নিজস্ব প্রতিবেদক: ‘এক এগারোর’ সঙ্গে যুক্ত করে বিএনপিকে ‘ভিন্ন শিবিরে ঠেলে দেওয়ার চক্রান্ত’ হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস।
তিনি বলেছেন, আমি স্পষ্টট করে বলতে চাই, বিএনপিকে যারা ভিন্ন শিবিরে ঠেলে দিয়ে ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করছেন, এর পরিণতি ভালো হবে না।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তার পাল্টায় সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, মির্জা ফখরুলের ‘নিরপেক্ষ’ সরকারের দাবি আরেকটা ‘এক এগারো সরকার গঠনের ইঙ্গিত’ বহন করে।
শুক্রবার (২৪ জানুয়ারি) এক দোয়া মাহফিলে নাহিদ ইসলামের মন্তব্যের জবাব দিয়ে মির্জা আব্বাস বলেন, এক এগারো নয়, যদি আপনারা এই ৫ আগস্টের পরে এই ধরনের কথা-বার্তা, সংঘাত-বিভেদ সৃষ্টির কথা বলতে থাকেন, তাহলে কিন্তু গণতন্ত্রের চেহারা কোনোদিন দেখবেন না। আমি বলব, এই বিভেদ-বিভ্রান্তি সৃষ্টি না করে দেশটাকে ঐক্যবদ্ধ রাখার চেষ্টা করেন।
৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক নাহিদ ইসলাম বৃহস্পতিবার বিকালে তার ফেইসবুক পোস্টে লিখেছিলেন, ছাত্ররাই এ সরকারের এবং বিদ্যমান বাস্তবতার একমাত্র ফ্যাক্টর, যেটা ১/১১ এর সরকার থেকে বর্তমান সরকারকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা করে। বিএনপি কয়েক দিন আগে ‘মাইনাস টু’ এর আলোচনা করলেও এখন ক্ষমতায় যাওয়ার পথ সুগম করার জন্য নিরপেক্ষ সরকারের নামে আরেকটি ১/১১ সরকারের প্রস্তাবনা করছে।
এ ধরনের পরিকল্পনা ‘গণতন্ত্র ও জাতীয় স্বার্থের’ বিরুদ্ধে যাবে এবং ছাত্র-জনতা কোনোভাবেই তা মেনে নেবে না মন্তব্য করে নাহিদ বলেন, আমি মনে করি এটা বিএনপির বিরুদ্ধেও ষড়যন্ত্র।
তার ওই বক্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে মির্জা আব্বাস শুক্রবার বলেন, আজকে বহু মত, বহু পথ, বহু টেলিভিশন, বহু সংবাদপত্র আর ইদানিং কথা বলার সুযোগ পেয়ে বহু কথা বিএনপির বিরুদ্ধে, আমাদের দলের বিরুদ্ধে বলছে। আমাদের দুয়েকজন নেতা তার নিজ দায়িত্বে দুয়েকটা কথা বলে থাকতে পারেন হয়ত কোথাও, আমি ঠিক শুনি নাই, আমি দেশের বাইরে ছিলাম। ইদানিং দেখলাম, বহু লোক বহুভাবে কথা বলছেন। কি বলছে? কেউ বলছে, বিএনপি নাকি ওয়ান ইলেভেন আনার পাঁয়তারা করছে।
তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, ২০০৭ সালের এক এগারোর ভয়াবহ পরিণতি– এটা বিএনপির চাইতে কেউ বেশি ভোগ করে নাই। বিএনপির প্রতিটি নেতা-কর্মী, সাধারণ কর্মী থেকে শুরু করে আমাদের দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া পর্যন্ত ওই এক এগারোর ষড়যন্ত্র থেকে রেহাই পায় নাই। তাকে নির্মমভাবে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে।’
উপদেষ্টা নাহিদের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানানোর পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীরও সমালোচনা করেন মির্জা আব্বাস। তিনি বলেন, একটা দল আছে যেটার নাম বলব না। ওই যে বলে না, গাছে কাঁঠাল, গোঁফে তেল… ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছে।
এবং তারা এমনভাব করছে যে তারা যেন কিছুই জানেন নাৃ ভাজা মাছটিও উল্টে খেতে জানে না। না জেনে পুট করে বিএনপি সম্পর্কে দুই-একটা কথা বলে ফেলেন। যাই হোক, আমি কারো সমালোচনা করব না।
মির্জা আব্বাস বলেন, আজকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, হঠাৎ করে যেমন নতুন মুখে কথা ফুটলে বাচ্চারা যেভাবে কথা বলেন নাৃ আবোল-তাবোল প্রলাপ বকতে থাকে। অনেক দল, অনেক ব্যক্তি, যারা আজকে কথা-বার্তা বলছেন, এমনভাবে কথা-বার্তা বলছেন যে– আমি মাঝে মাঝে হঠাৎ যথন সুযোগ হয় টেলিভিশনে দেখি, উনাদের কথা-বার্তায় মনে হয় বিএনপি যেন আওয়ামী লীগের দোসর। বিএনপিকে আওয়ামী শিবিরের দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, নিজের চেহারা আয়না দিয়ে দেখুন, নিজের অন্তরটা আয়না দিয়ে দেখুন। দেশবাসীকে আর ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করবেন না।
তিনি বলেন, বিএনপি ১৭ বছর রাজপথে লড়াই করেছে, এখনো যারা এখানে আছেন, আমাদের রিজভীসহ (রুহুল কবির রিজভী), রিজভীতো পঙ্গু হয়ে গেছে, অকালে মৃত্যু হয়ে গেছে ছেলেটার। এবং আমার নিজের পরিবারের কথা যদি বলি, আমার জেল হয়েছে ১১ বছর, আমার স্ত্রীর জেল হয়েছে ১৬ বছর, আমার ছোট ভাইয়ের (মির্জা খোকন) ৮ বছর জেল হয়েছে; ১৭ বছর বিদেশে থেকে আজকে বাংলাদেশে ফেরত এসেছে। এই নিপীড়ন শুধু আমার পরিবার নয়, বাংলাদেশের প্রতিটি বিএনপির নেতা-কর্মীর ওপর এই নিপীড়ন হয়েছে।
আজকে আমাদেরকে ঠেলে দিতে চাচ্ছেন অন্য শিবিরে। উদ্দেশ্যটা কী? আওয়ামী লীগের সিল মারতে চান? আমাদেরকে তাড়াতে চান? এই কথা কখনো চিন্তাও করবেন না। এদেশের অতন্দ্র প্রহরী ছিলেন রাষ্ট্রপতি জিয়্উার রহমান, এদেশের স্বাধীনতার অতন্দ্র প্রহরী ছিলেন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, এদেশের অতন্দ্র প্রহরী আমার এই দলের নেতা-কর্মী ভাইয়েরা স্বাধীনতা-সার্বভ্মৌত্বের জন্য।
বিএনপির ব্লগার ভাইদের অনুরোধ: মির্জা আব্বাস বলেন, অনেক বলেন, বিএনপি শুধু নির্বাচন নির্বাচন করে। আরে ভাই নির্বাচন নির্বাচন করি না। কিছু কিছু বিএনপির ব্লগার ভাইয়েরা আছেন, বিদেশ থেকে দেশ পরিচালনার চেষ্টা করেন। আপনারা যা বলেন, মনে হয় তাই হতে হবে দেশে।
আরে ভাই, আপনাদের প্রতিটা মানুষকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি, আপনারাও আমাদেরকে চেনেন। আপনারা জ্ঞান-গরিমায় যথেষ্ট উন্নত, অনেক লেখাপড়া আপনারা করেন। কিন্তু এই সমস্ত জ্ঞান-গরিমা-গুণ, এই সমস্ত বুদ্ধি বলে এমন কিছু করবেন না, যাতে জাতির মধ্যে একটা বিভেদ সৃষ্টি হয়। দয়া করে দেশে শান্তি আনার চেষ্টা করেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই নেতা বলেন, আপনারা কথা বলতে জানেন, আপনাদের বুদ্ধি আছে। আপনাদের বুদ্ধি প্রজ্ঞা দেশ গঠনের কাজে লাগান। বিএনপিকে দোষারোপ কইরেন না।
কারণ এদেশের স্বাধীনতার জন্য শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জীবন দিয়েছেন, এদেশের স্বাধীনতার জন্য শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের পরিবারের চরম ক্ষতি হয়েছে, এদেশের স্বাধীনতার জন্য বিএনপির সকল কর্মী বাহিনী আজকে ধ্বংস হওয়ার পথে। সুতরাং বিএনপির মত দেশপ্রেমিক একটি দল বাংলাদেশে এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয় নাই, নতুন করে কখনো হবে কিনা আমি জানি না।
নতুন দল হলে বিএনপি স্বাগত জানাবে: মির্জা আব্বাস বলেন, অনেকে বলেন, নতুন একটা দল হচ্ছে বিএনপি নাকি জেলাস করছে। এই কথা যারা বলেন, তারা জাতির শত্রু। নতুন দল হবে কিংবা হবে না সেটা যারা করবে, তাদের ওপর নির্ভর করে।
দল ঘোষণা হওয়ার পরে বিএনপির ভূমিকা কী হবে সেটা দেখবেন। আমরা নতুন দল হলে স্বাগত জানাই। যারা দল করবেন তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দেশটাকে পরিচালিত করবেন, আমরা সরে যাব প্রয়োজন পড়লে। কিন্তু ওই রকম উল্টা-পাল্টা কথা-বার্তা বলে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবেন না।
তিনি বলেন, বিএনপি গণতান্ত্রিক দল, আমরা গণতন্ত্রের কথা বলেছি। ১৭ বছর রাজপথে লড়াই করেছি। আজকে অনেকে বলেন, ৫ আগস্ট যারা এনেছে, তারা সকল কিছুর অধিকার রাখে। ঠিক আছে, অস্বীকার করব না। কিন্তু আমরা যারা ১৭ বছর রক্ত দিলাম, আমাদের ঘর পুড়ল, আমাদের সংসার পুড়ল, তাদের কী হবে?
আমাদের ইলিয়াস আলী গুম হল, আমাদের চৌধুরী আলম গুম হল, আমাদের ৫ হাজার লোক গুম হয়ে গেল, আমাদের হাজার হাজার কর্মী জেল খাটল, এখানে (দোয়া মাহফিলে) যারা আছেন, সবাই কমবেশি জেল খেটেছি; তাহলে আমার কী কোনো অবদান নাই?
মির্জা আব্বাস বলেন, একজনের অবদানকে স্বীকৃতি দিতে গিয়ে অন্যদের অবদানকে অস্বীকার করার ফয়দা বাংলাদেশে নাই। যারা চেষ্টা করেন, তারা অপচেষ্টাই করছেন। যারা চেষ্টা করেন, তারা জাতির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছেন।
খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এই দোয়া মাহফিল হয়। ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি মালয়েশিয়ায় থাকা অবস্থায় হৃদরোগে মারা যান জিয়াউর রহমানের ছোট ছেলে কোকো। দিনটি উপলক্ষে সকালে বনানী কবরাস্থনে কোকোর কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বিএনপি নেতা-কর্মীরা। দুপুরে নয়া পল্টনে হয় দোয়া মাহফিল।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, কেন্দ্রীয় নেতা মীর সরাফত আলী সপু, আসাদুল করীম শাহিন, আবদুল কাদির ভুঁইয়া জুয়েল, মহানগর বিএনপি দক্ষিনের রফিকুল আলম মজনু, স্বেচ্ছাসেবক দলের এসএম জিলানি, রাজিব আহসানও দোয়া মাহফিলে উপস্থিত ছিলেন।