প্রত্যাশা ডেস্ক: একসময় যে বার্ধক্যকে সমাজের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হতো, চীন এখন ধীরে ধীরে সেটিকেই নতুন সম্ভাবনার দৃষ্টিতে দেখছে। ২০২৬ সাল থেকে শুরু হতে যাওয়া ১৫তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০২৬-২০৩০) সেই দৃষ্টিভঙ্গিরই স্পষ্ট প্রতিফলন। এই পরিকল্পনায় প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে শুধু সামাজিক কল্যাণের আওতায় না রেখে, দীর্ঘমেয়াদি পরিচর্যা বীমা, বেসরকারি পেনশন সংস্কার এবং ‘সিলভার ইকোনমি’র মাধ্যমে একটি কৌশলগত অর্থনৈতিক শক্তিতে রূপ দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
চীনের বেসামরিক বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে বর্তমানে ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩১ কোটি, যা মোট জনসংখ্যার ২২ শতাংশ। এর মধ্যে ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে রয়েছেন প্রায় ২২ কোটি মানুষ। আশাব্যঞ্জক দিক হলো, ১৪তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা মেয়াদে (২০২১-২০২৫) চীনে গড় আয়ু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৯ বছরে—যা বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে প্রায় পাঁচ বছর বেশি।
কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়নার সদ্য প্রকাশিত ১৫তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সুপারিশে বলা হয়েছে, জাতীয় পেনশন ব্যবস্থাকে আরো সুসংহত করতে হবে। বিশেষ করে বহুমাত্রিক ও বহুস্তরবিশিষ্ট পেনশন বীমা কাঠামো গড়ে তুলে মানুষের অবসরকালীন মৌলিক আয়ের নিরাপত্তা বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
এই সুপারিশে প্রবীণদের জন্য মৌলিক সেবা উন্নত করা, জনপরিকাঠামোকে আরো নিরাপদ ও প্রতিবন্ধকতামুক্ত করা এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিচর্যা বীমাকে জনপ্রিয় করার কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে ধাপে ধাপে অবসর গ্রহণের বয়স বাড়ানো, কর্মসংস্থান ও সামাজিক বীমায় বয়সসংক্রান্ত সীমাবদ্ধতা শিথিল করে প্রবীণ কর্মশক্তিকে কাজে লাগানোর আহ্বান জানানো হয়েছে—যা ‘সিলভার ইকোনমি’কে আরো গতিশীল করবে।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে চীনের সিলভার ইকোনমির আকার প্রায় ৭ ট্রিলিয়ন ইউয়ান, যা দেশটির মোট জিডিপির প্রায় ৬ শতাংশ। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে এই খাতের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াতে পারে ৩০ ট্রিলিয়ন ইউয়ানে, যা জিডিপির ১০ শতাংশের সমান হবে।
গত কয়েক বছরে প্রবীণ সেবার অবকাঠামোও উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়েছে। বেসামরিক বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের শেষ নাগাদ চীনে ৪ লাখের বেশি প্রবীণ সেবা কেন্দ্র ও নার্সিং হোম ছিল, যেখানে প্রায় ৮০ লাখ শয্যার ব্যবস্থা রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা সুবিধাসম্পন্ন শয্যার হার ২০২০ সালের ৪৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬৫ শতাংশের বেশি হয়েছে। এ ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ ও অসহায় প্রবীণদের জন্য ঘর সংস্কার কর্মসূচির আওতায় ১৪তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা মেয়াদে ২২ লাখের বেশি বাড়ি সংস্কার করা হয়েছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী, দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থ বা প্রতিবন্ধী এবং একা থাকা প্রবীণরা এতে বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু সেবা বাড়ালেই হবে না, প্রবীণদের কর্মসংস্থানের অধিকার ও দক্ষতা উন্নয়নও সমান গুরুত্বপূর্ণ। বেইজিংয়ের চায়না রিসার্চ সেন্টার অন এজিং-এর গবেষক ইয়াং সিয়াওছি বলেন, আগামী পাঁচ বছরে পরিচর্যা সেবার মান উন্নয়ন, নার্সিং হোমে প্রশিক্ষিত কর্মী বাড়ানো এবং প্রবীণদের জন্য ন্যায়সংগত সেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা জরুরি। একই সঙ্গে অবসর-পরবর্তী জীবনের প্রস্তুতি নিয়েও ভাবার তাগিদ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, অবসর জীবনের জন্য চীনা নাগরিকদের প্রস্তুতির সূচক এখনো মাঝামাঝি পর্যায়ে রয়েছে। আয়ের নিশ্চয়তা, পেনশন পরিকল্পনা ও ভবিষ্যৎ কর্মজীবন—সব মিলিয়ে ব্যক্তিগত পরিকল্পনার গুরুত্ব দিন দিন আরো স্পষ্ট হচ্ছে।
সব মিলিয়ে, চীন এখন বার্ধক্যকে একটি বাস্তবতা হিসেবে মেনে নিয়ে, সেটিকে বোঝা নয় বরং সম্ভাবনায় রূপ দেওয়ার পথে এগোচ্ছে। নীতিগত সংস্কার, সামাজিক সেবা এবং অর্থনৈতিক পরিকল্পনার সমন্বয়ে প্রবীণ জীবনকে আরো সম্মানজনক ও অর্থবহ করে তোলাই এই নতুন যাত্রার মূল লক্ষ্য। সূত্র: সিএমজি
সানা/এসি/আপ্র/২৯/১২/২০২৫






















