নিজস্ব প্রতিবেদক: ‘সংস্কারে রাষ্ট্র কাঠামো পরিবর্তনে বিএনপি সচেতনভাবে সামনের দিকে এগোচ্ছে’ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘অনেকে আজকাল অনেক কথা বলছেন, সংস্কার হচ্ছে। সংস্কার তো আমরা অনেক আগেই থেকে উপলব্ধি করেছি। আমরা ২০১৬ সালে প্রথম ভিশন-২০৩০ দিয়েছি, যেখানে আমাদের সব পরিবর্তনের কথা, সংস্কারের কথা, আমরা প্রথম বিএনপির পক্ষ থেকে বলেছি। আমাদের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন।’
রোববার (২৭ জুলাই) এক সেমিনারে বিএনপি মহাসচিব এ মন্তব্য করেন। মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টার মিলনায়তনে ‘পদ্মা ব্যারেজ ও দ্বিতীয় পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন জাতীয় কমিটি’র উদ্যোগে এ সেমিনার হয়। সেমিনারে ‘ফারাক্কা ব্যারেজ ও বাংলাদেশের সংকট: পদ্মা ব্যারেজ ও বাংলাদেশের সম্ভাবনা’ নিয়ে একটি তথ্যচিত্র উপস্থাপন করেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক প্রকৌশলী আব্দুল ওয়াদুদ ভুঁইয়া। ‘দ্বিতীয় পদ্মা সেতুর আবশ্যিকতা নিয়ে একটি তথ্যচিত্র উপস্থাপন করেন প্রকৌশলী শহিদুল ইমাম।
অনুষ্ঠান শুরুতেই উত্তরায় বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনায় মাইলস্টোন স্কুলের শিক্ষার্থীসহ বিমানের পাইলট তৌকির ইসলামের মৃত্যুতে শোক প্রস্তাব উপস্থাপন করেন জাতীয় কমিটির মহাসচিব অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবু ওহার মো. হাফিজুল হক। ফখরুল আরো বলেন, ‘২০২২ সালে আমাদের নেতা তারেক রহমান সাহেব ৩১ দফা দিয়েছেন। সেই ৩১ দফাই আজকে কিন্তু সব সংস্কার বিষয়ক যে কমিটিগুলো হয়েছে-সেখানে সেই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা চলছে। সুতরাং, আমরা রাজনৈতিক দল হিসেবে আমরা অত্যন্ত সচেতন-জনগণের যেটা প্রয়োজন এবং কালের যুগের সঙ্গে সঙ্গে যে পরিবর্তনগুলো আনা দরকার, রাষ্ট্রকাঠামো পরিবর্তনের ব্যাপারে আমরা অত্যন্ত সচেতন। সচেতনভাবেই আমরা সামনের দিকে এগোচ্ছি।
জনগণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চায়: মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সব কিছুই নির্ভর করবে মানুষের ওপরে। আমরা ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করেছি, দেশ স্বাধীন করেছি, আমরা তারও আগে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন করেছি, ’৬৯-এ আন্দোলন করেছি এবং সবশেষে দীর্ঘ ১৫ বছর ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াই করে আমরা একটা জায়গায় পৌঁছেছি। এই জুলাই-আগস্ট মাসে একটা ভয়াবহ দানবীয় সরকারকে আমরা সরাতে সক্ষম হয়েছি। সুতরাং, আমরা পারি, আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকি আমরা পারি এবং আমার বিশ্বাস আগামীতেও আমরা পারবো।
একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে আমি এইটুকু বুঝি-আমার দেশের মানুষের পালস সেটা আমি বুঝি। আমার দেশের মানুষ ওপরে উঠতে চায়, উন্নতি চায়, একটা সত্যিকার অর্থেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চায় এবং সেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে কিন্তু সব বিষয়গুলোর সমাধানে পথ খুঁজে পাওয়া যাবে।
ফ্যাসিস্ট সরকার পতনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছিল, তাকে এগিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সেই জাতীয় ঐক্যকে সামনে নিয়ে আমরা যদি সবাই আমাদের মূল বিষয়গুলো সামনে আনতে পারি, সেগুলো নিয়ে যদি কাজ করি এবং আমাদের মধ্যে সেই ঐক্য যদি থাকে, তা নিঃসন্দেহে আমরা সফল হবো।
দ্বিতীয় পদ্মা সেতু: খালেদা জিয়ার কমিটমেন্ট আছে: ‘প্রায় আট কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা পদ্মা ব্যারেজ ও পদ্মা সেতুর সঙ্গে জড়িত। দীর্ঘ সাতবার সম্ভাব্যতা যাচাই হলেও এখন পর্যন্ত কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি, যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। আজকে ফারাক্কা ব্যারেজ বা ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাবে শুধু ফরিদপুর বা রাজবাড়ীর সমস্যা নয়-এটা আজকে পুরো দক্ষিণাঞ্চলের সমস্যা। আমাদের নাগরিকদের আজকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সর্বস্তরের মানুষকে তাদের দাবি নিয়ে দাঁড়াতে হবে। সেটা যে সরকারই আসুক তাদের বলতে হবে এটা আমরা চাই।
‘দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণে আমাদের দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার অনেক আগেই কমিটমেন্ট এবং আমরা রাজনৈতিক দল হিসেবে আমরা মনে করি, এসব অঞ্চলকে যেখানে জীবন-জীবিকার প্রশ্ন জড়িত আছে, মানুষের নিরাপত্তার প্রশ্ন আছে, যে প্রশ্নটা কিছুক্ষণ আগে আইনুন নিশাত সাহেব তুলেছেন-দক্ষিণাঞ্চলের বহু অংশ চলে যাচ্ছে, ছেড়ে যাচ্ছে, এসব এলাকায় মানুষের বসবাস উপযোগী থাকছে না। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু-এটা শুধু পরবর্তী সরকার নয়, জনগণকেও এ বিষয়ে সজাগ থাকা উচিত।
দেশ রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে: ব্র্যাকের চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে আছে। শুধু রাজনৈতিক কাঠামোর বিষয় নয়, আমাদের আগামীর রাজনীতির পথ চলার বৈশিষ্ট্য কী হবে, সেটাই এই মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেখানে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সুনির্দিষ্ট ও যোগ্য যে ভূমিকা-সেটা গুরুত্বপূর্ণ এবং কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাজনৈতিক শাসনগুলো পরিচালিত হবে এবং সেটা জনমানুষের মধ্যে তাদের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মিলিয়ে দৃষ্টি ভঙ্গিগুলো তৈরি হচ্ছে সেটাও দেখার বিষয়।
‘রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে আমরা যে একটা শব্দ ব্যবহার করি সার্বভৌমত্ব, এই সার্বভৌমত্ব শব্দটা সেই অর্থে মিনিংফুল হয়ে ওঠে-এটার জাতীয় জীবনে এর প্রয়োগটা কীভাবে, সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা? এটার অনুপস্থিতি আমরা দেখেছি বিগত বছরগুলোতে। এই যে সার্বভৌমত্বে, দক্ষ ও যোগ্য প্রয়োগটা, এটা সবার মাথার মধ্যে থাকা দরকার।
নতুন সরকারকে এখন থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে: সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘ফারাক্কার কারণে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ, কেউ বলে ৩৭ শতাংশ মানুষ-জমি প্রকটভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে-আমরা সবাই বুঝি কী হয়েছে? আমরা কাছে আশ্চর্য লাগছে, আইনুন নিশাত ভাইয়ের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে যে ৩০ বছরের (গঙ্গা চুক্তি) হয়েছিল-সেটি আগামী বছর শেষ হয়ে যাচ্ছে। আপনারা কি কেউ আলোচনা শুনেছেন, এই চুক্তিকে আগামী দিনে আমরা কী ধরনের দরকষাকষি করে আমার পক্ষে রাখার চেষ্টা করবো। সেটার কারিগরি এবং অন্যান্য ধরনের আলোচনা আমি শুনতে পাই না। আমি প্রত্যাশা করছি, আগামী বছর নতুন সরকার এলে পরে একটা যথোপযুক্ত বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষাকারী গঙ্গা চুক্তির আমাদের নিশ্চয়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে-কারিগরি পেশাগত দিক থেকে এবং রাজনৈতিক দিক থেকে যৌক্তিক আলোচনা করার মতো সক্ষমতা ওনাদের তৈরি করতে হবে আজকে থেকে। যাতে আগামী বছর যখনই এই আলোচনাটার সূত্রপাত হবে, আমরা যেন পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে ওখানে যেতে পারি।
পদ্মা ব্যারেজ প্রকল্প প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘যদি ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন হয়, যে সরকার আসবে সে বর্তমানে যেই বাজেটটি চলছে-সেই বাজেটটি তাকে সংশোধন করতে হবে, এটা প্রচলন আছে মার্চ-এপ্রিল মাসে। আমি আশা করবো, সেই সংশোধনের ভেতরে যেন এই প্রকল্পটিকে হালনাগাদ করার জন্য ব্যবস্থা করা হয়। নতুন সরকার আসলে পরে তাকে একটা মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। উচ্ছেদকৃত সরকার তারা অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা করেছিল, বর্তমান সরকার এসে ওটাকে স্থগিত করেছে। কিন্তু তারা কোনো মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা করেনি। আগামী সরকার যেটা আসবে, তার প্রথম কাজ হবে একটি মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা করা, বিনিয়োগ-কর্মসংস্থান ইত্যাদি বহুবিধ কাজে। আমি প্রত্যাশা করবো যে নতুন সরকার আসার পরে সংশোধিত বাজেটে যদি এই প্রকল্পটিকে পুনর্মূল্যায়নে আধুনিকায়নের অর্থ দেওয়া হয়-তাহলে প্রকল্প হিসেবে ওই মধ্যমেয়াদি নবম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা এবং ২০২৬-২৭ অর্থবছরে এই প্রকল্পটি যেন প্রকৃত অর্থায়নের জন্য সংযুক্ত হয় তালিকার ভেতরে।
পদ্মা ব্যারেজ প্রসঙ্গে: ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, ‘আমি আপনাদের বলতে চাচ্ছি- গঙ্গা ব্যারেজটা না হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ভবিষ্যৎ খুব খারাপ অবস্থায় যাবে। আপনারা নিজের দেশটাকে কতটুকু জানেন? জানেন না। সাতক্ষীরা-খুলনা-বাগেরহাট-বরগুনার দক্ষিণাংশে ইতোমধ্যে জনসংখ্যা গ্রোথ ইজ নেগেটিভ। মানুষ ওখান থেকে পালাচ্ছে? কারণ সেটা বসবাসযোগ্য নেই।
‘জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টা যোগ করলে এখন থেকে ৩০/৪০ বছরের ওই অংশগুলো বসবাসযোগ্য থাকবে না। কাজেই এখন থেকে যদি চিন্তা করতে হয়, তাহলে দক্ষিণ-পশ্চিমাংশকে পানি দিতে হবে। ভারতের সাথে চুক্তির ফলে ১৯৯৬ সাল থেকে আমরা যতটুকু পানি পাচ্ছি, তার কিছু অংশ ৩৫ হাজার কিউসেক পানি পাওয়ার কথা, তার থেকে ১৫ হাজারৃ আচ্ছা ১০ হাজার কিউসেক পানি যদি যশোর-খুলনায় দিতে পারি, তাহলে ওই এলাকাটা রক্ষা পাবে। এটা কেন হয়নি? এর একটাই উত্তর-এর পেছনে রাজনৈতিক শক্তি ছিল না। এটা মূলত সিদ্ধান্তটা হবে রাজনৈতিক ভিত্তিতে। তিনি বলেন, সেতু নির্মাণ করবেন? এটা হবে কী হবে নাৃ ১৮ আনাই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। আমরা এখানে যারা আছি আমরা কারিগরি বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাই। কিন্তু সিদ্ধান্ত আসে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছ থেকেই।
‘
পদ্মা ব্যারেজ ও দ্বিতীয় পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন জাতীয় কমিটি’র সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়মের সভাপতিত্বে এই সেমিনারে বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য মিজানুর রহমান মিনু, চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুল হান্নান চৌধুরী, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান, সাবেক প্রকৌশলী গিয়াস উদ্দিন, ‘পদ্মা ব্যারেজ ও দ্বিতীয় পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন জাতীয় কমিটি’র প্রধান সমন্বয়ক জাহাঙ্গীর হোসেন খান জালাল বক্তব্য রাখেন।