ঝালকাঠি প্রতিনিধি : ঝালকাঠিতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের স্বজনদের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। জেলা সদর হাসপাতাল ও আশপাশের এলাকায় স্বজন হারানোর শোকে অনেককে বিলাপ করতে দেখা গেছে। গোটা হাসপাতালে শোকের পরিবেশ বিরাজ করছে। সাগর নামের নিহতের এক স্বজন জানান, ৮ বছর বয়সী ছেলে নাইমকে ডাক্তার দেখাতে বরিশালের বাসে ওঠেন বড় ভাই তারেক (৪০)। পথে ধীরগতিতে গাড়ি চালিয়ে যাত্রী সংগ্রহে নির্ধারিত সময়ের অধিকাংশই শেষ হয়ে যায়। পরে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে ছত্রকান্দায় পৌঁছালে গতি না কমিয়ে একটি অটোরিকশাকে সাইড দিতে গেলে গাড়িটি উল্টে পুকুরে পড়ে যায়। সেখান থেকে ১৭ জনকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করে সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। এদের মধ্যে বড় ভাই তারেক মারা গেলেও নাইমকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে সদর হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। তিনি জানান, ভাইয়ের শোকে পুরো পরিবার এখন মুহ্যমান। পরিবারের উপার্জন করার মতো একমাত্র ব্যক্তিকে হারিয়ে শোকে পাথর পরিবারের সদস্যরা। আরেক স্বজন জানান, ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার বলাইবাড়ি এলাকার বাবার বাড়ি থেকে বরিশালের হিজলা উপজেলার শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন আইরিন (২৬)। সঙ্গে দেবর নয়ন (১৫) ও একবছর বয়সী শিশুকন্যা নিপা। বাসটি দুর্ঘটনায় পতিত হলে তিনজনই মারা যান। হাসপাতালের বারান্দায় বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন আইরিনের মা নুরনেহার বেগম। তাদের আহাজারিতে হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকা ভারী হয়ে উঠছে। এর আগে শনিবার (২২ জুলাই) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঝালকাঠি সদর উপজেলার ছত্রকান্দা এলাকায় একটি অটোরিকশাকে সাইড দিতে গিয়ে বাস পুকুরে পড়ে ১৭ জন নিহত হন।
ভাই-বোন-ভাগনি হারিয়ে পাগলপ্রায় রুবেল: বরিশালের বাসিন্দা রিপনের স্ত্রী আইরিন আক্তার বেড়াতে এসেছিলেন বাবার বাড়ি ঝালকাঠিতে। বাবার বাড়ির ছুটি কাটিয়ে তিনি দুই বছরের মেয়ে রিপাকে নিয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন শ্বশুর বাড়ি। এ সময় বোন ও আদুরে ভাগনিকে বরিশালের লঞ্চে তুলে দিতে যান নয়ন (১৬)। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে রাজাপুর থেকে বরিশালগামী বাশার স্মৃতি বাসটিতে ওঠেন তারা তিনজন। কে জানতো, এটিই তাদের শেষ যাত্রা হবে। দুর্ঘটনার কিছুক্ষণ পর খবর পেয়ে প্রথমে বড় ভাই রুবেল ছুটে যান ঘটনাস্থল ছত্রকন্দায়। কিন্তু সেখানে না পেয়ে আইরিনের সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোন দেন, তখন ফোনটি বন্ধ পান তিনি। এরপর ছুটে আসেন ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে। সেখানেই তিনজনের লাশ খুঁজে পান ১৭ জনের মধ্যে। আত্মার ধন তিনজনের লাশ একসঙ্গে দেখে পাগলপ্রায় রুবেলের গগন বিদারী আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে সদর হাসপাতাল। রুবেল কান্নারত অবস্থায় বলেন, ‘তোগোর এইটাই শ্যাষ বিদায় বুঝলে যাইতে দিতাম না। এ্যা কি হইলো রে….আল্লাহ….আমাগোর সব শ্যাষ কইরা দিয়া গ্যালা।’ পাশেই বারবার মুর্ছা যাচ্ছেন তার আরেক ভাই। রুবেল বলেন, ‘বোন আইরিনকে লঞ্চে তুলে দিয়ে ফিরে আসার কথা ছিল ছোট ভাই নয়নের। দুই বছরের রিপামনি খুব দুষ্ট। আমার বোন একা সামলাতে পারছিলো না বলে নয়নও পৌঁছে দেওয়ার জন্য যায়। কিন্তু কতক্ষণ পর শুনি বাস অ্যাকসিডেন্ট করছে। তহন মনে কামড় দিছে। খোঁজ লইয়া দেহি যে বাসে মোর ভাই-বুইন-ভাগনি তুইল্লা দিছি হেইডাই পড়ছে। দৌড়াইয়া গ্যালাম। খালি দেহি বাসের মধ্যে দিয়া লাশ উডায়। আমি বুঝছিলাম আমার ভাই-বুইন-ভাগনিরে আল্লাহ বাঁচাইছে। কিন্তু না হ্যাগোরে আগেই লইয়্যা গ্যাছে। এহন মোর মায়ের ধারে কি জবাব দিমু।’
উল্লেখ্য, ভান্ডারিয়া থেকে বাশার স্মৃতি পরিবহণ যাত্রী নিয়ে বরিশালের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে ১০টার দিকে। ঝালকাঠি সদর উপজেলার ছত্রকান্দা নামক এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পুকুরের মধ্যে পড়ে যায় বাসটি। এতে এখন পর্যন্ত ১৭ জন নিহত ও ৩৫ জন আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন রয়েছে। নিহতদের মধ্যে ১৫ জন হলেন- তারেক রহমান, ছালাম মোল্লা, খাদিজা বেগম, খুশবু আক্তার, আবুল কালাম হাওলাদার, রিপা মনি, আইরিন আক্তার, নয়ন, রাবেয়া বেগম, সালমা আক্তার মিতা, সাদিয়া আক্তার, শাহীন মোল্লা, সুমাইয়া, আব্দুল্লাহ ও রহিমা বেগম। বাকি দুই জনের পরিচয় এখনো শনাক্ত হয়নি। দুর্ঘটনায় ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক ফারাহ গুল নিঝুম।
বাস পুকুরে পড়ে ১৭ যাত্রী নিহত স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হাসপাতালের পরিবেশ
জনপ্রিয় সংবাদ