প্রীতিলতা দেবী : বাংলাদেশ বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তি উদ্যাপন করছে। স্বাধীন দেশ হিসাবে জাতিসংঘের অন্যান্য সদস্য ১৯৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে অনেক দেশ বরাবরই স্বাধীন দেশ হিসেবে থেকেছে। আবার অনেক দেশ পরাধীনতা থেকে বা কলোনি থেকে আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এদের মধ্যে কোন কোন দেশ আলোচনার মাধ্যমে, আবার কোন কোন দেশ বিপক্ষ শক্তিকে যুদ্ধে হারিয়ে বিজয়ী হয়েছে।
যেসব দেশ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বিপক্ষ শক্তিকে পরাজিত করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, তাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, আলজেরিয়া, হাইতি, চিলি, বেলজিয়াম ইত্যাদি দেশের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। তবে বাংলাদেশের মতো খুব কম দেশই আছে, যারা একটানা দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে শত্রুকে পরাজিত করে বিজয় অর্জন করেছে, স্বাধীনতা লাভ করেছে।
ইতিহাস থেকে আমরা জানি, ভারত ব্রিটিশ শাসন থেকে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভ করে এবং দেশ বিভক্ত হয়। বর্তমান বাংলাদেশ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত ছিল। ভাষা, সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার, অবস্থান ইত্যাদি সবকিছুর ভিন্নতার কারণে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে খাপ খাওয়াতে পারিনি আমরা কখনোই। সেই প্রথম থেকে শুরু করে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানিদের হাতে আমাদের অনেক অত্যাচারিত হতে হয়েছে। ব্রিটিশ শাসনের পরে পাকিস্তানিদের সীমাহীন অত্যাচার আমাদের সহ্য করতে হয়েছে। সহ্যের বাঁধ ভাঙার ডাক দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত। সেই বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে তার ৫০ বছর উদ্যাপন করছে। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়েও পাকিস্তান আমাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। আন্তজার্তিক চাপে পড়ে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও তাদের বর্বর অত্যাচার, নিপীড়ন, গণহত্যা, ধর্ষণ – কোন কিছুর জন্যও তারা ক্ষমা চায়নি বাংলাদেশের কাছে। জাতিসংঘে দেয়া ভাষণে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান হয়ত পারতেন বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাইতে। বিশ্ব দরবারে কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিবেচনা করে হলেও তারা অন্তত জাতিসংঘের সহানুভূতি আদায় করতে পারতেন। কিন্তু পাকিস্তান ক্ষমা চায়নি। ৫০ বছরেও তারা তাদের অন্যায়ের জন্য অনুশোচনা করেনা।বাংলাদেশ কী করেছে এই ৫০ বছরে?
প্রায় দুই দশকের প্রস্তুতি নিয়ে, দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, আকাশে উড়েছে লাল সবুজের পতাকা, উজ্জ্বল বাংলাদেশের মানচিত্র নিয়ে সেই পতাকা আমাদের শিখিয়েছে বুক ভরে নির্ভয়ে শ্বাস নিতে। জাতীয় সংগীত বেজে উঠলে গায়ে কাঁটা ওঠা অনুভূত করতে। স্বাধীনতা থেকে বড় অর্জন আর কিছু হতে পারেনা, স্বাধীনতা উপভোগ করার আনন্দের থেকে বড় আনন্দ আর কিছু নেই। আজকের প্রজন্ম সেই আনন্দটা শুধু অনুমান করতে পারে, জাতীয় পরিচয়পত্র হাতে নিয়ে বলতে পারে যে, সে বাংলাদেশের নাগরিক। কিন্তু এই মহান অর্জনের পেছনে যাদের আত্মত্যাগ ছিল, সেই মানুষগুলোর মতো করে স্বাধীন দেশ লাভের জন্য যে দেশপ্রেমের প্রমাণ তারা দিয়ে গেছেন, সেটি নিজেদের মধ্যে জাগানোটা বা বোধ করানোটা এই প্রজন্মের জন্য কঠিন। কারণ তাদের অভিজ্ঞতায় এর তুল্য কিছু নেই। দেখতে হয়নি নিজের মাটি ছেড়ে চলে যাবার কষ্ট, আপনজন হারানোর কষ্ট, দেখতে হয়নি মৃত্যু, চোখের সামনে থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া মা-বোনের বর্বরোচিত ধর্ষণ। আজকাল বড় কোন খেলায় বাংলাদেশ জিতলে তরুণেরা উদ্বেলিত হয়ে পতাকা হাতে উদ্যাপনে নেমে পড়ে। তাই বলে একটি জাতির জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন, স্বাধীনতা জয়ের আনন্দের কিয়দাংশও তাদের পক্ষে অনুভব করতে পারা সম্ভব নয়।
স্বাধীনতার জন্য বাংলাদেশকে যে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে, তার দাম কিছু দিয়ে শোধ করা সম্ভব নয়। লাখ লাখ প্রাণ, শূন্য বুকের চিরস্থায়ী বেদনা, সম্ভ্রম হারানোর ট্রমা, পাকিস্তানিদের দিয়ে যাওয়া বীজ নিজের মধ্যে বড় হতে দেখার আতঙ্ক – এর মূল্য কোন ঠুনকো ক্ষমা দিয়ে শোধ করা সম্ভব না কোনদিনও।স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও সেই বিজয়ের আনন্দের সঙ্গে স্বজন হারানোর কান্না আর হাহাকার মিশে আছে অঙ্গাঙ্গিভাবে। সেই সাথে এ সত্য আমাদের মেনে নিতে হয়েছে যে এই মাটিতে জন্ম নেওয়া, এর হাওয়ায় বড় হওয়া কিছু মানুষ কিনা আমাদের শত্রুদের সাহায্য করেছে আমাদের হত্যা করতে, বাড়িঘর পুড়িয়ে দিতে। তারা ঘরে ঘরে নিয়ে গেছে খাকি পোশাক পরা পাকিস্তানি হানাদার খুনি আর ধর্ষকদের। সাথে নিজেরাও এই অপকর্মে মেতেছে এই আশায় যে যুদ্ধে পাকিস্তান জয়ী হবে আর তারা এই সহযোগীতা করার সুবাদে পাবে সম্মান। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য এ ঘটনার মানুষগুলোকে আমরা স্বাধীনতার পরে চিনেছি ‘রাজাকার’ নামে।
এই রাজাকারদের ফাঁসি কার্যকর করে আওয়ামী লীগ সরকার একটি যুগান্তকারী উদাহরণ স্থাপন করতে পেরেছে বলে আমি মনে করি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের সবাই কী মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে যে পাকিস্তান নামক দেশেিট্ক শুধু ঘৃণা ছাড়া আর কিছু দেবার কথা নয় আমাদের? ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ থেকে বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় নাম তুলেছে। বাংলাদেশের টাকার মান আজ পাকিস্তানি রুপির দ্বিগুণ। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে খুব প্রশংসনীয় অবস্থানে আমরা হয়ত এখনো পৌঁছতে পারিনি, তবে এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে গেলে সরকারের দিকে, রাজনৈতিক অবকাঠামোর দিকে আমাদের অভিযোগের আঙুল ওঠে। কিন্তু এই আঙুল কি আমরা নিজেদের দিকে একবারও তুলি? দেশে দুর্নীতির শেষ নেই। এই দুর্নীতির অপচর্চা কি আমরাই করি না? নাকি অন্যদেশি মানুষরা পদগুলোতে বসে দুর্নীতি করে আমাদের নামে চালিয়ে দেয়? ঘুষ খেয়ে বা ঘুষ দিয়ে আমরা আজ অভ্যস্থ। প্রতিদিনের সদাই কিনতে গিয়ে টাকা দিয়ে বিষ কিনে খাচ্ছি জেনেও আমরা চুপ। প্রতিটি ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক উৎসবের আগে নিত্য প্রয়োজনীয় সব কিছুর দাম বাড়িয়ে দেয়ার নীতিতে আমাদের এখন আর কিছু এসে যায় না। কারণ এই সব কর্মকা-ের পেছনে আমাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হাত আছে। যদি দুর্নীতিকে ‘না’ বলে, সব কাজে, পরিবার থেকে, সমাজ থেকে এর বিরুদ্ধাচরণ করা হয়, তাহলে কি দোষ খোঁজার জন্য সরকারের দিকে আঙ্গুল তুলতে হতো প্রতিটি ক্ষেত্রে?
যাই হোক, আমাদের আলোচ্য বিষয় দেশপ্রেম নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বর্তমান সামাজিক অবক্ষয়ের প্রসঙ্গ উঠে এলেও যে বিষয়টিতে আমি এখন আলোকপাত করতে চাই, তা হল সম্প্রতি শেষ হয়ে যাওয়া বাংলাদেশ-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ টিটোয়েন্টি-টেস্ট সিরিজ এর সময়টার দিকে। আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে রাখা ছবি দেখেছি, মুক্তিযুদ্ধের গল্প পড়েছি, লেখা পড়েছি, ছোটবেলায় ‘মুক্তির গান’ বার বার দেখেছি, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক আর্টিকেল পড়েছি। তবু বলবো, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার জানার পরিধি খুবই কম। শুধু এটুকু গর্ব করে বলতে পারি, ‘খেলায় রাজনীতি মেশাবেন না’ বলা দলের মানুষদের মধ্যে আমি নিজেকে ফেলি না। সুন্দর জামা দেখা বা কেনার নামে আর যাই হোক, পাকিস্তানি লন বিক্রি/ ক্রয় করাকে আমি সমর্থন করতে পারি না। ফার্মের মুরগি খেতে স্বাদ নয়, দেশি মুরগির দাম বেশি, তবু পাকিস্তানি মুরগি কিনতে/ খেতে আমি নারাজ। কারণ পাকিস্তানের পণ্য আমি নিতে পারি না। বাংলাদেশ ক্রিকেট খেলা এখনো ভালোভাবে রপ্ত করে উঠতে পারেনি। তাই বলে, বাংলাদেশের মাঠে বাংলাদেশ বনাম পাকিস্তান খেলায় একজন বাংলাদেশি নাগরিকের বাংলাদেশকে সমর্থন না করে পাকিস্তানকে সমর্থন করা – এটা মেনে নেয়া কি কোনভাবে সম্ভব? সম্প্রতি যে ম্যাচগুলো বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল, সেটাকে ঘিরে গ্যালারিতে যে ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে, যেমন – পাকিস্তানি পতাকা হাতে, পাকিস্তানের জার্সি গায়ে বাংলাদেশিদের আনন্দ উল্লাস,খেলা উপভোগ – এই ঘটনাগুলো কি স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে লক্ষ শহীদদের স্মৃতিতে কালিমা লেপন নয়? ৫০ বছর পরে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের কাছে কি এমনটা প্রত্যাশিত ছিল? এই আদর্শিক অবক্ষয়ের জন্য আমরা কাকে দুষবো?
লেখক : পিএইচডি রিসার্চার, জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় নিউ দিল্লী, ভারত। এছাড়া তিনি বাংলাদেশের ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক হিসেবে কাজ করছেন।
বিজয়ের অর্ধশতক ও আমাদের দেশপ্রেম
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ