বিশেষ সংবাদদাতা : গত অগাস্ট থেকে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত সাড়ে চার মাসে বিএনপিসহ বিভিন্ন বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৬৭টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে আদালতে; সাজা হয়েছে হাজারের বেশি আসামির। বিশেষ করে গত ২৮ অক্টোবর নয়া পল্টনে সংঘাতের মধ্যে বিএনপির সমাবেশ প- হওয়ার পর থেকে বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা নিষ্পত্তির গতি বেড়েছে বলে আইনজীবীদের ভাষ্য।
৬৭টি মামলার মধ্যে শুধু গত নভেম্বরেই ৩৩টি মামলায় ৬১৫ জনের সাজা হয়েছে। এর বেশিরভাগই ২০১৩ ও ২০১৮ সালের মামলা; ২০১৫, ২০১৬ সালের মামলাও রয়েছে।
সর্বশেষ মঙ্গলবার রাজধানীর ভাটারা, ডেমরা, পল্লবী ও কামরাঙ্গীরচর থানার পৃথক চার মামলায় বিএনপি-জামায়াতের ৪৯ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজার রায় আসে।
সবমিলিয়ে ৬৭টি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অপরাধ, তথ্য ও প্রসিকিউশন বিভাগ থেকে রায় ও দ-িতের পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও বিএনপি সমর্থিত আইনজীবী ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর বিশ্লেষণ করে ওই তথ্য পাওয়া গেছে। বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের অভিযোগ, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ‘তড়িঘড়ি’ এসব মামলায় রায় দেওয়া হচ্ছে। তাদের প্রশ্ন, ২০১৩, ২০১৮ সালের মামলাগুলো এতদিন ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল কেন? এতদিন কেন রায়ের মুখ দেখেনি এসব মামলা? বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এসব মামলার অধিকাংশই বেআইনি সমাবেশ, পুলিশের কাজে বাধা, গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, হোতবোমা নিক্ষেপসহ নাশকতার বিভিন্ন অভিযোগে দায়ের করা হয়েছিল। রায় হওয়া কোনো মামলায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের কারাদ- হয়েছে ছয় মাস করে, কোনো মামলায় হয়েছে সাত বছর পর্যন্ত। তবে বেশির ভাগ মামলায় কারাদ- হয়েছে দুই থেকে তিন বছর করে। এক ব্যক্তির একাধিক মামলায় সাজাও হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় এ সময়ে আদালতের রায়ে তিন শতাধিক আসামি খালাসও পেয়েছেন। আইনজীবীরা বলছেন, বিএনপির রাজনীতিতে যারা সক্রিয়, তাদের সাজা হওয়ার ঘটনা বেশি। তালিকায় যেমন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা। সাম্প্রতিক সময়ে দ- পেয়েছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবীবুর রহমান, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান, তথ্যবিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী, স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক মীর সরাফত আলী, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্যসচিব রফিকুল আলম, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম, বর্তমান সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনামুল হক, বর্তমান সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকার ও ঢাকা মহানগর উত্তর যুবদলের সাবেক সভাপতি এস এম জাহাঙ্গীর। এছাড়া ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আবদুল কাদের ভূঁইয়া, রাজীব আহসান ও হাবিবুর রশীদ, সাবেক সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান প্রমুখ রয়েছেন দ-প্রাপ্তদের তালিকায়। বিএনপিপন্থি আইনজীবী আবুল কালাম খান বলেন, “বিএনপি এবং দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে আরও বেশ কিছু মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। গণসাজা দেয়ার জন্য যা করা দরকার সব করা হচ্ছে। ১৫-২০ দিনের মধ্যে আপনারা আরো রায় দেখতে পাবেন। “কিন্তু ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের আগে সব মামলার রায় লেখা শেষ করা যাবে না। যদিও সাজা হওয়া নেতাকর্মীদের পক্ষে আপিল তৈরি করা হচ্ছে। হাই কোর্ট বন্ধ হয়ে যাবে শিগগিরই। অবকাশকালীন বেঞ্চে আপিল জমা পড়বে।” বিএনপি সমর্থক আইনজীবীদের দাবি, বেশিরভাগ মামলাতেই সুনির্দিষ্টভাবে কোনো আসামির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের কোনো সাক্ষী আদালতে দাঁড়িয়ে ‘কিছু বলতে পারেননি’,তারপরও সাজা দেওয়া হচ্ছে। বিএনপির নেতাকর্মীদের বিভিন্ন মামলার আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, “২০১৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত মিথ্যা মামলা, গায়েবি মামলা দেওয়া হয়েছে বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। এখন বিরোধী দলকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার জন্য কৌশল হিসেবে এসব মামলার রায় দেওয়া হচ্ছে।” তিনি বলেন, “নিরপেক্ষ কোনো সাক্ষী আসছে না। পুলিশ সাক্ষীরাও সুনির্দিষ্টভাবে কোনো আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে ধরতে পারছেন না। তারপরও সাজা হচ্ছে। অর্থাৎ সরকার একটা স্কিম দিয়েছে যে, নির্বাচনের আগে যেনতেন প্রকারে সাজা দিতে হবে বিরোধী ফ্রন্টলাইনের লোকজনদের। নি¤œ আদালতে একটা সিন্ডিকেট তৈরি করেছে সরকার প্রহসনের এ স্কিম বাস্তবায়ন করার জন্য।” বিএনপপন্থি আইনজীবীর অভিযোগ নাকচ করে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবু বলেন, “এর আগেও এসব মামলার কোনো কোনোটিতে সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। প্রধান বিচারপতি মহোদয় পুরনো মামলার নিষ্পত্তি করতে বলেছেন, আর সে কারণেই পুরনো মামলা তাড়াতাড়ি শেষ করা হচ্ছে। নির্বাচনের সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই।” সাক্ষ্য নিয়ে আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদারের অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, “তখন সাক্ষী পাওয়া যায়নি। এখন সাক্ষী আসছে, সে কারণে বিচার তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে। শুধু পুলিশ সাক্ষী নয়, পাবলিক সাক্ষীদেরও আদালতে হাজির করা হচ্ছে। পুরনো মামলা নিষ্পত্তির জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে সাক্ষী হাজির করছে।” সাক্ষীদের সাক্ষ্য নিয়ে যাদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হচ্ছে, আদালত তাদেরই দ- দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।