ঢাকা ০৩:২৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ অগাস্ট ২০২৫

বিজয়া দশমী: অসুরবধ ও মাতৃশক্তির বিজয়গাথা

  • আপডেট সময় : ০৪:৩৮:৪৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪
  • ১০৬ বার পড়া হয়েছে

গুঞ্জন রহমান :বিশ্বসংসারে সর্বপ্রথম সৃষ্টি হয়েছে কী?
এক মহাচেতনা।
সেই মহাচেতনার নাম মহামায়া।
মহামায়া এক মহাজ্ঞান। মহান এক বোধ। চিন্তা। ধারণা। অসীম এক কৌতূহল। অনিঃশেষ এক স্পৃহা। বিজ্ঞান। সকল সৃজনশীলতার মূলে আছে এই মহামায়া। সনাতন ধর্মশাস্ত্রে এই মহামায়াকেই বলা হয় সৃষ্টির আদি সৃষ্টিকর্তা।
মহামায়া যখন চেতনা থেকে আকৃতি ধারণ করলেন, তখন তাঁর যে অবতার, সেটি হলো সরস্বতী। জ্ঞান, সংগীত, শিল্পকলা, বাক্য, প্রজ্ঞা ও বিদ্যার্জনের দেবী। এই দেবী যখন সৃষ্টির পরিকল্পনা করলেন, তখন তাঁর তিনটি সত্তা বিভক্ত হলো। তার কারণও ছিল। প্রথমে তিনি ব্রহ্মা; যার কাজ সব কিছু সৃষ্টি করা। যিনি সৃষ্টিকর্মে রত, তার প্রতিপালনের সময় কই? তাই ব্রহ্মা সৃষ্টি করলেন তাঁর দ্বিতীয় সত্তা বিষ্ণু। বিষ্ণুর কাজ প্রতিপালন করা। এবার, সৃষ্টি হচ্ছে, সৃষ্ট প্রাণীর প্রতিপালনও হচ্ছে, কিন্তু তার লয় করা তো চাই। ব্রহ্মা বললেন, যাকে নিজ হাতে গড়েছি, তাকে ধ্বংস করি কী করে? একই কথা বিষ্ণুর প্রতিপালকও তো পিতাই, পিতা হয়ে ধ্বংস করবো সন্তানকে? ফলে, মহামায়া গড়লেন স্রষ্টার তৃতীয় সত্তা শিব; যার কাজ সব সৃষ্টির লয় করা।
শিব একদম শুরু থেকেই লয়-ক্রিয়ায় মেতে উঠলেন। প্রলয়-নাচন নেচে ধ্বংস করে দিতে থাকলেন সব কিছু। তাতে দেখা দিলো আরেক দুর্বিপাক। কার কখন মৃত্যু, কে আগে যাবে, কে পরে যাবে– এসবের বাছবিচার করছেন না শিব, এভাবে তো চলতে পারে না। তখন মহামায়া ঠিক করলেন, শিবকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখতে হবে, যেন তিনি অতিরিক্ত কর্তব্যপরায়ণতা দেখাতে না পারেন। ফলে শিবকে দেওয়া হলো সিদ্ধি, যা তার চেতনাকে লুপ্ত করে রাখতে পারবে। কিন্তু তাতেও যখন কাজ হলো না, তখন তাকে সংসারী করার জন্য বিয়ে দিয়ে দিলেন পার্বতীর সঙ্গে। শিব-পার্বতীর সেই জুটি দেখে দেবী সরস্বতী এতই মুগ্ধ হলেন যে তাদের ঘরে তিনি কন্যারূপে জন্ম নেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলেন। ফলে পার্বতী, যিনি মহামায়ার প্রতিকৃতি (আইকন বা বিগ্রহ) সরস্বতীর মাতা হলেন, তিনি পেলেন দেবী ভগবতীর স্থান। এই ভগবতীই যখন অসুরবধের জন্য মর্ত্যে নেমে আসেন, তখন তিনি দুর্গা।
দুর্গাদেবীর বোধন হয় ঋতুরাজ বসন্তকালে, তখনই তাঁর অর্চনা হয়ে থাকে। কিন্তু রাবণবধের জন্য রাম যখন কোনোমতেই আর পেরে উঠছিলেন না, তখন তাঁর দেবী ভগবতীর শরণ নিতে হয়। না নিয়ে উপায় নেই, কারণ রামের সব অস্ত্র থেকে, সব কয়টা দুর্ভেদ্য বান থেকে রাবণকে যে সুরক্ষিত রাখছিলেন দেবী ভগবতী স্বয়ং। কেননা ব্রহ্মাণ্ডে রাবণের মতো দেবীভক্ত ব্রাহ্মণ আর একজনও ছিলেন না। কাস্ট সিস্টেমে দেখতে গেলেও রাম তাঁর নিচের স্তরে ছিলেন। কারণ রাম ছিলেন ক্ষত্রিয়, অপর দিকে রাবণ তো ব্রাহ্মণ। যা হোক, দেবী ভগবতীর সবচেয়ে বড় ভক্তকে বিনাশ করতে সেই ভগবতীরই শরণ চাইলেন রাম। এবং তার জন্য প্রয়োজন হলো অকালবোধনের। সেই অকালবোধন হলো শরৎকালে, আশ্বিন মাসে।
অকালে পিতৃগৃহে দেবীকে ফেরানোর জন্য যে যজ্ঞ, তার পৌরহিত্য করলেন কে? স্বয়ং রাবণ! কারণ ত্রি-সন্ধ্যা গায়ত্রী মন্ত্র জপ করা শুদ্ধতম কোনো ব্রাহ্মণকে দিয়েই কেবল এই যজ্ঞের পৌরহিত্য করানো যেত, নচেৎ দেবীর অকালবোধন হতে পারতো না। আর সেই শুদ্ধতম ব্রাহ্মণ রাবণ ছাড়া আর কেউ ছিলেন না ব্রহ্মাণ্ডে। রাম তাই বাধ্য হয়ে পৌরহিত্যের আমন্ত্রণ জানালেন রাবণকে এবং রাবণ তা গ্রহণও করলেন। তিনি বললেন, ‘আমি জানি এই পুজো সফল হলে আমি তোমার হাতে নিহত হবো। কিন্তু তবু আমাকে পুজো করতে হবে। কারণ, আমি ব্রাহ্মণ। আমন্ত্রণ পেলে ব্রাহ্মণের তা অগ্রাহ্য করার সাধ্য নেই।’ নিজের মৃত্যুর জন্য যে যজ্ঞ, সেই যজ্ঞের পৌরহিত্যের আমন্ত্রণও একজন শুদ্ধ ব্রাহ্মণ এড়াতে পারেন না! ফলে রাবণ যজ্ঞে বসলেন। কায়মনোবাক্যে উচ্চারণ করলেন সৃষ্টিজগতের সবচেয়ে শক্তিশালী মন্ত্র – ‘ইয়া দেবী, সর্বভুতেষু; মাতৃরূপেন সংস্থিতা।’
বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীরা যে দুর্গাপূজা করেন, সেটি মূলত রাম কর্তৃক রাবণবধেরই ভিন্ন সংস্করণ। ভারতজুড়ে এই রাবণবধের নাম দশেরা। দশ মাথাওয়ালা রাবণকে বধ করা। রাবণের দশ মাথাকে প্রতীক হিসেবে দেখানো হয় মনুষ্য সম্প্রদায়ের দশটি ত্রুটি হিসেবে, দশটি শত্রু হিসেবে। যদিও রামায়ণে রাবণের এই দশ মাথাকে দেখানো হয়েছে দশ রকমের শক্তি হিসেবে, যোগ্যতা হিসেবে, জ্ঞান ও বুদ্ধি হিসেবে অর্থাৎ ইতিবাচক অর্থে; যার আবাহনে দেবী ভগবতী মর্ত্যে এলেন, দশভূজা ‘শক্তিরূপেন সংস্থিতা’ হলেন, সেই রাবণকেই বধ করলেন তিনি। কেন? এবং তার জন্য রাবণই বা তাঁকে দোষারোপ করতে পারেন না কেন? কারণ দেবী আগেই তাঁকে সতর্ক করে রেখেছিলেন; যা কিছুই তুমি অর্জন করো না কেন একমুহূর্তে তা বালির বাঁধের মতো ধসে যাবে তোমার একটা মাত্র দোষে– অহঙ্কার! সেই অহঙ্কার তো রাবণের মধ্যে ছিল! ভরপুর ছিল। রাবণকে ধ্বংস করেছে তার অহঙ্কার, দেবী ভগবতীই বলুন আর অবতার রামই বলুনÑ তাঁরা তো নিমিত্ত মাত্র।
একইভাবে রাবণের বাঙালি সংস্করণ মহিষাসুরও বধিত হন দশভূজা দুর্গাদেবীর হাতে। মহিষাসুরের পিতা রম্ভ কঠোর তপস্যায় শিবের মন গলাতে পেরেছিলেন। শিব বলেছিলেন, অমরত্ব-বিনা যেকোনও বর চাও, দেবো। রম্ভ বললেন, অমরত্ব আমার চাই না। আমার কোনো বরই চাই না। কিন্তু আমার পুত্রের জন্য বর চাই। অন্য কোনো বর চাই না। অমরত্বের বরই চাই! শিব পড়ে গেলেন ধর্মসংকটে। বলেছেন রম্ভকে অমরত্ব দেবেন না, সে তো তা চাইছে না। বলেছেন রম্ভ যা চায়। তাই দেবেন। রম্ভ তো অমর-পুত্রের বর চাইছে! শেষে তিনি বর দিলেন, ত্রিলোকজয়ী পুত্র সন্তান তুই পাবি। কিন্তু মনে রাখবি, সেই পুত্রের অমরত্ব-বরও ঘুচে যাবে, যদি সে কোনো নারীকে অসম্মান করে। কারণ, কোনো নারীই হবে তার বিনাসের কারণ। সেই নারী, যে কারো গর্ভজাত নয়।
মহিষাসুরের জন্মকাহিনি বড় বিচিত্র। সে বিস্তার আজ নয়, অন্য কখনও করা যাবে। কেবল এটুকু বলি, তার পিতা রম্ভ কীভাবে শিবের কাছ থেকে তার জন্য ত্রিলোকজয়ী বর নিয়ে এসেছিলেন, সেই বরের শর্তই বা কী ছিল, এসব তিনি পরে জানতে পারেন তাঁর আজ্ঞাবহ পুরোহিতের যজ্ঞ হতে দিব্যজ্ঞানের মাধ্যমে। কিন্তু খুব সামান্য ঘাটতি থেকে যায় তাঁর জানায়। শর্তের শেষ বাক্য ছিল, ‘সেই নারী, যে কারও গর্ভজাত নয়’Ñ এ কথাটি তিনি এড়িয়ে যান। তিনি ধরে নেন, যেকোনও নারীই তাঁর হত্যাকারী হতে পারেন। তিনি শুরু করেন নির্বিচারে নারীদের বধ করতে। মর্ত্যে সৃষ্টি হয় ত্রাসের রাজত্ব। সর্বত্র অনাচার পাপাচারে ভরে যায়। মর্ত্যরে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ দশ জন মুনি দেবতাদের নিকট আহ্বান জানান প্রতিকারের, দেবাসন টলমল করতে থাকে মুনিদের হাহাকারে। আমূল কেঁপে ওঠে দেবলোক। দেবতারা সতর্ক করেন মহিষাসুরকে। মহিষাসুর তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হন না, একদম পরোয়া করেন না দেবতাদের; বরং সরাসরি আক্রমণ করে বসেন দেবলোকেই। কারণ তিনি যে স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল এই ত্রিলোকজয়ী!
দেবতারাও স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হলে সবাই মিলে আশ্রয় প্রার্থনা করেন, প্রতিকার দাবি করেন মহেশ্বর (শিব) ও নারায়ণের (বিষ্ণু) কাছে। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন মর্ত্যের ঋষিগণও। সকলে দাবি জানাতে থাকেন সর্বশক্তিধর, মাতৃশক্তির অধিকারিণী ভগবতীকে আকৃতি ধারণ করতে আহ্বান জানিয়ে যেন অবিলম্বে যজ্ঞ আয়োজন করা হয়। ভগবতীর জন্য দেবতারা নিজ নিজ অস্ত্র নিবেদন করতে থাকেন। মুনি দধিচির কোনো হাতিয়ার ছিল না, তিনি উৎসর্গ করেন তাঁর নিজের পাঁজরের হাড়। মহেশ্বর (শিব) ও নারায়ণের (বিষ্ণু) মিলিত ক্রোধ এক অগ্নিবলয় সৃষ্টি করে, যা থেকে সৃষ্টি হয় যজ্ঞ। সঙ্গে স্বয়ং ব্রহ্মার ক্রোধও আহুতি দেয় সে যজ্ঞে। দধিচির হাড়েই জ্বলে ওঠে যজ্ঞের হোমানল। মহামায়া দেবী অকালে জেগে ওঠেন, তাঁর অকাল বোধন হয় এই আশ্বিন মাসে। ত্রিলোকজয়ী মহিষাসুরকে বধ করতে তিনি তিনটি আলাদা অবতার বা ডেইটি ধারণ করেন – চণ্ডী, কালী ও দুর্গা।
সর্বশেষ দুর্গাবতার হন তিনি দশ হাত নিয়ে, যে দশটি হাতে থাকে প্রমুখ দেবতার দেওয়া দশটি অস্ত্র। মহাদেব শিব তাঁর নিজ ত্রিশূল তুলে দেন দুর্গার হাতে, যার তিনটি ফলা যথাক্রমে ধর্মজ্ঞান, আত্মমর্যাদা ও অন্ধকার-জয়ের প্রতীক। মহাদেব তাঁর কণ্ঠলগ্ন সর্পটিকেও প্রেরণ করেন দেবীর সঙ্গে, যা হলো চেতনা ও শক্তির প্রতীক। পিতৃদেব ব্রহ্মা তুলে দেন অর্ধপ্রস্ফুটিত পদ্ম; যা আধ্যাত্মিক জ্ঞানের প্রতীক। দেবরাজ ইন্দ্র তাঁকে দেন বজ্র; যা আত্মশক্তির প্রতীক। বিশ্বত্রাতা বিষ্ণু দেন সুদর্শন চক্র; যা বিশ্বসংসারের ওপর দেবীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হওয়াকেই নির্দেশ করে। পবনদেব ও সূর্যদেব দেবীকে দেন তীর ও ধনুক। তির ও ধনুক হল প্রাণশক্তির প্রতীক। ধনুক যেখানে সম্ভাব্য ক্ষমতাকে নির্দেশ করে এবং তীর নির্দেশ করে গতিময়তা।
অগ্নিদেব নিবেদন করেন তাঁর বর্ষা; যা ন্যায়পরায়ণ, পবিত্র এবং ভুল-সঠিকের পার্থক্যকারী হিসেবে দুর্গা’কে প্রতিষ্ঠিত করে। বিশ্বকর্মা তুলে দেন পরশু বা কুঠার; যা অশুভের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দুর্গতিনাশিনীর নির্ভীক চেতনাকে নির্দেশ করে। এবং গণেশদেব মা দুর্গাকে অসুরবধের যুদ্ধে আশীর্বাদ করেন তাঁর নিজ খড়্গ বা তলোয়ার নিবেদন করে, যা জ্ঞান ও ধীশক্তির প্রতীক। দশভূজার দশটি হাত সশস্ত্র হলে, মহিষাসুরের ধারণার বাইরে থেকে আবিভূত হন তাকে বধকারী, তার বিনাশকারী দুর্গাবতার, যিনি কোনো নারীর গর্ভজাত নন।
মহালয়ার মাধ্যমে শুরু হলো দেবীপক্ষের, অসুরবধের স্মারক বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় উৎসব। বিশ্বজুড়ে নানান-রূপে, নানাভাবে প্রতাপ বিরাজকারী অসুরদের বিনাশ হোক, শান্তি নেমে আসুক ধরিত্রী মা’র কোলে। সবাইকে শুভেচ্ছা।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক।
মড়ড়হলড়যহ১০০৬৭৮@মসধরষ.পড়স

 

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

বিজয়া দশমী: অসুরবধ ও মাতৃশক্তির বিজয়গাথা

আপডেট সময় : ০৪:৩৮:৪৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪

গুঞ্জন রহমান :বিশ্বসংসারে সর্বপ্রথম সৃষ্টি হয়েছে কী?
এক মহাচেতনা।
সেই মহাচেতনার নাম মহামায়া।
মহামায়া এক মহাজ্ঞান। মহান এক বোধ। চিন্তা। ধারণা। অসীম এক কৌতূহল। অনিঃশেষ এক স্পৃহা। বিজ্ঞান। সকল সৃজনশীলতার মূলে আছে এই মহামায়া। সনাতন ধর্মশাস্ত্রে এই মহামায়াকেই বলা হয় সৃষ্টির আদি সৃষ্টিকর্তা।
মহামায়া যখন চেতনা থেকে আকৃতি ধারণ করলেন, তখন তাঁর যে অবতার, সেটি হলো সরস্বতী। জ্ঞান, সংগীত, শিল্পকলা, বাক্য, প্রজ্ঞা ও বিদ্যার্জনের দেবী। এই দেবী যখন সৃষ্টির পরিকল্পনা করলেন, তখন তাঁর তিনটি সত্তা বিভক্ত হলো। তার কারণও ছিল। প্রথমে তিনি ব্রহ্মা; যার কাজ সব কিছু সৃষ্টি করা। যিনি সৃষ্টিকর্মে রত, তার প্রতিপালনের সময় কই? তাই ব্রহ্মা সৃষ্টি করলেন তাঁর দ্বিতীয় সত্তা বিষ্ণু। বিষ্ণুর কাজ প্রতিপালন করা। এবার, সৃষ্টি হচ্ছে, সৃষ্ট প্রাণীর প্রতিপালনও হচ্ছে, কিন্তু তার লয় করা তো চাই। ব্রহ্মা বললেন, যাকে নিজ হাতে গড়েছি, তাকে ধ্বংস করি কী করে? একই কথা বিষ্ণুর প্রতিপালকও তো পিতাই, পিতা হয়ে ধ্বংস করবো সন্তানকে? ফলে, মহামায়া গড়লেন স্রষ্টার তৃতীয় সত্তা শিব; যার কাজ সব সৃষ্টির লয় করা।
শিব একদম শুরু থেকেই লয়-ক্রিয়ায় মেতে উঠলেন। প্রলয়-নাচন নেচে ধ্বংস করে দিতে থাকলেন সব কিছু। তাতে দেখা দিলো আরেক দুর্বিপাক। কার কখন মৃত্যু, কে আগে যাবে, কে পরে যাবে– এসবের বাছবিচার করছেন না শিব, এভাবে তো চলতে পারে না। তখন মহামায়া ঠিক করলেন, শিবকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখতে হবে, যেন তিনি অতিরিক্ত কর্তব্যপরায়ণতা দেখাতে না পারেন। ফলে শিবকে দেওয়া হলো সিদ্ধি, যা তার চেতনাকে লুপ্ত করে রাখতে পারবে। কিন্তু তাতেও যখন কাজ হলো না, তখন তাকে সংসারী করার জন্য বিয়ে দিয়ে দিলেন পার্বতীর সঙ্গে। শিব-পার্বতীর সেই জুটি দেখে দেবী সরস্বতী এতই মুগ্ধ হলেন যে তাদের ঘরে তিনি কন্যারূপে জন্ম নেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলেন। ফলে পার্বতী, যিনি মহামায়ার প্রতিকৃতি (আইকন বা বিগ্রহ) সরস্বতীর মাতা হলেন, তিনি পেলেন দেবী ভগবতীর স্থান। এই ভগবতীই যখন অসুরবধের জন্য মর্ত্যে নেমে আসেন, তখন তিনি দুর্গা।
দুর্গাদেবীর বোধন হয় ঋতুরাজ বসন্তকালে, তখনই তাঁর অর্চনা হয়ে থাকে। কিন্তু রাবণবধের জন্য রাম যখন কোনোমতেই আর পেরে উঠছিলেন না, তখন তাঁর দেবী ভগবতীর শরণ নিতে হয়। না নিয়ে উপায় নেই, কারণ রামের সব অস্ত্র থেকে, সব কয়টা দুর্ভেদ্য বান থেকে রাবণকে যে সুরক্ষিত রাখছিলেন দেবী ভগবতী স্বয়ং। কেননা ব্রহ্মাণ্ডে রাবণের মতো দেবীভক্ত ব্রাহ্মণ আর একজনও ছিলেন না। কাস্ট সিস্টেমে দেখতে গেলেও রাম তাঁর নিচের স্তরে ছিলেন। কারণ রাম ছিলেন ক্ষত্রিয়, অপর দিকে রাবণ তো ব্রাহ্মণ। যা হোক, দেবী ভগবতীর সবচেয়ে বড় ভক্তকে বিনাশ করতে সেই ভগবতীরই শরণ চাইলেন রাম। এবং তার জন্য প্রয়োজন হলো অকালবোধনের। সেই অকালবোধন হলো শরৎকালে, আশ্বিন মাসে।
অকালে পিতৃগৃহে দেবীকে ফেরানোর জন্য যে যজ্ঞ, তার পৌরহিত্য করলেন কে? স্বয়ং রাবণ! কারণ ত্রি-সন্ধ্যা গায়ত্রী মন্ত্র জপ করা শুদ্ধতম কোনো ব্রাহ্মণকে দিয়েই কেবল এই যজ্ঞের পৌরহিত্য করানো যেত, নচেৎ দেবীর অকালবোধন হতে পারতো না। আর সেই শুদ্ধতম ব্রাহ্মণ রাবণ ছাড়া আর কেউ ছিলেন না ব্রহ্মাণ্ডে। রাম তাই বাধ্য হয়ে পৌরহিত্যের আমন্ত্রণ জানালেন রাবণকে এবং রাবণ তা গ্রহণও করলেন। তিনি বললেন, ‘আমি জানি এই পুজো সফল হলে আমি তোমার হাতে নিহত হবো। কিন্তু তবু আমাকে পুজো করতে হবে। কারণ, আমি ব্রাহ্মণ। আমন্ত্রণ পেলে ব্রাহ্মণের তা অগ্রাহ্য করার সাধ্য নেই।’ নিজের মৃত্যুর জন্য যে যজ্ঞ, সেই যজ্ঞের পৌরহিত্যের আমন্ত্রণও একজন শুদ্ধ ব্রাহ্মণ এড়াতে পারেন না! ফলে রাবণ যজ্ঞে বসলেন। কায়মনোবাক্যে উচ্চারণ করলেন সৃষ্টিজগতের সবচেয়ে শক্তিশালী মন্ত্র – ‘ইয়া দেবী, সর্বভুতেষু; মাতৃরূপেন সংস্থিতা।’
বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীরা যে দুর্গাপূজা করেন, সেটি মূলত রাম কর্তৃক রাবণবধেরই ভিন্ন সংস্করণ। ভারতজুড়ে এই রাবণবধের নাম দশেরা। দশ মাথাওয়ালা রাবণকে বধ করা। রাবণের দশ মাথাকে প্রতীক হিসেবে দেখানো হয় মনুষ্য সম্প্রদায়ের দশটি ত্রুটি হিসেবে, দশটি শত্রু হিসেবে। যদিও রামায়ণে রাবণের এই দশ মাথাকে দেখানো হয়েছে দশ রকমের শক্তি হিসেবে, যোগ্যতা হিসেবে, জ্ঞান ও বুদ্ধি হিসেবে অর্থাৎ ইতিবাচক অর্থে; যার আবাহনে দেবী ভগবতী মর্ত্যে এলেন, দশভূজা ‘শক্তিরূপেন সংস্থিতা’ হলেন, সেই রাবণকেই বধ করলেন তিনি। কেন? এবং তার জন্য রাবণই বা তাঁকে দোষারোপ করতে পারেন না কেন? কারণ দেবী আগেই তাঁকে সতর্ক করে রেখেছিলেন; যা কিছুই তুমি অর্জন করো না কেন একমুহূর্তে তা বালির বাঁধের মতো ধসে যাবে তোমার একটা মাত্র দোষে– অহঙ্কার! সেই অহঙ্কার তো রাবণের মধ্যে ছিল! ভরপুর ছিল। রাবণকে ধ্বংস করেছে তার অহঙ্কার, দেবী ভগবতীই বলুন আর অবতার রামই বলুনÑ তাঁরা তো নিমিত্ত মাত্র।
একইভাবে রাবণের বাঙালি সংস্করণ মহিষাসুরও বধিত হন দশভূজা দুর্গাদেবীর হাতে। মহিষাসুরের পিতা রম্ভ কঠোর তপস্যায় শিবের মন গলাতে পেরেছিলেন। শিব বলেছিলেন, অমরত্ব-বিনা যেকোনও বর চাও, দেবো। রম্ভ বললেন, অমরত্ব আমার চাই না। আমার কোনো বরই চাই না। কিন্তু আমার পুত্রের জন্য বর চাই। অন্য কোনো বর চাই না। অমরত্বের বরই চাই! শিব পড়ে গেলেন ধর্মসংকটে। বলেছেন রম্ভকে অমরত্ব দেবেন না, সে তো তা চাইছে না। বলেছেন রম্ভ যা চায়। তাই দেবেন। রম্ভ তো অমর-পুত্রের বর চাইছে! শেষে তিনি বর দিলেন, ত্রিলোকজয়ী পুত্র সন্তান তুই পাবি। কিন্তু মনে রাখবি, সেই পুত্রের অমরত্ব-বরও ঘুচে যাবে, যদি সে কোনো নারীকে অসম্মান করে। কারণ, কোনো নারীই হবে তার বিনাসের কারণ। সেই নারী, যে কারো গর্ভজাত নয়।
মহিষাসুরের জন্মকাহিনি বড় বিচিত্র। সে বিস্তার আজ নয়, অন্য কখনও করা যাবে। কেবল এটুকু বলি, তার পিতা রম্ভ কীভাবে শিবের কাছ থেকে তার জন্য ত্রিলোকজয়ী বর নিয়ে এসেছিলেন, সেই বরের শর্তই বা কী ছিল, এসব তিনি পরে জানতে পারেন তাঁর আজ্ঞাবহ পুরোহিতের যজ্ঞ হতে দিব্যজ্ঞানের মাধ্যমে। কিন্তু খুব সামান্য ঘাটতি থেকে যায় তাঁর জানায়। শর্তের শেষ বাক্য ছিল, ‘সেই নারী, যে কারও গর্ভজাত নয়’Ñ এ কথাটি তিনি এড়িয়ে যান। তিনি ধরে নেন, যেকোনও নারীই তাঁর হত্যাকারী হতে পারেন। তিনি শুরু করেন নির্বিচারে নারীদের বধ করতে। মর্ত্যে সৃষ্টি হয় ত্রাসের রাজত্ব। সর্বত্র অনাচার পাপাচারে ভরে যায়। মর্ত্যরে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ দশ জন মুনি দেবতাদের নিকট আহ্বান জানান প্রতিকারের, দেবাসন টলমল করতে থাকে মুনিদের হাহাকারে। আমূল কেঁপে ওঠে দেবলোক। দেবতারা সতর্ক করেন মহিষাসুরকে। মহিষাসুর তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হন না, একদম পরোয়া করেন না দেবতাদের; বরং সরাসরি আক্রমণ করে বসেন দেবলোকেই। কারণ তিনি যে স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল এই ত্রিলোকজয়ী!
দেবতারাও স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হলে সবাই মিলে আশ্রয় প্রার্থনা করেন, প্রতিকার দাবি করেন মহেশ্বর (শিব) ও নারায়ণের (বিষ্ণু) কাছে। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন মর্ত্যের ঋষিগণও। সকলে দাবি জানাতে থাকেন সর্বশক্তিধর, মাতৃশক্তির অধিকারিণী ভগবতীকে আকৃতি ধারণ করতে আহ্বান জানিয়ে যেন অবিলম্বে যজ্ঞ আয়োজন করা হয়। ভগবতীর জন্য দেবতারা নিজ নিজ অস্ত্র নিবেদন করতে থাকেন। মুনি দধিচির কোনো হাতিয়ার ছিল না, তিনি উৎসর্গ করেন তাঁর নিজের পাঁজরের হাড়। মহেশ্বর (শিব) ও নারায়ণের (বিষ্ণু) মিলিত ক্রোধ এক অগ্নিবলয় সৃষ্টি করে, যা থেকে সৃষ্টি হয় যজ্ঞ। সঙ্গে স্বয়ং ব্রহ্মার ক্রোধও আহুতি দেয় সে যজ্ঞে। দধিচির হাড়েই জ্বলে ওঠে যজ্ঞের হোমানল। মহামায়া দেবী অকালে জেগে ওঠেন, তাঁর অকাল বোধন হয় এই আশ্বিন মাসে। ত্রিলোকজয়ী মহিষাসুরকে বধ করতে তিনি তিনটি আলাদা অবতার বা ডেইটি ধারণ করেন – চণ্ডী, কালী ও দুর্গা।
সর্বশেষ দুর্গাবতার হন তিনি দশ হাত নিয়ে, যে দশটি হাতে থাকে প্রমুখ দেবতার দেওয়া দশটি অস্ত্র। মহাদেব শিব তাঁর নিজ ত্রিশূল তুলে দেন দুর্গার হাতে, যার তিনটি ফলা যথাক্রমে ধর্মজ্ঞান, আত্মমর্যাদা ও অন্ধকার-জয়ের প্রতীক। মহাদেব তাঁর কণ্ঠলগ্ন সর্পটিকেও প্রেরণ করেন দেবীর সঙ্গে, যা হলো চেতনা ও শক্তির প্রতীক। পিতৃদেব ব্রহ্মা তুলে দেন অর্ধপ্রস্ফুটিত পদ্ম; যা আধ্যাত্মিক জ্ঞানের প্রতীক। দেবরাজ ইন্দ্র তাঁকে দেন বজ্র; যা আত্মশক্তির প্রতীক। বিশ্বত্রাতা বিষ্ণু দেন সুদর্শন চক্র; যা বিশ্বসংসারের ওপর দেবীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হওয়াকেই নির্দেশ করে। পবনদেব ও সূর্যদেব দেবীকে দেন তীর ও ধনুক। তির ও ধনুক হল প্রাণশক্তির প্রতীক। ধনুক যেখানে সম্ভাব্য ক্ষমতাকে নির্দেশ করে এবং তীর নির্দেশ করে গতিময়তা।
অগ্নিদেব নিবেদন করেন তাঁর বর্ষা; যা ন্যায়পরায়ণ, পবিত্র এবং ভুল-সঠিকের পার্থক্যকারী হিসেবে দুর্গা’কে প্রতিষ্ঠিত করে। বিশ্বকর্মা তুলে দেন পরশু বা কুঠার; যা অশুভের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দুর্গতিনাশিনীর নির্ভীক চেতনাকে নির্দেশ করে। এবং গণেশদেব মা দুর্গাকে অসুরবধের যুদ্ধে আশীর্বাদ করেন তাঁর নিজ খড়্গ বা তলোয়ার নিবেদন করে, যা জ্ঞান ও ধীশক্তির প্রতীক। দশভূজার দশটি হাত সশস্ত্র হলে, মহিষাসুরের ধারণার বাইরে থেকে আবিভূত হন তাকে বধকারী, তার বিনাশকারী দুর্গাবতার, যিনি কোনো নারীর গর্ভজাত নন।
মহালয়ার মাধ্যমে শুরু হলো দেবীপক্ষের, অসুরবধের স্মারক বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় উৎসব। বিশ্বজুড়ে নানান-রূপে, নানাভাবে প্রতাপ বিরাজকারী অসুরদের বিনাশ হোক, শান্তি নেমে আসুক ধরিত্রী মা’র কোলে। সবাইকে শুভেচ্ছা।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক।
মড়ড়হলড়যহ১০০৬৭৮@মসধরষ.পড়স