টাকা দেওয়া হয়েছিল।’
ফারুক তার অভিনয়ের জন্য ১৯বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে মনোনীত হয়েছিলেন। কিন্তু তার হাতে পুরস্কার উঠেছিল কেবলই একবার। অবশ্য ২০১৬ সালে তাকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত করা হয়।
আজ শহীদ মিনারে গার্ড অব অনার দেয়া হবে: বীর মুক্তিযোদ্ধা নায়ক ও সংসদ সদস্য ফারুকের মরদেহ আজ মঙ্গলবার সকালে সিঙ্গাপুর থেকে দেশে আসবে। পরে শ্রদ্ধা জানাতে নেয়া হবে শহীদ মিনারে। সেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে গার্ড অব অনারদেয়া হবে তাকে। গতকাল সোমবার ফারুকের খালাতো ভাই আগা খান মিন্টু এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, মরদেহ দেশে পৌঁছানোর পর বেলা ১১টায় শহীদ মিনারে নেয়া হবে। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন ও শেষে দুপুর ২টায় মরদেহ নেয়া হবে এফডিসিতে। পরে গুলশানের আজাদ মসজিদে বাদ আসর জানাজা শেষে গাজীপুরের কালীগঞ্জে পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হবে ফারুককে। আগা খান আরও বলেন, ফারুকের ইচ্ছা অনুযায়ী পারিবারিক কবরস্থানে তার বাবার কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হবে।