নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনায় একে একে ঝরে গেছে ৩২টি তাজা প্রাণ। গুরুতর আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন দেড় শতাধিক মানুষ। আহত-নিহতদের বেশিরভাগই শিশু। আহতদের মধ্যে জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের বেডে আছে ৪৩ জন। প্রতিক্ষণে যন্ত্রণায় ছটফটে করছে তারা। তাদের সুস্থতায় নীরবে চোখের পানি ফেলে দু’হাত তুলে প্রার্থনা করছেন অভিভাবকরা।
মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি
একটি সংবাদসংস্থা বুধবার (২৩ জুলাই) সকালে সরেজমিনে জাতীয় বার্ন ইউনিট ঘুরে দেখে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, চিকিৎসাধীন শিশুদের স্বজনরা কখনও বারান্দায় আবার কখনও বা ফ্লোরে বসে কাঁদছিলেন। আবার কেউবা কাঁচের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে দগ্ধ প্রিয় মানুষটি কেমন আছে- একনজর দেখার চেষ্টা করছেন। চোখের পানিতে সৃষ্টিকর্তার কাছে তাদের সুস্থতার জন্য দোয়া করছেন। অনেক স্বজন ওয়ার্ড থেকে আইসিইউতে ছোটাছুটি করছেন। আবার কেউ কেউ হাসপাতালের ভেতরে ঢুকার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। কিন্তু, দগ্ধ শিশুদের সুচিকিৎসায় যাতে কোনো ধরনের ইনফেকশন না ছড়ায়, সেজন্য স্বজনদের প্রবেশ সীমিত করে দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
এদিকে, চিকিৎসক থেকে শুরু করে নার্সসহ হাসপাতালে দায়িত্বরত সবাই চিকিৎসাধীন সবার সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা গজ-ব্যান্ডেজে ঢাকা শিশুরা যা খাওয়ার কথা বলছেন তা মুহূর্তেই হাজির করার চেষ্টা করছেন আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে হাসপাতালের কর্মীরা। বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন সব শিশুই আগুনে পোড়া বা ঝলসে যাওয়া জায়গার জ্বালা-যন্ত্রণায় হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছেন। বেশিরভাগ অভিভাবকই পোড়া জায়গায় হাতপাখা দিয়ে বাতাস করে দগ্ধ শিশুদের কিছুটা স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা করছেন। মায়েরা চুপি চুপি শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছছেন আর সৃষ্টিকর্তার কাছে সুস্থতার দোয়া করছেন।
বার্ন ইউনিটের বাইরে এক অভিভাবকের সঙ্গে কথা হয়। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে ফ্লোরে বসে কাঁদছিলেন তিনি। একটু পর পর দোয়া করছিলেন, আল্লাহ তুমি আমার বাচ্চাটারে সুস্থ করে দাও। কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর জানতে পারি তার ছেলে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইংরেজি ভার্সনের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. মাহতাব রহমান ভূঁইয়া (১৫)। বিমান দুর্ঘটনায় আগুনে দগ্ধ হয়ে শরীরের প্রায় ৭০ শতাংশ পুড়ে গেছে তার। বর্তমানে আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে ছেলে মাহতাব। ছেলের সুস্থতার জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন তিনি। তামজিদ হোসেন নামে আরো এক অভিভাবকের সঙ্গে কথা হয়। ভেজা চোখে তিনি বলেন, আমার একমাত্র ভাগ্নি, কলিজাটা ফেটে যাচ্ছে তার কান্না দেখে। মুখমণ্ডলসহ শরীরের অনেক অংশ ঝলসে গেছে। ফলে ওখানে তীব্র যন্ত্রণা করছে। এসির মধ্যে আছে, তবু বলছে মা বাতাস করো, মামা বাতাস করো। ওরে কখনও কিচেন রুমে যেতে দিতাম না আগুনের তাপ লাগবে বলে আর আজকে সে আগুনে পুড়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে।
সন্তানরা কোথায় নিরাপদ, প্রশ্ন দগ্ধ শিশুদের আত্মীয়-স্বজনদের: বার্ন ইউনিটের বাইরে অপেক্ষমাণ দগ্ধ শিশুদের আত্মীয়-স্বজনদের আর্তনাদে ভারী হাসপাতালের পরিবেশ। কেউ কেউ আক্ষেপ করে বলছেন, হাসপাতালের বিছানায় যারা এখনও বাঁচার জন্য লড়ছেন, তারা জানেই না বাঁচা-মরা কাকে বলে। যেখানে স্কুল ছুটি হওয়ার পর বাসায় এসে একসাথে ভাত খাওয়ার কথা ছিল কিন্তু তারা এখন হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছে।
অভিভাবকরা ক্ষুব্ধ হয়ে প্রশ্ন করেন, সন্তানরা কোথায় নিরাপদ? সন্তানরা যদি স্কুলেও নিরাপদ না হয় তাহলে আমাদের করণীয় কী? এই দেশে কি জীবনের কোনো মূল্য নেই? দেশ ছেড়ে যাওয়ায় কি সমাধান? এই দেশের আইনপ্রণেতার কি কখনোই জীবনের মূল্য বুঝবে না? এসব বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে ওঠেছেন অনেকে।
বার্ন ইউনিটের আইসিইউ বিভাগ থেকে বের হওয়া সাইদুর রহমান নামে একজন অভিভাবক বলেন, দগ্ধদের অবস্থা এতই ভয়াবহ যে ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। অনেকেই শতভাগ পোড়া শরীর নিয়ে ভর্তি আছেন। যাদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা বেশি। আল্লাহ সহায় হওয়া ছাড়া বাচ্চাগুলোর বাঁচার উপায় নেই। এই অভিভাবক আরো বলেন, এতগুলো প্রাণ যে ঝরেছে এর দায়ভার কার! সরকার কীভাবে এর জবাব দেবে? জবাব দিলেই কী আর এই প্রাণগুলো ফিরে আসবে? ছোট ছোট বাচ্চাগুলো পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। যারা বেঁচে আছে তারা মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করছে। জ্বালা-যন্ত্রণায় অনবরত কান্না করছে। তাদের কান্না দেখে আমরাও কান্না থামাতে পারছি না, বলতে বলতে কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে তার।