ঢাকা ০৬:২৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৪ মে ২০২৫

বাসে নৈরাজ্য চলছেই : এখনও চলছে সিটিং সার্ভিস, নেওয়া হচ্ছে বাড়তি ভাড়া

  • আপডেট সময় : ০২:১০:১৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ নভেম্বর ২০২১
  • ৭৪ বার পড়া হয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক : জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর বাসের ভাড়াও বাড়ানো হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে রাজধানীতে যাত্রীদের হয়রানি ঠেকাতে সিটিং সার্ভিস বন্ধ করা হয়। গণপরিবহন যেন বর্ধিত ভাড়ার অতিরিক্ত আদায় না করে সে বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়। গতকাল সোমবার রাজধানী ঘুরে দেখা গেছে, কিছু কিছু বাস এই নিয়ম মানলেও এখনও অনেক বাস সিটিং সার্ভিস চালু রেখেছে এবং যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় করছে।
এদিন সকালে দিশারী পরিবহনের একটি বাসে ওঠেন এই প্রতিবেদক। গন্তব্য রাজধানীর মিরপুর ১ নম্বর থেকে প্রেস ক্লাব। বাসে ওঠার আগে হেলপারকে ভাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রেস ক্লাব পর্যন্ত ৩০ টাকা। পরে বাসে উঠে চার্ট খুঁজে দেখা যায়, মিরপুর ১ নম্বর থেকে প্রেস ক্লাবের নতুন ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ২৪ টাকা।
গেটলক সিটিং সার্ভিসের কথা বললেও মিরপুর ১ নম্বর থেকে বাস ছাড়ার কিছুক্ষণ পর পর রাস্তায় যাত্রী ইশারা করলেই ব্রেক চাপছেন চালক। রাস্তা থেকে তোলা হচ্ছে যাত্রী। টেকনিক্যালের পার বাসের যাত্রী সংখ্যা গুনে ওয়েবিলে সিগনেচার করেন এক ব্যক্তি। তাকে হেলপার দেন ১০ টাকার একটি নোট। তারপর শুরু হয় হেলপারের যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া নেওয়ার কাজ। ভাড়া নিতে নিতে কল্যাণপুর যেতে না যেতেই রাস্তার মাঝখান থেকে আরও যাত্রী তোলা হয়। কল্যাণপুরে কিছুটা অপেক্ষার পর শ্যামলী গিয়ে আবারও যাত্রীর অপেক্ষা। এরমধ্যেই শুরু হয় চালককে উদ্দেশ করে যাত্রীদের কথাবার্তা। গেটলক সার্ভিসের কথা বলে এখন কী সার্ভিস দেওয়া হচ্ছে, এমন প্রশ্ন যাত্রীদের।
সাজ্জাদ নামের এক যাত্রী বলছিলেন, ‘ভাবলাম একটু আগে যাওয়ার জন্য বাড়তি টাকা দিয়ে উঠলাম। এখন দেখি যেই লাউ সেই কদু। এরা কখনও মানুষ হবে না।’ তিনি বলেন, ‘দায়িত্বরত বিআরটিএ চেয়ারম্যানকে শুধু টেলিভিশনের সামনে কথা বলতেই দেখি।’ মোতাহার নামের এক যাত্রী বলেন, ‘পরিবহন মালিকদের নৈরাজ্যের বিষয়ে কার্যকর কোনও উদ্যোগ নিতে পারছে না বিআরটিএ।
বাস আসাদগেট-আড়ং সিগন্যালে দাঁড়িয়ে। সেখান থেকেও তোলা হলো আরও দুজন যাত্রীকে। যাত্রীর ওঠানোর পর আবারও বাকি যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া তোলা শুরু করলেন হেলপার। ধানমন্ডি ২৭-এ নেমে গেলেন দু’জন। সেখান থেকে যাত্রী তুললেন তিন জন। যে দুজন নেমে গেলেন তাদের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে জনপ্রতি ৩০ টাকা করে।
বাসযাত্রী কাইয়ুম বলছিলেন, ‘গতকাল থেকে তো রাজধানীতে কোনও সিটিং সার্ভিস নেই। তোমরা কেমনে চালাও।’ এই প্রশ্নের জবাবে ভাড়া তুলতে আসা হেলপার বলেন, ‘সব মালিকরা জানেন। আমাদের করার কিছু নেই। আপনার না পোষালে আপনি নেমে যেতে পারেন।’
আড়ং সিগন্যাল থেকে ওঠা দুজন নামবেন সায়েন্স ল্যাব। তাদের কাছ থেকেও ভাড়া চাওয়া হয় জনপ্রতি ৩০ টাকা করে। তাদের সঙ্গে তর্কাতর্কির একপর্যায়ে যাত্রীরা চার্ট দেখতে চাইলে গাড়ির জানালায় ঝুলানো চার্ট দেখতে বলেন হেলপার। সেখানেও দেখা যায়, গাড়িটিকে মিরপুর ১ নম্বর থেকে ফার্মগেট হয়ে গুলিস্তান যাওয়ার কথা থাকলেও রুট পরিবর্তন করে মিরপুর ১ থেকে কলাবাগান-সাইন্সল্যাব-শাহবাগ হয়ে গুলিস্তান যাচ্ছে। টানানো রয়েছে মিরপুর ১, ফার্মগেট, গুলিস্তানের ভাড়ার চার্ট।
গাড়ির চার্ট এবং রুড পরিবর্তন হওয়ার বিষয়টি জানতে চাইলে দিশারী পরিবহনের চালক আশিক বলেন, ‘এটা মালিকরা ম্যানেজ করেছেন। আমরা শুধু গাড়ি চালাই। আমাদের চালাতে বলা হয়েছে। আমরা আর কিছু জানি না।’
বাস থেকে নেমে যাওয়ার সময় রফিকুল ইসলাম নামের এক যাত্রী বলছিলেন, ‘তোরা কি তোদের আচরণ ভালো করবি না। লোকজনের কাছ থেকে এভাবেই বাড়তি টাকা নিবি গেটলক সার্ভিসের কথা বলে?’
শ্যামলী থেকে ধানমন্ডি ৩২ যাওয়ার জন্য বাসে ওঠেন খাইরুল। তিনি বলেন, ‘যেখানে আগে বাস ভাড়া ছিল ১০ টাকা, এখনও অনেক পরিবহন সিটিং সার্ভিসের নামে ২০ থেকে ৩০ টাকা আদায় করছে। এই এলাকায় বিআরটিএ’র কোনও অভিযান তো চোখে পড়লো না।’
কলাবাগান মোড়ে নেমে গেলেন কয়েকজন যাত্রী। এখান থেকে ওঠানো হলো আরও কয়েকজন যাত্রীকে। সায়েন্স ল্যাব মোড়ে আরও কয়েকজন যাত্রী নেমে যাওয়ায় যাত্রীর জন্য আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন বাসচালক। বাসে অবস্থানরত যাত্রীদের কিছুটা উত্তেজিত আচরণের কারণে লেগে যায় চালকের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক। একপর্যায়ে চালক বাধ্য হয়ে থেমে থাকা গাড়িটি চালানো শুরু করেন। শাহবাগ মোড়ে পৌঁছালে আবারও চলে ওঠানো-নামানোর কাজ। মৎস্য ভবন পার হয়ে প্রেস ক্লাবের সামনে নেমে যাই। আর বাসটি তখন মতিঝিলের দিকে ছুটে চলে।
সিএনজিচালিত বাসেও বাড়তি ভাড়া : সিএনজিচালিত বাসেও নেওয়া হচ্ছে বাড়তি ভাড়া। বাসের সামনে সিএনজিচালিত স্টিকার লাগানো থাকলেও তোয়াক্কা না করে হেলপাররা বাড়তি ভাড়া আদায় করছেন বলে অভিযোগ যাত্রীদের। এসব অরাজকতা ঠেকাতে বিআরটিএ’র ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে রয়েছে। করা হচ্ছে জরিমানা। তারপরও থামছে না নৈরাজ্য।
আজিমপুর থেকে ছেড়ে আসা আশীর্বাদ পরিবহনে সিএনজি চালিত স্টিকার থাকার পরও যাত্রীদের কাছ থেকে মিরপুর ১ নম্বর পর্যন্ত ভাড়া নেওয়া হয়েছে ২০ টাকা। বাসের যাত্রী আলমগীর বলেন, ‘আমি একসময় হেলপারকে বলেছিলাম, সিএনজিচালিত বাসে বাড়তি ভাড়া কেন? হেলপার বলেন, ‘২০ টাকা দিতে হবে। কমে হবে না। কী আর করা, চার টাকার জন্য আর কিছু বলিনি।’
এদিকে, বিআরটিএ’র ভ্রাম্যমাণ আদালতে আশীর্বাদ পরিবহনের বাসটিকে বাড়তি ভাড়া নেওয়ার অভিযোগে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এ সময় ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট ফখরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য ঠেকাতে বিআরটিএ ম্যাজিস্ট্রেটরা মাঠে রয়েছেন। যেসব বাসে অনিয়ম পাওয়া যাচ্ছে, সেসব বাসকে আমরা আইনের আওতায় এনে জরিমানা করছি। অভিযানে দেখা যায়, অনেক সিএনজি বাস নতুন নির্ধারিত চার্জ অনুযায়ী ভাড়া আদায় করছেন; যা ঠিক নয়। কারণ, সিএনজিচালিত কোনও বাসের ভাড়া বাড়েনি।
পরিবহন মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘যা বাড়তি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে, তা হেলপার ও চালকরা নিচ্ছেন। এ বিষয়গুলো আমরা নজরে রাখছি। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া বাসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’ বাড়তি ভাড়া নেওয়ার বিষয় অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘যদি কেউ নিয়ে থাকে বাড়তি ভাড়া তাহলে তাদের চিহ্নিত করে কয়েক দিনের মধ্যেই আমরা এসব বন্ধ করে দিতে সক্ষম হবো।’
লেগুনা-অটোরিকশার ভাড়া নির্ধারণের দাবি যাত্রীকল্যাণ সমিতির : হিউম্যান হলার, লেগুনা, অটো-টেম্পু, অটোরিকশা, প্যাডেলচালিত রিকশা ও মোটরসাইকেলসহ সব ধরনের পরিবহনে ভাড়া নির্ধারণের দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষিতে সিএনজি, ডিজেল, পেট্রোল ও অকটেনচালিত সকল প্রকার বাস-মিনিবাসের পাশাপাশি এসব পরিবহনে বেশি মাত্রায় ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। সেজন্য এসব যানে পৃথক পৃথক ভাড়া নির্ধারণ করতে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর কাছে দাবি জানিয়েছে সমিতি।
গতকাল সোমবার সকালে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের দপ্তরে জমা দেওয়া এক স্মারকলিপিতে এই দাবি জানায় সংগঠনটি।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরীর সই করা স্মারকলিপিতে বলা হয়, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষিতে সরকার শুধুমাত্র ডিজেলচালিত বাস-মিনিবাসের ভাড়া বাড়ায়। কিন্তু বাসে ভাড়া বৃদ্ধির আদেশ জারির সঙ্গে সঙ্গে সিএনজি, ডিজেল, পেট্রোল ও অকটেনচালিত সকল প্রকার বাস-মিনিবাসের পাশাপাশি হিউম্যান হলার, লেগুনা, অটো-টেম্পু, অটোরিকশা, প্যাডেলচালিত রিকশা ও মোটরসাইকেলসহ সব ধরনের পরিবহনে অতিরিক্ত মাত্রায় বর্ধিত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।
সংগঠনের গণপরিবহনে ভাড়া নৈরাজ্য পর্যবেক্ষণ উপ-কমিটির সদস্য ও সারাদেশে সংগঠনের নেতা-কর্মীরা ভাড়া নৈরাজ্য ও যাত্রী ভোগান্তি সব দিক পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পেয়েছে যে, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির পর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহানগরীসহ দেশব্যাপী চলাচলরত সিএনজিচালিত হিউম্যান হলার, লেগুনা এবং সিএনজি অটোরিকশায় অস্বাভাবিকহারে বর্ধিত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য চালাচ্ছে।
সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ অনুযায়ী সব গণপরিবহনের ভাড়া সরকার কর্তৃক নির্ধারণ করে দেওয়ার ক্ষমতা থাকলেও সরকার এসব পরিবহনের ভাড়া নির্ধারণ না করায় যে যার ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করছে। সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা না থাকায় যাত্রীসাধারণ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আইনের আশ্রয় লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের প্রতিবাদ করলে পরিবহন শ্রমিকদের হাতে যাত্রীরা নাজেহাল হচ্ছে। এসব গাড়িতে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা না থাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও যাত্রীদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। প্রায় এক দশক ধরে এসব যানবাহনের ভাড়া নির্ধারণের জন্য বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে বেশ কয়েক দফা সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কাছে আবেদন করা হলেও সরকার ভাড়া নির্ধারণ করেনি। গণমাধ্যমে এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলে ফাইল একটু আগায় আবার গণমাধ্যমে নিউজ করা বন্ধ হলে ফাইল আবার ডিপ ফ্রিজে ঢুকে পরে বলে স্মারকলিপিতে বলা হয়। এছাড়াও যাত্রী প্রতিনিধিবিহীন গণপরিবহনের ভাড়া নির্ধারণের ফলে, মালিকদের চাওয়া মতো ভাড়া বাড়ানো হয়। এসব যানবাহনের ভাড়া নির্ধারণের আগে গণপরিবহন ভাড়া নির্ধারণের ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটি ও ভাড়া নির্ধারণ কমিটি পুনর্গঠন করে মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে যাত্রীদের রাখার দাবি করে সংগঠনটি।

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

বাসে নৈরাজ্য চলছেই : এখনও চলছে সিটিং সার্ভিস, নেওয়া হচ্ছে বাড়তি ভাড়া

আপডেট সময় : ০২:১০:১৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ নভেম্বর ২০২১

নিজস্ব প্রতিবেদক : জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর বাসের ভাড়াও বাড়ানো হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে রাজধানীতে যাত্রীদের হয়রানি ঠেকাতে সিটিং সার্ভিস বন্ধ করা হয়। গণপরিবহন যেন বর্ধিত ভাড়ার অতিরিক্ত আদায় না করে সে বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়। গতকাল সোমবার রাজধানী ঘুরে দেখা গেছে, কিছু কিছু বাস এই নিয়ম মানলেও এখনও অনেক বাস সিটিং সার্ভিস চালু রেখেছে এবং যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় করছে।
এদিন সকালে দিশারী পরিবহনের একটি বাসে ওঠেন এই প্রতিবেদক। গন্তব্য রাজধানীর মিরপুর ১ নম্বর থেকে প্রেস ক্লাব। বাসে ওঠার আগে হেলপারকে ভাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রেস ক্লাব পর্যন্ত ৩০ টাকা। পরে বাসে উঠে চার্ট খুঁজে দেখা যায়, মিরপুর ১ নম্বর থেকে প্রেস ক্লাবের নতুন ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ২৪ টাকা।
গেটলক সিটিং সার্ভিসের কথা বললেও মিরপুর ১ নম্বর থেকে বাস ছাড়ার কিছুক্ষণ পর পর রাস্তায় যাত্রী ইশারা করলেই ব্রেক চাপছেন চালক। রাস্তা থেকে তোলা হচ্ছে যাত্রী। টেকনিক্যালের পার বাসের যাত্রী সংখ্যা গুনে ওয়েবিলে সিগনেচার করেন এক ব্যক্তি। তাকে হেলপার দেন ১০ টাকার একটি নোট। তারপর শুরু হয় হেলপারের যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া নেওয়ার কাজ। ভাড়া নিতে নিতে কল্যাণপুর যেতে না যেতেই রাস্তার মাঝখান থেকে আরও যাত্রী তোলা হয়। কল্যাণপুরে কিছুটা অপেক্ষার পর শ্যামলী গিয়ে আবারও যাত্রীর অপেক্ষা। এরমধ্যেই শুরু হয় চালককে উদ্দেশ করে যাত্রীদের কথাবার্তা। গেটলক সার্ভিসের কথা বলে এখন কী সার্ভিস দেওয়া হচ্ছে, এমন প্রশ্ন যাত্রীদের।
সাজ্জাদ নামের এক যাত্রী বলছিলেন, ‘ভাবলাম একটু আগে যাওয়ার জন্য বাড়তি টাকা দিয়ে উঠলাম। এখন দেখি যেই লাউ সেই কদু। এরা কখনও মানুষ হবে না।’ তিনি বলেন, ‘দায়িত্বরত বিআরটিএ চেয়ারম্যানকে শুধু টেলিভিশনের সামনে কথা বলতেই দেখি।’ মোতাহার নামের এক যাত্রী বলেন, ‘পরিবহন মালিকদের নৈরাজ্যের বিষয়ে কার্যকর কোনও উদ্যোগ নিতে পারছে না বিআরটিএ।
বাস আসাদগেট-আড়ং সিগন্যালে দাঁড়িয়ে। সেখান থেকেও তোলা হলো আরও দুজন যাত্রীকে। যাত্রীর ওঠানোর পর আবারও বাকি যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া তোলা শুরু করলেন হেলপার। ধানমন্ডি ২৭-এ নেমে গেলেন দু’জন। সেখান থেকে যাত্রী তুললেন তিন জন। যে দুজন নেমে গেলেন তাদের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে জনপ্রতি ৩০ টাকা করে।
বাসযাত্রী কাইয়ুম বলছিলেন, ‘গতকাল থেকে তো রাজধানীতে কোনও সিটিং সার্ভিস নেই। তোমরা কেমনে চালাও।’ এই প্রশ্নের জবাবে ভাড়া তুলতে আসা হেলপার বলেন, ‘সব মালিকরা জানেন। আমাদের করার কিছু নেই। আপনার না পোষালে আপনি নেমে যেতে পারেন।’
আড়ং সিগন্যাল থেকে ওঠা দুজন নামবেন সায়েন্স ল্যাব। তাদের কাছ থেকেও ভাড়া চাওয়া হয় জনপ্রতি ৩০ টাকা করে। তাদের সঙ্গে তর্কাতর্কির একপর্যায়ে যাত্রীরা চার্ট দেখতে চাইলে গাড়ির জানালায় ঝুলানো চার্ট দেখতে বলেন হেলপার। সেখানেও দেখা যায়, গাড়িটিকে মিরপুর ১ নম্বর থেকে ফার্মগেট হয়ে গুলিস্তান যাওয়ার কথা থাকলেও রুট পরিবর্তন করে মিরপুর ১ থেকে কলাবাগান-সাইন্সল্যাব-শাহবাগ হয়ে গুলিস্তান যাচ্ছে। টানানো রয়েছে মিরপুর ১, ফার্মগেট, গুলিস্তানের ভাড়ার চার্ট।
গাড়ির চার্ট এবং রুড পরিবর্তন হওয়ার বিষয়টি জানতে চাইলে দিশারী পরিবহনের চালক আশিক বলেন, ‘এটা মালিকরা ম্যানেজ করেছেন। আমরা শুধু গাড়ি চালাই। আমাদের চালাতে বলা হয়েছে। আমরা আর কিছু জানি না।’
বাস থেকে নেমে যাওয়ার সময় রফিকুল ইসলাম নামের এক যাত্রী বলছিলেন, ‘তোরা কি তোদের আচরণ ভালো করবি না। লোকজনের কাছ থেকে এভাবেই বাড়তি টাকা নিবি গেটলক সার্ভিসের কথা বলে?’
শ্যামলী থেকে ধানমন্ডি ৩২ যাওয়ার জন্য বাসে ওঠেন খাইরুল। তিনি বলেন, ‘যেখানে আগে বাস ভাড়া ছিল ১০ টাকা, এখনও অনেক পরিবহন সিটিং সার্ভিসের নামে ২০ থেকে ৩০ টাকা আদায় করছে। এই এলাকায় বিআরটিএ’র কোনও অভিযান তো চোখে পড়লো না।’
কলাবাগান মোড়ে নেমে গেলেন কয়েকজন যাত্রী। এখান থেকে ওঠানো হলো আরও কয়েকজন যাত্রীকে। সায়েন্স ল্যাব মোড়ে আরও কয়েকজন যাত্রী নেমে যাওয়ায় যাত্রীর জন্য আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন বাসচালক। বাসে অবস্থানরত যাত্রীদের কিছুটা উত্তেজিত আচরণের কারণে লেগে যায় চালকের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক। একপর্যায়ে চালক বাধ্য হয়ে থেমে থাকা গাড়িটি চালানো শুরু করেন। শাহবাগ মোড়ে পৌঁছালে আবারও চলে ওঠানো-নামানোর কাজ। মৎস্য ভবন পার হয়ে প্রেস ক্লাবের সামনে নেমে যাই। আর বাসটি তখন মতিঝিলের দিকে ছুটে চলে।
সিএনজিচালিত বাসেও বাড়তি ভাড়া : সিএনজিচালিত বাসেও নেওয়া হচ্ছে বাড়তি ভাড়া। বাসের সামনে সিএনজিচালিত স্টিকার লাগানো থাকলেও তোয়াক্কা না করে হেলপাররা বাড়তি ভাড়া আদায় করছেন বলে অভিযোগ যাত্রীদের। এসব অরাজকতা ঠেকাতে বিআরটিএ’র ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে রয়েছে। করা হচ্ছে জরিমানা। তারপরও থামছে না নৈরাজ্য।
আজিমপুর থেকে ছেড়ে আসা আশীর্বাদ পরিবহনে সিএনজি চালিত স্টিকার থাকার পরও যাত্রীদের কাছ থেকে মিরপুর ১ নম্বর পর্যন্ত ভাড়া নেওয়া হয়েছে ২০ টাকা। বাসের যাত্রী আলমগীর বলেন, ‘আমি একসময় হেলপারকে বলেছিলাম, সিএনজিচালিত বাসে বাড়তি ভাড়া কেন? হেলপার বলেন, ‘২০ টাকা দিতে হবে। কমে হবে না। কী আর করা, চার টাকার জন্য আর কিছু বলিনি।’
এদিকে, বিআরটিএ’র ভ্রাম্যমাণ আদালতে আশীর্বাদ পরিবহনের বাসটিকে বাড়তি ভাড়া নেওয়ার অভিযোগে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এ সময় ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট ফখরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য ঠেকাতে বিআরটিএ ম্যাজিস্ট্রেটরা মাঠে রয়েছেন। যেসব বাসে অনিয়ম পাওয়া যাচ্ছে, সেসব বাসকে আমরা আইনের আওতায় এনে জরিমানা করছি। অভিযানে দেখা যায়, অনেক সিএনজি বাস নতুন নির্ধারিত চার্জ অনুযায়ী ভাড়া আদায় করছেন; যা ঠিক নয়। কারণ, সিএনজিচালিত কোনও বাসের ভাড়া বাড়েনি।
পরিবহন মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘যা বাড়তি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে, তা হেলপার ও চালকরা নিচ্ছেন। এ বিষয়গুলো আমরা নজরে রাখছি। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া বাসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’ বাড়তি ভাড়া নেওয়ার বিষয় অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘যদি কেউ নিয়ে থাকে বাড়তি ভাড়া তাহলে তাদের চিহ্নিত করে কয়েক দিনের মধ্যেই আমরা এসব বন্ধ করে দিতে সক্ষম হবো।’
লেগুনা-অটোরিকশার ভাড়া নির্ধারণের দাবি যাত্রীকল্যাণ সমিতির : হিউম্যান হলার, লেগুনা, অটো-টেম্পু, অটোরিকশা, প্যাডেলচালিত রিকশা ও মোটরসাইকেলসহ সব ধরনের পরিবহনে ভাড়া নির্ধারণের দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষিতে সিএনজি, ডিজেল, পেট্রোল ও অকটেনচালিত সকল প্রকার বাস-মিনিবাসের পাশাপাশি এসব পরিবহনে বেশি মাত্রায় ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। সেজন্য এসব যানে পৃথক পৃথক ভাড়া নির্ধারণ করতে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর কাছে দাবি জানিয়েছে সমিতি।
গতকাল সোমবার সকালে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের দপ্তরে জমা দেওয়া এক স্মারকলিপিতে এই দাবি জানায় সংগঠনটি।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরীর সই করা স্মারকলিপিতে বলা হয়, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষিতে সরকার শুধুমাত্র ডিজেলচালিত বাস-মিনিবাসের ভাড়া বাড়ায়। কিন্তু বাসে ভাড়া বৃদ্ধির আদেশ জারির সঙ্গে সঙ্গে সিএনজি, ডিজেল, পেট্রোল ও অকটেনচালিত সকল প্রকার বাস-মিনিবাসের পাশাপাশি হিউম্যান হলার, লেগুনা, অটো-টেম্পু, অটোরিকশা, প্যাডেলচালিত রিকশা ও মোটরসাইকেলসহ সব ধরনের পরিবহনে অতিরিক্ত মাত্রায় বর্ধিত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।
সংগঠনের গণপরিবহনে ভাড়া নৈরাজ্য পর্যবেক্ষণ উপ-কমিটির সদস্য ও সারাদেশে সংগঠনের নেতা-কর্মীরা ভাড়া নৈরাজ্য ও যাত্রী ভোগান্তি সব দিক পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পেয়েছে যে, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির পর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহানগরীসহ দেশব্যাপী চলাচলরত সিএনজিচালিত হিউম্যান হলার, লেগুনা এবং সিএনজি অটোরিকশায় অস্বাভাবিকহারে বর্ধিত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য চালাচ্ছে।
সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ অনুযায়ী সব গণপরিবহনের ভাড়া সরকার কর্তৃক নির্ধারণ করে দেওয়ার ক্ষমতা থাকলেও সরকার এসব পরিবহনের ভাড়া নির্ধারণ না করায় যে যার ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করছে। সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা না থাকায় যাত্রীসাধারণ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আইনের আশ্রয় লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের প্রতিবাদ করলে পরিবহন শ্রমিকদের হাতে যাত্রীরা নাজেহাল হচ্ছে। এসব গাড়িতে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা না থাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও যাত্রীদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। প্রায় এক দশক ধরে এসব যানবাহনের ভাড়া নির্ধারণের জন্য বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে বেশ কয়েক দফা সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কাছে আবেদন করা হলেও সরকার ভাড়া নির্ধারণ করেনি। গণমাধ্যমে এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলে ফাইল একটু আগায় আবার গণমাধ্যমে নিউজ করা বন্ধ হলে ফাইল আবার ডিপ ফ্রিজে ঢুকে পরে বলে স্মারকলিপিতে বলা হয়। এছাড়াও যাত্রী প্রতিনিধিবিহীন গণপরিবহনের ভাড়া নির্ধারণের ফলে, মালিকদের চাওয়া মতো ভাড়া বাড়ানো হয়। এসব যানবাহনের ভাড়া নির্ধারণের আগে গণপরিবহন ভাড়া নির্ধারণের ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটি ও ভাড়া নির্ধারণ কমিটি পুনর্গঠন করে মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে যাত্রীদের রাখার দাবি করে সংগঠনটি।